শৈব কালী: আঠারো



“ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্বানি”-কে কাশ্মীর শৈব দর্শনের (বিশেষত প্রত্যভিজ্ঞা ও ত্রিক প্রণালী অনুসারে) একটানা দার্শনিক ধারায় ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়—চেতনার পরম উৎস ‘শিব’ ক্রমে নিজেকে অভিব্যক্ত, সীমিত ও বহুরূপী করে তোলে। এই প্রক্রিয়া কোনো বাহ্যিক সৃষ্টি নয়; এটি চেতনারই অন্তর্মুখী আত্মবিমর্শন ও স্ব-বিকাশ, যার প্রতিটি স্তর “তত্ত্ব” নামে পরিচিত। ছত্রিশ তত্ত্ব এইভাবে চেতনার উন্মোচনের ধারায় এক অবিচ্ছিন্ন পর্যায়বিন্যাস, যা পরম শিব-চেতনা থেকে স্থূল পৃথিবী পর্যন্ত নেমে আসে—যেমন এক আলো ক্রমশ নিজেকে ঘন অন্ধকারে রূপান্তরিত করে, কিন্তু মূলত আলোই থেকে যায়।

শুদ্ধ তত্ত্ব (Pure Categories): প্রথমেই আসে শিবের চেতনা থেকে সৃষ্ট প্রথম পাঁচটি তত্ত্ব। এগুলি ব্রহ্মাণ্ডের বিশুদ্ধ ও আধ্যাত্মিক দিকটি নিয়ে কাজ করে। শিব তত্ত্বে (১) চেতনা সম্পূর্ণ এক, নিরাবরণ, স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে কোনো ‘অন্য’ নেই, কোনো প্রকাশ নেই। এটি ‘অনুত্তর’—যার ওপরে কিছু নেই। কিন্তু এই শিব নিজের স্বরূপে স্থির না থেকে নিজেকে চিনতে চায়; এই চিনতেই জন্ম নেয় শক্তি তত্ত্ব (২), অর্থাৎ চেতনার স্ববিমর্শন। শক্তি শিবের প্রতিফলন নয়, বরং শিবেরই ক্রিয়াশক্তি—অদ্বিতীয় চেতনার অন্তর্গত কম্পন। যখন শিব স্থির আলোক, শক্তি সেই আলোর স্পন্দন। এই যুগল-অদ্বৈত স্তরেই ত্রিকের প্রথম নৃত্য—চেতনা ও তার স্ববিমর্শন একাকার হয়ে থাকে। এই দুই একত্রে পরম চৈতন্যের দ্বিধাহীন সত্তা।

‘অনুত্তর’ (Anuttara) শব্দটি একটি সংস্কৃত শব্দ, যার একাধিক গভীর অর্থ রয়েছে, বিশেষত কাশ্মীর শৈবদর্শন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাশ্মীর শৈবদর্শনে (কাশ্মীর ত্রিক দর্শন), ‘অনুত্তর’ হলো কেন্দ্রীয় ধারণা এবং সর্বোচ্চ তত্ত্ব। এখানে এর অর্থ—সর্বোচ্চ, যার উপরে আর কিছু নেই (The Supreme, the one without a superior), ফলে যা অনতিক্রম্য (Insuperable)। এটি হলো পরম শিব বা পরম চেতনা। শিবই সেই চরম ও শেষ বাস্তবতা, যা সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। এই তত্ত্বের কোনো আদি বা অন্ত নেই, এটি স্বয়ম্ভূ এবং সমস্ত সৃষ্টির উৎস। এটি হলো A-U-M বা অউম বা ওঁ-এর সেই 'অ' (A) বর্ণ বা আদি বীজমন্ত্র, যা সৃষ্টি ও ধ্বনির মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

বৌদ্ধধর্মে, বিশেষত মহাযান ঐতিহ্যে, অনুত্তর শব্দটি প্রায়শই সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক লক্ষ্য বা গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন, অনুত্তর সম্যক সম্বোধি (Anuttara Samyak Sambodhi)-এর অর্থ হলো "অনুপম, পূর্ণ ও সঠিক জ্ঞান" বা "সর্বোচ্চ নিখুঁত আলোকপ্রাপ্তি"। বুদ্ধত্ব বা বুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াকে এই শব্দটি দ্বারা বর্ণনা করা হয়। এটিই হলো বুদ্ধের অর্জিত সর্বোচ্চ জ্ঞানাবস্থা।

সাধারণ সংস্কৃত বা বাংলা অর্থে অনুত্তর শব্দটির মানে হলো: যার কোনো উত্তর বা প্রত্যুত্তর নেই—উত্তর-অযোগ্য (Unanswerable)—যা সর্বশ্রেষ্ঠ বা অতুলনীয় (Unequalled, Unsurpassed)।


এরপর সদাশিব তত্ত্বে (৩) উদয় হয় ‘ইচ্ছাশক্তি’। এখানে চেতনা প্রথমবার বলে ওঠে—“অহম্ ইদম্”—“আমি এই।” কিন্তু “এই”-এর মধ্যে এখনও কোনো ভেদ নেই; এটি সম্ভাবনার গর্ভে-থাকা বিশ্ব। ঈশ্বর তত্ত্বে (৪) সেই ইচ্ছা জ্ঞানে পরিণত হয়—এখানে চেতনা বলে, “ইদম্ অহম্”—“এ-ই আমি।” এখানে বিশ্ব স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করে, যদিও এখনও তা অদ্বৈত চেতনার মধ্যেই অন্তর্গত। শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্বে (৫) এই জ্ঞান ক্রিয়ায় রূপ নেয়—চেতনা নিজের প্রকাশের মধ্যে নিজেকে কার্যকর করে তোলে। এই পাঁচটি শুদ্ধ তত্ত্ব চেতনার বিশুদ্ধ স্তর—এখানে অজ্ঞতা বা সীমাবদ্ধতার কোনো ছোঁয়া নেই; এগুলি ‘শুদ্ধ-তত্ত্ব’।

পাঁচটি তত্ত্ব—

১) শিব (Śiva): পরম বাস্তবতা, অপরিবর্তনীয় চেতনা ও আনন্দ।

২) শক্তি (Śakti): শিবের সৃজনশীল ক্ষমতা, যা বিশ্বের সৃষ্টি ও প্রকাশ ঘটায়।

৩) সদাশিব (Sadāśiva): ইচ্ছাশক্তি বা ইচ্ছার প্রকাশ।

৪) ঈশ্বর (Īśvara): জ্ঞান বা জ্ঞানের প্রকাশ।

৫) শুদ্ধবিদ্যা (Śuddhavidyā): ক্রিয়া বা কর্মের প্রকাশ।

শুদ্ধ-অশুদ্ধ তত্ত্ব (Pure-Impure Categories): এই তত্ত্বগুলি বিশুদ্ধ চেতনা এবং জাগতিক বিষয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এগুলি হলো মায়ার পর থেকে পুরুষ ও প্রকৃতি পর্যন্ত ছয়টি তত্ত্ব। এই পরিপূর্ণ ঐক্য চিরস্থায়ী লীলার তাগিদে নিজেকে সীমিত করতে শুরু করে। মায়া তত্ত্বে (৬) চেতনা নিজের অসীমতাকে আড়াল করে বহুরূপ সৃষ্টির মঞ্চ প্রস্তুত করে। এখানে প্রথম সীমার উদ্ভব—বৈচিত্র্য, পরিমিতি, সময়, আকাঙ্ক্ষা, নিয়ম—সবই মায়ার ভেতর জন্মায়। কলা (৭), বিদ্যা (৮), রাগ (৯), কাল (১০), নিয়তি (১১)—এই পাঁচ কঞ্চুক চেতনার ওপর আবরণ সৃষ্টি করে; একে বলা হয় “পঞ্চকঞ্চুক”, যা দ্বারা সীমাবদ্ধতার পাঁচটি আবরণ বোঝায়—যা পরম চৈতন্যকে (শিব) ঢেকে রাখে এবং অসীম আত্মাকে সসীম বা জীবাত্মায় রূপান্তরিত করে। এর ফলে চেতনা আর সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপ্ত থাকে না; সে হয়ে ওঠে ‘পুরুষ’—সীমিত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আত্মা। পুরুষ তত্ত্বে (১২) চেতনা নিজেকে ব্যক্তি হিসেবে অনুভব করে—সে আর পরম শিব নয়, এক সীমানাবদ্ধ “আমি”। এই স্তরেই ‘শুদ্ধ’ ও ‘অশুদ্ধ’-এর সন্ধিক্ষণ—যেখানে পরম চেতনা প্রথমবার নিজেকে জগৎ হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে।

সাতটি তত্ত্ব—

৬) মায়া (Māyā): বিভ্রম বা ভ্রমের শক্তি, যা বৈচিত্র্য ও সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

৭) কলা (Kalā): সীমিত কর্তৃত্ব বা কর্মক্ষমতা।

8) বিদ্যা (Vidyā): সীমিত জ্ঞান।

৯) রাগ (Rāga): আসক্তি বা সীমিত আকাঙ্ক্ষা।

১০) কাল (Kāla): সময় বা কালগত সীমাবদ্ধতা।

১১) নিয়তি (Niyati): কার্যকারণ বা কার্যকারণের উপর সীমাবদ্ধতা।

১২) পুরুষ (Puruṣa): সীমিত আত্মা বা জীবাত্মা, যিনি এই সীমাবদ্ধতাগুলির অধীন।

অশুদ্ধ তত্ত্ব (Impure Categories): এগুলি হলো জাগতিক বা ভৌত জগৎ গঠনের জন্য সাংখ্য দর্শনের চব্বিশটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বগুলি পুরুষ (জীবাত্মা)-এর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র তৈরি করে। পুরুষের পরেই প্রকৃতি তত্ত্ব (১৩), যেখানে চেতনা নিজের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতাগুলি প্রকাশের মাধ্যমে বহুরূপ জগৎ রূপে বিকশিত হয়। সাংখ্যের ভাষায় প্রকৃতি হলো ত্রিগুণময় মূলকারণ—সত্ত্ব, রজ, তম—যার সাম্যভঙ্গেই সৃষ্টি প্রবাহিত হয়। মহৎ বা বুদ্ধি তত্ত্বে (১৪) উদয় হয় বোধশক্তি; অহঙ্কারে (১৫) জন্ম নেয় ব্যক্তিত্ববোধ; মনস তত্ত্বে (১৬) সেই ব্যক্তিত্ব বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এখানে চেতনা আর ‘সাক্ষী’ নয়, বরং “মননশীল সত্তা”—সে ভাবে, বিচার করে, সিদ্ধান্ত নেয়। এই চারটি অন্তঃকরণ তত্ত্ব মানুষের অভ্যন্তরীণ চৈতন্যের স্তর গঠন করে।

এরপর উদয় হয় জ্ঞানেন্দ্রিয়—শ্রবণ (১৭), স্পর্শ (১৮), দর্শন (১৯), স্বাদ (২০) ও গন্ধের (২১) অঙ্গ। এগুলি চেতনার বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। কর্মেন্দ্রিয়—বাক্ (২২), পাণি (২৩), পাদ (২৪), পায়ু (২৫), উপস্থ (২৬)—চেতনার ক্রিয়া-শক্তিকে প্রকাশ করে; এগুলি চেতনার প্রকাশের যন্ত্র। জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের এই দশটি তত্ত্ব মানুষের সীমিত চৈতন্যের ইন্দ্রিয়জগৎ গঠন করে, যেখানে জ্ঞান ও ক্রিয়া পরস্পর নির্ভরশীল।

তন্মাত্রাগুলি (শব্দ (২৭), স্পর্শ (২৮), রূপ (২৯), রস (৩০), গন্ধ (৩১)) হলো সূক্ষ্ম উপাদান—এরা জগতের সংবেদনীয় গঠন-বীজ। এগুলি থেকেই উৎপন্ন হয় স্থূল পাঁচ মহাভূত—আকাশ (৩২), বায়ু (৩৩), অগ্নি (৩৪), জল (৩৫) ও পৃথিবী (৩৬)। আকাশে শব্দ, বায়ুতে স্পর্শ, অগ্নিতে রূপ, জলে রস, পৃথিবীতে গন্ধ—এইভাবে সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলি স্থূল রূপে ঘনীভূত হয়। এরা চেতনার শেষ প্রান্তের প্রকাশ—যেখানে আলোক ধীরে ধীরে কঠিন পদার্থে বদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে—এটিও চেতনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ—সবই চেতনারই রূপান্তর। অভিনবগুপ্ত ‘তন্ত্রালোক’-এ বলেন, “চিদানন্দময়ং বিশ্বম্”—এই জগৎ নিজেই চিত্‌-আনন্দময়।

চব্বিশটি তত্ত্ব—

ক. অন্তঃকরণ (Internal Organs):

১৩) প্রকৃতি (Prakṛti): জাগতিক কারণ, সমস্ত জাগতিক উপাদানের উৎস।

১৪) মহৎ/বুদ্ধি (Mahat/Buddhi): বুদ্ধি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা।

১৫) অহঙ্কার (Ahaṃkāra): অহং, স্ব-সচেতনতা বা 'আমি' জ্ঞান।

১৬) মনস (Manas): মন, সংকল্প ও বিকল্পের অঙ্গ।

খ. জ্ঞানেন্দ্রিয় (Organs of Knowledge):

১৭) শ্রোত্র (Śrotra): কান (শ্রবণের অঙ্গ)।

১৮) ত্বক্ (Tvak): ত্বক (স্পর্শের অঙ্গ)।

১৯) চক্ষু (Cakṣus): চোখ (দর্শনের অঙ্গ)।

২০) রসনা (Rasanā): জিহ্বা (স্বাদের অঙ্গ)।

২১) ঘ্রাণ (Ghrāṇa): নাক (ঘ্রাণের অঙ্গ)।

গ. কর্মেন্দ্রিয় (Organs of Action):

২২) বাক্ (Vāk): কথা বা বাকশক্তি।

২৩) পাণি (Pāṇi): হাত (গ্রহণের অঙ্গ)।

২৪) পাদ (Pāda): পা (চলার অঙ্গ)।

২৫) পায়ু (Pāyu): মলদ্বার (নিষ্কাশনের অঙ্গ)।

২৬) উপস্থ (Upastha): জননেন্দ্রিয় (প্রজননের অঙ্গ)।

ঘ. তন্মাত্রা বা সূক্ষ্ম উপাদান (Subtle Elements):

২৭) শব্দ তন্মাত্রা (Śabda-tanmātra): শব্দের সূক্ষ্ম উপাদান।

২৮) স্পর্শ তন্মাত্রা (Sparśa-tanmātra): স্পর্শের সূক্ষ্ম উপাদান।

২৯) রূপ তন্মাত্রা (Rūpa-tanmātra): রূপের সূক্ষ্ম উপাদান।

৩০) রস তন্মাত্রা (Rasa-tanmātra): স্বাদের সূক্ষ্ম উপাদান।

৩১) গন্ধ তন্মাত্রা (Gandha-tanmātra): গন্ধের সূক্ষ্ম উপাদান।

ঙ. মহাভূত বা স্থূল উপাদান (Gross Elements):

৩২) আকাশ (Ākāśa): ইথার বা স্থান।

৩৩) বায়ু (Vāyu): বাতাস বা বায়ু।

৩৪) তেজস্ (Tejas): অগ্নি বা তেজ।

৩৫) আপ্ (Āp): জল বা অপ্।

৩৬) পৃথ্বী (Pṛthvī): পৃথিবী বা মাটি।

এই ছত্রিশটি তত্ত্ব শৈব দর্শন অনুসারে পরম চেতনা শিব থেকে শুরু করে স্থূল পৃথিবী পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টির ক্রমবিকাশকে ব্যাখ্যা করে। এই ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্ব আসলে কোনো সৃষ্টির সারণি নয়, বরং চেতনার স্ব-বিস্তাররেখা। এটি ‘অদ্বয়ং তু দ্বয়াভাসম্‌ স্বক্রীড়ারূপতাম্‌ গতম্‌’—"সেই অদ্বৈত (পরম সত্তা বা শিব) বস্তুত দ্বৈতের (দুইয়ের) মতো প্রতিভাত হয়, কারণ সে নিজের লীলা বা খেলার রূপ গ্রহণ করেছে।" অর্থাৎ, অদ্বৈত চেতনা নিজের লীলায় দ্বৈততার আভাস সৃষ্টি করে—এরই বিস্তারিত ব্যাখ্যা। প্রতিটি তত্ত্ব একেকটি পর্দা, একেকটি স্পন্দন, যার মধ্য দিয়ে পরম শিব-চেতনা নিজেরই রূপ দেখছে। যখন সাধক প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition)-এর পথে এগোয়, তখন সে এই তত্ত্বগুলিকে উলটো পথে অতিক্রম করে—পৃথ্বী থেকে শুরু করে শিব পর্যন্ত উঠে যায়, সীমা থেকে অসীমে প্রত্যাবর্তন ঘটে। এটিই মুক্তির পথ—যেখানে চেতনা আবার নিজের উৎসে প্রত্যাবর্তন করে।

ষট্‌ত্রিংশৎ তত্ত্ব কেবল সৃষ্টিতত্ত্বের তালিকা (Cosmological list) নয়; এটি চেতনার অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী যাত্রার মানচিত্র। শিব থেকে পৃথ্বী পর্যন্ত নামা মানে স্ববিমর্শন থেকে আত্মভ্রান্তি; পৃথ্বী থেকে শিব পর্যন্ত ওঠা মানে আত্মভ্রান্তি থেকে স্ববিমর্শনে প্রত্যাবর্তন। দুই দিকেই স্রোত এক—চেতনার নিজস্ব নৃত্য, যেখানে শিব ও শক্তি চিরকাল অভিন্ন।

অদ্বৈত বেদান্তে যেমন জগৎকে “মায়া” বলা হয়, কাশ্মীর শৈব দর্শনে জগৎ সেই মায়ার আড়ালে থাকা চেতনারই “বাস্তব প্রকাশ” (real manifestation)। যেমন ঢেউ সমুদ্র থেকে পৃথক নয়, তেমনি জগৎও শিবচেতনারই তরঙ্গ। এই দৃষ্টিভঙ্গির নাম অভিন্ন-অভেদবাদ (Abhedābheda-vāda)—অর্থাৎ, শিব ও জগৎ ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয়; তারা একই চেতনার দুই প্রকাশ।

এটি ভারতীয় দর্শনের এমন এক তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়, বাস্তবতা এক হলেও তার প্রকাশে ভেদ বা পার্থক্যের অনুভব ঘটে; অথচ সেই ভেদ প্রকৃত নয়, বরং একই চেতনার স্ব-আবির্ভাব। শব্দটির অর্থই বোঝায়—অভিন্ন অর্থাৎ অবিভক্ত, আর অভেদ অর্থাৎ ভিন্নতা; তাই অভিন্ন-অভেদবাদ মানে একত্ব ও ভিন্নত্বের সমন্বয়। এটি এমন এক দর্শন, যা একদিকে অদ্বৈত (non-dualism)-এর সারবস্তু ধরে রাখে, আবার অন্যদিকে বহুরূপ প্রকাশকে মায়া বলে অস্বীকার করে না।