উভয়ের লক্ষ্য এক—মনের অন্ধকারে যা লুকিয়ে আছে, তাকে চেতনার আলোয় আনতে হবে; পার্থক্য কেবল পদ্ধতিতে—ফ্রয়েড তা করেন বিশ্লেষণের মাধ্যমে, যোগী করেন ধ্যানের মাধ্যমে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, চিত্ত ও অবচেতন মনের মধ্যে এক আশ্চর্য সমান্তরালতা রয়েছে। চিত্ত হলো চেতনার গভীর, প্রবহমাণ স্তর; অবচেতন মনও তাই—চেতনার সেই অংশ, যা দেখা যায় না কিন্তু অনুভূত হয়। চিত্তের বীজ যেমন কর্মের কারণ, তেমনি অবচেতন স্মৃতি ও প্রবৃত্তিও আচরণের মূল কারণ। দুটিই বলে—মানুষের সত্যিকারের জীবন চেতনার পৃষ্ঠে নয়, বরং গভীরে; আর মুক্তি মানে সেই গভীর স্তরকে বিশুদ্ধ করা।
চিত্ত, আলয়বিজ্ঞান ও অবচেতন মন—এই তিনটি ধারণা ভিন্ন দার্শনিক ভাষায় একই বাস্তব সত্যের ইঙ্গিত দেয়। তারা শেখায়, মানুষের মন কেবল চিন্তা বা বুদ্ধি নয়; এটি এক গভীর জীবন্ত স্রোত, যেখানে অতীত ও বর্তমান, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক, জাগ্রত ও নিদ্রিত সব একত্রে প্রবাহিত হয়। সেই গভীর স্তরই মানুষের প্রকৃত কেন্দ্র, আর তার পরিচ্ছন্নতাই মুক্তি—যা যোগী বলেন চিত্তনিরোধ, বৌদ্ধ বলেন আলয়বিশুদ্ধি, আর পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানী বলেন psychic integration—চেতনার পূর্ণ সংহতি।
তথাগতগর্ভ দর্শন (Tathāgatagarbha) মহাযানের সেই অন্তর্মুখ ও আধ্যাত্মিক ধারা, যেখানে মুক্তি কোনো বাহ্য গন্তব্য নয়—মুক্তি মানে নিজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধত্বকে (Buddha-nature) প্রত্যক্ষ করা। “তথাগতগর্ভ” শব্দটি দু’ভাগে গঠিত—তথাগত (বুদ্ধের আরেক নাম) + গর্ভ (অন্তঃস্থ ভাণ্ডার/গর্ভ/বীজ)। অর্থাৎ, প্রত্যেক জীবের হৃদমধ্যে বুদ্ধের বীজ—একটি অমল, জাগ্রত চেতনা—স্বভাবতই বিদ্যমান। এই বুদ্ধত্ব নতুন করে সৃষ্টি করতে হয় না; এটি আদি থেকে আছে (প্রকৃতিসিদ্ধ), কেবল অজ্ঞান (অবিদ্যা) ও ক্লেশ (রাগ-দ্বেষ-মোহ প্রভৃতি)-এর ধুলোয় ঢাকা। যেমন মেঘ সূর্যকে ঢেকে দেয়—সূর্য নিভে যায় না, কেবল আড়াল হয়—তেমনি নিজের ভেতরের বুদ্ধত্ব মলিন হয় না, শুধু আচ্ছন্ন থাকে; ক্লেশ-মেঘ সরে গেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দীপ্ত হয়ে ওঠে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সাধনার লক্ষ্য “নতুন কিছু হওয়া” নয়; বরং যা আছেন, তা-ই দেখা—নিজের প্রকৃত স্বরূপকে চেনা। তাই তথাগতগর্ভ বলে, দুঃখ ও বন্ধন আমাদের আসল পরিচয় নয়; ওগুলো আগত-আবরণ (adventitious)—এসে জুড়েছে, তাই অপসারণযোগ্য। মুক্তি বলতে বোঝা যায়:
আবরণ-মোচন—অবিদ্যা ও ক্লেশের স্তরগুলি সরানো,
স্বভাব-প্রকাশ—অন্তর্লীন করুণা-প্রজ্ঞার দীপ্তি উন্মুক্ত হওয়া।
এখানে তিনটি স্তর পরিষ্কার হয়ে ওঠে—
স্বভাব: বুদ্ধত্ব বা “ধর্মধাতু”—নির্মল, অদ্বৈত, অলৌকিক কিছু নয়; চেতনার নির্মল স্বরূপ।
আবরণ: অজ্ঞান-ক্লেশ, সংস্কার, ভুল ধারণা—যা প্রকৃতিতে অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই দূরযোগ্য।
সাধনা: যে-পথে আবরণ ক্ষয় হয় ও স্বভাব উন্মুক্ত হয়—শীল (নৈতিকতা), সমাধি (ধ্যান), প্রজ্ঞা (বোধ)—এবং মহাযানে বিশেষ করে বোধিচিত্ত (সকলের কল্যাণে জাগরণের সংকল্প) ও করুণা-প্রজ্ঞার ঐক্যচর্চা।
এই তত্ত্ব আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে কিভাবে জুড়ে যায়?
আমরা যখন সচেতন মনোযোগ (mindfulness)-এ থাকি, তখন দেখা যায়, রাগ-দ্বেষ আসে-যায়, কিন্তু তাদের ভেতরে একটি অচঞ্চল, অবলোকনশীল স্বচ্ছতা অপরিবর্তিত। তথাগতগর্ভ বলে—সেই স্বচ্ছতাই আমাদের বুদ্ধ-স্বভাব।
আমরা যখন করুণার চর্চা করি, তখন কেবল নৈতিক কাজই করছি না; নিজের স্বভাবসিদ্ধ স্পন্দন—বোধিসত্ত্বও—হৃদয়ের স্বতঃপ্রকাশও—তার সাথে জেগে ওঠে।
আমরা যখন প্রজ্ঞা-র আলোয় “আমি/অন্য”, “আছে/নেই” ইত্যাদি কঠিন বিভাজন শিথিল হতে দিই, তখন আবরণ ঝরে পড়ে, স্বভাব উজ্জ্বল হয়।
দার্শনিকভাবে, তথাগতগর্ভ মধ্যমক (Madhyamaka)-এর শূন্যতাবোধের সঙ্গে বিরোধ করে না; বরং বলে—শূন্যতা মানে অভাব নয়, শূন্যতা মানে আগত-আবরণের অনুপস্থিতি ও নির্মল স্বভাবের আড়ালহীনতা। এই কারণে অনেকে বলেন, বুদ্ধত্ব = শূন্যতার দীপ্ত উপস্থিতি। যোগাচার-এর ভাষায় বললে, যখন আলয়বিজ্ঞান (storehouse consciousness) ক্লেশ-বীজ থেকে বিশুদ্ধ হয়, তখনই বুদ্ধ-জ্ঞান স্বয়ং প্রকাশিত—এটাই তথাগতগর্ভের বাস্তব অর্থ।
সাধনার রূপরেখা এ তত্ত্বে খুব স্বাভাবিক—
শীল: আচরণে অহিংসা, সত্য, অপরিগ্রহ—আবরণের স্থূলতম স্তর শিথিল হয়।
সমাধি: একাগ্র ধ্যান (শমথ) ও অন্তর্দৃষ্টি (বিপশ্যনা)—মন পরিষ্কার হয়, স্বচ্ছতা স্থিতিশীল হয়।
প্রজ্ঞা: সকল ধর্মের অনাত্ম-পরস্পরনির্ভর স্বরূপ প্রত্যক্ষ—আবরণের মূল কেটে যায়।
বোধিচিত্ত/করুণা-কর্ম: “আমি-তুমি” বিভাজন গলে, স্বভাব-করুণা অবারিত স্রোত হয়ে ওঠে।
ফলত, তথাগতগর্ভ এই আত্মবিশ্বাস দেয়—“আমার মধ্যে বুদ্ধত্ব আছে”—এবং একসঙ্গে দায়িত্ববোধ জাগায়—“এই দীপ্তি ঢাকছে যে-অবিদ্যা-ক্লেশ, তা মুছতে হবে।” এটি কোনো ধারণাগত সান্ত্বনা নয়; বরং অভিজ্ঞতামূলক পথনির্দেশ: মেঘ সরান, তবেই সূর্য নিজে-নিজে উজ্জ্বল হবে—নতুন সূর্য বানাতে হয় না।
তথাগতগর্ভ দর্শন বলে—আপনি মূলত বুদ্ধ; দুঃখ আপনার স্বরূপ নয়, আবরণ। মুক্তি মানে নিজেকে বদলে অন্য কিছু হওয়া নয়; মুক্তি মানে যা আপনি চিরকাল—সেই নির্মল, করুণাময়, জাগ্রত স্বরূপকে স্বচক্ষে জানা। এই জানাটাই জাগরণ; এই জাগরণই বুদ্ধত্ব।
অদ্বৈত বেদান্তের মূলকথাগুলিকেই এই দর্শন মেনে চলে।
এই তিন দর্শন—মধ্যমক, যোগাচার, ও তথাগতগর্ভ—একই সত্যের তিনটি দিক। মধ্যমক শেখায়, বাস্তবতার প্রকৃতি শূন্য ও অদ্বৈত; যোগাচার দেখায়, এই বাস্তবতা চেতনারই প্রতিফলন; আর তথাগতগর্ভ উপলব্ধি করায়, এই চেতনা আসলে বুদ্ধসত্তা নিজে—অন্তর্লীন জাগ্রত বোধি। ফলে তিনটি ধারা মিলিয়ে মহাযান বৌদ্ধ দর্শন আমাদের শেখায়—জগৎ মিথ্যা নয়, বরং চেতনার দীপ্ত লীলা, যেখানে শূন্যতা, মন ও বুদ্ধত্ব—তিনটি এক পরম ঐক্যের প্রকাশমাত্র।
৪. প্রজ্ঞা ও করুণার ঐক্য: মহাযান বৌদ্ধ দর্শনে প্রজ্ঞা (জ্ঞান) ও করুণা (সহানুভূতি) একে অপরের থেকে আলাদা নয়; বরং তারা একে অপরের গভীর প্রতিফলন—দুই দিক, এক সত্য। প্রজ্ঞা সেই জ্ঞান, যা বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে—যে-সমস্ত বস্তু, ধারণা ও অভিজ্ঞতা আপাতভাবে পৃথক বলে মনে হয়, আসলে তারা সকলেই শূন্যতা (Śūnyatā)-র প্রকাশ। আর করুণা হলো সেই উপলব্ধ জ্ঞানের জীবন্ত প্রতিক্রিয়া—যেখানে এই অদ্বৈত সত্যের বোধ জীবজগতের প্রতি সীমাহীন সহানুভূতি ও মমতায় রূপ নেয়।
প্রজ্ঞা শেখায়—জগৎ কোনো স্বতন্ত্র সত্তার সমষ্টি নয়, বরং সম্পর্কনির্ভর উদ্ভবের এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। যে এই সত্য বোঝে, সে জানে—“আমি” ও “অন্য”-এর মধ্যে যে-বিভাজন আমরা কল্পনা করি, সেটি আসলে মননের প্রক্ষেপণ। এই বোধের মধ্য দিয়ে “আমি”-এর সীমানা ভেঙে যায়, এবং সমস্ত জীবের সাথে এক গভীর ঐক্যের অনুভূতি জাগে। এখানেই করুণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নেয়। কারণ যখন আমি জানি যে, অন্যের দুঃখ আমারই দুঃখ, তখন সাহায্য করা বা প্রেম করা আর কোনো কর্তব্য নয়—এটি হয়ে ওঠে স্বাভাবিক স্বরূপের প্রকাশ।
অন্যদিকে, করুণা ছাড়া প্রজ্ঞা অসম্পূর্ণ। কেবল বুদ্ধিগত উপলব্ধি, যদি জীবের কল্যাণে কার্যরূপে প্রকাশ না পায়, তবে তা নিস্তেজ থাকে। তাই মহাযান বৌদ্ধদর্শনে বোধিসত্ত্ব আদর্শ প্রজ্ঞা ও করুণার ঐক্যরূপ—তিনি শূন্যতার জ্ঞান লাভ করেও দুঃখী প্রাণীদের ত্যাগ করেন না, বরং সেই জ্ঞানের আলোয় সবার মুক্তির জন্য করুণার সাগরে অবগাহন করেন।
এই দুই শক্তির পরিপূর্ণ মিলনই হলো প্রজ্ঞাপারমিতা (Prajñāpāramitā)—অর্থাৎ “জ্ঞানের পরম পূর্ণতা”। প্রজ্ঞা এখানে আর কোনো ধারণা নয়; এটি সেই জীবন্ত অভিজ্ঞতা, যেখানে জানা ও ভালোবাসা, শূন্যতা ও করুণা, জ্ঞান ও কর্ম—সব এক হয়ে যায়। প্রজ্ঞা আলো দেয়; করুণা সেই আলোকে তাপ ও প্রাণে পরিণত করে। প্রজ্ঞা সত্যকে দেখে; করুণা সেই সত্যকে জীবিত করে তোলে।
এই কারণেই মহাযান সূত্রগুলোতে বলা হয়েছে—“প্রজ্ঞা ছাড়া করুণা অন্ধ, আর করুণা ছাড়া প্রজ্ঞা শূন্য।” প্রজ্ঞা হৃদয়কে মুক্ত করে; করুণা হৃদয়কে ভরিয়ে তোলে। এই দুই মিলেই উদ্ভূত হয় সম্পূর্ণ বোধি—যেখানে বুদ্ধত্ব কেবল জ্ঞানে নয়, ভালোবাসায়ও পরিপূর্ণ হয়।
মহাযানের দর্শনে প্রজ্ঞা ও করুণা কোনো পৃথক সাধনা নয়; তারা একে অপরের অন্তর্গত। প্রজ্ঞাপারমিতা মানে সেই চূড়ান্ত অবস্থান, যেখানে জ্ঞান আর প্রেম একত্রে রূপ নেয় জাগরণের দীপ্তিতে—যেখানে জানা মানেই ভালোবাসা, আর ভালোবাসা মানেই জানা।
৫. দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য: মহাযান দর্শন শেখায়—সমস্ত সত্তা পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল, কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই। জ্ঞান (প্রজ্ঞা) ও প্রেম (করুণা) একই চেতনার দুই দিক। মুক্তি ব্যক্তিগত নয়, বরং সর্বজনীন। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো অদ্বৈত চেতনার উপলব্ধি, যেখানে জ্ঞানী, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদ মুছে যায়।
মহাযান বৌদ্ধ দর্শন এমন এক গভীর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে বুদ্ধত্ব কোনো দূরের গন্তব্য নয়; এটি প্রতিটি জীবের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা। মুক্তি মানে জগৎ থেকে সরে যাওয়া নয়, বরং জগৎকেই দেখা অদ্বৈত চেতনার লীলারূপে—যেখানে প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি নিঃশ্বাসই সেই এক চিরন্তন বোধির দীপ্ত প্রকাশ।
এখন দেখা যাক, ক্রমপন্থার কালী কীভাবে একই সত্য প্রকাশ করছেন। ক্রমদর্শনে কালী হলেন সময় ও চেতনার ঐক্য—তিনি “কাল” অর্থাৎ সময়কে অতিক্রম করেন, অথচ সময়ের ভেতর দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করেন। তিনি সেই পরম শক্তি, যিনি প্রতিক্ষণে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ঘটাচ্ছেন, কিন্তু নিজে সব কিছুর ঊর্ধ্বে অচঞ্চল, শাশ্বত। অভিনবগুপ্ত বলেছেন, “কালকালিকা তত্ত্বমেকম্”—কাল (সময়) ও কালিকা (দেবী) মূলত এক অভিন্ন তত্ত্ব। অর্থাৎ, সময় নিজেই তাঁর দেহ, আর চেতনা তাঁর আত্মা। কালী তাই সময়ের গতির মধ্যে চিরন্তনের দীপ্তি—তিনি সৃষ্টির মহাশ্বাস, যার এক প্রান্তে প্রকাশ, আরেক প্রান্তে প্রত্যাবর্তন।
এই দুটি দর্শনের অন্তর্নিহিত মিল এখানেই—প্রজ্ঞাপারমিতা যেমন শূন্যতার মধ্য দিয়ে অদ্বৈত চেতনার অভিজ্ঞতা দেন, তেমনি ক্রম কালী সময়ের অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই একই চেতনার চিরন্তন রূপ প্রকাশ করেন। একদিকে শূন্যতা মানে সব সীমা ও বিভেদের বিলোপ, অন্যদিকে কালীর সময়-অতিক্রম মানে পরিবর্তনের ভেতরেই নিত্যতার প্রকাশ। দু-জনেই শেখান, চেতনা নিজেই পূর্ণ, নিজেই জাননীয়/জ্ঞান, নিজেই জ্ঞেয়—তাকে আলাদা করে কোথাও খুঁজতে হয় না।
প্রজ্ঞাপারমিতা বলেন, “শূন্যতা মানেই পূর্ণতা,” আর ক্রম কালী বোঝান, “সময় মানেই শাশ্বততা।” বৌদ্ধ দৃষ্টিতে সব রূপ শূন্যতার প্রতিফলন, আর তান্ত্রিক দৃষ্টিতে সব সময়ই চেতনার দীপ্তি। একদিকে নীরবতার গভীরে দেখা যায় প্রজ্ঞার উদ্ভব, অন্যদিকে কালীর ছন্দে শোনা যায় সেই একই চেতনার নৃত্য।
তাদের অভিজ্ঞতার পদ্ধতিও আশ্চর্য সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রজ্ঞাপারমিতা উপলব্ধ হয় ধ্যানের নিঃশব্দ কেন্দ্রে—যেখানে মন থেমে যায়, আর জ্ঞান নিজের উৎসে ফিরে যায়। ক্রম কালী উপলব্ধ হয় কাল-চেতনার ঐক্যে—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক চিরন্তন “এখন”-এর মধ্যে মিলেমিশে যায়। দু-জনেরই কেন্দ্র হলো অদ্বৈত উপলব্ধি—যেখানে দ্বন্দ্ব মুছে গিয়ে কেবল এক চেতনা অবশিষ্ট থাকে।
শিবোপাধ্যায়ের মতে, ক্রম কালী ও প্রজ্ঞাপারমিতা কোনো পৃথক ধর্মীয় ধারণা নয়; তারা একই পরম দেবীর দুই দিক—একজন সময়ের অতিক্রমে প্রকাশিত, অন্যজন শূন্যতার নীরবতায় জাগ্রত। প্রজ্ঞাপারমিতা যেভাবে জ্ঞানের মাতৃরূপা, তেমনি কালী হলেন চেতনার মাতৃসত্তা। উভয়েই “চেতনা-স্বয়ং”—নিজেকে জানেন, নিজেকে ধারণ করেন, আর নিজেই সমস্ত জ্ঞেয় ও অভিজ্ঞতার ভিত্তি।
প্রজ্ঞাপারমিতা ও ক্রম কালী দুই ভিন্ন ধারায় প্রকাশিত হলেও, তাঁদের মর্ম এক—অদ্বৈত চেতনার সেই পরম সত্য, যেখানে শূন্যতা ও পূর্ণতা, সময় ও শাশ্বততা, নীরবতা ও নৃত্য, জ্ঞান ও শক্তি—সব এক হয়ে যায় এক অনন্ত আত্মস্বরূপে।
এই তুলনাটি কেবল প্রতীকি বা রূপগত নয়—এটি এক গভীর দার্শনিক সেতুবন্ধনের প্রকাশ, যা ভারতীয় তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সমস্ত শাখাকে এক অভিন্ন চেতনা-তত্ত্বের (Unity of Consciousness) কেন্দ্রে একত্রিত করে।