শৈব কালী: একচল্লিশ



কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই আকাশবসন রূপ শিবের “বিমল স্বাতন্ত্র্য” বা Svatantrya-tattva-র প্রতীক। শিবচেতনা স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। অভিনবগুপ্ত এই স্বাতন্ত্র্যকে “চিদানন্দস্পন্দ” বলেছেন—চেতনার সেই স্বাধীন কম্পন, যা নিজের আনন্দে সৃষ্টি হয়, আবার নিজের আনন্দেই লয় পায়। কালী সেই স্বাধীন চেতনার গতিশক্তি, যিনি কোনো নিয়মে, কোনো সীমায়, কোনো বন্ধনে আবদ্ধ নন। আকাশবসন মানে, তিনি “অদ্বৈতচেতনা”—যিনি সব দিকেই এক, কিন্তু কোনো দিকেই সীমাবদ্ধ নন।

শাক্ত দর্শনে, “আকাশ” হলো মহাশক্তির প্রাথমিক ক্ষেত্র—Vyoma-tattva, যেখানে সমস্ত সৃষ্টি জন্ম নেয়। কালীকে বলা হয় “দিগম্বরী”—অর্থাৎ যিনি দিকসমূহকে বস্ত্ররূপে ধারণ করেছেন। এখানে “দিক” মানে মহাশক্তির নিজস্ব দিকনির্দেশ, অস্তিত্বের বিস্তার। তাঁর আকাশবসন বোঝায় যে, তিনি মায়ার আবরণে ঢাকা নন, বরং মায়ারও উৎস। তিনি সেই শূন্য ক্ষেত্র, যেখানে সৃষ্টি সম্ভব, কিন্তু তিনি নিজে কখনও সৃষ্টির দ্বারা সীমাবদ্ধ হন না।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে, আকাশবসন রূপ মানে মনের সেই অবস্থান, যেখানে মানুষ নিজেকে সমস্ত সামাজিক, নৈতিক ও ব্যক্তিগত আবরণের ওপারে চিনতে শেখে। এটি “Pure Being” বা “Unconditioned Awareness”-এর প্রতীক—যেখানে মানুষ আর কোনো পরিচয়ে বাঁধা থাকে না। এই রূপে কালী শেখান, মুক্তি মানে দমন নয়, বরং আচ্ছাদনের বিলোপ; সত্যকে জানতে হলে প্রথমে সমস্ত ছদ্মবেশ, বিশ্বাস, ধারণা ও ভয়ের পোশাক খুলে ফেলতে হয়।

কালীর আকাশবসন রূপ আসলে ব্রহ্মচেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ। এটি সেই স্তর, যেখানে আকাশ আর দেহ, দিক আর দৃষ্টি, অন্তর আর বাহির—সব মিলে যায় এক অসীম পরিসরে। কালী নগ্ন, কারণ সত্য নগ্ন; তিনি দিগম্বরী, কারণ চেতনা আকাশের মতোই সর্বত্র, অথচ অস্পর্শিত। এই অবস্থাই পরম মুক্তি—যেখানে চেতনা নিরাবরণ, নির্ভয়, সীমাহীন এবং সমস্ত কিছুতে অব্যক্তভাবে বিরাজমান।

কালীর দেহে বাঘচর্ম বা হাতিচর্মের আবরণ এক গভীর প্রতীক, যা তাঁর শক্তি, আত্মসংযম ও প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির উপর জয়ের প্রকাশ। বাহ্যত এই পশুচর্ম তাঁকে ভয়ংকর রূপে প্রকাশ করে, কিন্তু দার্শনিক দৃষ্টিতে এটি কেবল অলঙ্কার নয়—এটি মানুষের অন্তর্গত প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ, প্রবৃত্তির রূপান্তর এবং চেতনার শক্তিশালী শাসনের প্রতীক।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই পশুচর্ম মানে সেই দেহ-প্রবৃত্তি বা প্রকৃতি (Prakṛti), যা আত্মাকে আবৃত করে রাখে। দেহ, ইন্দ্রিয়, কামনা ও ভোগ—এই সবই প্রকৃতির চঞ্চল গুণ, যা আত্মাকে সীমাবদ্ধ করে। কালী সেই সীমাবদ্ধ প্রকৃতির উপর দাঁড়িয়ে আছেন—তাই তাঁর পশুচর্ম দেহের নিচে নয়, দেহের উপরে। তিনি দেহকে ধ্বংস করেন না, বরং তাকে অতিক্রম করেন; তিনি প্রবৃত্তিকে দমন নয়, রূপান্তর করেন। শঙ্করাচার্যের ভাষায়, “প্রকৃতির উপর আত্মার অধিকার”—এই অধিকারই মুক্তি। তাঁর বাঘচর্ম তাই আত্মসংযমের প্রতীক, যা কামনা ও ভয়ের দুই চরম সীমাকে জয় করে স্থির চেতনার দিকে নিয়ে যায়।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায়, পশুচর্ম মানে চেতনার স্পন্দ-শক্তি, যা প্রাথমিকভাবে প্রকৃতির আকারে প্রকাশিত হয়। বাঘ বা হাতি—এই দুই প্রাণীই প্রকৃতির শক্তি ও প্রাচুর্যের প্রতীক। বাঘের গর্জন মানে তেজ, হাতির দৃঢ়তা মানে স্থিতি। কালী এই দুই শক্তিকেই নিজের শরীরের আবরণ করেছেন, কারণ তিনিই প্রকৃতির প্রাণশক্তি। কিন্তু তাঁর দ্বারা এই প্রবৃত্তিগুলি সীমিত থাকে না; বরং তিনি সেই শক্তিগুলিকে নিজের চেতনায় লীন করে রূপান্তরিত করেন। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেন Śaktipāta—যেখানে প্রাকৃতিক শক্তি আত্মসচেতন শক্তিতে উত্তীর্ণ হয়।

কাশ্মীর শৈবদর্শনে ‘শক্তিপাত’ (Śaktipāta) শব্দটি এমন এক দার্শনিক পরিভাষা, যা শিবচেতনার সর্বোচ্চ করুণার প্রতীক। আক্ষরিকভাবে ‘শক্তি’ মানে দিব্য চেতনার স্পন্দন, আর ‘পাত’ মানে পতন বা অবতরণ। কিন্তু এটি কোনো ভৌত পতন বা নিচের দিকে পড়ে যাওয়া নয়—বরং অসীম চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত অবতারণা, যেখানে শিব তাঁর নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (স্বাতন্ত্র্য) দ্বারা নিজের চৈতন্যশক্তিকে জীবের অন্তঃকরণে জাগিয়ে তোলেন। শক্তিপাত তাই আসলে “ঐশ্বরিক অনুগ্রহের স্বতঃপ্রকাশ”—চেতনার নিজেরই নিজের উপর করুণা।

কাশ্মীর শৈবদর্শন অনুসারে, শিব বা পরমচৈতন্য সর্বব্যাপী, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন। তিনি কোনো বাহ্যশক্তির অধীন নন; বরং তাঁর নিজেরই চেতনা শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়—এবং সেই প্রকাশেরই একটি রূপ শক্তিপাত। এখানে শিষ্যের কোনো বিশেষ কৃতিত্ব বা সাধনাই এই শক্তিপাতের কারণ নয়; এটি সম্পূর্ণভাবে শিবের অনুগ্রহ। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১৩.২৯৩-২৯৯)-এ বলেছেন—“শক্তিপাতঃ শিবস্য অনুগ্রহঃ”—অর্থাৎ, শক্তিপাত হল শিবের করুণারই প্রতিফলন। যখন এই অনুগ্রহ ঘটে, তখন শিষ্যের অন্তরে থাকা তিনটি প্রধান আবরণ—অজ্ঞান বা আণবমল, কর্মমল এবং মায়ামল—ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। গুরুর দৃষ্টি, শব্দ, স্পর্শ বা কেবল তাঁর ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমেও এই শক্তিপাত ঘটতে পারে; আবার কখনো সরাসরি পরম শিবের ইচ্ছায়, কোনো বাহ্য মধ্যস্থতা ছাড়াই ঘটে।

এই শক্তিপাতের তীব্রতা অনুযায়ী তার বিভিন্ন স্তর নির্ধারিত হয়েছে। শক্তিপাত যত তীব্র, মুক্তি তত দ্রুত। কাশ্মীর শৈব মতে, শক্তিপাতের ষড়্ভেদ (ছয়টি স্তর) আছে—

১. তীব্রতম তীব্র শক্তিপাত—যাতে শিষ্য তৎক্ষণাৎ মোক্ষলাভ করে।

২. তীব্র তীব্র শক্তিপাত—যাতে গুরুর সামান্য সহায়তায় মুক্তি ঘটে।

৩. মধ্য তীব্র শক্তিপাত—যাতে দীর্ঘ সাধনা প্রয়োজন।

৪. মৃদু তীব্র শক্তিপাত—যাতে বারবার গুরুর কৃপা লাগে।

৫. মধ্য মৃদু শক্তিপাত—যাতে জীব বহু জন্মে প্রস্তুত হয়।

৬. মৃদুমৃদু শক্তিপাত—যাতে শক্তি জাগ্রত হলেও ফল অনেক পরে আসে।

এই স্তরবিভাগ আসলে চেতনার আবরণভেদের ইঙ্গিত দেয়। শিব সকলের অন্তরে সমানভাবে উপস্থিত, কিন্তু জীবের গ্রহণক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সূর্য সবার উপর সমান আলো ফেললেও কুয়াশা বা মেঘের ঘনত্ব অনুযায়ী আলোর প্রতিফলন ভিন্ন হয়—তেমনি শক্তিপাতও জীবের অন্তর-স্বচ্ছতার ওপর নির্ভর করে।

অদ্বৈত বেদান্তে “শক্তিপাত” (śaktipāta) কোনো বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ নয়; এটি অন্তর্নিহিত ব্রহ্মচেতনারই হঠাৎ আত্ম-উন্মোচন। মানুষ যখন তত্ত্বচিন্তা, তপস্যা, ধ্যান ইত্যাদির দ্বারা নিজের মনকে প্রস্তুত করে, তখন একমুহূর্তে সেই অন্তঃস্থ আত্মা—যে সর্বদা সেখানে উপস্থিত ছিল—নিজ পর্দা সরিয়ে নিজের পরিচয় দেয়। তাই বলা হয়, শক্তিপাত আসলে কোনো transfer of power নয়, বরং remembrance of Being—অর্থাৎ, “আমি চেতনা”—এই মৌলিক সত্যের হঠাৎ প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।

এই প্রক্রিয়াটিই উপনিষদের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে—“নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন। যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্‌।” (কঠোপনিষদ ২.২৩, মুণ্ডক উপনিষদ ৩.২.৩)। এর অর্থ—“এই আত্মা কোনো বক্তৃতা, তর্ক বা অধ্যয়নের দ্বারা লাভ হয় না; যাঁকে আত্মা নিজে গ্রহণ করেন, কেবল তিনিই তাঁকে লাভ করতে পারেন; আত্মা নিজেই তাঁর কাছে নিজের রূপ প্রকাশ করে।” এখানে আত্মার “বিবৃণুতে তনূং স্বাম্‌”—এই বাক্যাংশের মধ্যে নিহিত আছে শক্তিপাতের চূড়ান্ত তত্ত্ব। আত্মা কখনও বাইরের প্রভাবে প্রকাশিত হয় না; বরং নিজে, নিজেরই অনুগ্রহে, নিজেরই পর্দা সরিয়ে দেয়।

অদ্বৈতের ভাষায়, এটি ঈশ্বরকৃপা বা আত্মকৃপা—যেখানে জ্ঞানের উদয় কোনো “কারণ” দ্বারা ঘটে না, বরং নিজস্ব প্রস্তুতি বা পরিপক্বতার মুহূর্তে সত্য নিজেই উন্মোচিত হয়। যেমন সূর্যকে দেখার জন্য বাতি জ্বালাতে হয় না—শুধু মেঘ সরলেই আলো প্রকাশিত হয়—তেমনি শক্তিপাত মানে সেই মেঘের অপসারণ, চেতনার নিজেরই পর্দা তোলা।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই শক্তিপাত ধারণাটি আরও স্পন্দমান ও জীবন্ত রূপে ব্যাখ্যাত। সেখানে বলা হয়, শক্তিপাত হল শিবচেতনার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যশক্তির (svātantrya-śakti) আকস্মিক অবগাহন—যেখানে ব্যক্তি বা jīva অনুভব করে, তার চেতনা ও সর্বচেতনা এক। অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ বলেন, “শক্তিপাতঃ শিবস্য স্বেচ্ছা”—অর্থাৎ, শক্তিপাত শিবচেতনার নিজের ইচ্ছা। কিন্তু এই “ইচ্ছা” কোনো বাহ্য প্রভাব নয়; এটি চেতনার নিজস্ব আত্মবিমর্শন, যেখানে শিব নিজেকে জীবরূপে চিনে এবং পুনরায় নিজের ঐক্য উপলব্ধি করে।

তাই শক্তিপাত হলো সেই পরম করুণা, যা বেদান্তে ঈশ্বরকৃপা, আর শৈব দর্শনে স্বতঃপ্রকাশিত চিত্‌শক্তি। একে “অনুগ্রহ” বলা হলেও, এটি কোনো দেবতার অনুগ্রহ নয়—এটি আত্মার নিজেরই প্রতি করুণা, নিজেরই অন্তর্লীন স্বরূপে ফিরে আসার আহ্বান।

অদ্বৈত ও শৈব উভয় ধারাতেই শক্তিপাত একটিই ঘটনা—চেতনার নিজের প্রতি জাগরণ। যখন মায়া ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, যখন অহং শান্ত হয়, তখন সেই চেতনা নিজেকে চিনে বলে ওঠে—“অহম্‌ ব্রহ্মাস্মি”—“আমি চেতনা, আমি সেই।” এই জাগরণই শক্তিপাত—না কোনো প্রভাব, না কোনো সংক্রমণ, বরং এক আত্ম-উন্মোচনের দীপ্ত মুহূর্ত, যেখানে মানুষ হঠাৎ উপলব্ধি করে—সে কখনোই অন্ধকারে ছিল না, কেবল চোখ (পরমজ্ঞান গ্রহণ করার দৃষ্টি) বন্ধ রেখেছিল।

শক্তিপাত তাই আসলে চেতনার নিজেরই জাগরণ। গুরুর ভূমিকা এখানে সূর্যের মতো—তিনি আলো দেন না, কেবল মেঘ সরিয়ে দেন। আলো তো জীবের মধ্যেই ছিল, নিভে যায়নি কখনও। যখন সেই পর্দা সরে যায়, তখন শিষ্য উপলব্ধি করে—শক্তি কখনও বাইরে থেকে অবতীর্ণ হয়নি; সে চিরকালই অন্তরে কম্পমান ছিল, অপেক্ষা করছিল কেবল সেই মুহূর্তের জন্য, যখন শিব নিজের উপর করুণা বর্ষণ করবেন, আর জীব বুঝবে—“আমি-ই সেই শিব।”

শাক্ত দর্শনে বাঘচর্ম বোঝায় “ইন্দ্রিয় ও কামনার জয়”। বাঘ কামনা, লালসা ও হিংস্রতার প্রতীক; কালী সেই কামনাশক্তির উপর অবস্থান করেন, অর্থাৎ তিনি কামনাকে নিঃশেষ করেন না, বরং তাকে দেবশক্তিতে রূপান্তরিত করেন। তাই তন্ত্রশাস্ত্রে কালীকে বলা হয় Kāma-rūpiṇī—যিনি কামনাকে ব্রহ্মস্বরূপে উত্তীর্ণ করেন। তাঁর পশুচর্ম পরিধান সেই রূপান্তরের প্রতীক—যেখানে জীব তার পশুপ্রবৃত্তিকে আত্মপ্রবৃত্তিতে উন্নীত করে।

মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে, পশুচর্ম মানে মনের সেই অচেতন, প্রবৃত্তিমূলক স্তর, যেখানে রাগ, ভয়, কাম, হিংসা ইত্যাদি জন্ম নেয়। কালী সেই প্রবৃত্তিমূলক স্তরে নেমে যান, কিন্তু তাতে হারিয়ে যান না—তিনি তা পরিশুদ্ধ করেন। এটি “Instinct Integration”-এর প্রতীক—যেখানে মানুষ নিজের অন্ধ প্রবৃত্তিকে দমন না করে, সচেতনতার আলোয় রূপান্তরিত করে। তাঁর শরীরে পশুচর্ম মানে, তিনি অবচেতনের শক্তিকে নিজের সত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন—এবং তা তাঁর শক্তির উৎস হয়ে উঠেছে।

কালীর পশুচর্ম কেবল ভয়ঙ্কর দৃশ্য নয়, এটি গভীর আধ্যাত্মিক নির্দেশ। এটি শেখায় যে, সত্যিকারের সংযম মানে দমন নয়, বরং রূপান্তর—যেখানে প্রকৃতির গর্জন চেতনার গানে মিলিত হয়। বাঘচর্ম-পরিহিতা কালী তাই প্রতীক সেই জাগ্রত আত্মার, যিনি প্রকৃতির শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তাঁর দেহে পশুর চামড়া, কিন্তু মনে চেতনার দীপ্তি—এই দ্বৈততার মধ্যেই প্রকাশ পায় মুক্তির সার সত্য: প্রকৃতি ও চেতনা এক, তবে চেতনারই আধিপত্য।

কালীর রক্তাভ চোখ তাঁর চেতনার জাগ্রত আগুন—যেখানে জ্ঞান ও ক্রিয়া, বোধ ও শক্তি, দর্শন ও কর্ম—সব একত্রে দীপ্তি ছড়ায়। তাঁর এই রক্তাভ দৃষ্টি কোনো ক্রোধের প্রতীক নয়; এটি জাগরণের প্রতীক—চেতনার সেই মুহূর্ত, যখন নিদ্রিত আত্মা হঠাৎ নিজের দীপ্তিতে জেগে ওঠে। এই চোখে আগুন আছে, কিন্তু সেই আগুন দহন করার নয়, আলোকিত করার; এই দীপ্তি ধ্বংসের নয়, বরং উদ্‌ভাসনের।

অদ্বৈত বেদান্তে কালীর রক্তাভ চোখ প্রতীক “চিত্-প্রকাশ”-এর—অর্থাৎ চেতনার নিজস্ব আলোক। শঙ্করাচার্য বলেন, “চিতিরেব হি বুদ্ধিরূপা”—জ্ঞানই চেতনার রূপ। এই জ্ঞান যখন নিজের প্রকৃত স্বরূপে জাগ্রত হয়, তখন তা সমস্ত অজ্ঞানকে দহন করে ফেলে, যেমন সূর্যের আলো অন্ধকারকে দূর করে। কালীর রক্তাভ চোখ সেই সূর্যদৃষ্টির প্রতীক—যেখানে দৃষ্টি মানে শুধু দেখা নয়, উপলব্ধি করা, সত্তার সত্যকে অনাবৃত করা। তাঁর চোখে রক্তের দীপ্তি এই কারণে—এটি সেই চেতনার অগ্নি, যা জীবনকে রূপান্তরিত করে।