শৈব কালী: একুশ



অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে, এই স্তরটি মহৎ বা কারণ জগৎ (cosmic intellect) নামে পরিচিত। এটি সেই সূক্ষ্ম অবস্থা, যেখানে ব্রহ্ম, পরম সত্তা, নিজেকে বিশ্বেরূপে প্রকাশ করার প্রাথমিক ইচ্ছে নির্বাহ করে। এই স্তরে নাম-রূপের (name and form) বীজরূপ ধারণা জন্ম নেয়। অর্থাৎ, স্থূল জগতের বৈচিত্র্যময় বস্তু ও ঘটনার যে বিশেষ নাম ও রূপ রয়েছে, তার মূল সুপ্ত ধারণা এই মহৎ স্তরে নিহিত।

এটি হিরণ্যগর্ভ স্তরের এক সূক্ষ্ম অভ্যন্তর। হিরণ্যগর্ভকে সমষ্টিগত সূক্ষ্ম শরীর বা cosmic subtle body বলা হয়, যেখানে ব্রহ্মচেতনা নিজেকে বিশ্বরূপে দেখতে শুরু করে। তবে এই মহৎ স্তরে বিভাজন এখনও সম্পূর্ণ প্রকট হয় না। এখানে বিশ্ব একটি অবিভক্ত, একীভূত ধারণারূপে বিরাজ করে। যেমন একটি গাছের বীজ, যার মধ্যে সম্পূর্ণ গাছের ভবিষ্যৎ লুকায়িত থাকে, কিন্তু এখনও তা শাখা-প্রশাখা, পাতা বা ফুলে বিভক্ত হয়নি।

এই স্তরটিকে তাই বিশ্ব সৃষ্টির প্রথম স্পন্দন বা আদিম প্রজ্ঞা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা অসীম ব্রহ্মের মধ্যে থেকে সসীম বিশ্বের সম্ভাব্য রূপকে ধারণ করে। এই অবস্থায়, ব্রহ্ম একাধারে জ্ঞাত, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান—এই ত্রিবিধ রূপের সম্মিলিত একত্বকে অনুভব করে, যেখানে সব কিছু এখনও তার মূল অভিন্ন সত্তায় একীভূত। এটি সেই বিন্দু, যেখানে পরম কারণ থেকে কার্যরূপী জগতের যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু এখনও তা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়নি।

শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্ব তাই এক মহাজাগতিক সেতু—অদ্বৈতের অনন্ত স্বচ্ছ দীপ্তি থেকে দ্বৈতের বর্ণময় প্রকাশের দিকে নামার পথ। এখানে চেতনা প্রথম বার আত্মপরিচয় ও বিশ্বপরিচয়ের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করে; এই ভারসাম্য থেকেই পরবর্তী স্তরে মায়া ও সীমাবদ্ধতার জন্ম হবে।

শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্ব হলো চেতনার সেই সোনালী সীমানা, যেখানে জ্ঞান ও ক্রিয়া একে অপরকে আলোকিত করে, আর “আমি” ও “এটি”—এই দুই একে অপরের প্রতিফলন হয়ে ওঠে। এখান থেকেই পরবর্তী স্তরে পরম ঐক্য ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার জগতে রূপান্তরিত হয়, কিন্তু তার মূলে চেতনার সেই চিরন্তন ঐক্যই অনাহতভাবে থেকে যায়।

এই পঞ্চতত্ত্বগুলি পরম ব্রহ্মের সৃজনী লীলার একটি ধারাবাহিক ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা কেবল দার্শনিক নয়, আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এই তত্ত্বগুলি উপলব্ধি করার মাধ্যমে একজন সাধক সৃষ্টির রহস্য এবং নিজের অস্তিত্বের গভীর অর্থ অনুধাবন করতে পারে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে “তত্ত্ব” শব্দের অর্থ কেবল কোনো দার্শনিক মতবাদ বা তাত্ত্বিক ধারণা নয়; বরং এটি বাস্তবতার স্বরূপ—“যথার্থে যা আছে”, তার অনন্ত প্রকাশের স্তরসমূহ। ‘তত্ত্ব’ শব্দটি এসেছে মূল সংস্কৃত ধাতু “তৎ” (that, সেই) এবং প্রত্যয় “ত্ব” (নিসর্গ বা স্বরূপতা) থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ—“যা সত্যভাবে বিদ্যমান, তা-ই তত্ত্ব”। অর্থাৎ, “যথার্থত্বই তত্ত্বত্ব”—যে-অস্তিত্ব তার নিজের স্বরূপে সত্য, পরিবর্তনের অন্তরেও অপরিবর্তনীয়, সেটিই তত্ত্ব।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের মহাগ্রন্থ তন্ত্রালোক-এর (১.৬৬) ভাষায়—“তত্ত্বম্‌ নাম তদ্‌ যথাভূতবোধগম্যম্‌”, অর্থাৎ, তত্ত্ব হলো তা-ই, যা যথার্থ জ্ঞানে উপলব্ধি করা যায়—যা কেবল ধারণা নয়, চেতনার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এই দর্শনের কাছে তত্ত্ব কোনো নিষ্ক্রিয় বস্তু নয়; এটি চেতনার আত্মপ্রকাশের স্তর—পরম শিবের নিস্তরঙ্গ ঐক্য থেকে শুরু করে স্থূল জগৎ পর্যন্ত চেতনার ধাপে ধাপে উন্মোচন।

অভিনবগুপ্ত তাঁর ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞাভাষ্য (১.৫.৮)-এ বলেছেন, “সা হি পরমা সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী, স্ববিমর্শরূপা”—পরম চেতনা নিজের স্বাতন্ত্র্যে প্রকাশিত হয়ে নিজেকে জানে; আর সেই আত্মবিমর্শনের প্রকাশই তত্ত্বগুলির ক্রমবিকাশ। অর্থাৎ, প্রতিটি তত্ত্ব শিব-চেতনার একেকটি আত্মবিমর্শন, একেকটি স্পন্দন বা ābhāsa (প্রকাশ)।

তত্ত্ব এখানে চেতনার প্রকাশধারা (manifestation process)—যেখানে “অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌” (তন্ত্রালোক, ১.৯৪)—অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। এই লীলার প্রতিটি পর্যায়, প্রতিটি আত্ম-প্রতিফলনই একেকটি তত্ত্ব।

তত্ত্বের সংজ্ঞা কাশ্মীর শৈব দর্শনে দ্বিগুণ অর্থ বহন করে—

প্রথমত, এটি অস্তিত্বের ontological স্তর, অর্থাৎ বাস্তবতার ক্রমানুসারে চেতনার রূপান্তর;

দ্বিতীয়ত, এটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার epistemic স্তর, অর্থাৎ জ্ঞাতার চেতনা যেভাবে নিজেকে চিনে।

শিব থেকে পৃথ্বী পর্যন্ত এই ছত্রিশটি তত্ত্ব আসলে চেতনার অবতরণ—অপরিমিত ঐক্য থেকে সীমাবদ্ধ বহুত্বে নামার পথ। আবার মুক্তির সাধনায় এই তত্ত্বগুলিই উলটো ক্রমে আত্মোদ্ধারের সোপান—বহুত্ব থেকে ঐক্যে ফিরে যাওয়ার পথ।

সংক্ষেপে—তত্ত্ব মানে সেই বাস্তবতার মৌল নীতি, যা চেতনার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya) দ্বারা প্রকাশিত প্রতিটি স্তরকে বোঝায়। এটি শিবের আত্মবিমর্শনের অনন্ত ধারা—যেখানে প্রতিটি স্তরই এক এক “সত্য”, এক এক “তদ্‌ভাব”—তার প্রকৃতি বা স্বরূপ—আর এই অনন্ত সত্যের ধারাবাহিকতাই, মালিনীবিজয়তন্ত্র ও তন্ত্রালোক অনুসারে—“ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্বানি।”

দ্বিতীয় স্তর—সীমাবদ্ধ চেতনার স্তর (শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্ব)—হলো সেই গূঢ় সন্ধিক্ষণ, যেখানে পরম শিবচেতনা নিজের অসীম, সর্বব্যাপী দীপ্তি থেকে স্বেচ্ছায় সীমাবদ্ধতার দিকে অবতীর্ণ হতে শুরু করে। এখানে চেতনা আর পরম ঐক্যে স্থিত নয়; সে নিজেরই এক ক্ষুদ্র প্রতিফলন অনুভব করে—যেন অখণ্ড আলোর মধ্যেই ছায়ার রেখা টানল, অথচ সেই ছায়াটিও আলোরই অংশ।

এই স্তর কোনো “পতন” নয়, বরং চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)-র স্বতঃস্ফূর্ত লীলা—অর্থাৎ, চেতনা নিজেই নিজের অসীমতা সীমিত করতে চায়, যাতে নিজের বিপরীতে নিজেরই রূপ দেখতে পারে। আচার্য উৎপলদেব এই গভীর সত্যটি ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা (১.৫.৮)-এ এভাবে প্রকাশ করেছেন—“চিদেব চিদ্রূপতয়া বিবর্ততে, স্বাতন্ত্র্যেন দ্বৈতাভাসনা ভবতি”—চেতনা নিজস্ব চৈতন্যরূপেই বিবর্তিত হয়, এবং নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে।

অর্থাৎ, সীমাবদ্ধতা কোনো বাইরের আরোপ নয়; এটি শিবের নিজেরই লীলা। পরম চেতনা নিজের মধ্যে সম্ভাব্য জগৎরূপকে উদ্‌ভাসিত করতে গিয়ে একধরনের স্ব-আবরণ (self-veiling) সৃষ্টি করে—যার ফলেই অসীম চৈতন্য নিজেকে আংশিক, সীমিত, ও বহু রূপে বিভক্ত দেখতে শুরু করে। এই বিভাজন কিন্তু প্রকৃত নয়; এটি কেবল চেতনার নিজের মধ্যেকার “আভাস” (ābhāsa), যেমন সূর্যরশ্মি মেঘের ভিতর দিয়ে নিজেকে আলাদা রঙে প্রতিফলিত করে, অথচ সূর্য অপরিবর্তিত থাকে।

এই স্তরেই জন্ম নেয় মায়া তত্ত্ব—চেতনার সেই প্রথম পর্দা, যা অদ্বৈত সত্তাকে বহুরূপী অভিজ্ঞতার ভেতর লুকিয়ে ফেলে। শিব এখানে আর সর্বব্যাপী অনন্ত নন; তিনি যেন নিজেকে সংকুচিত করে এক সীমিত দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করছেন। কিন্তু এই সংকোচন কোনো বাস্তব ক্ষতি নয়—এটি সেই স্বেচ্ছাসীমা, যা ছাড়া প্রকাশ অসম্ভব। চেতনা যদি চিরকাল অনন্তই থেকে যায়, তবে ‘জানা’, ‘অভিজ্ঞতা’, ‘লীলা’—সবই অর্থহীন হতো। তাই নিজেরই আনন্দে, নিজেরই স্বাধীনতায়, চেতনা নিজেকে সীমাবদ্ধ করে—এবং এই আত্মসীমাবদ্ধতাই শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্বের সূচনা।

এখানেই পরম “আমি” নিজের সর্বশক্তিময় প্রকৃতিকে আংশিকভাবে আড়াল করে, এবং সেই আড়াল থেকেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের সীমা, সময়, নিয়ম, ও আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। কিন্তু কাশ্মীর শৈব মতে, এই আবরণ আসলে মুক্তিরই প্রস্তুতি—কারণ যে-সীমা স্বেচ্ছায় গৃহীত, তা চিরকালই ভেদযোগ্য। তাই শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্বের মূল রহস্য এই: চেতনা নিজের সীমা সৃষ্টি করে, যাতে একদিন সেই সীমা ভেদ করে নিজের অসীম স্বরূপে ফিরে যেতে পারে।

মায়া তত্ত্ব হলো সেই গূঢ় পরিসর, যেখানে পরম চেতনা—যিনি এতক্ষণ পর্যন্ত নিজেই নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ ও অদ্বিতীয়—প্রথম বার নিজের দীপ্তিকে আংশিকভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেন, যেন নিজের অসীমতার মধ্যে এক পরিমিত সীমানা টানেন। এটি কোনো বাইরের শক্তি নয়, বরং শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)-রই এক রূপ—নিজেকে সীমিত করার, নিজেকে গোপন করার, আবার সেই গোপনতার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করার এক স্বেচ্ছানির্মিত লীলা।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, মায়া হল চেতনার আত্ম-আবরণ (ātma-āvaraṇa)। এটি এমন এক শক্তি, যা চেতনার ঐক্যকে ভঙ্গ না করে, তবুও বহুত্বের আভাস সৃষ্টি করে। এখানেই অদ্বৈত থেকে বহুত্বের সূচনা—এমন এক রহস্যময় রূপান্তর, যেখানে শিব নিজের মধ্যকার অসংখ্য সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপে অভিজ্ঞতা করতে শুরু করেন। স্পন্দ-নির্ণয় বলে, “ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—কিছুই স্পন্দহীন নয়; তাই মায়াও কোনো জড় অন্ধকার নয়, বরং চেতনারই এক গতি, এক সৃজনশীল কম্পন।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৯৩)-এ বলেছেন, “অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌”, অর্থাৎ, অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে। মায়া সেই লীলারই পর্দা—যার আড়ালে চেতনা নিজের প্রতিফলনকে “অন্য” বলে অনুভব করে। কিন্তু এই “অন্য” কোনো বাস্তব ভেদ নয়, কেবল অভিব্যক্তির ভিন্ন রূপ। যেমন একটিই আলো বিভিন্ন বস্তুর উপর পড়ে নানা রঙে প্রতিফলিত হয়, তেমনি মায়ার মাধ্যমে এক চেতনা অসংখ্য রূপে প্রকাশিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে মায়াকে বলা হয়েছে ব্রহ্মের আচ্ছাদনশক্তি, যা একত্বের সত্যকে ঢেকে দেয় ও নাম-রূপের ভেদ সৃষ্টি করে। তবে কাশ্মীর শৈব দৃষ্টিতে এই মায়া কোনো অবিদ্যা নয়; এটি চেতনারই কৌতুকবিলাস (divine play)—নিজেকে অসীম থেকে সীমিত রূপে অভিজ্ঞতা করার আনন্দ। তাই এখানে মায়া মানে ভুল নয়, বরং অভিজ্ঞতার অনন্ত সম্ভাবনা।

মায়া তত্ত্বে চেতনা নিজের ভেতরেই ভেদবোধের বীজ স্থাপন করে। এখান থেকেই জন্ম নেয় পাঁচটি কঞ্চুক (āvaraṇa বা সীমাবন্ধ শক্তি)—কলা, বিদ্যা, রাগ, কাল, নিয়তি—যারা মিলিত হয়ে পরবর্তী তত্ত্বগুলির ভিত্তি গঠন করে। এরা পরম শিবচেতনার অগাধ স্বাধীনতাকে ক্রমশ সংকুচিত করে জীব বা পুরুষের অভিজ্ঞতা-ক্ষেত্র তৈরি করে।

মায়া তাই কোনো অন্ধকার নয়, বরং সেই স্বচ্ছ পর্দা, যার মাধ্যমে শিব নিজেরই আলোকে অসংখ্য প্রতিচ্ছবিতে দেখতে পান। তিনি নিজের অনন্ত ঐক্যকে আড়াল করে বহুরূপে প্রকাশিত হন, এবং সেই বহুরূপের মধ্য দিয়েই আবার নিজের একত্বকে উপভোগ করেন। এইভাবেই মায়া তত্ত্ব শিবচেতনার স্বাতন্ত্র্য, লীলা ও প্রকাশের অপরূপ রহস্য প্রকাশ করে—যেখানে সীমা ও অসীম, আচ্ছাদন ও উদ্‌ভাস—সব এক চেতনারই দুই দিক।

মায়া তত্ত্বের পর চেতনার আত্ম-আবরণ আরও সূক্ষ্ম এবং ঘন হয়ে ওঠে পাঁচটি কঞ্চুক (pañca-kañcuka)—অর্থাৎ পাঁচটি সীমাবদ্ধতার পর্দার মাধ্যমে। এই কঞ্চুকগুলি পরম চেতনার অসীম গুণগুলিকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে ব্যক্তিসত্তার অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। শিবের পরম চৈতন্য, যা সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বতৃপ্ত, কালাতীত ও স্বাধীন, এখন সেই ঐশ্বরিক গুণগুলির ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ সংস্করণ নিয়ে ব্যক্তিতে প্রতিফলিত হয়। উৎপলদেবের ভাষায়, এটি চেতনার “স্বাতন্ত্র্যের স্বেচ্ছাসীমাবদ্ধ রূপ”—যেখানে পরম স্বাধীনতা নিজেই নিজেকে খণ্ডে রূপান্তরিত করে, কিন্তু নিজের মূল চেতনা কখনও হারায় না।

কলা (Kalā): এটি অসীম শক্তির সংকোচন। পরম শিবচেতনা সর্বশক্তিমান—তার ক্রিয়া ও প্রকাশ সীমাহীন; কিন্তু যখন মায়ার প্রভাব পড়ে, তখন সেই অসীম কর্মশক্তি সঙ্কুচিত হয়ে সীমিত কর্তৃত্বে রূপ নেয়। জীবাত্মা তখন অনুভব করে, “আমি সব কিছু করতে পারি না, আমার শক্তি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ।” এটি “সর্বক্রিয়াশক্তি থেকে সীমিত কর্মশক্তি”-তে রূপান্তরের স্তর।

বিদ্যা (Vidyā): এটি সর্বজ্ঞতার সংকোচন। পরম চেতনা সর্বজ্ঞানী—তাঁর কাছে কোনো অজানা কিছু নেই; কিন্তু সীমাবদ্ধ জীব মাত্র আংশিকভাবে জানে, খণ্ডিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। বিদ্যা কঞ্চুকের ফলে অসীম জ্ঞান সীমিত ব্যক্তিগত জ্ঞানরূপে প্রকাশিত হয়। এই সীমাবদ্ধতাই “অবজ্ঞা (অবিদ্যা)”-র জন্ম দেয়, কিন্তু কাশ্মীর শৈব মতে, এটি কোনো অন্ধকার নয়; বরং চেতনার নিজেরই সীমিত অভিজ্ঞতা লাভের ইচ্ছা।