শৈব কালী: উনসত্তর



দুঃখ হলো সেই অন্তর্গত ক্লেশ, যা এই সমস্ত অস্থিরতার ফল। দুঃখ মানে কেবল বাহ্যিক যন্ত্রণা নয়, বরং আত্মার ভুল পরিচয়ের বেদনা—যেখানে মানুষ নিজের সত্য সত্তাকে হারিয়ে ফেলে।

হতাশা হলো দুঃখের স্থিত রূপ—যখন আশা নিঃশেষ, মন ক্লান্ত ও অনুৎসাহিত। এটি এক শূন্যতার অনুভব, যেখানে চেতনা নিজের দীপ্তি ভুলে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

দম্ভ হলো নিজের সীমিত জ্ঞানকে সর্বজ্ঞ ভাবার মানসিক প্রবণতা। এটি অস্মিতার বিকৃত ফল, যেখানে ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতাকে লুকিয়ে “আমি জানি” এই ভ্রমে স্থিত থাকে।

সবশেষে, অদর্শন—এটি সত্যকে না দেখা, নিজের অন্তর্লোক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। এখানে চেতনা নিজের প্রতিফলনে মুগ্ধ, কিন্তু উৎসের দিকে ফিরতে জানে না। এটাই আত্মবিস্মৃতির গভীরতম স্তর, যেখানে জ্ঞান, বোধ ও দৃষ্টি—তিনটি স্তরই আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

এই সব সূক্ষ্ম বিকৃতি আসলে একই শিকড় থেকে জন্ম নেয়—অবিদ্যা। অবিদ্যা হলো মূল অন্ধকার, আর বাকিগুলি তার ছায়া। তাই যোগশাস্ত্র বলে, যখন অবিদ্যা নাশ হয়, তখন সব ক্লেশ ও বিকার নিজে থেকেই বিলীন হয়ে যায়। অবিদ্যা নাশ মানে আত্মজ্ঞান—যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে, “আমি দেহ নই, মন নই, বরং সেই চিরসচেতন আত্মা।” তখন এই সমস্ত ক্লেশ বিলীন হয় আলোর মতো, যেমন অন্ধকার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়।

এই সমস্ত বিকৃতি মিলে চেতনার স্বজ্ঞাপ্রকাশ শক্তিকে আচ্ছন্ন করে দেয়। চেতনা, যা নিজের দীপ্তিতে জ্বলে ওঠার কথা, তা তখন যেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন প্রদীপের মতো নিস্তেজ হয়ে যায়। জীব তখন নিজেকে পৃথক ও সীমিত মনে করে—“আমি এই শরীর”, “আমি এই মন”, “আমি এই জীবন”—এই ভ্রান্ত বোধই তাকে দুঃখের চক্রে বেঁধে রাখে।

বেদান্ত এই অবস্থাকেই বলে অবিদ্যা-বিকার, অর্থাৎ অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন বিভ্রান্ত চেতনা। এখানে চেতনা নিজেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে তাকে সত্য মনে করে। যেমন কুয়াশায় ঢাকা সূর্য ম্লান দেখায়, অথচ সূর্য নিজে কখনও ম্লান নয়—তেমনি আত্মাও সর্বদা দীপ্ত, কিন্তু অবিদ্যার কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে জ্ঞানের আলো ক্ষীণ মনে হয়।

এই বিকৃতিগুলির অবসান ঘটে কেবল আত্মস্মরণ বা আত্মজ্ঞান দ্বারা। যখন মানুষ ধীরে ধীরে দেখে—“আমি এই দেহ নই, মন নই, বরং সেই সাক্ষী চেতনা”—তখন এই সমস্ত ভ্রম নিজে থেকেই বিলীন হতে থাকে। অবিদ্যা তখন বিদ্যায় পরিণত হয়, অবিবেক হয় বিবেক, রাগ ও দ্বেষ গলে যায় করুণায় ও সমত্বে। তখন চেতনা আবার নিজের স্বরূপে জেগে ওঠে—অখণ্ড, শান্ত ও দীপ্ত।

চৈতন্য বিকৃতি আসলে জ্ঞানের বিকৃতি—যেখানে জানার আলোক নিজেই নিজের উৎস ভুলে যায়। আর মুক্তি মানে সেই আলোকে পুনরায় নিজের কেন্দ্রের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া—যেখানে আর কোনো বিভ্রান্তি নেই, শুধু এক নীরব উপলব্ধি: “আমি সেই চেতনা, যা কখনও আচ্ছন্ন হয় না; অবিদ্যা কেবল আমার প্রতিফলনের কুয়াশা মাত্র।”

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়, ব্রহ্মচেতনা স্বতঃপ্রকাশ, কিন্তু অবিদ্যা তার উপর আচ্ছাদন ফেলে; এই আচ্ছাদনই আবরণশক্তি, আর যে ভুল প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হয়—সেই বিভ্রমই বিক্ষেপশক্তি। এই দুই শক্তির মিলনে জন্ম নেয় এই বত্রিশ অন্তর্যামী দোষ। তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়, চেতনার প্রতিটি দোষই কুণ্ডলিনীর একেকটি স্থিতাবস্থা, একেকটি গ্রন্থি বা অবরোধ। যতক্ষণ না এই দোষগুলো শুদ্ধ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তর্যামী চেতনা নিজ ব্রহ্মস্বরূপে জাগ্রত হয় না।

এই বত্রিশ বিকার বা অভ্যন্তরীণ বিকৃতি মনের, প্রাণের ও জ্ঞানের তিন স্তরে ছায়ারূপে বিরাজমান। এগুলি শুদ্ধির সাধনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিলীন হলে আত্মা নিজের প্রকৃত ব্রহ্মরূপে, চৈতন্যের বিশুদ্ধ ঐক্যে, পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

তৃতীয় স্তরের “বত্রিশ কেন্দ্র” বা “বত্রিশ নাড়ি”-র ধারণাটি আসলে যোগশাস্ত্র, তন্ত্র এবং কুণ্ডলিনী তত্ত্ব—এই তিনটি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক প্রণালীর এক গভীর সংমিশ্রণ। এখানে “নাড়ি” বলতে বোঝানো হয়েছে সেই সূক্ষ্ম শক্তিপথ, যেগুলির মধ্য দিয়ে প্রাণশক্তি (prāṇa) তথা চেতনার কম্পন শরীর জুড়ে প্রবাহিত হয়। মানবদেহ কেবল হাড়-মাংস বা রক্ত-মাংসের সমষ্টি নয়—এটি এক সূক্ষ্ম শক্তিনেটওয়ার্ক, এক জীবন্ত স্পন্দন-ব্যবস্থা, যেখানে চেতনা অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে নাড়ি-পথে। যোগ ও তন্ত্র উভয়ই মনে করে, এই শক্তিপথের সঠিক ভারসাম্যই মানুষের মানসিক, শারীরিক ও আত্মিক স্বাস্থ্যের মূল।

যোগশাস্ত্রের দৃষ্টিতে, মানবদেহে অসংখ্য নাড়ি রয়েছে—প্রায় ৭২,০০০ থেকে ৩৫০,০০০ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন সূত্রে। এই নাড়িগুলির মধ্যে তিনটি প্রধান: ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না।

ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না—এই তিনটি নাড়ি যোগশাস্ত্র ও তন্ত্রে মানুষের শক্তি-ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। এগুলো শুধু শারীরিক বা শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ নয়, বরং চেতনা ও প্রাণশক্তির প্রবাহপথ, যার ভারসাম্যের উপর নির্ভর করে মানুষের মানসিক স্থিতি, শারীরিক স্বাস্থ্য ও আত্মিক জাগরণ। এই তিন নাড়ির সমন্বয়ই মানুষকে “পুরুষ” থেকে “পুরুষোত্তম” কিংবা সীমিত থেকে অসীমে উত্তীর্ণ করে।

প্রথমে ইড়া নাড়ি—এটি শরীরের বাম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং “চন্দ্রনাড়ি” নামেও পরিচিত। চন্দ্রতত্ত্ব মানে শান্তি, শীতলতা, গ্রহণশীলতা ও অন্তর্মুখিতা। ইড়া নাড়ি মন ও আবেগের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এটি আমাদের মানসিক ভারসাম্য, অনুভূতির কোমলতা, সহানুভূতি, কল্পনা ও অন্তর্জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করে। ইড়ার কার্যকলাপ প্রাধান্য পেলে মন শান্ত, সংবেদনশীল ও ধ্যানমগ্ন হয়; মানুষ তখন অন্তর্মুখী বা আত্ম-জিজ্ঞাসু (introspective), মৃদুভাষী ও সহৃদয় হয়ে ওঠে। তবে ইড়া যদি অতিরিক্ত সক্রিয় হয়, তখন মন অতিরিক্ত সংবেদনশীল, অলস বা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে—তাই এর ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

এরপর আসে পিঙ্গলা নাড়ি, যা শরীরের ডান দিকে প্রবাহিত হয় এবং “সূর্যনাড়ি” নামে পরিচিত। সূর্যতত্ত্ব হলো উষ্ণতা, উদ্যম, প্রাণশক্তি ও বহির্মুখতার প্রতীক। এটি শরীরের ক্রিয়াশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির কেন্দ্র। পিঙ্গলার কার্যপ্রবাহ বাড়লে মানুষ দৃঢ়, সাহসী ও কর্মনিষ্ঠ হয়; শরীরে তেজ, মস্তিষ্কে সক্রিয়তা ও মননে উদ্দীপনা আসে। তবে এই নাড়ি যদি অতি সক্রিয় হয়, তাহলে ক্রোধ, অস্থিরতা, অতিরিক্ত উদ্দীপনা ও ক্লান্তি দেখা দেয়। পিঙ্গলা হলো সূর্যের মতো—যথার্থ সীমায় এটি জীবনদায়ক, কিন্তু অতিরিক্ত হলে জ্বালাময়।

সবশেষে আসে সুষুম্না নাড়ি, যা মেরুদণ্ড বরাবর সোজা উপরে উঠে গিয়ে মস্তিষ্কের শীর্ষে সহস্রার চক্রে মিলিত হয়। এই নাড়ি ইড়া ও পিঙ্গলার মাঝখানে অবস্থান করে এবং দুটির ভারসাম্যের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এটি “মধ্যপথ”—যেখানে চন্দ্রের শান্তি ও সূর্যের তেজ, স্থিরতা ও গতিশীলতা, মন ও প্রাণ—সব মিলেমিশে একাকার হয়। সুষুম্না হলো আত্মিক উত্থানের পথ; এখানেই কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ ঘটে।

কুণ্ডলিনী তত্ত্ব মানবচেতনার এক গূঢ় মানচিত্র, যেখানে দেহ, মন ও আত্মা—এই তিনের পারস্পরিক সম্পর্ককে শক্তি ও চেতনার একত্রীকরণ হিসেবে দেখা হয়। কুণ্ডলিনীকে বলা হয় সুপ্ত শক্তি, অর্থাৎ এমন এক আদ্যশক্তি, যা প্রত্যেক মানুষের ভেতরে নিদ্রিত অবস্থায় অবস্থান করে। যোগ ও তন্ত্র উভয়ই একমত যে, এই কুণ্ডলিনীই মানুষের আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মূল উৎস—সে নিদ্রিত অবস্থায় থাকে মূলাধার চক্রে, এবং জাগ্রত হলে মানুষের সীমিত চেতনা সর্বব্যাপী চেতনার সঙ্গে মিলিত হয়।

মূলাধার চক্র দেহের মেরুদণ্ডের গোড়ায় অবস্থিত—এটি “পৃথিবী তত্ত্ব” বা স্থিতির প্রতীক। এখানে কুণ্ডলিনী তিন অর্ধচক্রে পেঁচানো সাপের মতো নিদ্রিত থাকে—এই “নিদ্রা” মানে নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং সুপ্ত সম্ভাবনা। এটি সেই মহাশক্তি, যা জগৎ সৃষ্টি, পালন ও লয়ের মূল। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই শক্তিকে অনুজ্জ্বল অবস্থায় রাখে, কারণ তার মন ও প্রণশক্তি বিকেন্দ্রীভূত।

যখন সাধক ধ্যান, প্রাণায়াম, মন্ত্র বা তান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে মন ও প্রাণকে সুষুম্না নাড়িতে স্থিত করে, তখন এই কুণ্ডলিনী ধীরে ধীরে জাগতে শুরু করে। জাগ্রত মানে হলো—চেতনার উর্ধ্বগমন। সে ক্রমে মেরুদণ্ড বরাবর উঠে যেতে থাকে, এবং পথে পথে ছয়টি প্রধান চক্র বা শক্তিকেন্দ্রকে জাগ্রত করে।

প্রথমে সে জাগায় মূলাধার চক্র—যা স্থিতি, নিরাপত্তা ও দেহচেতনার কেন্দ্র। এখানে কুণ্ডলিনীর প্রথম স্পন্দন মানুষকে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে।

তারপর আসে স্বাধিষ্ঠান চক্র, যা নাভির নিচে অবস্থিত এবং জলের তত্ত্বের প্রতীক। এটি সৃজনশীলতা, আবেগ ও ইন্দ্রিয়ানন্দের কেন্দ্র। কুণ্ডলিনী এখানে পৌঁছলে মানুষ নিজের আবেগ ও কামনাকে শুদ্ধ শক্তিতে রূপান্তর করতে শেখে।

তৃতীয় কেন্দ্র মণিপুর চক্র, যা নাভির স্থানে অবস্থিত। এটি অগ্নিতত্ত্বের প্রতীক—এখানে কুণ্ডলিনী শক্তি রূপান্তরের ক্ষমতা পায়। সাধকের মধ্যে জাগে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণ।

চতুর্থ কেন্দ্র অনাহত চক্র, হৃদয়স্থল—এটি বায়ুতত্ত্বের প্রতীক এবং প্রেম, করুণা ও সংবেদনশীলতার কেন্দ্র। কুণ্ডলিনী এখানে পৌঁছলে মানুষ ভেদবুদ্ধি অতিক্রম করে ভালোবাসাকে সর্বজনীন চেতনা হিসেবে অনুভব করে।

পঞ্চম কেন্দ্র বিশুদ্ধ চক্র, যা কণ্ঠদেশে অবস্থিত এবং আকাশতত্ত্বের প্রতীক। এটি শব্দ, বাক্য ও প্রকাশের কেন্দ্র। কুণ্ডলিনী এখানে এসে মানুষকে সত্য উচ্চারণ ও নীরব ধ্যান—দুইয়ের সুষম ভারসাম্যে স্থিত করে।

ষষ্ঠ কেন্দ্র আজ্ঞা চক্র, যা ভ্রূমধ্যস্থলে অবস্থিত—এটি বুদ্ধি, অন্তর্জ্ঞান ও দৃষ্টির কেন্দ্র। কুণ্ডলিনী এখানে পৌঁছলে সাধক “দ্বৈত-দৃষ্টি” হারিয়ে অন্তরচক্ষুতে সমগ্র অস্তিত্বকে এক চেতনার প্রকাশ হিসেবে দেখতে পায়।

অবশেষে কুণ্ডলিনী পৌঁছে যায় সহস্রার চক্রে—মস্তিষ্কের মুকুটদেশে, যেখানে অসংখ্য পাপড়িওয়ালা পদ্মের প্রতীক দেওয়া হয়েছে। এটি আর কোনো “চক্র” নয়, বরং চেতনার পরম শিখর। এখানে কুণ্ডলিনী, অর্থাৎ শক্তি, মিলিত হয় শিব বা পরম চেতনার সঙ্গে। এই মিলনই হলো শিব-শক্তির ঐক্য, যেখানে গতি (শক্তি) ও স্থিতি (চেতনা) একাকার হয়ে যায়।

যোগদর্শন এই অবস্থাকে বলে “সমাধি”—যেখানে মন, চিন্তা, ও কর্ম—সব এক পরম স্থিরতায় লীন। বেদান্তের ভাষায় এটি “ব্রহ্মসাক্ষাত্কার”—অর্থাৎ আত্মা নিজের ব্রহ্মস্বরূপকে প্রত্যক্ষ করে।

এই মিলন কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়; এটি ঘটে মানুষের অন্তর্লোকে। কুণ্ডলিনী হলো নিজের মধ্যকার চেতনার তরঙ্গ, আর শিব হলো সেই তরঙ্গের নীরব ভিত্তি। যখন তরঙ্গ উৎসে ফিরে যায়, তখন ব্যক্তি ও পরম, জাগতিক ও আধ্যাত্মিক—সব ভেদ মুছে যায়।

তখন মানুষের অভিজ্ঞতা হয় এক অনির্বচনীয় একত্বের—যেখানে আলো ও অন্ধকার, শব্দ ও নীরবতা, জাগরণ ও নিদ্রা—সব মিশে যায় এক অনন্ত প্রশান্ত চেতনার সাগরে। এই অবস্থাই তন্ত্রে মুক্তি, যোগে নির্বাণ, আর বেদান্তে পরব্রহ্মানুভব। এখানে আর কোনো আরোহন নেই, কোনো অনুসন্ধানও নেই—কারণ যাকে খুঁজছিলাম, সে-ই এখন জেগে আছে নিজের মধ্যেই, কুণ্ডলিনী রূপে পরিণত চেতনার মহাশক্তি।

এই তিনটি নাড়ি—ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না—আসলে চেতনার তিন প্রবাহ বা শক্তির তিন রূপ: গ্রহণ (চন্দ্র), কর্ম (সূর্য), ও ঐক্য (শূন্য)। যখন ইড়া ও পিঙ্গলা সুষুম্নায় মিলিত হয়, তখন দ্বৈততা বিলুপ্ত হয়—বাম ও ডান, স্থিরতা ও গতি, চেতনা ও শক্তি এক হয়ে যায়।

ইড়া হলো চেতনার শান্ত স্বরূপ, পিঙ্গলা হলো তার কর্মশক্তি, আর সুষুম্না হলো সেই ঐক্য-সেতু, যা তাদের মধ্য দিয়ে মানবচেতনার উত্থানকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। এই তিন নাড়ির সুষম প্রবাহই প্রকৃত যোগ বা একত্ব—যেখানে শ্বাস ও মন, শরীর ও আত্মা, শিব ও শক্তি, আলো ও ছায়া—সব মিলেমিশে যায় এক মহাশান্ত, জাগ্রত চৈতন্যে।

এই তিনটির মিলনেই প্রাণশক্তি সুষমভাবে প্রবাহিত হয়। কিন্তু এগুলির বাইরে আরও অসংখ্য সূক্ষ্ম নাড়ি আছে—যারা এই তিনটির সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সারাশরীরের শক্তি-বিন্যাসকে চালিত করে।