শৈব কালী: চুয়াল্লিশ



ডাকিনী ও যোগিনীগণ দেবীরই ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপ—তাঁরা চেতনার বিভাজিত শক্তির রূপে দেবীর মহাশক্তিকে প্রকাশ করেন। তাঁরা শেখান, চেতনা কখনও স্থির নয়; এটি এক অবিরাম স্পন্দন, যেখানে অন্ধকার, আলো, ভয়, প্রেম, ক্রোধ, শান্তি—সবই দেবীর ভিন্ন নৃত্যভঙ্গি। কালী সেই কেন্দ্রীয় চেতনা, আর ডাকিনী-যোগিনীরা সেই চেতনার তরঙ্গ—যাঁরা আমাদের অন্তরজগতে মৃত্যু থেকে মুক্তি, ভয় থেকে জ্ঞান, আর অজ্ঞান থেকে জাগরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

কালীর পরিসরে যে ভূত, প্রেত ও পিশাচের উল্লেখ আমরা পাই, সেগুলি কোনো ভয়াবহ অতিপ্রাকৃত প্রাণী নয়—তারা মানুষের অন্তর্জগতের প্রতীক, বিশেষত অবচেতনের (unconscious) স্তরে সঞ্চিত দমিত শক্তিগুলির (repressed energies) রূপক প্রকাশ। তন্ত্রশাস্ত্রের এই প্রতীকবাদ এতটাই সূক্ষ্ম যে, যা বাইরে মৃত বা অন্ধকার বলে মনে হয়, কিন্তু তার মধ্যেই ভিতরের প্রাণশক্তি ও আত্মজাগরণের বীজ লুকিয়ে থাকে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, ভূত, প্রেত, পিশাচ—এই শব্দগুলো অবিদ্যা-র বিভিন্ন স্তরের প্রতীক। “ভূত” মানে যা ‘হয়ে গেছে’—অর্থাৎ অতীত অভিজ্ঞতার সংস্কার; “প্রেত” মানে যা এখনও অস্থির—অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিকভাবে অসম্পূর্ণ, অশান্ত আকাঙ্ক্ষা; আর “পিশাচ” মানে যা মিথ্যা ভয় ও আসক্তির রূপে আমাদের মনকে তাড়া করে। এই তিনেই মায়ার খেলা। শঙ্করাচার্য বলেছেন, “অবিদ্যা নাশনম্ জ্ঞানম্”—এই দমিত শক্তিগুলি অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন এবং আত্মজ্ঞানেই তাদের রূপান্তর ঘটে। কালী সেই জ্ঞানের শক্তি, যিনি অবচেতনের এই অন্ধকার স্তরগুলিতে প্রবেশ করেন ও তাদের আলোয় রূপান্তরিত করেন। তাই তিনি “শ্মশানবাসিনী”—অর্থাৎ, মনের অন্ধকার প্রদেশের অধিষ্ঠাত্রী, যেখানে মৃত্যু মানেই নবজন্ম।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, ভূত-প্রেত-পিশাচকে স্পন্দ (Spanda) তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত কম্পমান চেতনার স্থূল রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। শিবচেতনা স্বয়ং নিস্তরঙ্গ, কিন্তু যখন শক্তি তার স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে, তখন বিভিন্ন বৃত্তি (vṛtti) বা মানসিক গতির সৃষ্টি হয়। এই গতিগুলির মধ্যেই কখনও ভারসাম্য থাকে না—যখন কোনো অনুভূতি দমন করা হয়, তা অবচেতনে জমে থেকে ‘ভূত’ বা ‘প্রেত’-রূপে ফিরে আসে। দেবী এই দমনকৃত শক্তিগুলির রক্ষক ও নিয়ন্ত্রী; তাঁর ভয়ংকর রূপ আসলে সেই অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল শক্তিকে সামঞ্জস্যে ফেরানোর প্রতীক। অভিনবগুপ্তের ভাষায়, “যদ্দমনাত্ ভূতগণঃ প্রসরন্তি, তত্তে শক্তির লীলা”—অর্থাৎ, দমন করা শক্তিগুলির পুনরুত্থানই দেবীর লীলা।

শাক্ত দর্শনে, এই ভূত-প্রেত-পিশাচরা কালীশক্তিরই উপ-রূপ। তারা মনের দমিত কামনা, ভয়, লালসা, ক্রোধ, অপরাধবোধ, এমনকি মৃত্যুভীতিরও প্রতীক। দেবী তাঁদের আশ্রয় দেন—তাঁর চারপাশে তাঁরা নৃত্য করে—কারণ তিনি জানেন, এই অন্ধকার শক্তিগুলিকে দমন নয়, স্বীকৃতির মাধ্যমে মুক্তি দিতে হয়। তিনি “অভয়মুদ্রা” ধারণ করেন, কারণ তাঁর সাধনা ভয়কে দমন নয়, তার রূপান্তর শেখায়। তাই কালী বলেন—“ভূত, প্রেত, পিশাচ তোমার শত্রু নয়, তারা তোমারই ছায়া। তাদের গ্রহণ করো, তবেই পূর্ণতা আসবে।”

মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, বিশেষত কার্ল ইয়ুং-এর দৃষ্টিতে, ভূত, প্রেত, পিশাচ মানে মনের Shadow Archetype—আমাদের অবচেতনের সেই অন্ধকার অংশ, যা আমরা স্বীকার করতে চাই না। যখন আমরা নিজের রাগ, লালসা, হিংসা বা ভয়কে অস্বীকার করি, তখন তারা ‘ভূত’ হয়ে ফিরে আসে—অশান্তি, স্বপ্ন, মানসিক বিভ্রান্তি বা রোগের আকারে। কালী সেই ছায়াকে আলোকিত করেন—তাঁর শ্মশান-নৃত্য মানে সেই মুহূর্ত, যখন আমরা নিজেদের অন্ধকার দিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে আত্মসচেতনতার আলোয় রূপান্তর করি।

ভূত, প্রেত, পিশাচ—তারা কোনো বাহ্যিক শত্রু নয়; তারা অন্তর্গত শক্তির প্রতীক, যা অবচেতনে বন্দি হয়ে আছে। কালী সেই মহাশক্তি, যিনি এই দমিত শক্তিগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে চেতনার সাথে মিলিত করেন। তিনি শেখান—ভয়কে মেরে ফেলো না, তাকে চিনে নাও; ছায়াকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না, তাকে নিজের আলোতে টেনে আনো। কারণ চেতনার পূর্ণতা তখনই আসে, যখন আলোক ও অন্ধকার, শুভ ও অশুভ—সব এক হয়ে ব্রহ্মরূপে প্রকাশ পায়।

কালীর চারপাশে যে অগ্নি ও ধোঁয়ার দৃশ্য তন্ত্রচিত্রে বা ধ্যানচিত্রে আমরা দেখি, সেটি কেবল ভয়ঙ্কর পরিবেশের সৃষ্টির জন্য নয়—এটি চেতনার রূপান্তরের এক গভীর প্রতীকী ব্যাখ্যা। অগ্নি ও ধোঁয়া তান্ত্রিক দর্শনে এক গভীর দ্বৈত প্রতীকের রূপে বিবেচিত—যেখানে তারা একসঙ্গে সংস্কারদহন (saṁskāra-dahana) ও চেতনার উন্মেষ (cetanāra unmeṣa)-এর যুগল প্রক্রিয়া নির্দেশ করে। অগ্নি এখানে কেবল বাহ্যিক জ্বালা নয়; এটি অন্তর্গত জ্ঞানের আগুন, যা অবিদ্যা, আসক্তি ও পুরাতন সংস্কারগুলিকে দগ্ধ করে। ধোঁয়া সেই দহন-প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট ছায়া, যা আমাদের চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা অপূর্ণতার, ভয়ের, ও দমিত স্মৃতির প্রতীক।

শাক্ত ও তান্ত্রিক ব্যাখ্যায়, যখন দেবী-চেতনা জাগ্রত হয়, তখন অগ্নির মতো সে পুরোনো সংস্কার—অর্থাৎ মনের সঞ্চিত প্রতিক্রিয়া, স্মৃতি ও প্রবণতাগুলিকে—দগ্ধ করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া ভয়াবহ হলেও পরিশুদ্ধিকর; কারণ ধোঁয়া যেভাবে অগ্নির পরিণাম, তেমনি অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি চেতনার নবজন্মের পূর্বাবস্থা। ধোঁয়া বিলীন হলে অগ্নির দীপ্তি যেমন উন্মোচিত হয়, তেমনি যখন মন সমস্ত দহন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, তখন চেতনা উন্মেষ লাভ করে—unmeṣa, অর্থাৎ অন্তর্লীন দীপ্তির প্রকাশ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, এই দ্বন্দ্ব স্পন্দের (spanda) প্রকাশ—চেতনার স্বাভাবিক কম্পন, যেখানে nirodha (সংযম) ও unmeṣa (উন্মেষ) পরস্পর নির্ভরশীল। দেবী কালী এই দুই শক্তিরই রূপ: তিনি দহন করেন (নিগ্রহ), আবার সেই দহনের মধ্যেই নতুন আলো উদ্‌ভাসিত করেন (অনুগ্রহ)। একদিকে ধ্বংস, অন্যদিকে জাগরণ—এটাই তাঁর চিরন্তন লীলা।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, অগ্নি হল jñānāgni—জ্ঞানাগ্নি, যা গীতায় বলা হয়েছে: “জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে” (গীতা, ৪.৩৭)—“জ্ঞানের আগুন সমস্ত কর্মকে ভস্ম করে।” সেই দগ্ধ কর্মই ধোঁয়ায় রূপান্তরিত হয়—যা অবশিষ্ট সংস্কারের চিহ্ন, ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকা ব্যক্তিত্বের কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত। কিন্তু এই ধোঁয়া দগ্ধতার প্রমাণ, তার বাধা নয়; বরং এটি সেই রূপান্তরের চিহ্ন, যা ব্যক্তিচেতনা থেকে পরমচেতনার দিকে উত্তরণ নির্দেশ করে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, অগ্নি মানে অন্তরের আত্মসচেতন তীব্রতা, আর ধোঁয়া সেই প্রক্রিয়ার অস্পষ্ট, দোদুল্যমান ধাপ। যখন মানুষ নিজের ভয়, আসক্তি, দুঃখ ও দমিত প্রবৃত্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন ভিতরে জ্বলে ওঠে পরিবর্তনের অগ্নি—কিন্তু সেই জ্বালার সঙ্গে উঠে আসে ধোঁয়া, অর্থাৎ বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা। এই ধোঁয়াকে তাড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং তা বুঝে নেওয়া, গ্রহণ করা এবং তার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাওয়াই তান্ত্রিক চেতনার পথ।

অগ্নি ও ধোঁয়া একসাথে মিলে সৃষ্টি করে সেই দ্বৈত প্রক্রিয়া—যেখানে ধ্বংসই শুদ্ধি এবং শুদ্ধিই জাগরণ। কালী-চেতনার আলোতে অগ্নি মানে রূপান্তরের শক্তি, আর ধোঁয়া মানে সেই রূপান্তরের সাক্ষ্য। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ—কারণ জ্ঞান জন্মায় দহনের মধ্যেই, আর দহন সম্পূর্ণ হয় আলোয় মিলেই।

অগ্নি এখানে শুদ্ধির শক্তি, যে সমস্ত মলিনতা, আসক্তি ও অবচেতন সংস্কার মনের গভীরে জমে থাকে, সেসবকে দহন করে দেয়। ধোঁয়া সেই দহনের অন্তর্গত ক্রিয়ার প্রতীক—যেখানে পুরোনো সত্তা বিলীন হয়ে নবজাগরণের সূচনা ঘটে। কালী এই দুই শক্তির মধ্যস্থ চেতনা—তিনি নিজেই সেই দহন এবং সেই উদ্‌ভাসন।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, অগ্নি মানে জ্ঞান, আর ধোঁয়া মানে অজ্ঞান বিলয়ের প্রক্রিয়া। উপনিষদ বলে, “অগ্নির্যথৈকেন চরণেন সূর্যং প্রভাসয়তি”—যেমন অগ্নি অন্ধকার ভেদ করে আলো দেয়, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান মায়ার পর্দা ভেদ করে চেতনার দীপ্তি জাগিয়ে তোলে। কালী সেই জ্ঞানের অগ্নি—যিনি মায়ার ধোঁয়া সৃষ্টি করেন কেবল এজন্য যে, জীব সেই ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে অবশেষে সত্যের অগ্নিজ্যোতিতে পৌঁছে যায়। ধোঁয়া তাই অজ্ঞান নয়, বরং অজ্ঞান থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে, অগ্নি ও ধোঁয়া চেতনার দুই অবস্থা—unmeṣa (উন্মেষ, বিকাশ) ও nimeṣa (নিমেষ, সংহতি)-র প্রতীক। চেতনা কখনও নিজেকে বিস্তার করে—এটাই অগ্নি, সৃষ্টির উত্থান; আবার কখনও নিজের মধ্যে প্রত্যাহার করে—এটাই ধোঁয়া, বিলয়। এই দুটি পর্যায়ের মধ্যে চলমান সত্তাই কালী, যিনি শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তির জীবন্ত প্রকাশ। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ বলেন, “শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ”—শিব চিরকাল সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোভাব ও অনুগ্রহে লিপ্ত; অগ্নি হলো সংহার ও অনুগ্রহের যোগফল, আর ধোঁয়া তিরোভাব—অর্থাৎ চেতনার গোপন অবস্থান।

শাক্ত দর্শনে, অগ্নি হলো দেবীর “জ্ঞানশক্তি” এবং ধোঁয়া হলো “মায়াশক্তি”-র আবরণ। কালী এই দুই শক্তির ঐক্য—তাঁর অগ্নির মতো উগ্রতা ধ্বংস করে, কিন্তু সেই ধোঁয়াশার মধ্য দিয়েই তিনি চেতনার বীজকে সুরক্ষা দেন, যেন তা পরিণত হয় নতুন জীবনে। তাঁর শ্মশানভূমিতে এই অগ্নি ও ধোঁয়া হলো আত্মবিসর্জনের প্রতীক—যেখানে দেহ, মন, অহং ও সংস্কার জ্বলে যায়, কিন্তু চেতনা অনন্ত দীপ্তিতে পুনর্জন্ম লাভ করে।

মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, অগ্নি ও ধোঁয়া মানুষের অন্তর্জাগতিক রূপান্তরের দুটি ধাপ। অগ্নি মানে সেই মানসিক অন্তঃশক্তি, যা দমিত অভিজ্ঞতা, অপরাধবোধ ও অচেতন আকাঙ্ক্ষাগুলিকে সচেতনতার আলোয় টেনে আনে। ধোঁয়া মানে সেই মেঘলা পর্ব, যেখানে পুরোনো চিন্তা ও পরিচয় দহনের পর মস্তিষ্ক সাময়িক বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যায়—এটি আত্মরূপান্তরের স্বাভাবিক ধাপ।

ইয়ুং এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন nigredo বা ‘কালো পর্যায়’—এটি ছিল আলকেমির একটি মৌলিক ধারণা, যা রূপকভাবে বোঝায় বিশৃঙ্খলা, পচন এবং আত্ম-বিস্মৃতির একটি অবস্থা। এই পর্যায়ে, মানসিক অন্ধকারের দহন ঘটেই অবশেষে আত্মসচেতনতার আলো জাগে। এটি এমন একটি গভীর রূপান্তরের সময়, যেখানে ব্যক্তির অচেতন মনস্তত্ত্বের গভীরে লুকানো ভয়, উদ্‌বেগ, অপূর্ণতা এবং নেতিবাচক দিকগুলির মুখোমুখি হতে হয়। এই ‘কালো পর্যায়’ কেবল ধ্বংসের প্রতীক নয়, বরং এটি নতুন সূচনা এবং আত্মিক পুনর্জন্মের জন্য একটি অপরিহার্য ধাপ। এই আত্ম-অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ব্যক্তি তার আত্মসত্তা ও প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে, যা তাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়।

কালীর অগ্নি ও ধোঁয়া কোনো ভয়ংকর ধ্বংস নয়, বরং আধ্যাত্মিক শুদ্ধির প্রতীক। অগ্নি সেই জ্ঞানযজ্ঞের শিখা, যা মায়ার সকল আবরণ পোড়ায়; ধোঁয়া সেই অন্তর-সংক্রমণ, যা জীবনের নতুন ভোরের ইঙ্গিত দেয়। কালী শেখান—তুমি যতক্ষণ না দহনের আগুনে প্রবেশ করছ, ততক্ষণ সত্যের আলোতে জাগতে পারবে না। তাই তাঁর চারপাশে অগ্নি ও ধোঁয়া জ্বলতে থাকে—চেতনার সেই নিত্যচক্রের স্মারক হিসেবে, যেখানে দহনই নবজন্ম, আর ধোঁয়াই আত্মার শ্বাস।

কালীর পরিবেশ সর্বদাই অন্ধকারে আবৃত, কিন্তু দীপ্তি সেই অন্ধকারকে চিরে ওঠে এক আকস্মিক বজ্রালোকে—এই দৃশ্য তান্ত্রিক প্রতীকতত্ত্বের অন্যতম গূঢ় অর্থবাহী উপাদান। অন্ধকার ও বজ্রালোকে দীপ্তির এই যুগল প্রতীক জানিয়ে দেয়, জ্ঞানের আলো কখনও অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয় না, বরং তারই গর্ভে উদ্‌ভাসিত হয়। যেমন বজ্র বিদ্যুৎ রাতের আকাশে হঠাৎ জ্বলে ওঠে এবং মুহূর্তেই সমস্ত দিক উন্মোচিত করে, তেমনি আত্মজ্ঞানও মায়ার গভীর অবিদ্যার মধ্য দিয়েই উদ্‌ভাসিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই অন্ধকার হলো অবিদ্যা—যে অজ্ঞতার পর্দা আত্মার উপর পড়ে আছে; আর বজ্রালোকে দীপ্তি হলো ব্রহ্মজ্ঞান—যা মুহূর্তেই সেই পর্দা ভেদ করে সত্য প্রকাশ করে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “তমসো মা জ্যোতির্গময়” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, পবমান মন্ত্র, ১.৩.২৮)—অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। কিন্তু এই যাত্রা বাইরে নয়, অন্তরে—অন্ধকারই আলোকে জন্ম দেয়, কারণ মায়া ছাড়া জ্ঞানের অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়। কালী সেই জ্ঞানের শক্তি, যিনি অবিদ্যার গর্ভেই চেতনার বজ্রালোকে দীপ্তি জাগিয়ে তোলেন। তাঁর কৃষ্ণরূপ সেই অন্ধকার, আর তাঁর হাসি সেই আলোর ঝলক—দুইয়ে মিলে ব্রহ্মের অখণ্ড লীলা।