শৈব কালী: একান্ন



সপ্তম ধূমাবতী—তিনি শূন্যতা, নিরাশ্রয়তা ও সময়ের অবশেষ। তিনি সৃষ্টি-চক্রের অন্তিম পর্যায়, যেখানে রূপ বিলীন হয়ে থাকে সম্ভাবনায়। অদ্বৈত মতে এটি নিত্যশূন্য ব্রহ্মচেতনার অভিজ্ঞতা—রূপের অনুপস্থিতিতেও অস্তিত্ব। শৈব মতে এটি তিরোভাব—শক্তির অন্তর্মুখী অবস্থা; মনোবিজ্ঞানে এটি “existential emptiness”—যেখানে মানুষ অর্থের অনুপস্থিতির মধ্যেই গভীর শান্তি খুঁজে পায়।

অষ্টম বগলামুখী—তিনি নিবারণের দেবী, যিনি ক্রিয়া, চিন্তা ও শব্দকে স্তব্ধ করেন। তাঁর শক্তি introspection—মনের অন্তর্গমন। অদ্বৈতে এটি প্রত্যাহার, মনসংযম; শৈব মতে এটি শক্তির নিঃশব্দ অবস্থা, যেখানে স্পন্দ থেমে যায় কিন্তু চেতনা জাগ্রত থাকে; মনোবিজ্ঞানে এটি cognitive stillness—মনোসংযম ও সচেতন স্থিরতা।

নবম মাতঙ্গী—তিনি অন্তর্গত বাক্‌শক্তির প্রতীক, যিনি জ্ঞানের ভাষা প্রকাশ করেন। তিনি সমাজবহির্ভূতা, কারণ জ্ঞান কখনও প্রথার দ্বারা বদ্ধ নয়। অদ্বৈত মতে তিনি মায়ার মধ্যেও ব্রহ্মের প্রকাশ; শৈব মতে তিনি পরাবাকের প্রতিফলন; মনোবিজ্ঞানে তিনি creative unconscious—অচেতনের সৃজনশক্তি, যা ভাষা ও কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

দশম কমলা—তিনি দেবী লক্ষ্মীর রূপে চেতনার পূর্ণতা, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধি। কিন্তু এটি কেবল বাহ্যিক সম্পদের নয়, অন্তরের আনন্দের প্রতীক। অদ্বৈত মতে তিনি ব্রহ্মানন্দ, শৈব মতে তিনি অনুগ্রহ (anugraha)—চেতনার চূড়ান্ত মুক্তি; মনোবিজ্ঞানে তিনি self-actualization—নিজের সমস্ত সম্ভাবনা পূর্ণ করে শান্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা।

এই দশ মহাবিদ্যা তাই কোনো পৃথক দেবীসমষ্টি নয়; এরা চেতনার দশ স্তর, আত্ম-অনুসন্ধানের দশ ধাপ। কালী থেকে কমলা পর্যন্ত এই যাত্রা মানে, অন্ধকার থেকে আলো, বিভাজন থেকে ঐক্য এবং অজ্ঞতা থেকে আত্মজ্ঞানে অগ্রসর হওয়া। অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত—তিন দর্শনের এককেন্দ্রিয় সত্য এখানেই যে, চেতনা এক, সেই চেতনার দশ প্রকাশই দশ মহাবিদ্যা।

অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে ব্রহ্মচেতনার দশ প্রকাশ বলতে বোঝানো যায় সেই দশটি ধাপ বা পর্যায়কে, যার মাধ্যমে নিরাকার, নির্বিশেষ ব্রহ্ম নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা ধীরে ধীরে সগুণ, সচেতন, অভিজ্ঞ জগৎরূপে আত্মপ্রকাশ করে—এবং পুনরায় সেই জগৎ নিজ ব্রহ্মে লীন হয়। এগুলি কোনো ক্রমান্বয়ে হওয়া “সৃষ্টি” নয়, বরং চেতনার নিজস্ব উদ্‌ভাসন (manifestation of Consciousness); যেমন সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থেকেও দশভাবে প্রকাশিত হয়—

১. আলোক (প্রকাশ)—সবকিছুকে দৃশ্যমান করে;

২. তাপ (ক্রিয়া)—জীবনধারণের শক্তি দেয়;

৩. দিবস (সময়)—দিন-রাত্রির চক্রের সূচনা করে;

৪. ছায়া (বিপরীত প্রতিফলন)—আলোর সীমা নির্দেশ করে;

৫. প্রভা (উজ্জ্বলতা)—চেতনার তেজ প্রকাশ করে;

৬. জীবন (প্রাণশক্তি)—সমস্ত জীবের বিকাশে সহায়;

৭. রূপবৈচিত্র্য (রং ও সৌন্দর্য)—জগৎকে নানা রূপে প্রতিফলিত করে;

৮. দিক্‌বিভাজন (দিক ও স্থান নির্ধারণ)—চেতনার প্রসার ও স্থানবোধের প্রতীক;

৯. কালের গতি (চলমানতা)—সৃষ্টি ও বিনাশের ধারাবাহিকতা সূচিত করে;

১০. অন্তর্লীন দীপ্তি (অস্তরাগ বা নিঃশেষ)—যেখানে সব আলো পুনরায় উৎসে লীন হয়।

যেমন সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থেকেও দশভাবে প্রকাশিত হয়—আলোক, তাপ, দিবস, প্রভা, ছায়া, জীবন, রূপবৈচিত্র্য, দিক্‌বিভাজন, কালের গতি ও অন্তর্লীন দীপ্তি—তেমনি ব্রহ্মও চিরনির্বিকার থেকেও নিজের চেতনা-প্রবাহে দশভাবে আত্মপ্রকাশ করে। সূর্যের এই দশ রূপ প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মচেতনার দশ প্রকাশের প্রতীক—যেখানে প্রতিটি সৌররূপ চেতনার একটি নির্দিষ্ট পর্যায় বা গতি বোঝায়।

সূর্যের আলোক হলো স্বরূপ-প্রকাশ—যেখানে ব্রহ্ম নিজেকে চেতনা হিসেবে উপলব্ধি করে: “অহমস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১০-এর অনুরূপ)। সূর্য যেমন নিজের আলোয় সমস্ত কিছু দৃশ্যমান করে, তেমনি ব্রহ্মও নিজের সচেতন জ্যোতিতে বিশ্বকে উদ্‌ভাসিত করে। এটি আত্মার নিজস্ব স্বজ্ঞা, যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের কোনো বিভাজন নেই।

সূর্যের তাপ ইচ্ছা-প্রকাশের প্রতীক—চেতনার সেই প্রথম গতি, যেখানে সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। তাপ যেমন সূর্যের কর্মক্ষমতা, তেমনি ইচ্ছা ব্রহ্মচেতনার লীলা—“লীলারূপেণ ব্রহ্ম জগৎ প্রকাশয়তি”।

দিবস বোঝায় মায়া-প্রকাশ—দিন-রাত্রির আবর্তনের মতোই এখানে চেতনা দ্বৈততার ছায়া ফেলে। মায়া মানে আচ্ছাদন ও প্রকাশের খেলা; আলোর সঙ্গে ছায়া মিলেই জগৎ গঠিত হয়।

প্রভা হলো হিরণ্যগর্ভ-প্রকাশ—যেখানে ব্রহ্ম এক মহাজাগতিক মন বা সমষ্টি-বুদ্ধি রূপে প্রতীয়মান হয়। সূর্যের প্রভা যেমন আলোর বিস্তার, তেমনি হিরণ্যগর্ভ চেতনার মহাবুদ্ধি, যেখানে সূক্ষ্ম জগতের সমস্ত সম্ভাবনা নিহিত।

ছায়া ঈশ্বর-প্রকাশের প্রতীক—কারণ ছায়া আলোর বিপরীত মনে হলেও আলোরই ফল। ঈশ্বরও ব্রহ্মের সেই দিক, যেখানে নিয়ম, কর্ম ও কারণ-ফল সূত্রে বিশ্ব পরিচালিত হয়।

জীবন সূর্যের প্রাণশক্তি, যার সঙ্গে মেলে প্রাণ-প্রকাশ—যেখানে চেতনা জীবনের গতিশক্তি রূপে প্রবাহিত হয়। এই প্রাণই জীব ও প্রকৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে; এটি চেতনার জীবন্ত স্পন্দন।

রূপবৈচিত্র্য প্রতীক মন-প্রকাশের—সূর্যের আলো যখন রঙে বিভক্ত হয়, তখন সৃষ্টি হয় রূপ ও সৌন্দর্যের জগত। মনও সেই আলোর প্রতিফলন—যেখানে ভাব, স্মৃতি ও ইচ্ছার মাধ্যমে চেতনা নানা রঙে আত্মপ্রকাশ করে।

দিক্‌বিভাজন সূর্যের আরেক রূপ, যার প্রতীক ইন্দ্রিয়-প্রকাশ—যেখানে চেতনা নিজেকে বহির্জগতের দিকে প্রসারিত করে। সূর্য দিক নির্ধারণ করে, তেমনি ইন্দ্রিয় আমাদের জ্ঞানের দিক নির্ধারণ করে, বহির্প্রকাশের পথ তৈরি করে।

কালের গতি মেলে স্থূল-প্রকাশে—সূর্যের আবর্তনে যেমন দিন, রাত্রি, ঋতু ও পরিবর্তন ঘটে, তেমনি চেতনার স্থূলপ্রকাশে পঞ্চমহাভূতের সংমিশ্রণে দৃশ্যমান জগৎ গঠিত হয়। এখানে চেতনা সম্পূর্ণভাবে বস্তুজগতে রূপ নেয়।

শেষে আসে অন্তর্লীন দীপ্তি, সূর্যের অস্তরাগের প্রতীক—এটি লয়-প্রকাশ। সূর্য অস্ত গেলেও আলো লুপ্ত হয় না; তেমনি ব্রহ্মচেতনা থেকেও জগৎ বিলীন হয়, কিন্তু চেতনা অক্ষুণ্ণ থাকে। এটি সেই বিশ্রাম, যেখানে সব নাম-রূপ পুনরায় নিরাকার ব্রহ্মে মিশে যায়—“ব্রহ্মই জগৎ, জগৎই ব্রহ্ম।”

এইভাবে সূর্যের দশ রূপ সূক্ষ্মভাবে বোঝায় ব্রহ্মচেতনার দশ প্রকাশ—যেখানে নিরাকার ব্রহ্ম নিজেই প্রকাশিত হয় জ্ঞান, ইচ্ছা, ক্রিয়া, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, রূপ, সময়, দিক, প্রাণ ও বিশ্রাম—এই দশ গতি বা স্পন্দনের মধ্যে। সূর্য যেমন স্থির থেকেও এইসব রূপে বিকীর্ণ, তেমনি ব্রহ্মও চিরনির্বিকার থেকেও অনন্ত জগতরূপে উদ্‌ভাসিত—চেতনার দীপ্তিতে, শক্তির স্পন্দনে, এবং অস্তিত্বের মহা-নৃত্যে।

এই দশ প্রকাশ একসঙ্গে গঠন করে চেতনার পূর্ণচক্র—ব্রহ্ম থেকে বিশ্বে, বিশ্ব থেকে পুনরায় ব্রহ্মে। অদ্বৈত ব্যাখ্যায়, এগুলি কোনো বাস্তব রূপান্তর নয়; বরং ব্রহ্মের মায়াময় উদ্‌ভাস (vivarta)—যেমন সাপ-ভ্রম দণ্ডে দেখা যায়, কিন্তু দণ্ড অপরিবর্তিত থাকে। ব্রহ্ম এখানে সর্বদা নিস্তরঙ্গ, কিন্তু তার চেতনা-প্রভা এই দশরূপে প্রতিফলিত হয়।

কাশ্মীর শৈবের পরাশক্তির দশ স্পন্দনের সঙ্গে এই ব্রহ্মচেতনার দশ প্রকাশ এক গভীর সমান্তরাল বহন করে। শৈবতত্ত্বে যেখানে বলা হয়, “স্পন্দো হি পরমেশ্বরঃ”—চেতনার কম্পনই ঈশ্বর, সেখানে বেদান্ত বলে, “ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা”—অর্থাৎ, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, বাকিটা সেই সত্যের খেলায় প্রতিফলিত ছায়া। দুটি দর্শন মিলেমিশে বোঝায়, চেতনার এই দশ প্রকাশ কোনো বহির্জাগতিক সৃষ্টির বিবরণ নয়, বরং অস্তিত্বের স্বয়ং-স্মরণ—এক অনন্ত চৈতন্যের নিজের প্রতি জাগরণ, যেখানে ব্রহ্ম নিজেই নানারূপে খেলে, আবার নিজের মধ্যেই বিশ্রাম নেয়।

কাশ্মীর শৈবদর্শনে পরাশক্তি হলেন চেতনার স্বয়ং-গতিশীলতা, শিবচেতনার অভ্যন্তরীণ স্পন্দ—যা প্রকাশ ও বিমর্শ এই দুই চির-অভিন্ন ধারা হিসেবে একটিমাত্র চৈতন্যতত্ত্বে অবিরত খেলায় মগ্ন। এই পরাশক্তির আত্মপ্রকাশের দশটি মৌল ধাপ বা কম্পনই পরিচিত পরাশক্তির দশ স্পন্দন নামে, যা চেতনার গভীর স্তর থেকে জাগতিক অভিজ্ঞতার সীমা পর্যন্ত এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা গঠন করে।

শৈব দর্শন অনুযায়ী, সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের এই অবিরাম চক্র একটি গভীর আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া, যা দশটি স্পন্দনের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়। এই স্পন্দনগুলি কেবল বাহ্যিক ক্রিয়া নয়, বরং পরম চেতনার আত্মপ্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়। এই প্রতিটি স্পন্দন শিব ও শক্তির লীলাকে মূর্ত করে তোলে, যেখানে শিব হলেন স্থির চেতনা এবং শক্তি হলেন তাঁর স্পন্দিত প্রকাশ।

১. উন্মেষ (The First Pulsation: Unfoldment): এই প্রথম স্পন্দন হলো চেতনার অভ্যন্তরে প্রথম আত্মপ্রকাশ, যেন নিঃস্তরঙ্গ শিবসত্তার মধ্যে হালকা তরঙ্গের উদয়। পরম শিব যখন নিজের অনন্ত নীরবতা ভেঙে নিজেকে প্রকাশ করতে উদ্যত হন, তখন এই উন্মেষ ঘটে। এটি সেই আদিম "আমি"-বোধ, যা সমস্ত সৃষ্টির মূল ভিত্তি। এই স্তরে, পরম সত্তা তার নিজের স্বরূপকে প্রথমবার অনুভব করে, যেন এক অব্যক্ত ইচ্ছা প্রথম আকার ধারণ করে। এটি সুপ্ত শক্তির জাগরণ, যা সৃষ্টির আদিম বীজ বপন করে। এটি এমন এক মুহূর্ত, যখন সমস্ত সম্ভাবনা প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত থাকে, কিন্তু এখনও কোনো নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেনি। এই স্পন্দন হলো অসীম চেতনার গর্ভ থেকে 'আমি' রূপে প্রথম স্বীয় অস্তিত্বের ঘোষণা। এটি সেই আদিম উৎস, যেখানে থেকে সমস্ত পৃথকীকরণ এবং বহুরূপতা পরে বিকশিত হবে।

২. প্রসার (The Second Pulsation: Expansion): দ্বিতীয় স্পন্দন হলো প্রসারের পর্যায়, যেখানে চেতনা তার নিজের স্বরূপকে বিস্তার দিতে চায়। এটি শক্তির প্রথম গতি, যা কখনো কখনো ইচ্ছাশক্তি বা 'ইচ্ছা-শক্তি' নামে পরিচিত। উন্মেষের মাধ্যমে যে-'আমি'-বোধের জন্ম হয়েছে, সেই 'আমি' এবার নিজেকে প্রসারিত করতে চায়, নিজের সত্তাকে ছড়িয়ে দিতে চায়। এটি যেন একটি ছোটো বিন্দুর মতো চেতনা, যা নিজের সীমানা অতিক্রম করে আরও বৃহৎ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। এই স্পন্দন সৃষ্টির প্রাথমিক ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে, যেখানে অসীম সম্ভাবনার জগত প্রসারিত হতে শুরু করে। এটি কেবল একটি মানসিক ইচ্ছা নয়, বরং মহাজাগতিক স্কেলে একটি স্বতঃস্ফূর্ত গতি, যা ভবিষ্যতের সমস্ত রূপ ও কাঠামোকে ধারণ করে। এই পর্যায়ে শক্তি তার পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৩. নির্মাণ বা সৃষ্টিস্পন্দন (The Third Pulsation: Construction/Creation): এই তৃতীয় স্পন্দন হলো নির্মাণ বা সৃষ্টিস্পন্দন, যেখানে চেতনা নিজের ভেতর থেকে জগৎকে অভিক্ষেপ করে এবং "অন্য" ধারণার সূচনা করে। প্রসারের মাধ্যমে যে-ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হয়েছিল, এখন তা বাস্তব রূপ ধারণ করতে শুরু করে। এই পর্যায়ে, পরম চেতনা তার নিজেরই অংশগুলিকে বাহ্যিক জগতে প্রক্ষেপ করে, যা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব রূপে প্রতীয়মান হয়। এটি কেবলমাত্র একটি বাহ্যিক সৃষ্টি নয়, বরং চেতনার নিজস্ব প্রতিফলন। এখানে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়ের প্রাথমিক বিভেদ তৈরি হয়। "আমি" থেকে "এটি" বা "অন্য" এর ধারণা উদ্ভূত হয়, যা আমাদের দ্বৈত অভিজ্ঞতার ভিত্তি। এই স্পন্দন হলো সেই মুহূর্ত, যখন অসীম শক্তি তার অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনার ভিত্তিতে বাস্তবতার বিভিন্ন স্তরের কাঠামো তৈরি করে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায়, চেতনা নিজেই স্রষ্টা, সৃষ্টি এবং সৃষ্টির উপকরণ হয়ে ওঠে।

৪. স্থিতি বা ধারকতা (The Fourth Pulsation: Sustenance/Containment): চতুর্থ স্পন্দন হলো স্থিতি বা ধারকতা, যেখানে চেতনা নিজ সৃষ্টিকে ধারণ করে, যেমন আয়না নিজের প্রতিবিম্বকে ধরে রাখে। একবার যখন জগৎ সৃষ্টি হয়, তখন তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি স্থায়িত্বের প্রয়োজন হয়। এই স্পন্দন নিশ্চিত করে যে, সৃষ্ট জগৎ বিশৃঙ্খল হয়ে বিলীন না হয়ে যায়, বরং একটি সুসংহত রূপে বজায় থাকে। পরম চেতনা তার সৃষ্ট জগৎকে কেবল তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং তাকে পরম যত্ন সহকারে ধারণ করে রাখে। এই স্থিতিশীলতা মহাবিশ্বের সমস্ত নিয়ম, শৃঙ্খলা এবং ভারসাম্যকে নির্দেশ করে। এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, যেখানে পরম শক্তি তার সৃষ্টিকে ক্রমাগত সমর্থন এবং পুষ্টি জোগায়, যাতে এটি তার সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হতে পারে। এই ধারকতা ছাড়া কোনো সৃষ্টিই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না।