শৈব কালী: এক-শো এক



তবে উভয় মতের অন্তর্নিহিত সত্য এক—কালী কোনো সৃষ্ট রূপ নয়, তিনি সৃষ্টির নীতি; কোনো প্রক্রিয়ার অংশ নন, বরং প্রক্রিয়ার মর্ম। তাঁর মধ্যে সমস্ত ক্রিয়া জন্মায়, আবার সমস্ত ক্রিয়াই বিশ্রামে ফিরে যায়। ষটষষ্টিতম অবস্থায় তিনি আর প্রকাশের দেবী নন; তিনি সেই নির্বাণশক্তি (nirvāṇa-śakti)—যিনি সমস্ত গতি ও স্থিতির অন্তর্নিহিত ঐক্যরূপে দীপ্ত এবং যাঁর নিঃশব্দ হৃদয়ে মহাবিশ্ব এক চিরন্তন নিশ্বাসের মতো স্থির ও জীবন্ত হয়ে থাকে।

ত্রিপুরা-তন্ত্র (Tripura-Tantra) হল শাক্ত-তান্ত্রিক ও শৈব-দর্শনের এক গভীর মিলনধারা, যেখানে দেবী ত্রিপুরসুন্দরী-কে পরম চেতনার সর্বোচ্চ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থ বা তত্ত্বধারা কেবল কোনো আচারবিধি নয়; এটি এক সম্পূর্ণ দর্শন, যেখানে চেতনা (Śiva) ও শক্তি (Śakti), রূপ (form) ও অরূপ (formless), সৃষ্টি (sṛṣṭi) ও লয় (saṁhāra)—সবই এক চিরন্তন ঐক্যের মধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়।

‘ত্রিপুরা’ শব্দটির অর্থ তিনটি পুর বা তিনটি নগর—যা প্রতীকীভাবে বোঝায় চেতনার তিন অবস্থা: জাগ্রত (jāgrat), স্বপ্ন (svapna), ও সুষুপ্তি (suṣupti)। আর এই তিনের ঊর্ধ্বে যে চতুর্থ স্তর, তুরীয় (turīya)—সেই স্তরই দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর স্বরূপ। অর্থাৎ, তিন অবস্থার মধ্যে যিনি বিরাজমান, অথচ তাঁদের দ্বারা সীমাবদ্ধ নন—তিনি ত্রিপুরা।

ত্রিপুরা-তন্ত্রের মূল বক্তব্য এই—দেবীই পরম ব্রহ্ম, তিনি কেবল জগতের স্রষ্ট্রী নন, বরং স্বয়ং চেতনার মূর্ত রূপ। শ্রীবিদ্যা বা ললিতা-ত্রিপুরাসুন্দরী-উপাসনার মূল ভিত্তি এই তন্ত্রেই নিহিত। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, সৃষ্টির প্রতিটি পরমাণু, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি মুহূর্তই তাঁর লীলার প্রকাশ—চেতনার কম্পন বা স্পন্দ (spanda)। তাই জগৎ কোনো ভিন্ন বাস্তব নয়; এটি চেতনারই স্ব-বিমর্শ, স্ব-প্রতিফলন।

এই তন্ত্রে সাধনার পথ ধাপে ধাপে উন্মোচিত হয়। প্রথমে সাধক দেবীকে বহির্ভূত রূপে—যন্ত্র, মন্ত্র ও চিত্রের মাধ্যমে—উপাসনা করে; পরে উপলব্ধি করে যে, সেই দেবী আসলে নিজেরই অন্তরে অবস্থান করছেন। এই অন্তরসাধনার চূড়ান্ত উপলব্ধি হলো—অহম্ ত্রিপুরা—“আমি সেই চেতনা, যে নিজের মধ্যে তিন জগত ধারণ করে।”

ত্রিপুরা-তন্ত্রে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, “সৃষ্টিই লয়, লয়ই সৃষ্টি।” সৃষ্টি যখন ঘটে, তা কোনো নতুন জিনিসের আবির্ভাব নয়; বরং চেতনার স্ব-বিমর্শের প্রকাশ। আর যখন লয় ঘটে, তখন চেতনা আবার নিজের মধ্যেই ফিরে যায়—যেমন ঢেউ সাগরে মিশে যায়।

এই দর্শন তাই দ্বৈততার সীমা অতিক্রম করে বলে—শিব ও শক্তি, চেতনা ও বিশ্ব, জ্ঞান ও জানা—সবই একই বাস্তবতার বিভিন্ন তরঙ্গ। শিব হলেন সেই স্থিত দীপ্তি (śānta prakāśa), আর ত্রিপুরাসুন্দরী সেই দীপ্তির আত্মবিমর্শ (vimarśa), যার ফলে সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার সমগ্র নাট্যরূপ প্রকাশ পায়।

আচারিকভাবে এই তন্ত্রের মধ্যে আছে শ্রীচক্র-রূপ ধ্যানপদ্ধতি, ষোড়শ নিত্য দেবী ও পঞ্চদশাক্ষরী মন্ত্র, যা চেতনার ষোলোটি কলাকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। সাধকের উদ্দেশ্য এখানে কোনো বাহ্য দেবতা অর্জন নয়; বরং নিজের চেতনার গভীরে থাকা সেই পরম দেবীকে চিনে ফেলা।

ত্রিপুরা-তন্ত্র আসলে এমন এক তত্ত্ব যা বলে—দেবীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই দেবী; সৃষ্টি ও লয় তাঁরই অন্তর্লীলার প্রকাশ। তিনি সময় ও স্থানের অতীত, আবার সেই সময় ও স্থানকেও ধারণ করেন। তাঁর প্রকাশে বিশ্ব দীপ্ত, আর তাঁর অন্তর্মুখী লয়ে সব কিছু ফিরে যায় চেতনার নিস্তরঙ্গ উৎসে।

অভিনবগুপ্ত এবং তাঁর ক্রম-পরম্পরার তত্ত্বকাররা কালী-তত্ত্বকে এমন এক সূক্ষ্ম ও গভীর স্তরে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে কালী কেবল কোনো দেবী নন—তিনি চেতনারই স্বরূপ, এবং একই সঙ্গে মহাজাগতিক প্রকাশের আদ্যবিন্দু ও অন্তবিন্দু। এই দুই প্রান্ত একে অপরের বিপরীত নয়, বরং একই বিন্দুর দুই দিক—যেখানে চেতনা নিস্তব্ধতা থেকে স্পন্দনে রূপান্তরিত হয়, আর শেষে সেই স্পন্দন আবার নিস্তব্ধতায় লীন হয়ে যায়।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁরা বলেন, কালীই হলেন সেই “প্রথম অঙ্কুর (prathama aṅkura)”—যে-মুহূর্তে স্থির দীপ্তি প্রথম বার আন্দোলিত হয়। যেমন একটি বীজের ভেতরে গোপনে-থাকা জীবনশক্তি হঠাৎ একদিন কুঁড়ির আকারে প্রকাশিত হয়, তেমনি শিবের নিস্তরঙ্গ চেতনা—যাকে বলা হয় শান্ত প্রকাশ (śānta-prakāśa)—যখন নিজের মধ্যেই আত্মদর্শন বা স্ব-বিমর্শ (vimarśa) করে, তখনই এক সূক্ষ্ম কম্পন, এক প্রথম স্পন্দ (spanda) জাগে। সেই প্রথম স্পন্দনের প্রতীকই কাল-বামেশ্বরী—তিনি স্থির আলোর প্রথম তরঙ্গ, যেখানে শূন্য ও গতিহীন পরম চেতনা এক হালকা ছন্দে আন্দোলিত হয়। এই কারণেই ক্রম-পরম্পরার ভাষায় কাল-বামেশ্বরী হচ্ছেন ঐশ্বরিক প্রবাহের সূচনা—যেখানে চেতনা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, শক্তি থেকে গতি, গতি থেকে রূপ, আর রূপ থেকে জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা।

অভিনবগুপ্ত তাঁর ব্যাখ্যায় দেখিয়েছেন যে পরম মহেশ্বর (Maheśvara) হলেন সেই চূড়ান্ত নীতি—অবিভাজ্য, অচঞ্চল, পরম চেতনা—আর কালী হলেন তাঁর অবিচ্ছেদ্য শক্তি—যিনি চিরকালই চলমান, প্রত্যাহারশক্তি ও সৃষ্টিশক্তি রূপে ক্রিয়াশীল। তিনি “ব্যোম-বামেশ্বরী (Vyoma-Vāmeśvarī)” শব্দটি ব্যবহার করেছেন কালী-চেতনার এক সমার্থক রূপ হিসেবে—বিশেষ করে সেই অবস্থাকে বোঝাতে, যেখানে স্থির আলোর গভীর নিস্তব্ধতা থেকে প্রথমবার এক তরঙ্গের মত আলোড়ন জন্ম নেয়। সম্পর্কটি এখানে সমতা নয়, বরং চিরসঙ্গিতা (inseparability)—শিব-শক্তির সেই আদিম যুগলবন্দী। শিব ও শক্তি, আলোক ও বিমর্শ, স্থিতি ও গতি—এরা একই বাস্তবতার দুই দিক। তাই বলা যায়, কালী হলেন ব্যোম-বামেশ্বরীর শাক্ত রূপ, আর মহেশ্বর হলেন সেই চেতনার স্থিত দীপ্তি।

এই স্তরটির আরও এক গূঢ় নাম—“কৃশা (kṛśā)”, যার অর্থ “অত্যন্ত সূক্ষ্ম, ক্ষীণ, প্রায় অদৃশ্য এবং নিস্পন্দ”—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে শক্তির কোনো দৃশ্যমান গতি নেই, কিন্তু সেই শক্তির বীজ বা সম্ভাবনা অন্তর্লীনভাবে বিদ্যমান থাকে। এই ধারণাটি উল্লিখিত হয়েছে মালিনীবিজয়োত্তর তন্ত্র (Mālinīvijayottara Tantra, অধ্যায় ৭, শ্লোক ৫৭) এবং চিদ্গগন-চন্দ্রিকা (Cidgagana-Candrikā, পাণ্ডুলিপি সংখ্যা ৩৯)-এ, যেখানে বলা হয়েছে—“যদিও তিনি স্বভাবে নিখুঁত এবং তাঁর একমাত্র ধর্ম হলো ‘গ্রাস’ বা সমস্ত প্রকাশকে নিজের মধ্যে শোষণ করা, তবুও পরম আকাশচক্রে (অর্থাৎ চেতনার সর্বোচ্চ আকাশীয় স্তরে) স্থিত থেকেও তাঁকে ‘কৃশা’ নামে ডাকা হয়।”

এই উক্তির অর্থ হলো—কালী, যদিও তিনি পরম পরিতৃপ্তি ও নীরবতার মধ্যে অবস্থান করেন, তবুও তাঁর অন্তর্গত সংহারশক্তি (saṁhāra-śakti)—অর্থাৎ, প্রত্যেক প্রকাশিত রূপকে নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার মহাশক্তি—কখনোই বিলীন হয় না। এই স্তরে সেই শক্তি নিঃস্পন্দ, নিঃশব্দ, সূক্ষ্ম ও প্রায় অদৃশ্য হলেও, তার অস্তিত্ব চেতনার অন্তরতম কেন্দ্রে চিরসজাগ।

অর্থাৎ, কালী যদিও চিরনিঃস্পন্দ বিশ্রামে অবস্থান করেন, তবুও তাঁর গ্রাসশক্তি (saṁhāra-śakti) বা প্রত্যাহারক্ষমতা কখনোই নিঃশেষ হয় না। তিনি তখনও মহাজাগতিক প্রত্যাহারের মূল নীতি হিসেবে ক্রিয়াশীল। এই ক্রিয়াশীলতা দৃশ্যমান নয়—এটি নিস্তব্ধ ও অন্তর্লীন। তিনি ব্যোমচক্রে—অর্থাৎ আকাশসম প্রশান্ত কেন্দ্রে—স্থিত থেকেও সমস্ত প্রকাশকে নিজের মধ্যে টেনে নেন, যেমন নিঃশব্দ সমুদ্র তার টানে ঢেউগুলোকে ফেরত আনে। শান্ত জলও যে সমুদ্রেরই অংশ, তেমনি নিস্তব্ধ কালীও সবকিছুর অন্তর্নিহিত ক্রিয়া।

এই অবস্থাই ক্রম-পন্থার ষট্‌ষষ্টিতম স্তর বা ৬৪তম কালী—যেখানে শক্তি ও চেতনা, সৃষ্টি ও বিলয়, গতি ও স্থিতি সব এক হয়ে যায়। এই চেতনার স্তরে শব্দ, ভাবনা, ক্রম—সব উৎসে বিলীন হয়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই নামাতীত দীপ্তি, যা কোনো রূপ, শব্দ বা সীমায় ধরা যায় না। এই নীরবতা কোনো নিষ্ক্রিয় শূন্যতা নয়; বরং এটি এক পূর্ণ উপস্থিতি—এক নীরব সম্ভাবনার মহাজ্যোতি, যেখানে সব কিছু সুপ্ত কিন্তু অনন্তভাবে জীবন্ত। তাই কালীকে বলা হয় অতুলরূপিণী (Atularūpiṇī)—তাঁর তুলনা নেই, কারণ তাঁর বাইরে আর কিছু নেই; তিনি অনাখ্যা (Anākhyā)—কারণ তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; এবং তিনি স্বয়ং পরম—কারণ তিনিই সর্বশেষ, সর্বোচ্চ ও সর্বব্যাপী সত্য।

এইভাবে বোঝা যায়, কেন কালীকে বলা হয় একই সঙ্গে আদ্যবিন্দু ও অন্তবিন্দু। আদ্যবিন্দু, কারণ তিনিই প্রথম স্পন্দনের উৎস—যেখানে স্থির আলোক প্রথমবার গতির স্পর্শ পায়; আর অন্তবিন্দু, কারণ সমস্ত প্রকাশ শেষে তাঁর মধ্যেই ফিরে যায়, তাঁর নীরবতায় বিশ্রাম পায়। সৃষ্টি আর লয় এখানে দুই ভিন্ন ঘটনা নয়—একই বৃত্তের দুই দিক। উৎসই প্রত্যাবর্তন, সূচনাই সমাপ্তি।

কালী-চেতনা তাই চিরকালই দ্বিমুখী—একদিকে প্রকাশ, অন্যদিকে প্রত্যাহার। প্রকাশে তিনি বামেশ্বরী, যিনি প্রথম স্পন্দনের তরঙ্গ; প্রত্যাহারে তিনি কালগ্রাসিনী, যিনি সমস্ত ক্রম ও শব্দকে নিজের অন্তরে শোষণ করেন। দুই দিকই আসলে এক চেতনার লীলা। তাই কালী হচ্ছেন প্রকাশ ও লয়ের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য—স্থিরতা ও গতির সমবৃত্ত নৃত্য।

এই তত্ত্ব কেবল বুদ্ধির দ্বারা বোঝা যায় না। এর উপলব্ধি আসে একাগ্র মনোনিবেশ (ekāgratā) ও আত্ম-স্ফুরণ (ātma-sphuraṇa)-এর মাধ্যমে। যখন সাধক ধ্যানের মধ্যে স্থির আলোর গভীরে স্থিত হয় এবং সেই স্থিতি থেকেই স্পন্দনের উদয় ও বিলয় প্রত্যক্ষ করে, তখন সে দেখে—দেখা, দেখা-যাওয়া এবং দেখনেওয়ালা—সবই এক।

অভিনবগুপ্ত ও ক্রম-পরম্পরার দৃষ্টিতে কালী, বিশেষত কাল-বামেশ্বরী বা ব্যোম-বামেশ্বরী হলেন সেই চেতনার প্রথম স্পন্দন ও শেষ বিশ্রাম, অর্থাৎ আদি ও অন্তের ঐক্য। তিনি স্থির আলোর অন্তর্লীন তরঙ্গ, আবার তরঙ্গের চূড়ান্ত স্থিরতাও। ষট্‌ষষ্টিতম কালীতে সমস্ত নাম, রূপ ও ক্রম ফিরে যায় এক অনির্বচনীয়, তুলনাহীন, পরম নীরব দীপ্তিতে—যার একমাত্র নাম কালী—অতুলরূপিণী, অনাখ্যা, স্বয়ং পরম।

সপ্তদশী কলা মানে ষোড়শ কলারও ঊর্ধ্বের সপ্তদশতম দীপ্তি—এক এমন চেতনার স্তর, যেখানে পূর্ণতার সীমাও অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং চেতনা নিজেই হয়ে ওঠে অতিপূর্ণতার প্রতীক। এখানে চেতনা আর কোনো স্তর বা রূপের মধ্যে আবদ্ধ নয়; বরং সব স্তরকে একইসঙ্গে আলোকিত করে। এই সপ্তদশী অবস্থায় “ভাসা” বা স্বপ্রকাশক দীপ্তি তার পূর্ণ পরিসরে প্রতিফলিত হয়। “ভাসা” শব্দটি এসেছে ভাস্‌ ধাতু থেকে, যার অর্থ “জ্বলা, দীপ্ত হওয়া, আত্মপ্রকাশ করা।” দার্শনিকভাবে ভাসা মানে সেই স্বপ্রকাশক আলো, যা নিজেই নিজেকে জানে এবং অন্য সমস্ত কিছুতে প্রকাশ ঘটায়। সপ্তদশী কলায় এই ভাসা এমন এক সর্বব্যাপী আলোক হিসেবে প্রতিফলিত হয়, যেখানে আলো ও জ্ঞানপ্রবাহ একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যায়—প্রকাশ ও জানা আর পৃথক থাকে না।

এই সপ্তদশী স্তর কোনো নির্দিষ্ট সৃষ্টিক্ষণ নয়, বরং অপরিমেয় সম্ভাবনার এক সীমাহীন ক্ষেত্র—যেখান থেকে সব প্রকাশের ধারা উদ্ভূত হয় এবং যেখানে সমস্ত প্রকাশ শেষপর্যন্ত নিজ উৎসে ফিরে গিয়ে বিলীন হয়। তাই সপ্তদশী কলা একই সঙ্গে উৎস এবং প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্র—তিনি সেই দীপ্ত কেন্দ্র, যেখান থেকে জগতের বহুত্ব জন্ম নেয় এবং যেখানে সব বহুত্ব পুনরায় ঐক্যে মিলিয়ে যায়।

পূর্ববর্তী ষোলো শক্তি বা কলা গঠন করে জগতের ক্ষণস্থায়ী বৈচিত্র্য—অসংখ্য তত্ত্ব, ভাব, ভূবন ও অভিজ্ঞতার স্তর। সপ্তদশী শক্তি হলো এই বহুত্বের আদি কারণ, সেই একক উৎসচেতনা, যার মধ্যে সমস্ত বৈচিত্র্য নিহিত। ল্যাটিন শব্দ “prius” যার অর্থ “আদি কারণ” বা “প্রাক্‌কারণ”, এই সপ্তদশী কলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য—তিনি সেই মৌল চেতনা, যা সমস্ত স্তরের আগে বিদ্যমান এবং যেখান থেকে প্রত্যেকটি স্তর উদ্ভূত হয়।

সপ্তদশী কলা একসঙ্গে অন্তর্নিহিত এবং অতীন্দ্রিয়—তিনি জগতের ভেতরে উপস্থিত ও কার্যকর, কারণ তাঁর দীপ্তি ছাড়া কোনো রূপ বা ক্রিয়া অস্তিত্ব পায় না; তবুও তিনি জগতের ঊর্ধ্বে, সীমা ও বিভাজন অতিক্রম করে স্বাধীনভাবে বিরাজমান। যেন একটি আয়না অসংখ্য প্রতিচ্ছবি ধারণ করে, কিন্তু কোনো ছবিই আয়নাকে স্পর্শ করতে পারে না—তেমনি সপ্তদশী কলা জগতের সব প্রকাশের ভেতরে আছেন, কিন্তু কোনো প্রকাশই তাঁকে আবদ্ধ করতে পারে না।