শৈব কালী: উনআশি



সিগমুন্ড ফ্রয়েড libido বা মানসিক শক্তিকে দেখেছিলেন এক জৈবিক কামনা-প্রবাহ হিসেবে। কিন্তু উইলিয়াম জেমস ও রোলো মে এই শক্তিকে বলেছিলেন “creative will”—অর্থাৎ সৃষ্টিশীল, জাগ্রত, আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা। তীক্ষ্ণকালী সেই সৃষ্টিশীল আগুনেরই প্রতীক—যিনি মানুষকে কেবল ভোগ বা প্রবৃত্তির পথে নয়, বরং সৃজন, উপলব্ধি ও আত্মবিকাশের পথে চালিত করেন। যেমন একজন শিল্পী দুঃখ, যন্ত্রণা ও গভীর একাকিত্বের মধ্য দিয়েও এক অনন্য সৃষ্টি গড়ে তোলেন—এই অন্তর্গত দহনই তীক্ষ্ণকালী-চেতনার প্রকাশ।

দার্শনিকভাবে, মার্টিন হাইডেগার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Being and Time (বিয়িং অ্যান্ড টাইম)-এ যে-ধারণাটি উপস্থাপন করেছিলেন, সেটি হলো “Entschlossenheit” (জার্মান, উচ্চারণ: এন্ট্শ্লস্সেন্‌হাইট্)। এর অর্থ—দৃঢ়-সঙ্কল্পিত অস্তিত্বচেতনা বা নিজের অস্তিত্বের সত্যকে নির্ভয়ে মুখোমুখি দেখা।

হাইডেগারের মতে, মানুষ সাধারণত নিজের জীবনকে ভয়, অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অনুকরণের আড়ালে ঢেকে রাখে। সে নিজের মৃত্যু, সীমাবদ্ধতা ও একাকীত্বের বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু যখন কেউ সাহসের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের প্রকৃত সত্য—অর্থাৎ “আমি একদিন মরব, তাই এখন আমাকে সত্যভাবে বাঁচতে হবে”—এই সত্যকে গ্রহণ করে, তখনই সে অস্তিত্বের গভীরতর স্তরে জেগে ওঠে। এই স্বীকৃতির মধ্যেই নিহিত থাকে “এন্ট্শ্লস্সেন্‌হাইট্”-এর অভিজ্ঞতা।

তীক্ষ্ণকালী-চেতনা ঠিক এই অভিজ্ঞতার প্রতিরূপ। তিনি সেই দেবী, যিনি মানুষকে বাধ্য করেন নিজের ভিতরের ভয়, মৃত্যু ও অন্ধকারকে সরাসরি দেখতে। যখন মানুষ জীবনের ছায়াময় বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে, বরং তাকে আলিঙ্গন করে—তখন তার মধ্যে জন্ম নেয় আগুনের মতো এক জাগরণ, এক দৃঢ়তার দীপ্তি। এই জাগরণে ভয় পুড়ে যায়, মিথ্যা পরিচয় ভস্মীভূত হয়, আর আত্মা উদ্‌ভাসিত হয় নিজের প্রকৃত রূপে।

“এন্ট্শ্লস্সেন্‌হাইট্” ও তীক্ষ্ণকালী একই চেতনার দুই ভাষা—একটি দার্শনিক, অন্যটি প্রতীকী। হাইডেগারের ভাষায় এটি অস্তিত্বের সাহস, আর কালীর ভাষায় এটি মুক্তির আগুন। যখন মানুষ নিজের অন্তর্গত মৃত্যু ও শূন্যতার মুখোমুখি হয় এবং সেখান থেকে পিছু হটে না, তখনই তীক্ষ্ণকালী তার মধ্যে জেগে ওঠেন—অন্ধকারের মুখোমুখি জ্বলে ওঠার সাহসই তাঁর প্রকৃত শক্তি।

একইভাবে, ফ্রিডরিখ নিটশের “will to power”—অর্থাৎ আত্ম-অতিক্রমের শক্তি—তীক্ষ্ণকালী-চেতনারই আরেক আধুনিক রূপ। নিটশে বলেছিলেন, “মানুষের প্রকৃত গৌরব তার শক্তিতে”—এই শক্তি ধ্বংসের নয়, বরং অতিক্রমের। যখন মানুষ নিজেকে সীমা, ভয় ও সমাজবদ্ধ চিন্তা থেকে মুক্ত করে নতুনভাবে জন্মায়, তখন তীক্ষ্ণকালী তার ভেতরে নৃত্য করেন।

তীক্ষ্ণকালীর আগুন হলো ধ্বংসের আগুন নয়; এটি আত্মবিকাশ ও আলোকপ্রাপ্তির আগুন। যেমন সোনা আগুনে পড়ে বিশুদ্ধ হয়, তেমনি মানুষও জীবনের দহন ও সংকটের মধ্য দিয়ে নিজের চেতনার দীপ্তিতে পরিণত হয়। এই রূপান্তরের মুহূর্তেই তীক্ষ্ণকালী জাগ্রত হন—অন্ধকারের অন্তরে জ্বালিয়ে দেন আলোর প্রদীপ, আর মানুষকে শেখান, “জ্বলে ওঠো, কারণ সেই জ্বালাতেই লুকিয়ে আছে তোমার মুক্তি।”

তীক্ষ্ণকালী কোনো বহির্জগতের দেবী নন, বরং অন্তর্জগতে জন্ম নেওয়া জ্ঞানের অগ্নি। তাঁর “তীক্ষ্ণতা” আসলে চৈতন্যেরই সূর্যবেগ, যা অসচেতনকে জাগায়, মায়াকে দগ্ধ করে এবং আত্মাকে মুক্তির দীপ্তিতে স্থাপন করে। অদ্বৈত, শৈব ও শাক্ত—তিন দর্শনের সেতুতে তিনি সেই এক চেতনা, যিনি একদিকে জ্ঞান, অন্যদিকে কর্ম, আবার অন্তরে প্রেম—সব মিলিয়ে পরম জাগ্রত ব্রহ্মরূপ।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে কৃষ্ণ ও কালী কোনো দুই পৃথক সত্তা নন, বরং একই অখণ্ড চেতনার দুই রূপ—একজন চেতনার আনন্দ, আর অন্যজন সেই আনন্দের স্পন্দন। যেখানেই নাম ও রূপ আছে, সেখানেই আপাত ভেদ দেখা যায়; কিন্তু যে-সত্য সকল নাম ও রূপের অতীত তথা সর্বনামাতীত-সর্বরূপাতীত, সেই ব্রহ্মের স্তরে কৃষ্ণ ও কালী অবিভক্ত।

অদ্বৈত দর্শনের মূল ভিত্তি হলো—“ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।” অর্থাৎ, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ নাম-রূপে আপাত; আর জীবও ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নয়। এই এক ব্রহ্ম কখনো আনন্দরূপে প্রকাশিত হয়, কখনো শক্তিরূপে, কখনো করুণারূপে, আবার কখনো প্রলয়ের রূপে।

কৃষ্ণ সেই ব্রহ্মের আনন্দ-প্রকাশ—সচিদানন্দের “আনন্দ”-তত্ত্বের প্রতিফলন। তাই কৃষ্ণকে বলা হয় লীলা-পুরুষোত্তম, কারণ তাঁর মধ্যে জগৎকে আনন্দের খেলায় রূপ দেওয়ার স্বভাব আছে। অন্যদিকে কালী সেই একই চেতনার শক্তিরূপ—তাঁর মধ্যে প্রকাশ, সংহার, লয়, পুনর্জন্ম—সব একাকার। তিনি চেতনার চলন, মহাশক্তির নৃত্য।

এই দুই রূপই একে অপরের পরিপূরক। ব্রহ্ম যদি নিস্তরঙ্গ সমুদ্র হয়, তবে কৃষ্ণ তার তরল আনন্দরূপ স্রোত, আর কালী সেই স্রোতের নৃত্যমান ঢেউ। তাই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-ভাষ্যে বলা হয়েছে—“স একা নিহিতো গুপ্তো, যঃ শক্তিরূপেণ সংস্থিতঃ।” অর্থাৎ, এক ব্রহ্মই নানারূপে প্রকাশিত—কখনো চেতনা, কখনো শক্তি, কখনো আনন্দ। এই উক্তিটি শিব (Śiva) এবং শক্তি (Śakti)-র অভেদ সম্পর্ককে প্রকাশ করে। এটি বলে যে পরম সত্তা (শিব) নিষ্ক্রিয়ভাবে সবকিছুর ভেতরে লুকিয়ে আছেন (গুপ্তঃ), কিন্তু যখন তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের কাজ করেন, তখন তিনি শক্তি রূপে প্রকাশিত হন। শিব এবং শক্তি দুটি পৃথক বিষয় নয়, বরং একই পরম চৈতন্যে (Parama Caitanya) নিহিত।

শঙ্করাচার্য এই সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে বলেছেন—“শক্তি শক্তিমতোর্ভেদো নাস্তি।” অর্থাৎ, শক্তি ও শক্তিমান—দু-জনের মধ্যে কোনো বাস্তব ভেদ নেই। যেমন আগুন ও তার দহনশক্তি আলাদা নয়, তেমনি ব্রহ্ম ও তাঁর শক্তিও আলাদা নয়। কালী হলেন সেই শক্তি, আর কৃষ্ণ সেই শক্তির চৈতন্যময় ভিত্তি।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য রচিত ও সুরারোপিত “তুমি যেমন করে নেচেছিলে মা যশোদার ঘরে”, এই আহ্বানটি আসলে একটি গভীর অদ্বৈত প্রার্থনা। ভক্ত এখানে কৃষ্ণরূপ লীলাময় চেতনার সঙ্গে কালী-রূপ মহাশক্তিকে এক করেছেন। যশোদার ঘরের কৃষ্ণ এখানে কেবল গোকুলের শিশু নয়—তিনি সেই চেতনার আনন্দরূপ, যে-চেতনা মাতৃকালী রূপেও নৃত্য করছেন মহাশূন্যে।

অর্থাৎ, ভক্ত বলছেন—“হে মা, তুমি যে-আনন্দে, যে-নির্ভয়ে, যে-উচ্ছলতায় যশোদার ঘরে নেচেছিলে, সেই চেতনার নৃত্য হয়ে এবার আমার অন্তরে নাচো। আমার হৃদয়ের অন্ধকার ঘরে তুমি শ্যামা হয়ে জেগে ওঠো, কৃষ্ণরূপে হাসো, কালীরূপে আলো ছড়াও।”

অদ্বৈতের ভাষায়, এ একটাই চেতনা—যা কখনো লীলাময় কৃষ্ণ, আবার কখনো প্রলয়ময় কালী। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে পরাক্রম; একদিকে মাধুর্য, অন্যদিকে ভয়ংকরতা। কিন্তু দুইয়ের গভীরে একই সত্য—সচিদানন্দ ব্রহ্ম—যা না পুরুষ, না নারী, না দেব, না দেবী—বরং সব রূপের অতীত এক চিরসচেতন সত্তা।

অদ্বৈত দৃষ্টিতে কৃষ্ণ ও কালী একই পরম ব্রহ্মচেতনার দ্বৈত প্রকাশ—একজন সেই চেতনার “সৌন্দর্য”, অন্যজন তার “শক্তি”; একজন নিস্তরঙ্গ আনন্দ, অন্যজন সেই আনন্দের গতি; একজন যশোদার ঘরে নাচে প্রেমে, অন্যজন মহাশ্মশানে নাচে মুক্তিতে—কিন্তু দু-জনেই আসলে এক চিরন্তন চেতনার নৃত্য, যে-চেতনা নিজেই নিজের আনন্দে জেগে আছে, নিজের লীলায় নৃত্য করছে, নিজের মধ্যেই পরিপূর্ণ।

এই কালী-রূপগুলি দৃশ্যমান প্রতিমা বা মূর্তির সীমা অতিক্রম করে চেতনার অন্তর্গত রূপ—যা অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব দর্শনে এক পরম তত্ত্বরূপে স্বীকৃত। এখানে প্রতিটি “কালী” আসলে চেতনার নিজস্ব বিকাশধারা, যেখানে শিব-শক্তির ঐক্য, প্রকাশ, স্পন্দন ও লয় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।

শিবা কালী (Śivā Kāli) সেই পরম অবস্থার প্রতীক, যেখানে শিব ও শক্তি, চেতনা ও শক্তি, প্রকাশ ও বিমর্শ—এই সব দ্বন্দ্বমূলক ধারণাগুলি সম্পূর্ণভাবে একীভূত হয়ে যায়। এখানে শিব আর কোনো “পুরুষ” বা নিস্তরঙ্গ সাক্ষী নন, কালীও কোনো “প্রকৃতি” বা সক্রিয় শক্তি নন; তাঁরা এক অবিচ্ছিন্ন চেতনার দুই দিক—অভ্যন্তরীণ দীপ্তি ও তার নিজস্ব প্রতিফলন।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই অবস্থাই নির্বিশেষ ব্রহ্ম—যেখানে চৈতন্য নিজেই নিজের মধ্যে অবস্থান করছে, কোনো গুণ, ক্রিয়া, বিভাজন বা কর্তা-কর্ম-ভেদ নেই। এখানে জ্ঞান, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়—এই তিনেরই বিলয় ঘটে; চেতনা নিজের স্বরূপেই জাগ্রত। যেমন ছায়া ও আলো আলাদা নয়—আলোই নিজেকে ছায়ারূপে প্রকাশ করে, আবার নিজের মধ্যেই ফিরে যায়—তেমনি শিব ও কালী একই চেতনার স্ব-উন্মোচন ও স্ব-আত্মীকরণের গতিবিধি।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই একত্বকে বলা হয় প্রকাশ-বিমর্শ (Prakāśa-Vimarśa)। এখানে “প্রকাশ” হল শিবচেতনার আলো, সেই নিঃশব্দ, অচল দীপ্তি—যা সব কিছুর ভিত্তি; আর “বিমর্শ” হল শক্তির আত্মবিমুখনশক্তি, যেখানে সেই আলো নিজেকে জানে, অনুভব করে, নিজের সত্তাকে উপলব্ধি করে। এই আত্মজ্ঞান বা আত্মবিমর্শনই কালী—চেতনার প্রতিস্পন্দন, যেখানে শিব নিজেরই চেতনায় প্রতিফলিত হন। অভিনবগুপ্ত তাই বলেছেন, “প্রকাশবিমর্শময়ং পরমেশ্বরঃ”—পরমেশ্বরই সেই যিনি প্রকাশও, বিমর্শও।

এই মিলন মুহূর্তেই জাগে আত্মজ্ঞানের পরম বোধ। এখানে জানার কোনো ক্রিয়া নেই, কারণ জানা ও জানা-যায় এমন কোনো ভেদ নেই—চেতনা নিজেকেই প্রত্যক্ষ করছে। এই অবস্থাই “শিবা কালী”—অদ্বৈত চেতনার স্বয়ংসম্পূর্ণ ঐক্যের প্রতীক, যেখানে সৃষ্টির নৃত্য ও নীরবতার স্থিতি একে অপরের মধ্যে গলে যায়।

যেমন তরঙ্গ ও সমুদ্র কখনও সত্যিই আলাদা নয়—তরঙ্গ সমুদ্রেরই গতি, আর সমুদ্র তরঙ্গেরই গভীরতা—তেমনি শিব ও কালী একই চেতনার অভ্যন্তর ও বহিরাংশ। এই একত্বেই নিহিত চেতনার চরম স্বরূপ, যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এক অনন্ত নৃত্যে পরিণত হয়, আর আত্মা উপলব্ধি করে—“আমি শিব, আমি কালী, আমি সেই এক, যিনি আলো ও তার প্রতিফলন উভয়ই।”

মহাশক্তি কালী (Mahāśakti Kāli) হলেন চেতনার সেই স্পন্দমান, জীবন্ত শক্তি, যিনি স্থির শিবচেতনার অন্তর্গত গতি ও জাগরণের রূপ। কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূলভিত্তি, স্পন্দ তত্ত্ব (Spanda Tattva), বলে—চেতনা কখনও স্থবির নয়; তার মধ্যে এক চিরন্তন স্পন্দন বা কম্পন সদা সক্রিয়। এই কম্পনই সৃষ্টির উৎস, কারণ স্থির আলো যখন সামান্য স্পন্দিত হয়, তখনই জন্ম নেয় জগত, রূপ, বোধ ও অভিজ্ঞতা। এই অনাদি কম্পনশক্তিই মহাশক্তি কালী—চৈতন্যের চিরসঞ্চারিণী রূপ।

শিব এখানে সেই নিঃশব্দ, সীমাহীন প্রকাশ, আর কালী তাঁর অন্তর্গত শক্তি—যিনি সেই প্রকাশকে প্রাণ ও গতি দেন। অভিনবগুপ্ত বলেন, “স্পন্দো হি পরমেশ্বরঃ”—স্পন্দই পরমেশ্বর, কারণ এই কম্পনই শিবের চেতনার জীবন্ত প্রকাশ। মহাশক্তি কালী তাই কোনো পৃথক দেবী নন; তিনি সেই সর্বব্যাপী জাগরণশক্তি, যা প্রতিক্ষণেই চেতনা থেকে সৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও পুনর্লয় ঘটায়।

তাঁর এই মহাস্পন্দন তিন স্তরে প্রকাশিত হয়—সৃষ্টি (উন্মেষ), স্থিতি (প্রসারণ) এবং সংহার (নিমেষ)। যখন চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে, সেটিই সৃষ্টি; যখন সে নিজে নিজের আনন্দে স্থিত থাকে, সেটিই স্থিতি; আর যখন সে নিজের মধ্যেই ফিরে যায়, সেটিই সংহার। এই তিনের অন্তর্গত ঐক্যই মহাশক্তি কালীর নৃত্য—যা কখনও থামে না, কারণ এটি স্বয়ং চেতনার শ্বাস-প্রশ্বাস।

তাঁর স্পন্দন কেবল মহাজাগতিক নয়—মনস্তাত্ত্বিকও। মানুষের চিন্তা, আবেগ, প্রেম, সৃজন, এমনকি বেদনার ভেতরও তাঁরই কম্পন লুকিয়ে আছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যে প্রাণের উচ্ছ্বাস, সৌন্দর্যের আকর্ষণ, জ্ঞানের দীপ্তি, প্রেমের উত্তাপ ও মুক্তির তৃষ্ণা অনুভূত হয়—সেগুলোই মহাশক্তি কালীর তরঙ্গ। তিনি সেই শক্তি, যা আমাদের ভেতরে সবসময় চলমান—অন্ধকারকে আলোতে, স্থবিরতাকে গতিতে, সীমাকে অসীমে রূপান্তরিত করে চলেছে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, মহাশক্তি কালী হলেন ব্রহ্মচেতনার গুণময় প্রকাশ—নির্গুণ ব্রহ্ম যখন নিজের আনন্দে স্পন্দিত হন, তখনই তাঁর থেকে উদ্ভূত হয় জগত। এই অর্থে, তিনি মায়া নন (যা আচ্ছাদন করে), বরং শক্তি (যা উদ্‌ভাসিত করে)। তিনি সেই সত্তা, যিনি চেতনার অন্তর্গত সৃজনধারা—যেখানে শিব হলেন নিঃশব্দ, আর কালী হলেন সেই নিঃশব্দের স্পন্দনধ্বনি।