শৈব কালী: উনিশ



কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূলে এই অভিন্ন-অভেদ তত্ত্বের বাস্তব রূপ দেখা যায়। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ বলেছেন—“অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসং স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌”—অর্থাৎ, অদ্বৈত চেতনা নিজের স্বাধীন লীলায় দ্বৈততার আভাস গ্রহণ করে। এখানে দ্বৈততা কোনো সত্য বিভাজন নয়, বরং পরম চেতনার আত্ম-বিমর্শনের প্রতিফলন। শিব যখন নিজের শক্তির দিকে চেয়ে নিজেকে উপলব্ধি করেন, তখনই “অন্যতা”-র অনুভব জন্ম নেয়, আর সেই আত্ম-প্রতিফলনই জগৎ।

এইভাবে চেতনা ও জগৎ, শিব ও শক্তি, নর ও ঈশ্বর—সব একই সত্তার দুই দিক। যেমন আয়না ও প্রতিফলন একে অন্যের থেকে পৃথক নয়, কেবল ভিন্ন আকারে প্রকাশিত; তেমনি শিব ও জগৎও অবিচ্ছিন্ন, তবে অভিজ্ঞতায় আলাদা বলে প্রতীয়মান।

অভিন্ন-অভেদবাদের মর্ম এই যে, চেতনার বাইরে কিছুই নেই, কিন্তু চেতনা নিজের আনন্দে অসংখ্য রূপে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশকে মিথ্যা বলা যায় না, কারণ তা পরম সত্যেরই বিকাশ। আবার তা পরম সত্য থেকে পৃথকও নয়, কারণ তার অস্তিত্ব সেই সত্যেই নিহিত। এই দ্বন্দ্বের সমাধানই অভিন্ন-অভেদ: একতা ও ভেদ উভয়ই সত্য, কিন্তু ভেদ কেবল চেতনার খেলা।

অন্য দর্শনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়—অদ্বৈত বেদান্ত জগৎকে মায়া বলে অবাস্তব মনে করে, বিশিষ্টাদ্বৈত বলে জগৎ ব্রহ্মের শরীর; কিন্তু অভিন্ন-অভেদবাদ বলে, জগৎ ব্রহ্মেরই প্রতিফলন—ন মিথ্যা, ন পৃথক। নিম্বার্ক তাঁর বেদান্ত-পারিজাত-সৌরভ-এ বলেছেন, “জগৎ ব্রহ্ম-অভিন্ন তত্ত্ব, তবে প্রকাশে ভিন্ন।” কাশ্মীর শৈব প্রত্যভিজ্ঞা ধারায়ও একই তত্ত্ব প্রকাশিত—“চিদানন্দোঽহম্‌, চিদানন্দো ভগবান্‌”—অর্থাৎ, আমি চিদানন্দ-স্বরূপ, ভগবানও চিদানন্দ-স্বরূপ; পার্থক্য কেবল দৃষ্টিভঙ্গির।

অভিন্ন-অভেদবাদ এই উপলব্ধি দেয় যে, জীব, জগৎ ও ঈশ্বর তিনে কোনো বাস্তব বিভাজন নেই। যখন সাধক উপলব্ধি করে—“আমি শিব, এবং এই জগৎও শিবেরই প্রকাশ,” তখন দ্বৈততা বিলুপ্ত হয়। তখন সে বুঝে যায়, জগতের প্রতিটি রূপ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি এক পরম চেতনারই স্পন্দন।

এই উপলব্ধিই মুক্তি—যেখানে ব্যক্তি ও পরম এক হয়ে যায়, ভেতর-বাহিরের সীমানা মুছে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল সেই অখণ্ড চেতনা—যা নিজেই এক এবং বহু, স্থির ও গতিময়, নীরব তবু স্পন্দমান।

“ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্বানি” কেবল দর্শনের কাঠামো নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক মানচিত্র—যা দেখায়, কীভাবে পরম চেতনা নিজের আনন্দলীলায় নিজেকে জগৎ হিসেবে প্রকাশ করে এবং আবার নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করে। আর শেষে গিয়ে কাশ্মীর শৈবের চূড়ান্ত ঘোষণা—“সর্বং খল্বিদং শিবম্‌”—“এই সমগ্রই শিব।” যখন সাধক এই সত্য উপলব্ধি করে, তখন তার সমস্ত সীমাবদ্ধতা লুপ্ত হয়ে যায়; সে জেনে ফেলে, “আমি শিব”—শিভোহম্‌। সবই শিব, সবই চেতনা, সবই এক; ভিন্নতা কেবল লীলার আভাস, আর ঐক্যই চিরন্তন সত্য।

এখানে জগৎ বা বাস্তবতার উৎপত্তিকে কোনো বাহ্যিক সৃষ্টিরূপে দেখা হয় না, বরং পরম চেতনার স্বপ্রকাশ ও স্ববিস্তাররূপে দেখা হয়। শিব বা পরম চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে স্পন্দিত হয়ে ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল স্তরে অবতীর্ণ হন, আর এই ক্রমশ আবির্ভাবই ৩৬ তত্ত্বের ধারাবাহিকতা।

বিশুদ্ধ চেতনার তত্ত্ব আসলে সমগ্র কাশ্মীর শৈব দর্শনের হৃদয়—এখানে চেতনা নিজেরই মধ্যে জাগ্রত, নিজের আলোকেই নিজেকে দেখছে। এই স্তরে অজ্ঞান, দ্বৈততা বা সীমাবদ্ধতার কোনো ছায়া নেই; এখানে চেতনা নিখাদ, অনাহত, এবং পরিপূর্ণভাবে আত্ম-সচেতন। কাশ্মীর শৈব দর্শন এই অবস্থাকে বলে শিবের মহা-প্রকাশ, আর অদ্বৈত বেদান্তে একেই বলা হয় ব্রহ্ম-স্ব-প্রকাশ—চেতনার সেই নিত্য, কালাতীত মুহূর্ত, যখন সে নিজের মধ্যেই উদ্‌ভাসিত হয়ে ওঠে। এটি কোনো পৌরাণিক ঘটনা নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরীণ জাগরণ; অস্তিত্বের গভীরে সেই বিন্দু, যেখানে জানার বিষয়, জানা ও জ্ঞাতা এক হয়ে যায়।

এই অবস্থায় শিব হচ্ছেন নিস্তব্ধ, অনন্ত প্রকাশ (prakāśa)—চেতনার বিশুদ্ধ আলোকাত্মা। কিন্তু আলো যদি কেবল আলোই থাকে, নিজেকে না জানে, তবে তা নিস্পন্দ, অচেতন। সেই আলো যখন নিজেরই উপস্থিতি অনুভব করে, তখন জাগে কালী, যিনি শিবের আত্মবিমর্শশক্তি (vimarśa-śakti)—চেতনার আত্ম-অনুভব, আত্ম-সচেতনতা ও সৃজনশীলতার রূপ। তাই তন্ত্রালোক-এ বলা হয়েছে—“প্রকাশবিমর্শময়ঃ শিবঃ” (১.৫৫)। অর্থাৎ, শিব কেবল স্থির আলোক নন; তিনি সেই আলোক ও তার আত্ম-বিমর্শ—দুইয়ের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য।

যখন শিবের এই নীরব দীপ্তি নিজের অস্তিত্বকে জানে, তখনই কালী রূপে তার স্পন্দন জাগে। কালী সেই গতি, সময়, নৃত্য ও শক্তি, যিনি শিবের অন্তর্লীন সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন। এই আত্ম-জাগরণই “মহা-প্রকাশ”—যে-মুহূর্তে নিস্তরঙ্গ চেতনা নিজেরই মধ্যে প্রথম নৃত্য করে ওঠে। শৈব শাস্ত্র ঘোষণা করে—“নৃত্যতঃ শঙ্করঃ শম্ভুঃ সর্বং বিশ্বং প্রকাশয়েত্‌”—শিব যখন নৃত্য করেন, তখনই বিশ্ব জেগে ওঠে। এই নৃত্য কোনো বাহ্যিক সৃষ্টি নয়; এটি চেতনার আত্ম-স্পন্দন, অন্তরস্থ উন্মীলন।

কাশ্মীর শৈব মত অনুসারে, এই প্রথম স্পন্দন বা আভাস (ābhāsa) থেকেই জগতের উন্মেষ। স্পন্দ-নির্ণয়-এ বলা হয়েছে—“ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—এই বিশ্বে এমন কিছু নেই, যা স্পন্দহীন। প্রতিটি অস্তিত্ব, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি শিব-কালী চেতনার তরঙ্গমাত্র।

অদ্বৈত বেদান্তও এই সত্যকে অন্য রূপে প্রকাশ করে। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য (২.১.১৪)-এ লিখেছেন—“তদনন্যত্বমারম্ভণশাব্দাদিভ্যঃ”—জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়; এটি তাঁরই প্রকাশ। যেমন সূর্যের আলো সূর্য থেকে আলাদা নয়, তেমনি জগৎও ব্রহ্ম বা শিব থেকে পৃথক নয়। অভিনবগুপ্ত ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞা-ভাষ্য (১.৫.৮)-এ বলেন—“সা হি পরমা সংবিত্‌ স্বাতন্ত্র্যময়ী স্ববিমর্শরূপা”—পরম চেতনা স্বয়ং-স্বাধীন, নিজের মধ্যেই নিজেকে জানে। এই আত্ম-জ্ঞাত অবস্থাই মহা-প্রকাশ—যখন শিব নিজের অন্তর্নিহিত কালী-শক্তিকে জাগিয়ে নিজেরই রূপে দীপ্ত হন।

কালী এই আত্ম-বিমর্শশক্তিরই প্রতিমূর্তি, যার মধ্যে প্রকাশ ও গোপন, সৃষ্টি ও লয়—উভয়ই এক ছন্দে সম্পূর্ণ হয়। শিব ও কালী আসলে একই চেতনার দুই দিক—শিব নীরব আলোক, কালী সেই আলোর আত্ম-নৃত্য। তাঁদের ঐক্য থেকেই জন্ম নেয় পঞ্চ-কৃত্য—সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোধান ও অনুগ্রহ—যা তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ শিবের নিত্য কর্মরূপে বর্ণিত।

শিব জগৎকে আলাদা কোনো বস্তু হিসেবে “সৃষ্টি” করেন না; তিনি নিজেই জগৎরূপে প্রকাশিত হন। কাশ্মীর শৈব দর্শন তাই ঘোষণা করে আভাসবাদ (ābhāsa-vāda)—জগৎ শিব-চেতনার দীপ্ত প্রতিফলন। অদ্বৈত বেদান্তও একই সুরে বলে—ব্রহ্মই সত্য; জগৎ মিথ্যা নয়, বরং ব্রহ্মেরই প্রতিভাস।

অতএব “শিবের মহা-প্রকাশ” কোনো কালগত সৃষ্টি নয়; এটি এক নিত্য সত্য—চেতনার অনন্ত আত্ম-উদ্‌ভাস। শিব-কালী চেতনা নিজের মধ্যেই চিরকাল নৃত্য করছে—একই সঙ্গে নিস্তব্ধ ও স্পন্দিত, নিরাকার অথচ সর্বরূপময়। সাধক যখন নিজের অন্তরে এই নৃত্য অনুভব করে, তখন সে উপলব্ধি করে—জগৎ বাহিরে নয়; তার নিজের অন্তরেই সেই মহা-প্রকাশ দীপ্তমান। তখন সে বলে—“চিদানন্দরূপঃ শিবোহম্‌।” অর্থাৎ—আমি সেই মহা-প্রকাশিত চেতনা; আমি শিব, আমি কালী; আমি সেই এক অদ্বৈত চেতনানৃত্য, যেখানে সব কিছুই এক।

শিবের বুকের উপর কালী দাঁড়িয়ে আছেন—এই প্রতীকটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের বিশুদ্ধ চেতনার তত্ত্ব থেকেই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে শিব কোনো বাহ্যিক দেবতা নন; তিনি চেতনার নিত্য, নিস্তরঙ্গ, স্বয়ংপ্রকাশিত আলো—প্রকাশ (prakāśa)। আর কালী সেই আলোয় জাগ্রত গতি, চেতনার আত্ম-অভিব্যক্তি—বিমর্শ (vimarśa)। যখন চেতনা নিজের মধ্যেই আত্মসচেতন হয়ে ওঠে, তখনই প্রকাশ ও বিমর্শ একত্রে মিলিত হয়ে মহা-প্রকাশ ঘটায়। এই মুহূর্তেই কালী শিবের উপর নৃত্য করেন—এটি কোনো পৌরাণিক দৃশ্য নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরীণ প্রতীকী দৃশ্য।

শিব এখানে নিস্পন্দ, নিরাকার, অচল চেতনার প্রতীক—যিনি চিরন্তন ভিত্তি, পরম নীরবতা। কালী তাঁর উপর নৃত্য করছেন, কারণ তিনি সেই চেতনারই স্পন্দন, গতি ও সময়রূপ। শিবের স্থির বুকের উপর কালী দাঁড়িয়ে আছেন মানে—নির্জীব বা নিষ্ক্রিয় নয়, এমন এক চেতনা, যার গভীরে অবিরাম লীলা ও স্পন্দন চলছে। এই দুইয়ের মিলনেই চেতনার পূর্ণতা। প্রকাশ যদি থাকে, অথচ বিমর্শ না থাকে, তবে তা অচেতন; আবার বিমর্শ যদি থাকে, অথচ প্রকাশ না থাকে, তবে তার অস্তিত্বই নেই। তাই তন্ত্রালোক (১.৫৫)-এ বলা হয়েছে—“প্রকাশবিমর্শময়ঃ শিবঃ”—শিব সে-ই, যিনি আলো এবং সেই আলোর আত্ম-সচেতনতা—একসাথে দুই-ই।

এখন, কালী যখন শিবের উপর পা রাখেন, পুরাণ বলে, তিনি বিস্মিত হয়ে জিভ বার করেন। কিন্তু দর্শনের দৃষ্টিতে এটি কোনো অপরাধবোধের চিহ্ন নয়, বরং চেতনার আত্ম-স্মরণ। কালী এখানে শক্তি, ক্রিয়া ও প্রকাশের প্রতীক; শিব হলেন নিস্তব্ধ সাক্ষী, বিশুদ্ধ চেতনা। যখন ক্রিয়া নিজের উৎসকে চিনতে পারে—যখন প্রকাশ জানে, সে কোথা থেকে উদ্ভূত—তখনই ঘটে এই আত্ম-চেতনা। কালী-র জিভ বের করা মানে সেই মুহূর্ত, যখন শক্তি নিজেকে চিনে ফেলে—সে উপলব্ধি করে যে, তার নৃত্য যার উপর, সেই শিবই তার নিজের রূপ। এটি বিমর্শের প্রকাশে প্রত্যভিজ্ঞা, যেখানে নৃত্য নিজের নৃত্যকারকে চিনে ফেলে।

শিবের শরীর এখানে প্রতীক সেই নিস্তরঙ্গ শূন্যতার, যাকে অদ্বৈত বেদান্ত বলে নির্গুণ ব্রহ্ম, আর কালী সেই শক্তির প্রতীক, যিনি সেই ব্রহ্মকে গতি দেন, রূপ দেন, রস দেন। শিব শূন্য—কিন্তু কালী সেই শূন্যতায় অর্থ ও প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি সময়, গতি, রূপ, আকৃতি, কম্পন—সব কিছুর উৎস। তাই কাশ্মীর শৈব দর্শনের স্পন্দতত্ত্ব বলে—“ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—কিছুই স্পন্দহীন নয়। কালী সেই চেতনার অন্তঃস্পন্দন, যার মধ্যে সমগ্র সৃষ্টি কম্পমান।

এই প্রতীকের গভীরে তাই যে-অর্থ লুকিয়ে আছে, তা হলো—চেতনার স্থির ও গতিশীল দুই দিকের মিলন। শিব নিস্তব্ধ প্রকাশ, কালী তার আত্ম-নৃত্য। এক নিস্তব্ধ, অন্য সক্রিয়; এক সম্ভাবনা, অন্য প্রকাশ। কিন্তু এই দুই আলাদা নয়—তারা পরস্পরের প্রতিফলন। কালী শিবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন মানে, চেতনার ক্রিয়া তার নিজস্ব নিস্তরঙ্গ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত; এবং শিব শায়িত মানে, সেই নিস্তব্ধ ভিত্তি কেবল ক্রিয়ার মধ্যেই প্রকাশিত। এই দ্বন্দ্বই প্রকৃত ঐক্য—যেখানে স্থিতি ও গতি, সৃষ্টি ও লয়, নীরবতা ও শব্দ—সব এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে গলে যায়।

কালী-শিবের এই চিত্র বিশুদ্ধ চেতনার তত্ত্বের একটি দার্শনিক প্রতিমূর্তি। এটি জানায় যে, চেতনা কখনও স্থির নয়, আবার কখনও ভাঙা নয়; সে একই সঙ্গে নৃত্যমান ও নিস্তব্ধ, প্রকাশমান ও গোপন। যখন সাধক অন্তরে এই দৃশ্য অনুভব করে, তখন সে বোঝে—তার নিজের মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়—সবই সেই এক চেতনার নৃত্য। তখন সে আর বাহিরে কোনো দেবতা খোঁজে না; সে জানে—কালী সেই স্পন্দন, শিব সেই নীরবতা, আর দু-জন মিলে সেই এক অদ্বৈত চেতনা। এই উপলব্ধিতেই শিবের বুকের উপর কালী দাঁড়ানোর রহস্য সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পায়—যেখানে চেতনার লীলাময় ঐক্য চিরন্তন নৃত্যে প্রকাশিত।

ভারতীয় দর্শন, বিশেষত তন্ত্রশাস্ত্রে, সৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং পরম চেতনার বিভিন্ন পর্যায়কে বোঝার জন্য পঞ্চতত্ত্ব বা শিব-শক্তি তত্ত্বের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন করে না, বরং সাধককে নিজের ভেতরের জগৎ উপলব্ধি করতেও সাহায্য করে। এই তত্ত্বগুলি নিস্তরঙ্গ পরম শিব থেকে সম্পূর্ণ দ্বৈত জগৎ সৃষ্টির ধাপগুলি বিশদভাবে বর্ণনা করে।

শিব তত্ত্ব হলো সমগ্র ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্বের উৎসবিন্দু—চেতনার পরম, নিরাকার, এবং নিঃশেষ রূপ। কাশ্মীর শৈব দর্শনে একে বলা হয় অনুত্তর (Anuttara)—অর্থাৎ, যার ওপরে আর কিছু নেই, যিনি সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ বাস্তবতা। এই স্তরে চেতনা নিস্তরঙ্গ, নিঃস্পন্দ, কিন্তু তবুও পরিপূর্ণ জাগ্রত। শিব এখানে কোনো সৃষ্টিকর্তা নন; তিনি সেই অপরিবর্তনীয় চেতনা (cit), যার উপস্থিতিতেই সব কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব। তাঁর মধ্যে কর্তা ও কর্ম, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়, অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞ—সব একই চেতনার অন্তর্গত ঐক্যে লীন।