শৈব কালী: একত্রিশ



তাঁর বিখণ্ডিত কেশরাশি, যা মুক্তভাবে ছড়ানো, সময় ও দিকের সব সীমা তা ভেঙে দেয়। এটি “কাল” বা সময়ের প্রতীক—যিনি নিজেই সময়কে ভক্ষণ করেন। কাশ্মীর শৈব মতে, সময় (kāla) কোনো বাহ্যিক রৈখিক প্রক্রিয়া নয়; এটি চেতনার স্পন্দ (spanda), যা সৃষ্টি ও লয়কে একে অপরের ভেতর দ্রবীভূত করে। কালীর মুক্ত কেশ, যা সময়ের সীমানা ভেঙে চেতনার অকালত্ব প্রকাশ করে।

তাঁর তৃতীয় নেত্র দ্বারা সর্বজ্ঞ চেতনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। এই তৃতীয় নেত্র শুধু ত্রিকালদর্শীই নয়, বরং এটি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের এক অখণ্ড ঐক্যবিন্দু। এর মাধ্যমে কালী মহাবিশ্বের সমস্ত জ্ঞান এবং সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে একীভূত করেন, যা তাঁর দিব্যজ্ঞানের গভীরতা ও ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে।

তাঁর দীর্ঘ প্রসারিত জিহ্বা একাধিক গভীর অর্থ বহন করে। তন্ত্রশাস্ত্রে, এই জিহ্বা আত্মবোধে লজ্জার চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়, যা আধ্যাত্মিক যাত্রায় অহংকারের পতন এবং বিনয়ের প্রকাশকে বোঝায়। আবার, এটি আগ্নেয় শক্তিরও প্রতীক, যা অহংকার, মায়া এবং জাগতিক বন্ধনসমূহকে দহন করে পরিশুদ্ধি দান করে। এই শক্তি জীবের অজ্ঞানতা দূর করে তাকে পরম সত্যের দিকে পরিচালিত করে।

অদ্বৈত দর্শনে, কালীর এই জিহ্বা চৈতন্যের আত্মস্মরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়—যে-মুহূর্তে "আমি" বা স্বতন্ত্র সত্তা উপলব্ধি করে যে, "আমি"-ই সর্বব্যাপী ব্রহ্ম। এই উপলব্ধি জীবের সঙ্গে ব্রহ্মের অভেদত্বকে তুলে ধরে, যেখানে ক্ষুদ্র সত্তা মহাবিশ্বের বিশালতার সঙ্গে মিশে যায়, এবং দ্বৈততার সকল বিভেদ বিলীন হয়ে যায়। এটি পরম জ্ঞানের এক চূড়ান্ত অবস্থা, যেখানে আত্ম-উপলব্ধিই পরমাত্মার সঙ্গে একাত্মতার পথ খুলে দেয়।

তাঁর হাতে-ধরা খড়্গ ও ছিন্নমুণ্ড অদ্বৈত চেতনার সবচেয়ে গূঢ় রূপক হিসেবে বিবেচিত হয়, যা গভীর দার্শনিক তাৎপর্য বহন করে। খড়্গ জ্ঞানের প্রতীক—সেই প্রখর, তীক্ষ্ণ এবং অবিচল জ্ঞান, যা অজ্ঞানের গাঢ় অন্ধকার, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সংস্কারের বহুস্তরীয় জাল এবং অহংকারের সমস্ত বন্ধনকে ছিন্ন করে। এই জ্ঞান কেবল তথ্যসংগ্রহ নয়, বরং আত্মোপলব্ধির একটি প্রক্রিয়া, যা ভেতরের ও বাইরের সব মিথ্যা আবরণকে ভেদ করে।

অন্যদিকে, ছিন্নমুণ্ড সেই অহংকারের চূড়ান্ত পরিণতি—একটি প্রতীকী বিনাশ, যা আত্মপরিচয়ের মিথ্যা কেন্দ্রকে ভেঙে ফেলে। এটি সেই মুহূর্তকে নির্দেশ করে, যখন সীমিত "আমি"-চেতনা, যা ব্যক্তি সত্তার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ, তা বিলীন হয়ে যায় অসীম, সর্বব্যাপী চৈতন্যে। এই বিলুপ্তি ভয় বা ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয় না, বরং এটি একটি মুক্তির অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারানো ছাড়াই মহাবিশ্বের সাথে একাত্মতা অনুভব করে। এই রূপকটির মাধ্যমে কালী শেখান যে, সত্যিকারের মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন আমরা আমাদের অহংকে বিসর্জন দিতে পারি এবং বৃহত্তর সত্তার অংশ হিসেবে নিজেদের উপলব্ধি করতে পারি।

অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা—এই দুটি মুদ্রা ভারতীয় দর্শন, তন্ত্র ও প্রতীকমূলক সাধনার গভীরে এক অদ্বৈত সত্যকে প্রকাশ করে। এগুলি দেবমূর্তির হাতের অলঙ্করণমাত্র নয়, বরং চেতনার দুটি মৌলিক অবস্থার প্রতিফলন—অভয়মুদ্রা হলো নির্ভয়তা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক, আর বরমুদ্রা হলো অনুগ্রহ, করুণা ও দানশক্তির প্রতীক। একটিতে আত্মা নিজের মধ্যে স্থিত হয়, অন্যটিতে সেই আত্মা নিজের দীপ্তি জগতে প্রসারিত করে।

অভয়মুদ্রার অর্থ “ভয়হীনতার আশ্বাস।” এখানে দেবতার ডান হাত বুকের সমান্তরে ঊর্ধ্বমুখী, তালু সামনের দিকে খোলা—যেন বলছেন, “ভয় করো না।” এই ভয়হীনতা কোনো বাহ্যিক সাহস নয়, বরং চেতনার নিখাদ আত্মপ্রত্যয়। অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়েছে—“দ্বিতীয়াদ্বৈভয়ং ভবতি”—দ্বিতীয়ের উপস্থিতিতেই ভয়ের জন্ম হয় (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.২)। অর্থাৎ, যতক্ষণ আমি ও তুমি, কর্তা ও কর্ম, সত্তা ও বস্তু—এই দ্বৈত বিভাজন বিদ্যমান, ততক্ষণ ভয় থাকবে। কিন্তু যখন চেতনা উপলব্ধি করে যে, এই সমগ্রই তারই প্রকাশ, তখন অন্য কিছু অবশিষ্ট থাকে না—ভয়ও নয়, বিপদও নয়। অভয়মুদ্রা সেই অবস্থার প্রতীক, যেখানে আত্মা বলে ওঠে, “আমি শিব”—আমি সেই চেতনা, যার বাইরে কিছুই নেই।

কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে অভিনবগুপ্ত অভয়মুদ্রাকে বলেছেন “চেতনার স্থিতপ্রজ্ঞা”—এক এমন অবস্থান, যেখানে যোগী সমস্ত কাল, দিক ও সীমাকে অতিক্রম করেছেন (তন্ত্রালোক, ৫.৪৮)। দেবীর ঊর্ধ্বতালু মানে চেতনার উন্মুক্ততা; তিনি সব দিকে সমভাবে প্রসারিত, কোনো দিকেই ভয়-উৎপত্তির কোনো আশংকা নেই। তাই অভয়মুদ্রা প্রতীক চেতনার সেই স্বরূপের, যা আচ্ছাদনের মধ্যেও আলোকিত থাকে, সীমার মধ্যেও অনন্ত।

বরমুদ্রার অর্থ “বরদান”—অর্থাৎ দান, করুণা, অনুগ্রহ। এতে দেবতার বাম হাত নিচের দিকে, তালু সামনের দিকে, যেন আশীর্বাদ দিচ্ছেন, কিছু দিচ্ছেন। এটি চেতনার প্রসারিত দিক—যেখানে আত্মা নিজের পূর্ণতা থেকে অন্যকে আশ্বস্ত করছে, নিজের দীপ্তি অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছে। অদ্বৈত বেদান্তে যেমন জ্ঞানী নিজের আনন্দে স্থিত থেকে অন্যের মঙ্গল কামনা করেন, তেমনি কাশ্মীর শৈব মতে, শিবচেতনা নিজের লীলায় এই বর প্রদান করেন—এটাই “অনুগ্রহ” (anugraha)—পঞ্চকৃত্যের পঞ্চম ধাপ (তন্ত্রালোক, ১.৮৭)।

বরমুদ্রা তাই শিবচেতনার করুণাশক্তির দৃশ্যরূপ—অসীম চেতনা যখন নিজেই সীমিত জীবের মধ্যে করুণা হয়ে প্রবাহিত হয়। উত্পলদেবের ভাষায়, চেতনা নিজের স্বাধীনতায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে (ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা কারিকা, ১.৫.৮), কিন্তু সেই দ্বৈততার মধ্যে আবার নিজেকে চিনে ফেলার জন্য অনুগ্রহ করেই জগৎ সৃষ্টি করে। বরমুদ্রা সেই আত্মপ্রকাশিত করুণার প্রতীক, যেখানে শিব নিজেরই আলো দিয়ে সীমিত সত্তাগুলিকে আলোকিত করেন।

এই দুটি মুদ্রা একত্রে দেখা যায় বহু দেবতার মূর্তিতে—বিশেষত শিব, কালী, দুর্গা, বিষ্ণু, এমনকি বুদ্ধের মূর্তিতেও। এক হাতে অভয়—“ভয় কোরো না”; অন্য হাতে বর—“আমি দিচ্ছি আশীর্বাদ, জ্ঞান, মুক্তি।” তারা একে অপরের বিপরীত নয়, বরং একই চেতনার দুই দিক—অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী। অভয়মুদ্রা চেতনার স্থিতি—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্ভীক; বরমুদ্রা চেতনার প্রসারণ—যেখানে সেই নির্ভীক চেতনা নিজের দীপ্তি জগতে বিলিয়ে দেয়।

এইভাবে অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা আসলে শৈব তত্ত্বের দুই ধ্রুব—“প্রতিসংহৃতি” ও “অনুগ্রহ।” অভয়মুদ্রা প্রতিসংহৃত চেতনার প্রতীক—যেখানে সব কিছু নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফিরে আসে; বরমুদ্রা অনুগ্রহশক্তির প্রতীক—যেখানে সেই একই চেতনা আবার জগতে প্রকাশিত হয়। একটিতে চেতনা বলে—“তুমি নিজেকে চেনো, ভয় নেই”; অন্যটিতে বলে—“যখন নিজেকে চিনবে, তখন সেই দীপ্তি অন্যদের বিলিয়ে দাও।”

তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ শিবের পঞ্চকৃত্যের মধ্যে যেমন এই দুটি ক্রিয়া একে অপরের পরিপূরক—সংহার ও অনুগ্রহ—তেমনি অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রাও তেমনই। প্রথমটি আত্ম-নিশ্চয়তার, দ্বিতীয়টি আত্ম-প্রকাশের প্রতীক। একটিতে মুক্তি, অন্যটিতে করুণা।

অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা মিলিয়ে যে-প্রতীক গঠিত হয়, তা হলো চেতনার সম্পূর্ণ গতিবিদ্যা—ভয়মুক্ত স্বরূপ ও সীমাহীন অনুগ্রহ। অভয়মুদ্রা বলে—“আমি পূর্ণ”; বরমুদ্রা বলে—“এই পূর্ণতা সবার।” দুটো মিলে গঠিত হয় অদ্বৈত তত্ত্বের এক দৃশ্যমান ভাষা—যেখানে অন্তর ও বহির, স্ব ও পর, কর্তা ও কর্ম—সব এক হয়ে যায় সেই এক চেতনার নিত্য লীলায়।

কালীর অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা কেবল আশ্রয় ও করুণার প্রতীক নয়; এগুলি আরও গভীরে গিয়ে মুক্তির প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দেয়। অভয়মুদ্রা ভীতি থেকে মুক্তি দেয়, আর বরমুদ্রা আশীর্বাদ ও বরদানের মাধ্যমে জীবনের সমস্ত বাধা থেকে উত্তরণের পথ খুলে দেয়। এই মুদ্রাগুলি সেই চরম আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, যেখানে একজন ব্যক্তি ভয়, মৃত্যু বা ধ্বংসের মতো মৌলিক অস্তিত্বের সংকট থেকেও ভীত হয় না। কারণ, যে সত্যের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে, সে জানে, জন্ম ও মৃত্যুর চক্র কেবল একটি বিভ্রম, এবং আত্মসত্তা অমর ও অবিনশ্বর। এই নির্ভীকতাই সত্যকে ধারণ করার এবং উপলব্ধি করার প্রকৃত যোগ্যতা।

আধুনিক মনোবিজ্ঞানে এই অবস্থাকে "আত্মবোধের ট্রান্সপার্সোনাল স্তর" হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এটি এমন একটি পর্যায়, যেখানে ব্যক্তি-মন (ego-self), যা দৈনন্দিন জীবনের উদ্‌বেগ, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিচিতির সাথে জড়িত, সেই সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বজনীন চেতনায় (unitive consciousness) প্রবেশ করে। এই চেতনার স্তর ব্যক্তি সত্তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বিশ্বজনীন একাত্মতার অনুভূতি প্রদান করে।

কার্ল ইয়ুং, একজন প্রভাবশালী সুইস মনোবিজ্ঞানী, এই অবস্থাকে তাঁর "individuation" প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইয়ুঙের মতে, ইন্ডিভিজুয়েশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি তার অচেতন এবং সচেতন মনের উপাদানগুলোকে একত্রিত করে একটি সামগ্রিক, সুসংহত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মা নিজের পূর্ণত্ব উপলব্ধি করে এবং "Self"-এ প্রতিষ্ঠিত হয়। "Self" এখানে কেবল ব্যক্তিসত্তা নয়, বরং আত্মার কেন্দ্রবিন্দু এবং সামগ্রিকতার প্রতীক, যা ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত অচেতন মনের সব উপাদানকে ধারণ করে। কালীর ছিন্নমুণ্ড ও খড়্গ এই রূপান্তরেরই প্রতীক, যা আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে আত্মোপলব্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়।

কালীর মুণ্ডমালা, যেখানে ৫১টি ছিন্নমুণ্ড, তা সংস্কৃত বর্ণমালার প্রতীক—১৩টি স্বর (অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৠ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ), এর সাথে অনুস্বার (ং) এবং বিসর্গ (ঃ)-কে পৃথক স্বরবর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ৩৩টি প্রচলিত ব্যঞ্জনবর্ণ (স্পর্শবর্ণ ২৫টি, অন্তঃস্থ ৪টি, উষ্মবর্ণ ৪টি), এর সাথে অতিরিক্ত ২টি বৈদিক বর্ণ বা কিছু ক্ষেত্রে ক্ষ (যদিও এটি যুক্তাক্ষর)-এর মতো বর্ণকে গণনা করা হয় (১৩+২+৩৩+২+১)—অর্থাৎ শব্দব্রহ্ম (śabda-brahman)-এর পূর্ণতা। এটি নির্দেশ করে যে, তিনি বাকশক্তির (vāk-śakti) পূর্ণ প্রকাশ—সৃষ্টি ও শব্দের একত্ব।

“শব্দব্রহ্ম” (śabda-brahman) শব্দযুগলটি ভারতীয় দর্শনে এক গভীর তত্ত্ব নির্দেশ করে, বিশেষত বেদান্ত, মীমাংসা ও তন্ত্র ঐতিহ্যে। এর আক্ষরিক অর্থ—“শব্দই ব্রহ্ম,” অর্থাৎ শব্দ বা ধ্বনি-রূপেই পরম চেতনার প্রকাশ।

ব্রহ্ম, যিনি অদ্বৈত, নিরাকার ও নির্বিশেষ, সেই চেতনা যখন প্রকাশিত বা উপলব্ধ হয়, তখন তাঁর প্রথম প্রকাশ শব্দ-রূপে হয়। তাই শব্দব্রহ্ম মানে সেই চেতনা-ব্রহ্ম, যিনি “নাদ” বা “বাক্‌” রূপে প্রকাশিত।

উপনিষদে বলা হয়েছে—“আদৌ হি শব্দঃ সর্ববিজ্ঞানানামাধারঃ” (শৈবাগম ও তন্ত্র উদ্ধৃতি অনুযায়ী)। মাণ্ডূক্য উপনিষদ (১-২)-এ বলা হয়েছে—“ওম্‌কারই ব্রহ্ম”, অর্থাৎ ওম্‌-শব্দ সেই চেতনার, প্রতীক যা সমস্ত জগৎকে ধারণ করে। তাই ওম্‌কার (ওঁ) বা প্রণবকেও শব্দব্রহ্ম বলা হয়।

মীমাংসা দর্শনে শব্দব্রহ্ম মানে বেদের চিরন্তন ধ্বনি-রূপ চেতনা—যা সৃষ্টি-কালেও নাশ হয় না, মানুষের মুখে উচ্চারণ মাত্র তার প্রকাশ ঘটে। বেদ এখানে কেবল গ্রন্থ নয়, বরং অনাদি “শব্দব্রহ্ম”—যা ঈশ্বরেরও পূর্বতন।

“শব্দব্রহ্ম ঈশ্বরেরও পূর্বতন”—এই উক্তি প্রথমে আপাতবিরোধী মনে হলেও, দর্শনগত দৃষ্টিতে এর অর্থ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর। এটি মূলত মীমাংসা ও বৈদিক দর্শনের একটি তত্ত্ব, যেখানে “পূর্বতন” মানে কালগত (time-based) নয়, বরং তত্ত্বগত বা অন্তঃসত্তাগত (ontological) অগ্রগণ্যতা। অর্থাৎ, এখানে বলা হচ্ছে না যে, শব্দব্রহ্ম সময়ের বিবেচনায় ঈশ্বরের আগে ছিল; বলা হচ্ছে যে, ঈশ্বর, সৃষ্টি ও সমস্ত জ্ঞানপ্রবাহ—সব কিছুই “শব্দব্রহ্ম” নামক মূল চেতনা-ধ্বনির উপর নির্ভর করে প্রকাশিত হয়।

মীমাংসা দর্শনে ঈশ্বরকে কোনো “সৃষ্টিকর্তা” হিসেবে ধরা হয় না। তাদের মতে, বেদ বা শব্দ নিজেই অনাদি ও স্বয়ম্ভূ। বেদ কেবল মানুষের লেখা নয়, বরং চিরন্তন চেতনার ধ্বনি—শব্দব্রহ্ম। এই বেদ বা শব্দব্রহ্ম কোনো ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়, কারণ এটি চেতনারই ধ্বনি-রূপ প্রকাশ। তাই ঈশ্বর যদি সৃষ্টিকর্তা হন, তবে বেদ তাঁর সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু যেহেতু বেদ বা শব্দব্রহ্ম অনাদি, তাই সে কারও দ্বারা সৃষ্ট নয়—সে নিজেই অনন্ত চেতনার কম্পন। সেই কারণেই বলা হয়, শব্দব্রহ্ম ঈশ্বরেরও পূর্বতন।