তাঁকে বোঝা মানে জীবনকে বোঝা, কারণ তিনি জীবনের নিজস্ব গতি ও রূপান্তরের প্রতীক। তাঁর নৃত্য থেমে গেলে, জীবন থেমে যায়; তাঁর কম্পন নিভে গেলে, সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়। তাই মহাশক্তি কালী কেবল ব্রহ্মাণ্ডের উৎস নন—তিনি প্রতিটি হৃদয়ের নাড়ির শব্দ, প্রতিটি নিঃশ্বাসের ছন্দ, প্রতিটি জাগরণের দীপ্তি।
মহাশক্তি কালী সেই অনন্ত স্পন্দন, যেখানে শিবের নীরবতা ও শক্তির গতি এক হয়ে যায়। তাঁর মধ্যেই সমস্ত রূপ জন্মায়, বিকশিত হয়, আবার ফিরে যায় তার উৎসে। এই চক্রই জীবন, এই চক্রই চেতনার নৃত্য, আর এই নৃত্যই মহাশক্তি কালীর চিরন্তন লীলা।
নির্গুণ কালী (Nirguṇā Kāli) সেই চেতনার প্রতীক, যিনি সমস্ত রূপ, গুণ, ধর্ম, সীমা ও দ্বৈততার ঊর্ধ্বে। তিনি কোনো রঙে, কোনো আকারে, কোনো ধারণায় বন্দি নন—কারণ তিনি স্বয়ং চেতনার নিখাদ পরম অবস্থান। এখানে কালী আর কোনো ক্রিয়াশীল শক্তি নন, কোনো জাগতিক রূপ নন; তিনি চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম—যিনি নিজেই আলো, নিজেই সাক্ষী, নিজেই নীরব আনন্দ।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, এই স্তরটি হলো পরম নির্বিশেষ সত্য (nirviśeṣa tattva)—যেখানে সমস্ত নাম, রূপ, কাল, কর্ম, স্থান, অভিজ্ঞতা—সব বিলীন হয়ে যায়, আর যা অবশিষ্ট থাকে তা কেবল সৎ-চিত্-আনন্দ (সচ্চিদানন্দ)। উপনিষদে বলা হয়েছে—“নেহ নানাস্তি কিন্চন” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৪.১৯) অর্থাৎ, “এখানে কোনো ভেদ নেই”—এই অভিজ্ঞতা-ক্ষেত্রেই নির্গুণ কালীর প্রকাশ। তিনি সেই এক, যিনি সর্বত্র, অথচ কোনো স্থানে নন; যিনি চিরন্তন, অথচ সময়েরও অতীত।
এই অবস্থায় চেতনা নিজের বাইরে কিছু দেখে না, নিজের মধ্যেই স্থিত থাকে। যেমন অগ্নিতে অগ্নি জ্বলে, বা আলোর মধ্যে আলো প্রতিফলিত হয়—তেমনি নির্গুণ কালী সেই চেতনা, যা নিজের মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধি করে। অদ্বৈতের ভাষায় এটি “আত্মনঃ স্বরূপাবোধ”—যেখানে আত্মা নিজেকে নিজের মধ্যে চেনে, কোনো মাধ্যম ছাড়াই।
পতঞ্জলি যোগসূত্র-এ আছে: "তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপেঽবস্থানম্", অর্থাৎ, যোগের মাধ্যমে যখন চিত্তবৃত্তিনিরোধ হয়, তখন দ্রষ্টা (পুরুষ) তার নিজের স্বরূপে (Svarūpa) অবস্থান করে। এটিই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি। কঠোপনিষদ এবং অন্যান্য উপনিষদ অনুসারে, আত্মানম্ বিদ্ধি, অর্থাৎ, “আত্মাকে জানো”-ই হলো মুক্তির একমাত্র পথ। এই জ্ঞান লাভ করলেই মর্ত্য-মানুষ অমরত্ব লাভ করে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায়, নির্গুণ কালী হলেন তুরীয় চেতনা (Turīya)—অর্থাৎ চেতনার চতুর্থ স্তর, যা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুপ্ত অবস্থার ঊর্ধ্বে। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে জগতের সামান্যতম আভাসও বিলীন হয়ে যায়; শুধু থাকে এক অবর্ণনীয় উপস্থিতি—“আমি আছি” (Aham Asmi)—এই অনন্ত উপলব্ধি। এই “আমি” কোনো ব্যক্তিগত অহং নয়, বরং চেতনার স্বয়ংস্বরূপ—শুদ্ধ সত্তা, অনন্ত নিরবতা, দীপ্ত নীরব আনন্দ।
তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়েছে, নির্গুণ কালী কোনো রূপে উপাস্য নন, কারণ তিনি রূপের ঊর্ধ্বে; কিন্তু তিনি সমস্ত রূপের মূল, কারণ রূপ তাঁর থেকেই উদ্ভূত। তিনি “কালাতীতা”—সময়েরও অতীত, কারণ কাল বা পরিবর্তন তাঁর চেতনার সীমার মধ্যে নেই। তাঁর পূজা মানে কোনো মূর্তিপূজা নয়, বরং নিজের অন্তর্সত্তায় আত্মবোধের জাগরণ—যেখানে সাধক উপলব্ধি করে, “আমি নই দেহ, আমি নই মন, আমি সেই এক চৈতন্য, যা সর্বত্র দীপ্ত।”
নির্গুণ কালী সেই পরম চেতনা, যেখানে শিব ও শক্তি, প্রকাশ ও বিমর্শ, জ্ঞানী ও জ্ঞেয়—সব এক হয়ে যায়। তাঁর মধ্যে কোনো গতি নেই, কোনো অভাব নেই, কোনো দ্বন্দ্ব নেই—শুধু থাকে অসীম পূর্ণতা, চিরন্তন নীরবতা, আর স্বয়ং চেতনার জ্যোতি।
তিনি সেই মুহূর্তের প্রতীক, যেখানে সব প্রশ্ন থেমে যায়, সব পরিচয় বিলীন হয়, আর চেতনা উপলব্ধি করে—“আমি সেই অনাদি, অনন্ত, নির্গুণ কালী—নিজেই আলোক, নিজেই শান্তি।”
সগুণ কালী (Saguṇā Kāli) হলেন সেই চেতনার রূপ, যিনি নির্গুণ, অরূপ ব্রহ্মচেতনার দৃশ্যমান প্রকাশ। তিনি সেই পরম, অব্যক্ত চৈতন্যেরই রূপময়, কর্মময়, গতিময় অবতার—যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি, পালন ও লয়ে চিরন্তন লীলারূপে ধারণ করেন। যেমন নির্গুণ কালী হলো নিঃশব্দ আকাশ, তেমনি সগুণ কালী সেই আকাশে জাগ্রত ঝড়, আলো, রং ও প্রতিধ্বনি—অর্থাৎ, জীবনের সমস্ত প্রকাশই তাঁরই স্পন্দন।
অদ্বৈত বেদান্তে এই স্তরকে বলা হয় “সগুণ ব্রহ্ম”, অর্থাৎ ব্রহ্ম যখন মায়া-র মাধ্যমে নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেন। এখানে “মায়া” মানে বিভ্রান্তিকর আচ্ছাদন নয়, বরং প্রকাশশক্তি—যার দ্বারা চেতনা নিজেকে জগতের রূপে অনুভব করে। ব্রহ্ম তখন সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, বিধাতা, জননী—এই সব রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। এই সগুণ রূপের মাধ্যমেই নির্গুণ ব্রহ্ম নিজের অভ্যন্তরীণ আনন্দকে লীলায় প্রকাশ করেন; তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে—“লীলা ক্রীড়ানতান্যেভ হি ব্রহ্মণঃ”—"লীলা বা ক্রীড়াই হলো ব্রহ্মের (সৃষ্টির) প্রবণতা/স্বভাব।" ব্রহ্মের প্রকাশ আসলে এক চিরন্তন লীলা।
অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্মকে উপাধিহীন (Upādhihīna) এবং নিষ্ক্রিয় বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সৃষ্টি কেন হলো? এর উত্তর হলো: ব্রহ্মের এটি কোনো প্রয়োজনভিত্তিক কর্ম নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত লীলা বা ক্রীড়া মাত্র। এই লীলা হলো ব্রহ্মের আনন্দময় স্বরূপ (Ātmānandaḥ Brahma) থেকে উৎসারিত। ব্রহ্ম তাঁর নিজস্ব আনন্দ বা ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে বহুত্বের এই জগৎকে (Sarvaṁ khalvidaṁ brahma) প্রকাশ করেন। এই জগৎকে যদি লীলা হিসেবে দেখা যায়, তবে জীবও বন্ধনমুক্ত হয়ে “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি” ("যোগে স্থিত হয়ে কর্মসমূহ করো।" গীতা, ২.৪৮) অনুসারে অনাসক্তভাবে কর্ম করতে পারে।
যোগে স্থিত হওয়া মানে হলো—মন, ইন্দ্রিয় ও চেতনার সমস্ত বিচ্ছুরণ থেমে গিয়ে নিজের অন্তঃসত্তায় স্থিত হওয়া।
মানসিক সমতা: সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়ে অচঞ্চল থাকা।
আত্মস্মরণ: নিজের ভিতরের চেতনা বা আত্মাকে সচেতনভাবে অনুভব করা।
অন্তর্মুখতা: বাহ্য জগত থেকে মনকে ফিরিয়ে নিজের মধ্যে স্থাপন করা।
চিন্তার নিবৃত্তি: চিত্তের তরঙ্গ থেমে গিয়ে স্থির সচেতনতায় পৌঁছানো।
ঐক্যবোধ: জ্ঞানী, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদ মুছে একতার অনুভূতি লাভ করা।
অর্থাৎ, “যোগে স্থিত” হওয়া মানে নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ভারসাম্য, শান্তি ও চেতনার ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত থাকা।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের দৃষ্টিতে, সগুণ কালী হলেন প্রকাশমান শক্তির রূপ, অর্থাৎ সেই চেতনা, যা নিজের দীপ্তি দ্বারা দৃশ্যমান জগতকে গঠন করে। এখানে “শিব” হলেন বিশুদ্ধ চেতনা, আর “কালী” হলেন তাঁর উন্মুক্ত শক্তি—যিনি প্রকাশকে দৃশ্য, শব্দ, ভাব ও ক্রিয়ায় রূপান্তরিত করেন। তিনি শুধু জগতের উৎস নন; তিনি জগতের অন্তর্গত প্রাণশক্তি (vital force)—যিনি প্রতিটি জীব, প্রতিটি পরমাণু, প্রতিটি শ্বাসের ভেতরে কার্যকর।
যেমন সূর্য ও তার আলো আলাদা নয়, তেমনি শিব ও কালীও দুই নয়—শিব হলেন স্থিতি, কালী হলেন গতি; শিব হলেন নীরবতা, কালী হলেন শব্দ; শিব হলেন চেতনার গভীর স্তর, কালী হলেন সেই চেতনার প্রসারণ। তাই তিনি জগতের “জননী”—কারণ সমস্ত প্রাণ, শক্তি ও চেতনা তাঁরই রূপ।
সগুণ কালীকে বুঝতে হলে দেখতে হয় জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে তাঁর উপস্থিতি—যখন একটি বীজ অঙ্কুরিত হয়, একটি সুর জন্ম নেয়, একটি হৃদয় ভালোবাসায় ভরে ওঠে, অথবা একটি মন সত্যের অনুসন্ধানে জেগে ওঠে—সব ক্ষেত্রেই সেই প্রাণোদ্যমই মহাশক্তির ক্রীড়া। সগুণ কালী সেই জীবনীশক্তি, যিনি অরূপ ব্রহ্মকে রূপ দেন, নীরবতাকে বাণীতে পরিণত করেন, ও শূন্যতাকে মহাবিশ্বের সৃজনে রূপান্তরিত করেন।
সগুণ কালী কোনো পৃথক দেবী নন; তিনি নির্গুণ চেতনারই উন্মেষ, পরম ব্রহ্মের গতিময় প্রকাশ। তাঁর মধ্যেই নির্গুণের লীলা, ব্রহ্মের রূপ, আর চেতনার আনন্দ সার্থকতা পায়। তিনি সেই মায়াশক্তি, যিনি জগতকে স্বপ্ন নয়, বরং দিব্য প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশ করেন—যেখানে প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি পরমাণু, প্রতিটি মুহূর্তে শিবচেতনার দীপ্তি ঝলমল করে।
তাঁরই বাণী যেন অনন্ত আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়—“আমি নির্গুণও আমি সগুণও; আমি নীরবতাও আমি নৃত্যও; আমি শিবের দীপ্তি, আমি কালীর জাগরণ।”
আদিকালী (Ādi Kāli) সেই চেতনার প্রাক্ভৌতিক, অনাদি অবস্থা—যেখানে এখনও কিছু প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশব্দভাবে সুপ্ত। তিনি সৃষ্টির পূর্বসূরী, সেই কালো গর্ভ—যেখানে সময়, রূপ, আলো, শব্দ কিছুই নেই, তবুও সবকিছু সম্ভাবনার রূপে লুকিয়ে আছে। এই অবস্থাই ব্রহ্মচেতনার “শূন্য-গর্ভ”—যেখানে চেতনা এখনো নিজেকে প্রকাশ করতে উদ্যত নয়, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে।
অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, আদিকালী সেই মায়ার নিদ্রিত রূপ, যেখানে ব্রহ্ম এখনও নিঃক্রিয়, অব্যক্ত। এখানে “মায়া” কোনো বিভ্রান্তি নয়; এটি সেই প্রাক্সৃষ্টির সম্ভাবনাশক্তি (potential energy), যেখান থেকে ব্রহ্ম নিজেরই ইচ্ছায় জগৎ রচনা করতে সচেষ্ট হন। অদ্বৈত বেদান্ত বা তান্ত্রিক দর্শন-এর একটি ব্যাখ্যামূলক সূত্র বলে—“স একাকী নরমেয়াত্—স একা আকাশতঃ প্রসৃতঃ”, অর্থাৎ “তিনি একা ছিলেন, তারপর নিজেকে প্রকাশ করলেন”—সেই একক, অসীম সত্তা (ব্রহ্ম) একা ছিলেন, কিন্তু তিনি আকাশ (space/ether) থেকে প্রসারিত হয়ে মানবতা বা জগৎরূপে প্রকাশিত হলেন। এই নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা-র পূর্ব মুহূর্তই আদিকালীর অবস্থা। তিনি সেই গূঢ় নিদ্রা, যেখান থেকে জাগরণের প্রথম স্পন্দন শুরু হয়।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই স্তরটি হলো প্রথম স্পন্দনের মুহূর্ত, যাকে বলা হয় “Ādi Spanda”। এখানে শিব, যিনি বিশুদ্ধ, স্থির, অচল চেতনা, হঠাৎ নিজের অস্তিত্ব অনুভব করেন—“আমি আছি”—এই আত্মবিমর্শনের সূক্ষ্মতম কম্পন থেকেই সৃষ্টি শুরু হয়। সেই প্রথম আত্মবোধ, সেই প্রাথমিক স্পন্দনই আদিকালী। অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেছেন “অনুত্তর স্পন্দ”, অর্থাৎ সেই চরম কম্পন, যা অন্য কিছুর দ্বারা নির্ধারিত নয়—যেখান থেকে প্রকাশ ও বিমর্শ উভয়েরই উদ্ভব।
তাঁকে বলা যায় চেতনার মহাগর্ভ (Cosmic Womb)—যেখানে সমস্ত দেবতা, তত্ত্ব ও শক্তি অদৃশ্যভাবে লীন অবস্থায় থাকে, যেমন বীজে গাছ, ফল ও ফুল সুপ্ত থাকে। তিনি জগতের উৎস, কিন্তু নিজে কোনো রূপে আবদ্ধ নন; তিনি সেই “অন্ধকার-আলো”-র সীমানা, যেখানে নিদ্রা ও জাগরণ, শূন্যতা ও পূর্ণতা একে অপরকে স্পর্শ করে।
তন্ত্রশাস্ত্রে আদিকালীকে বলা হয়েছে—“আদ্যা কালী, মহাযোগিনী”, “আদি বা প্রথম কালী (সময়েরও পূর্বে বিদ্যমান), মহাযোগিনী (সর্বশ্রেষ্ঠ যোগিনী, যিনি যোগের চূড়ান্ত শক্তি ধারণ করেন)” অর্থাৎ “তিনি আদ্য শক্তি, সমস্ত যোগের উৎস”—কারণ তিনিই চেতনা ও শক্তির মিলনের প্রথম সম্ভাবনা। তাঁর অবস্থান কালেরও পূর্বে, কারণ তিনিই কালকে জন্ম দেন; তাঁর থেকেই সময়ের প্রবাহ আরম্ভ হয়, এবং তাঁর মধ্যেই তা লীন হয়।
এই উক্তিটি দেবী কালীর সর্বোচ্চ ও মৌলিক স্বরূপকে ঘোষণা করে। আদ্যা (Ādyā) শব্দটি বোঝায় যে, তিনি সমস্ত সৃষ্টির পূর্বে বিদ্যমান। তিনি হলেন ‘আদিম সৃজনী শক্তি’ (Archetypal Creative Force)। মহাযোগিনী (Mahāyoginī) শব্দটি বোঝায় যে, তিনিই যোগের (Yoga) সমস্ত জ্ঞান ও শক্তির উৎস। তিনি কেবল যোগ চর্চা করেন না, বরং তিনিই সেই পরম চৈতন্য যিনি সমস্ত চেতনা, বন্ধন এবং মুক্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। এই উক্তিটি তান্ত্রিক উপাসনায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে কালীকে চূড়ান্ত বাস্তবতা (ব্রহ্ম) এবং সমস্ত যোগী ও যোগিনীদের সর্বোচ্চ নিয়ন্তা রূপে পূজা করা হয়।
আদিকালী কোনো প্রকাশিত দেবী নন, বরং সৃষ্টির পূর্বের নীরব চেতনা—যিনি সব রূপের সম্ভাবনাকে ধারণ করেন। তিনি সেই অন্ধকার, যা আলোকে জন্ম দেয়; সেই নিদ্রা, যা জাগরণে পরিণত হয়; সেই অনাদি সম্ভাবনা, যেখান থেকে জগতের প্রতিটি বিন্দু, প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি চেতনা আত্মপ্রকাশ লাভ করে।
তাঁরই প্রতীকী উচ্চারণ—“আমি সেই অন্ধকার, যার মধ্যে আলো জন্ম নেয়; আমি সেই নিঃশব্দতা, যার থেকে শব্দ উদ্ভূত; আমি সেই আদিকালী, যিনি শিবের নিঃশ্বাসের আগেও ছিলেন।”