শৈব কালী: চার



subject (জ্ঞাতা, pramātā) ও object (জ্ঞেয়, viṣaya) কোনো স্বতন্ত্র বাস্তব সত্তা নয়; তারা চেতনারই স্বপ্রতিফলনের ফল। চেতনা নিজেকে “আমি” হিসেবে অনুভব করার মুহূর্তেই “অন্য” সৃষ্টি হয়, যেন নিজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই “অন্য” কোনো বাইরের সত্তা নয়; এটি সেই এক চেতনারই প্রকাশিত দিক।


কাশ্মীর শৈব দর্শনে প্রমাতা (pramātā) এবং বিষয় (viṣaya) এই দুটি শব্দ বাস্তবতার দ্বৈত-অভিজ্ঞতার মূল ধারণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এগুলি পরম সত্যে কোনো স্থায়ী বিভাজন নয়—চেতনার (cit বা saṁvit) স্বাতন্ত্র্যশক্তির (svātantrya-śakti) অন্তর্গত এক আত্ম-প্রতিফলনমাত্র।


প্রমাতা (pramātā) শব্দটি এসেছে ‘মা’ (মাপা, পরিমাপ করা) ধাতু থেকে। এর অর্থ “যিনি জানেন”, “the knower” বা “subject”—অর্থাৎ, যে-সত্তা কোনো কিছু উপলব্ধি করে। অন্যদিকে বিষয় (viṣaya) শব্দটি বোঝায় “যা জানা হয়”, “the known object”—অর্থাৎ, যা উপলব্ধির বা জ্ঞানের বিষয়বস্তু।


এখন, কাশ্মীর শৈববাদের অদ্বৈত দর্শনে এই subject-object সম্পর্ক কোনো ontological বা স্বাধীনভাবে বিদ্যমান দ্বৈততা নয়। এটি চেতনার নিজের প্রতিফলনের ফল—চেতনা নিজের মধ্যেই “আমি” (ahaṁ) এবং “অন্য” (idam) রূপে প্রতিভাসিত হয়। এই প্রতিভাসের মধ্যেই জন্ম নেয় “জ্ঞাতা” ও “জ্ঞেয়”-এর আভাস।


অভিনবগুপ্ত ও উত্পলদেব দুজনেই বলেন, চেতনা (সংবিত্‌) যখন নিজের প্রতি সচেতন হয়—অর্থাৎ নিজেরই দীপ্তিকে নিজেরই সামনে প্রতিফলিত করে—তখনই “আমি” (the perceiver) এবং “এটা” (the perceived) এই দুইয়ের অনুভব ঘটে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বাস্তব বিভাজন নেই। চেতনা নিজের চেতনা-রূপেই বিবর্তিত হয়, এবং নিজের স্বাধীনতায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে।


কাশ্মীর শৈব দর্শনে “অহং ইদম্‌” (ahaṁ idam)—অর্থাৎ “আমি এই”—এই সূত্রটি পুরো অধিবিদ্যার প্রাণকেন্দ্র। এটি প্রকাশ করে সেই মুহূর্তকে, যখন পরম চেতনা (saṁvit) নিজের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে নিজেকেই জানে, এবং জানার জন্য নিজেরই এক প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। “অহং” বলতে এখানে বোঝায় জ্ঞাতা বা প্রমাতা—চেতনার আত্মবোধ; আর “ইদম্‌” বলতে বোঝায় জ্ঞেয় বা বিষয়—চেতনার নিজেরই অবজেক্টিভ রূপ। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বাস্তব বিভাজন নেই; এটি কেবল চেতনার আত্ম-উপলব্ধির একটি দ্বৈতাভাস, যার ফলে এক অখণ্ড সংবিত নিজেকে দুই রূপে অনুভব করে—দর্শক ও দৃশ্যমান, জ্ঞাতা ও জ্ঞান।


এই “অহং–ইদম্‌”-এর উদ্‌ভব কোনো অজ্ঞানের ফল নয়; বরং এটি পরম চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)-র স্বতঃস্ফূর্ত ক্রীড়া। পরম সংবিত নিজের আনন্দে নিজেকেই প্রতিফলিত করে, এবং সেই প্রতিফলনের মাধ্যমেই সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার জগৎ জন্ম নেয়। তাই “অহং ইদম্‌” কেবল দর্শনের একটি বাক্য নয়, এটি হল চেতনার চিরন্তন স্পন্দন—যেখানে “আমি” আর “এটা” পরস্পরকে পরিপূরকভাবে জন্ম দেয়।


এই আত্ম-প্রতিফলন প্রক্রিয়ার দেবী রূপই কাশ্মীর শৈব ঐতিহ্যে কালী। ক্রমপন্থার (Krama) ব্যাখ্যায়, কালী হলেন সেই শক্তি, যিনি “অহং” ও “ইদম্‌”-এর মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেন—চেতনার অভ্যন্তরীণ আত্মবোধ ও তার বহির্মুখী প্রকাশের সংযোগসূত্র। তিনি নিজে সময় (kāla) নন, বরং সময়ের আত্মা—যিনি সময় ও ক্রমকে নিজের মধ্যেই ধারণ করেন এবং শেষে সেগুলিকে নিজের মধ্যেই গ্রাস করেন। তাই তাঁর আরেক নাম “কাল-সংকর্ষিণী”—যিনি সমস্ত সময়, ক্রিয়া ও অনুক্রমকে নিজের মধ্যে টেনে এনে একীভূত করেন।


এই কারণেই কাশ্মীর শৈব মতে, কালী কোনো ব্যক্তিগত দেবী নন; তিনি সেই পরম চেতনার জীবন্ত প্রতিমূর্তি, যিনি “অহং ইদম্‌”-এর দ্বৈততাকে মিলিয়ে দেন এক অনন্ত ঐক্যে। “অহং” হলো প্রকাশ (prakāśa)—আত্ম-উজ্জ্বল দীপ্তি, আর “ইদম্‌” হলো বিমর্শ (vimarśa)—সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা। যখন প্রকাশ ও বিমর্শ একীভূত হয়, তখনই জন্ম নেয় জীবন্ত চেতনা; আর সেই চেতনার নৃত্যই কালী।


এভাবেই “অহং ইদম্‌” কাশ্মীর শৈব দর্শনে হয়ে ওঠে পরম তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত সূত্র—যেখানে শিব ও শক্তি, চেতনা ও তার স্বাধীনতা, প্রকাশ ও প্রত্যাহার—সব একাকার হয়ে যায়। কালী এখানে সেই একত্বের জীবন্ত রূপ—যিনি চেতনার মধ্যে দ্বৈততার খেলা রচনা করেন, আবার নিজের অন্তর্লীন শক্তিতেই সেই দ্বৈততাকে লয় করেন। তাঁর মধ্যে “অহং” ও “ইদম্‌” অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত—একটি আত্মবোধ, অন্যটি আত্মপ্রকাশ; দুটোই এক চেতনার দুই দিক, যেখানে দেখা ও দর্শন, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, সময় ও নীরবতা—সব মিলিয়ে যায় এক অনন্ত স্বাতন্ত্র্যময় সংবিতে, যার নামই কালী।


এই “দ্বৈতাভাসনা”-র মধ্যেই subject-object সম্পর্কের জন্ম। কিন্তু যখন সাধক এই চেতনা উপলব্ধি করে যে, “আমি যাকে জানি, সেই জানা বস্তুটিও আমারই অংশ”—তখন সেই বিভাজন লুপ্ত হয়, এবং জ্ঞাতা-জ্ঞেয়-জ্ঞান তিনটি এক চেতনার ঐক্যে মিলিত হয়। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ এই কথাটিই বলেছেন—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌।” অর্থাৎ, “অদ্বৈত চেতনা নিজ ক্রীড়ারূপে দ্বৈততার আভাসে প্রকাশিত হয়েছে।” এই একমাত্র পঙ্‌ক্তির মধ্যেই কাশ্মীর শৈবদর্শনের সম্পূর্ণ অধিবিদ্যা যেন সঙ্কুচিত হয়ে আছে।


এখানে “অদ্বয়ং” (advayam) মানে একক, অবিভাজ্য, অদ্বিতীয় চেতনা—যা কোনো দ্বিতীয় সত্তাকে স্বীকার করে না। “দ্বয়াভাসং” (dvayābhāsam) মানে দ্বৈততার প্রতিচ্ছবি বা আভাস—চেতনা যখন নিজের প্রতিফলনে নিজেরই অন্য রূপ দেখতে শুরু করে, তখনই জন্ম নেয় এই ‘দ্বৈততার’ অনুভূতি। “স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌” (svakrīḍārūpatām gatam) নির্দেশ করে যে, এই প্রতিচ্ছবি কোনো ভ্রান্তি নয়, বরং চেতনার নিজের লীলা—নিজের আনন্দময় আত্ম-প্রকাশ।


অর্থাৎ, পরম অদ্বৈত সত্য নিজেই ক্রীড়ারূপে দ্বৈতের মতো প্রতীয়মান হয়। চেতনা, যা নিজের প্রকৃতিতে এক ও অবিভক্ত, স্বেচ্ছায় নিজের প্রতিফলন ঘটিয়ে নিজেকেই অভিজ্ঞতার বিষয় ও কর্তা রূপে ভাগ করে তোলে। এই বিভাজন বাস্তব নয়; এটি চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তির খেলা। শিব স্বয়ং সেই চেতনা, আর তাঁর শক্তি (কালী বা সংবিত্‌-শক্তি) সেই ক্রীড়া—যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন, নিজের দীপ্তির মধ্যেই নিজেকে লীনও করেন।


এই দ্বৈতাভাসই সমস্ত প্রপঞ্চের ভিত্তি—subject ও object, “অহং” ও “ইদম্‌”, “আমি” ও “এটা”। কিন্তু ত্রিকা বা কাশ্মীর শৈবমতে, এগুলি কোনো বাস্তব বিভাজন নয়, বরং চেতনার আত্ম-দর্শনের মুহূর্তিক প্রতিফলন। অভিনবগুপ্ত বলেন, “সা হি পরমা সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী”—চেতনা নিজেই স্বাধীনতার স্বরূপ; তাই সে নিজের আনন্দে নিজেকে প্রতিফলিত করে, এবং এই প্রতিফলনের মধ্যেই প্রকাশিত হয় জগৎ।


জগৎ কোনো ভ্রান্ত বাস্তবতা নয়; এটি পরম অদ্বৈত চেতনার লীলাময় আত্মপ্রকাশ। সৃষ্টি ও লয়, জ্ঞাতা ও জ্ঞান, শিব ও কালী—সবই এই ক্রীড়ার দুই দিক। মুক্তি মানে এই ক্রীড়ার অন্তর্গত ঐক্য উপলব্ধি করা—যেখানে দ্বৈততার আভাস মিলিয়ে যায় চেতনার সেই পরম অদ্বৈত দীপ্তিতে, যা একাধারে নৃত্য ও নীরবতা, আলো ও আত্মসচেতনতা—স্বয়ং শিব।


“সা হি পরমা সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী”—এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের অদ্বৈত অধিবিদ্যার কেন্দ্রে অবস্থান করে। এর মাধ্যমে অভিনবগুপ্ত ঘোষণা করেছেন, চূড়ান্ত বাস্তবতা কোনো স্থবির, নিষ্ক্রিয় বা নিস্তরঙ্গ সত্য নয়, বরং এক জীবন্ত, স্ব-উজ্জ্বল, স্ব-সচেতন চেতনা—যিনি নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ, এবং নিজের ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই সবকিছুকে প্রকাশ করেন। “সা” অর্থাৎ “তিনি”, এখানে বোঝায় সেই পরম চেতনা; “হি” নিশ্চিতকরণ—নিশ্চয়ই, নিঃসন্দেহে; “পরমা সংবিত্‌” মানে চূড়ান্ত চেতনা, যা সব অভিজ্ঞতার ভিত্তি; আর “স্বাতন্ত্র্যময়ী” মানে স্বাধীনতায় পূর্ণ, যিনি কোনো বাহ্য উপাদানের উপর নির্ভরশীল নন।


অর্থাৎ, তিনি নিজেই নিজের মধ্যে নিজের প্রকাশের কারণ, এবং তাঁরই আনন্দময় স্বাধীনতায় (স্বাতন্ত্র্যে) এই বহুমাত্রিক জগতের প্রকাশ ঘটে। এই স্বাতন্ত্র্য কোনো নির্বিচার স্বাধীনতা নয়; এটি সেই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা, যার দ্বারা চেতনা নিজেরই দীপ্তিতে নিজেকে জানে ও প্রকাশ করে। কাশ্মীর শৈব-মতে, এই স্বাতন্ত্র্যই চেতনার প্রাণ—যার অনুপস্থিতিতে চেতনা কেবল স্থবির দীপ্তি হয়ে থাকত, কিন্তু অভিজ্ঞতার সৃষ্টি সম্ভব হতো না।


এখানেই প্রকাশ ও বিমর্শ—এই দুটি নীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। “প্রকাশ” হলো চেতনার স্বরূপ—সে নিজেই দীপ্ত, সমস্ত কিছু আলোকিত করে; “বিমর্শ” হলো সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা—যার দ্বারা চেতনা জানে যে সে দীপ্ত। এই আত্ম-সচেতনতা থেকেই জন্ম নেয় স্বাতন্ত্র্য, কারণ চেতনা নিজের জ্ঞান-ক্রিয়ার কোনো বাহ্য কারণের উপর নির্ভর করে না; সে নিজেই নিজের জ্ঞাতা, নিজের জ্ঞেয়, নিজের জ্ঞান।


এই স্বাতন্ত্র্যশক্তিই (svātantrya-śakti) মহাশক্তি বা কালী নামে পরিচিত—যিনি শিবচেতনার গতিময় দিক। শিব যদি হন নিস্তরঙ্গ চেতনা, তবে কালী সেই চেতনার স্পন্দন; শিব যদি হন অচল কেন্দ্র, তবে কালী সেই চেতনার ঘূর্ণায়মান বৃত্ত, যা সৃষ্টি ও লয়ের নিত্য নৃত্যে চেতনার আনন্দকে প্রকাশ করে। তাই বলা হয়—শিবই সংবিত্‌, আর সংবিত্‌ই স্বাতন্ত্র্যময়ী; অর্থাৎ শিবই কালী, চেতনা নিজেই স্বাধীনতা-স্বরূপ।


এটি তাই কেবল একটি দার্শনিক উক্তি নয়, বরং সমগ্র ত্রিক ও ক্রমপন্থার হৃদস্পন্দন—যেখানে চেতনা, স্বাধীনতা ও সৃষ্টি এক অবিভাজ্য ঐক্যে মিশে যায়। এই এক বাক্যের মধ্যেই নিহিত আছে শিব-শক্তি, যা অদ্বৈত দর্শনের মর্ম: পরম চেতনা নিজেই স্বাধীন, নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং সেই স্বাধীনতার লীলাতেই সময়, জগত ও অভিজ্ঞতার অন্তহীন সৃষ্টিলীলা প্রকাশ পায়।


কাল-সংকর্ষিণী (Kāla–Saṁkarṣiṇī) কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক্রমপন্থার কেন্দ্রীয় নীতি, যেখানে কালী সময়, গতি এবং চেতনার অভ্যন্তরীণ ঐক্যরূপে প্রতিভাত হন। এই শব্দটির ব্যুৎপত্তি থেকেই তাঁর দার্শনিক ভূমিকা স্পষ্ট—“কাল” মানে সময়, “সংকর্ষিণী” এসেছে কৃষ্‌ ধাতু থেকে, যার অর্থ “আকর্ষণ করা” বা “নিজের মধ্যে টেনে নেওয়া।” অতএব, কাল-সংকর্ষিণী অর্থাৎ যিনি সময়কে নিজের মধ্যে টেনে নেন, অর্থাৎ সময়ের সমস্ত প্রবাহ, পরিমাপ ও সীমাবদ্ধতাকে নিজের অন্তরচেতনায় গ্রাস করেন। তিনি সময়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ নন; বরং সময় তাঁরই এক প্রকাশরূপ।


এই দৃষ্টিকোণ থেকেই স্পষ্ট হয় যে কাল-সংকর্ষিণী আসলে কোনো পৃথক দেবী নন; তিনি চেতনার ‘স্বাতন্ত্র্যময় গতি’-র এক জীবন্ত প্রতীক, সেই শক্তি যাঁর মাধ্যমে অচল, নীরব চেতনা নিজেকে সময়, গতি, ও অভিজ্ঞতার ধারায় রূপান্তরিত করে। অভিনবগুপ্ত যখন বলেন, “কালস্য গ্রাসকারিণী স্বাতন্ত্র্যচেতনাশক্তিরূপা”, তখন তাঁর বক্তব্য এই যে, সময়ের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; সময় আসলে চেতনার নিজেরই স্বাতন্ত্র্য (svātantrya), অর্থাৎ নিজের মধ্যে নিজের প্রতিফলন করার ক্ষমতা। চেতনা এক অখণ্ড, স্ব-ভাস্বর বাস্তবতা হলেও তার স্বভাব নিছক স্থবির নয়; বরং সেই চেতনার অন্তর্নিহিত স্বরূপই বিমর্শ (vimarśa)—নিজেকে জানার চেষ্টার মধ্যে থাকা এক প্রাণস্পন্দ।


যখন এই চেতনা নিজেরই প্রতিফলন দেখতে শুরু করে, তখনই সূচিত হয় অভিজ্ঞতার ক্রম—“আগে-পরে”, “কারণ-ফল”, “ঘটনা-প্রতিক্রিয়া”—এইসব ধারার অনুভূতি। অর্থাৎ, সময়ের উৎপত্তি কোনো বাহ্য পদার্থে নয়; এটি জন্ম নেয় চেতনার অন্তর্লীন স্পন্দন (spanda) থেকে—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে নিজেকে অভিজ্ঞতার রূপে প্রকাশ করে। এই আত্ম-প্রবাহই সময়ের জন্ম, আর সেই আত্ম-প্রবাহের শোষণই সময়ের লয়।


এই অর্থেই “কালস্য গ্রাসকারিণী স্বাতন্ত্র্যচেতনাশক্তিরূপা”—এই সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর বাক্যটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক্রমতত্ত্ব-এর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এর অর্থ, “যিনি সময়কে গ্রাস করেন, তিনিই স্বাতন্ত্র্যময় চেতনার শক্তিরূপা”—অর্থাৎ তিনি সেই একমাত্র শক্তি, যাঁর দ্বারা সময়ের উদ্ভব ও বিলয় দুটোই ঘটে। এখানে ‘কাল’ কোনো বাহ্য, পদার্থগত বা রৈখিক সময় নয়; এটি চেতনার অন্তর্নিহিত গতি—চেতনার নিজের প্রতি আত্ম-প্রতিক্রিয়া বা বিমর্শ-এরই প্রবাহ।