শৈব কালী: উনচল্লিশ



অদ্বৈত বেদান্তে এই ত্রিপুণ্ড্র নির্দেশ করে আত্মার চতুর্থ অবস্থা—“তুরীয়” (চৈতন্যমাত্র অবস্থা)—যেখানে জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুপ্ত—এই তিন অবস্থার সীমা বিলীন হয়। তুরীয় অবস্থাই ব্রহ্মজ্ঞান—যেখানে ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্বৈততা মুছে যায়, আর চেতনা নিজের নিরুপাধিক স্বরূপে স্থিত হয়। কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই ত্রিপুণ্ড্রকে বলা হয় “ত্রিক”—শিব, শক্তি ও নর (জীব)-এর ঐক্যের প্রতীক। এখানে দেবী কেবল ধ্বংস করেন না; তিনি ঐক্য ঘটান—শিবের চৈতন্য, শক্তির গতি এবং জীবের অভিজ্ঞতা একত্রে মিলে এক অনন্ত স্পন্দনে রূপ নেয়।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে, কালীর এই দ্বৈত প্রকাশ মানুষকে শেখায়—ভয়কে দমন নয়, উপলব্ধি করো। ভয় আসলে অচেতনের সেই ছায়া, যা আলো পেলে বিলীন হয়। কালীর ভয়ঙ্কর ভঙ্গি সেই ছায়াকে প্রকাশ করে; আর তাঁর হাস্য তা গ্রহণ করে। এই গ্রহণই মানসিক মুক্তি—যেখানে মানুষ বুঝতে শেখে, ধ্বংসই আসলে পুনর্জন্মের আরেক নাম। তাঁর রূপ তাই আমাদের অন্তর্জীবনের গভীরতম সত্য উচ্চারণ করে—ভয় আর করুণা, মৃত্যু আর মুক্তি—সব একই চেতনার দুই তরঙ্গ, আর কালী সেই এক তরঙ্গের চিরন্তন নৃত্য।

তাঁর দাঁত (দশন) রক্তবর্ণ—এটি মায়ার গ্রাসশক্তি ও সংস্কারদহনের প্রতীক। তান্ত্রিক অর্থে রক্ত মানে জীবনের রস, শক্তি, যা কালী নিজের মধ্যে টেনে নেন; এটি ধ্বংসের নয়, শুদ্ধির প্রক্রিয়া। অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, মায়ার গ্রাস মানে অজ্ঞানের স্বয়ং-লয়, যেখানে চেতনা নিজের ছায়ারূপী মায়াকে গ্রহণ করে জ্ঞানে পরিণত করে। মনোবিশ্লেষণীয়ভাবে, এটি মানুষের অবচেতন প্রবৃত্তি, ভয় এবং সংস্কারের সম্মুখীন হওয়া—এক catharsis—যার ফলে মানসিক পরিশোধন ঘটে।

তাঁর চোখ রক্তাভ ও দীপ্ত। এই দীপ্তি দ্বৈত নয়; এটি জ্ঞান (বোধশক্তি) ও ক্রিয়া (কর্মশক্তি)-র ঐক্যের প্রতীক। শাক্ত ও শৈব দর্শনে এই দুই শক্তি পরস্পরের সম্পূরক—বিমর্শ ছাড়া প্রকাশ অর্থহীন, আর প্রকাশ ছাড়া বিমর্শ নিষ্ক্রিয়। তাই তাঁর রক্তাভ দৃষ্টি মানে জ্ঞানের অগ্নি ও ক্রিয়ার শক্তি একত্রে জাগ্রত। এই দৃষ্টি মায়াকে ভেদ করে সত্যকে উদ্‌ভাসিত করে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এটি সচেতনতার সেই অবস্থাকে নির্দেশ করে, যেখানে মানুষ নিজের অন্তর্গত শক্তি ও উপলব্ধিকে একত্রে ব্যবহার করে—অর্থাৎ সম্পূর্ণ সংহত চেতনা (integrated awareness)।

অদ্বৈত বেদান্তে সম্পূর্ণ সংহত চেতনা বলতে বোঝায় সেই অবস্থাকে, যেখানে চেতনা আর বিভক্ত নয়—যেখানে “আমি” ও “এটি”, “সচেতন” ও “চেত্য”, “বিষয়” ও “বস্তু”-র ভেদ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। এটি সেই অভিজ্ঞতা, যেখানে আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত—নির্বিশেষ, অবিভক্ত, সর্বব্যাপী।

সাধারণ চেতনা সবসময় খণ্ডিত—মন একদিকে ইন্দ্রিয়, অন্যদিকে চিন্তা-স্মৃতি-অনুভূতি নিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন থাকে। কিন্তু সংহত চেতনা মানে এই বিচ্ছিন্ন প্রবাহগুলির এক অভ্যন্তরীণ ঐক্যে মিলন। যেমন নদীগুলি মিলিত হয়ে সমুদ্রে একাকার হয়, তেমনি ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও আত্মার সমস্ত স্তর এক হয়ে যায়।

অদ্বৈতের ভাষায়, এটি তুরীয় অবস্থা—যেখানে জাগ্রত, স্বপ্ন, সুপ্তি—এই তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে চেতনা নিজেকে উপলব্ধি করে “সাক্ষীস্বরূপে।” সেই সাক্ষী চেতনা কোনো ক্রিয়া করে না, কিন্তু সমস্ত ক্রিয়ার ভিত্তি। এই অবস্থা হলো আত্মবোধ বা আত্মজ্ঞানের পরিণতি—যেখানে চেতনা কেবল নিজের মধ্যেই স্থিত।

মনস্তাত্ত্বিক অর্থে, এটি “self-integration”—অর্থাৎ অবচেতন, চেতন ও অতিচেতনের স্তর একীভূত হয়ে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিজ্ঞতায় মিলে যায়। এই অবস্থায় মানুষ আর ভেতর-বাহিরে, ভালো-মন্দে, কর্তা-কর্মে বিভক্ত থাকে না। মন স্থিত, কিন্তু সজাগ; কর্ম ঘটে, কিন্তু অহং থাকে না।

সম্পূর্ণ সংহত চেতনা মানে সেই জাগরণ, যেখানে মানুষ আর ব্যক্তিগত সত্তা নয়, পরম সত্তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অদ্বৈত ভাষায়—“যত্র বিশ্বং ভবতি একরূপম্, তদ্বৈ চৈতন্যম্।” অর্থাৎ, "যেখানে সমস্ত বিশ্ব একরূপ হয়ে যায়, নিশ্চয়ই তা-ই চৈতন্য।" সেটিই চেতনার প্রকৃত সংহতি।

তাঁর অলঙ্কারহীনতা—নাকছাবি, কর্ণফুল, মুকুটের অনুপস্থিতি—এই বার্তা দেয় যে, তিনি “নিরলঙ্কার সত্য,” মায়ার অতীত। অদ্বৈত বেদান্ত এবং নির্বিকল্প জ্ঞান সংক্রান্ত ধারণার একটি দার্শনিক সংক্ষেপ—“নির্বাচনা ন তস্য কোনোপাধিঃ”—সত্যকে কোনো রূপ বা অলঙ্কারে বাঁধা যায় না। অলঙ্কার মানে সীমা; আর কালী সেই সীমারও অতীত। অদ্বৈত বেদান্তে এই অবস্থা হলো নির্গুণ ব্রহ্ম—যিনি কোনো বিশেষণের দ্বারা বর্ণিত নন। কাশ্মীর শৈব দর্শনে, এটি নিরুপাধি স্পন্দ—চেতনার শুদ্ধতম রূপ, যেখানে আর কোনো সীমাবদ্ধতা বা প্রকাশের প্রয়োজন নেই।

তাঁর সহচরী ডাকিনী ও যোগিনীগণ, বিভিন্ন তন্ত্রশক্তির প্রতীক। তারা চেতনার নানা গতি, অভ্যন্তরীণ তত্ত্ব ও স্তরকে প্রকাশ করে। ডাকিনীরা মানসিক শক্তির প্রতীক, যোগিনীরা হলেন সেই শক্তি, যা চেতনা ও শরীরকে সংযুক্ত করে। কাশ্মীর শৈব মতে, তারা শক্তির তত্ত্ববাহিকা, অর্থাৎ চেতনার বহুমুখী প্রকাশ। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এরা মানসিক শক্তির বিভিন্ন প্রতিরূপ—instinct, emotion, intuition—যা সমন্বিত হলে পূর্ণ চেতনা উদ্‌ভাসিত হয়।

তাঁর পশুচর্ম, বিশেষত বাঘচর্ম, শক্তির জয় ও প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। বাঘ তীব্র প্রবৃত্তি, কামনা ও ক্রোধের প্রতীক; আর কালী সেই প্রবৃত্তিগুলিকে বশ করে তাঁর আসন বানিয়েছেন। অদ্বৈত বেদান্তে এটি কামনা-দমন নয়, কামনার রূপান্তর—যেখানে ইচ্ছাশক্তি আত্মবোধে মিলিত হয়। কাশ্মীর শৈব মতে, এটি চেতনার স্বাধীনতা (svatantrya)—যা প্রবৃত্তিকে নাশ না করে চেতনার সেবায় পরিণত করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি “sublimation”—যেখানে প্রাথমিক প্রবৃত্তি আত্মজাগরণের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

সবশেষে, তাঁর পায়ের নিচে রক্তাভ পদ্ম, যা মৃত্যু-পরবর্তী মুক্তির প্রতীক। পদ্ম সর্বদা চেতনার বিকাশের চিহ্ন; কিন্তু এখানে পদ্ম রক্তাভ—অর্থাৎ মৃত্যু ও জীবনের ঐক্য। এটি বোঝায়, চেতনা কখনও বিনষ্ট হয় না; মৃত্যুও তার রূপান্তর মাত্র। অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এটি সেই অবস্থা, যেখানে “মৃত্যু মৃত্যুম্‌ গচ্ছতি”—মৃত্যুরও মৃত্যু ঘটে। কাশ্মীর শৈব মতে, এটি চেতনার স্বতঃপ্রকাশ—লয় থেকে উদ্‌ভব, উদ্‌ভব থেকে লয়, এক চিরন্তন চক্র।

“মৃত্যু মৃত্যুম্‌ গচ্ছতি”—এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বাক্যটি জগৎ ও আত্মার প্রকৃত সম্পর্কের মৌল সত্য প্রকাশ করে। কঠোপনিষদ (২.১.১০)-এর এই বাণী কেবল এক ধর্মীয় সতর্কবাণী নয়, এটি চেতনার তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে ভেদদৃষ্টি বা বহুত্বদর্শনই মৃত্যুর কারণ, আর অভেদবোধ বা একত্বজ্ঞানই অমৃতত্বের পথ।

যে-ব্যক্তি “নানা পশ্যতি”—অর্থাৎ, চেতনার একত্বকে না দেখে বিভক্ত জগৎ, বহু সত্তা, বহু কর্তা ও বহু ভোক্তার ধারণায় আবদ্ধ থাকে—সে প্রকৃতপক্ষে অবিদ্যার দ্বারা আচ্ছন্ন। এই অবিদ্যা তাকে আত্মস্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ফলে সে নিজের ভিতরের চিরন্তন, অজন্মা সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারে না। সেই কারণেই উপনিষদ বলে—সে “মৃত্যুম্‌ মৃত্যুম্‌ গচ্ছতি”—অর্থাৎ, এক মৃত্যুর পর আরেক মৃত্যুর দিকে গিয়ে পতিত হয়, বা ক্রমাগত জন্ম-মৃত্যুর পুনরাবৃত্তিতে আবদ্ধ থাকে।

অদ্বৈত বেদান্ত ব্যাখ্যা করে—“মৃত্যু” এখানে কেবল শারীরিক মৃত্যুর অর্থে নয়, বরং প্রতিটি সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা, প্রতিটি অহংকেন্দ্রিক আসক্তি, প্রতিটি দ্বৈতবোধই এক একটি ক্ষণিক “মৃত্যু।” যতক্ষণ মানুষ নিজেকে পৃথক “আমি” বলে ভাবে, ততক্ষণ তার প্রতিটি অভিজ্ঞতাই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষণস্থায়ী—তাই তা মৃত্যুর সমান। কিন্তু যে-ব্যক্তি দেখে, “আমি ব্রহ্ম”—সে মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.১৪)-এ বলা হয়েছে, “যথা প্রাচ্যো ভবতি, তদা তম্‌ আত্মানমেবাবিদ্‌”—যখন মানুষ নিজের আত্মাকে চিনে ফেলে, তখন সে আর মৃত্যুকে চেনে না, কারণ তার কাছে মৃত্যুই আর একটি পরিবর্তনমাত্র।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের আলোচনায়ও এই শ্লোকটির গভীর অনুরণন আছে। সেখানে বলা হয়, “দ্বৈতদর্শনই আবরণ”—যখন চেতনা নিজেকে ও জগৎকে আলাদা ভাবে দেখতে শুরু করে, তখনই মায়ার পর্দা ঘন হয়। অভিনবগুপ্ত বলেন, “দ্বৈতবোধো মৃত্যু”—দ্বৈতবোধই মৃত্যু, কারণ সেটিই আত্মচেতনার বিচ্ছেদ। কিন্তু যখন সেই চেতনা নিজের ঐক্য উপলব্ধি করে—যখন সে জানে, শিব ও শক্তি, দেখা ও দেখনেওয়ালা এক—তখনই সে জীবন্মুক্ত হয়; সে আর “মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে” নয়, বরং “অমৃত থেকে অমৃতে” গমন করে।

মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে, “মৃত্যু মৃত্যুম্‌ গচ্ছতি” মানে হলো—যে-মন সর্বদা বিভাজন, বিচার, “আমি বনাম তুমি”-এর দ্বন্দ্বে বেঁচে থাকে, সে ক্রমাগত মানসিক মৃত্যু বরণ করছে। প্রতিটি আসক্তি, প্রতিটি ভয়, প্রতিটি প্রত্যাখ্যান—এসবই মনকে মেরে ফেলে। অথচ যখন মন নিজের দ্বৈততাকে অতিক্রম করে—যখন সে একীভূত চেতনার (integrated awareness) স্তরে পৌঁছায়—তখন মৃত্যু আর শত্রু নয়, বরং রূপান্তরের দ্বার।

উপনিষদ ঘোষণা করছে: যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যস্য হৃদি শ্রিতাঃ। অথ মর্ত্যোঽমৃতো ভবত্যত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।। (কঠোপনিষদ, ২.৩.১৪) অর্থাৎ, মুক্তি বা অমরত্ব লাভের জন্য মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। যখন একজন ব্যক্তি তার হৃদয়ে বাসা বাঁধা সমস্ত জাগতিক কামনা-বাসনা (Kāmāḥ) সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে বা মুক্ত হয়ে যায়, তখন সেই মরণশীল মানুষ (Martya) এই জীবিত অবস্থাতেই (Atra) অমরত্ব লাভ করে (Amṛtaḥ bhavati) এবং ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে। এটি হলো জীবন্মুক্তির আদর্শ—কর্মফল এবং আসক্তির বন্ধন থেকে মুক্তি।

তাই “মৃত্যু মৃত্যুম্‌ গচ্ছতি” হলো আত্ম-অজ্ঞতার পরিণতি, আর “অমৃতত্বম্‌ অশ্নুতে” (অমৃতকে লাভ করে)—এ হলো জ্ঞানীর অবস্থান। যে বহুত্ব দেখে, সে মৃত্যুর পথে; আর যে একত্ব দেখে, সে চিরঞ্জীব। অদ্বৈতের ভাষায়: “যঃ পশ্যতি একং সর্বত্র, ন তেন মৃত্যুঃ স্পর্শ্যতে।” (ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ-এর মুক্তির ধারণা থেকে উদ্‌ভূত) অর্থাৎ, "যিনি সর্বত্র একত্ব (অভিন্ন সত্তা) দর্শন করেন, মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করে না।"

কালীর রূপ কেবল এক পৌরাণিক দৃশ্য নয়; এটি এক সম্পূর্ণ দার্শনিক মানচিত্র, যেখানে ধ্বংস মানে পুনর্গঠন, ভয় মানে জাগরণ, আর অন্ধকার মানে লুকানো আলো। আধুনিক মনোবিজ্ঞানও এই প্রতীকতাকে আত্মরূপান্তরের এক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখে—যেখানে মানুষ নিজের গভীরতম স্তরকে চিনে নেয়, গ্রহণ করে এবং রূপান্তরিত হয়। কালীর মুখে সেই মৃদু হাস্য যেন ঘোষণা করে—“ভয় নয়, চেতনা সর্বত্র।”

কালীর ঐতিহ্যবাহী অবস্থান—শ্মশানভূমি—শুধু ভয় বা মৃত্যু নয়, বরং সমস্ত রূপ ও সীমার বিলয়ের প্রতীক। দর্শনের ভাষায়, শ্মশান হলো এক প্রতি-কাঠামো (anti-structure), এমন এক প্রান্তিক স্থান, যেখানে সমস্ত সামাজিক, বস্তুগত ও ব্যক্তিগত পরিচয় বিলুপ্ত হয়। এখানে দেহ ছাই হয়ে যায়, রূপ হারায়, কেবল চেতনার নীরব উপস্থিতি থেকে যায়। এই কারণেই তন্ত্রে শ্মশানকে বলা হয় পরম শুদ্ধির ক্ষেত্র—যা আর কিছুই ঢেকে রাখে না, সব সত্য নিজের নগ্নরূপে প্রকাশিত হয়।

সাধকের জন্য এটি বাহ্যিক স্থান নয়, এক অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা। তান্ত্রিক সাধনা শেখায়, নিজের শরীর ও মনই সেই শ্মশান, যেখানে অহং, ভয় ও আসক্তির দাহে সীমিত আত্মা বিলীন হয় এবং তখনই উদ্‌ভাসিত হয় সেই অবিনশ্বর আত্মা—যে মৃত্যুকে অতিক্রম করেছে। শ্মশান তাই জীবনের নাশ নয়, চেতনার পুনর্জন্মের ক্ষেত্র; এটি সেই মুহূর্ত, যখন জীব অনুভব করে—সে দেহ নয়, সে চেতনা।

এই শ্মশানচিত্রের কেন্দ্রেই দেখা যায় কালীকে—নগ্ন, দীপ্ত, রক্তস্নাত—শিবের নিস্তরঙ্গ বক্ষের উপর নৃত্যরত। এই দৃশ্য অদ্ভুত, কিন্তু এর দার্শনিক অর্থ গভীর। শিব এখানে “চিৎ”—বিশুদ্ধ চেতনা, যা স্থির, নিস্পন্দ ও স্বপ্রকাশিত। আর কালী সেই চেতনার শক্তিরূপ, যিনি গতি, ক্রিয়া ও প্রকাশের প্রতীক। শিবকে তাই বলা হয় শব—অচল, নিস্তরঙ্গ—আর শক্তিই সেই নিস্তরঙ্গ চেতনায় প্রাণ সঞ্চার করে।

কালী যখন শিবের বুকের উপর দাঁড়ান, তিনি কোনো আধিপত্য দেখান না; বরং এই অবস্থানই বোঝায় যে, স্থির চেতনা ও গতিশীল শক্তি একে অপরের পরিপূরক। চেতনা ছাড়া শক্তি অন্ধ, শক্তি ছাড়া চেতনা জড়—এই দুইয়ের মিলনেই সৃষ্টি ও চেতনার লীলা সম্ভব।