প্রায় খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর ভাষাতত্ত্বাচার্য ভর্তৃহরি। তাঁর চিন্তাধারার প্রভাব কাশ্মীর শৈববাদের ক্রমপন্থায় এমন গভীরভাবে প্রবাহিত হয়েছে যে, তাঁকে এই দর্শনের এক অদৃশ্য পূর্বপুরুষ বলা চলে। তাঁর ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থে যে-কাল-শক্তি-ধারণা প্রতিপন্ন হয়েছে—অর্থাৎ সময় কোনো বাহ্যিক বস্তু নয়, বরং চেতনার অন্তর্নিহিত শক্তি—সেই ধারণাই পরবর্তীকালে ক্রমপন্থার কেন্দ্রীয় নীতিতে রূপান্তরিত হয়। ভর্তৃহরির মতে, সময় চেতনারই এক শক্তি, যার দ্বারা অনন্ত অর্থ ধাপে ধাপে প্রকাশিত হয় এবং পুনরায় নিজের মধ্যেই লীন হয়ে যায়। এই সময়শক্তিই ভাষার অনুক্রম, চিন্তার ধারা ও অভিজ্ঞতার ক্রমবিকাশকে সম্ভব করে তোলে।
ক্রমপন্থার পরবর্তী আচার্যগণ—আনন্দবর্ধন, শ্রীবল্লভ ও বিশেষত অভিনবগুপ্ত—এই ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেন। তাঁদের মতে, কাল-শক্তি আসলে চেতনার একটি নির্দিষ্ট স্তর বা “গোচরী”—অর্থাৎ সেই পর্যায়, যেখানে পরমচেতনা নিজের শক্তিকে ধাপে ধাপে উন্মোচন করে। এই ধারাবাহিক আত্মপ্রকাশই ক্রম এবং তারই সর্বোচ্চ প্রতীক কালী, যিনি সময় ও চেতনার ঐক্যবিন্দু। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক ও ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিমর্শিনী-তে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ভর্তৃহরির কাল-শক্তি-ধারণা ছাড়া কাশ্মীর শৈব অদ্বৈততত্ত্বের “চেতনার গতিশীল ঐক্য” ধারণা সম্পূর্ণ হতো না। তাঁর কৃতজ্ঞতার উৎস এখানেই—ভর্তৃহরির ভাষাতত্ত্ব চেতনার রহস্যময় আত্মপ্রকাশকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, সেটিই পরবর্তীকালে ক্রমতত্ত্বের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
ভর্তৃহরি সময়কে দেখেছিলেন চেতনার অন্তঃক্রিয়াশক্তি হিসেবে, যার দুটি প্রধান দিক—প্রতিবন্ধ ও অনুজ্ঞা। প্রতিবন্ধ হলো সেই শক্তি, যা সীমারেখা টানে, অভিজ্ঞতার প্রবাহে এক বিন্দুকে অন্যের থেকে পৃথক করে এবং বস্তু, ঘটনা ও পরিচয় গঠন করে। প্রতিবন্ধ না থাকলে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা বা সময়বোধই সম্ভব হতো না। অপরদিকে অনুজ্ঞা সেই সীমারেখাকে অতিক্রমের অনুমোদন দেয়—ধারাবাহিকতা, সম্পর্ক ও ঐক্যের প্রবাহ বজায় রাখে। অনুজ্ঞা না থাকলে চেতনা বিচ্ছিন্ন ঘটনার এক বিশৃঙ্খল স্রোতে ভেঙে যেত। এই দুটি শক্তি একত্রে চেতনার অনুক্রমিক প্রকাশের মৌল কাঠামো গঠন করে। একদিকে প্রতিবন্ধ সীমা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে অনুজ্ঞা সেই সীমার মধ্য দিয়েই ঐক্যের স্রোতকে অটুট রাখে। এই দ্বন্দ্বাত্মক সমন্বয়েই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্ভব হয়। ক্রমপন্থা এই দুই কার্যকারিতাকে কালী-শক্তির অন্তর্নিহিত হৃদয়তত্ত্ব হিসেবে স্বীকার করে। কালী এখানে একই সঙ্গে বিভাজক ও ঐক্যপ্রতিষ্ঠা—তিনি সময়ের সীমানা টানেন, আবার সেই সীমা ভেঙেও দেন।
ত্রিকা দর্শনে কাল-শক্তি অবশ্যই ঈশ্বরের এক অন্তর্নিহিত দিক, কিন্তু তার ভূমিকা মূলত প্রকাশ ও কার্যধারার নীতিতে সীমিত। সেখানে কাল-শক্তি ঘটনাগুলিকে পৃথক করে, একটিকে অন্যটির পর স্থাপন করে—ফলে সময়ের অনুক্রম জন্ম নেয়। এই সময় বিভেদ ও সীমাবদ্ধতার নীতি, বহুত্বের সূক্ষ্ম কারণ। কিন্তু ক্রমপন্থা এই সীমাবদ্ধ ধারণাকে অতিক্রম করে কালী-শক্তিকে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যের, অর্থাৎ পরম স্বাধীনতার গতিশীল রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। সময় এখানে বিভেদের কারণ নয়; বরং চেতনার আত্মপ্রকাশের অন্তর্লীন ছন্দ। কালী তাই কেবল “কাল” নন, বরং “কালহীন কাল”—যিনি সময়ের মধ্য দিয়েই সময়কে অতিক্রম করেন।
এভাবে ত্রিকা যেখানে সময়কে বহুত্বের ভিত্তি বলে মনে করে, ক্রম সেখানে সময়কে ঐক্যের চলমান ছায়া হিসেবে বোঝে। কালী সেই চেতনা, যার মধ্যে সময়ের প্রতিটি ক্ষণ চিরন্তনের এক স্পন্দিত বিন্দু মাত্র, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে দীপ্ত হয় এক অবিচ্ছিন্ন উপস্থিতির মধ্যে। ফলে ক্রমপন্থা শেখায় যে, সময় কোনো শৃঙ্খল নয়, বরং মুক্তির পথ—প্রতিটি মুহূর্তই সেই পরমচেতনার আত্মপ্রকাশ। ভর্তৃহরির কাল-শক্তি-ধারণা এই উপলব্ধির মূল শিকড়, যেখানে সময় চেতনার শক্তি এবং চেতনা সময়ের হৃদয়। কালী এই দুইয়ের ঐক্য—তিনি সময়ের আত্মা, যিনি সীমিত মুহূর্তের মধ্যে অসীম চেতনার স্পন্দন বহন করেন এবং প্রতিটি ক্ষণকে পরম উপস্থিতির দীপ্তিতে পরিণত করেন।
ভর্তৃহরির কাল-শক্তি তত্ত্ব ক্রমপন্থায় কালী ধারণার রূপায়ণে এক মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করেছে। ভর্তৃহরি সময়কে কোনো বাহ্যিক গণনার নিয়ম নয়, বরং চেতনার অন্তর্নিহিত শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন—একটি এমন স্পন্দনশক্তি, যার মাধ্যমে চেতনা নিজেই নিজেকে ক্রমে উন্মোচন করে এবং পুনরায় নিজের মধ্যে লীন হয়ে যায়। ক্রমপন্থা এই ধারণাকে আরও প্রসারিত করে সময়কে বাস্তবতার অন্তর্গত চেতনা-গতি বলে ব্যাখ্যা করে—এক পরম সত্তার আত্ম-গতি, যার মাধ্যমে সমস্ত অভিজ্ঞতা সংগঠিত ও ক্রমান্বিত হয়। এই দৃষ্টিতে কালী কোনো স্থির প্রতীক নন; তিনি বাস্তবতার অন্তর্নিহিত গতিশীলতা, সেই চেতনার ছন্দ, যার মধ্যে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় একসঙ্গে সম্পন্ন হয়। তাঁর মধ্যে কোনো বহুত্ব বা বিভক্তি নেই; বরং মহাবিশ্বের যে আপাত-ক্রমবিন্যাস বা অনুক্রম আমরা অনুভব করি, তা কেবল তাঁর এক আপেক্ষিক প্রতিফলন, যা আমাদের সীমিত জ্ঞানের মধ্যেই ধরা পড়ে।
ক্রমপন্থার দৃষ্টিতে সময় ও ক্রমের এই দ্বৈততা উৎপন্ন হয়েছে পরম সত্তার নিজস্ব গতিশীলতা থেকে। পরম একতা, অর্থাৎ শিবচেতনা, কাল-চেতনার মধ্য দিয়ে নিজেকে অভিজ্ঞতার ধারায় প্রকাশ করে। এই কারণেই ক্রম দর্শনের অধিবিদ্যা দুটি যমজ ধারণার চারপাশে ঘুরে—কাল ও কলন। কাল হলো পার্থক্য ও পরিমাপের নীতি, যার দ্বারা এক অভিজ্ঞতা অন্যের থেকে পৃথক হয়; আর কলন হলো প্রকাশের নীতি—যার দ্বারা পরম চেতনা নিজেকে সীমাবদ্ধ করে জগৎ রচনা করে। কলন মানে সেই দেবীয় প্রক্রিয়া, যেখানে ঈশ্বর নিজেই “নির্ধারণ করেন, পরিমাপ করেন ও সৃষ্টি করেন।” এই শক্তিই সময়কে প্রকাশযোগ্য করে তোলে, কারণ তার প্রকৃত স্বরূপই অনুক্রম—চেতনার স্পন্দনের ধারাবাহিক বিকাশ। এটি সমস্ত বস্তুর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণশক্তি, যা তাদের সুপ্ত অবস্থান থেকে প্রকাশের দিকে টেনে আনে। কালী-র অধিবিদ্যা নিহিত এই কলন বা সৃষ্টিশক্তির চেতনা-প্রক্রিয়ার মধ্যে। তিনি সময়ের অধীন নন; বরং সময় তাঁর থেকেই উদ্ভূত। তিনি সময়ের আদিশক্তি, যার মধ্য দিয়েই সময়ের প্রকাশ সম্ভব হয়।
“কালী” শব্দের ব্যুৎপত্তিও এই গভীর অধিবিদ্যা প্রতিফলিত করে। প্রাচীন ভাষ্যকাররা এই নামের নানা দিক উন্মোচন করেছেন, যেগুলো বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর প্রকাশ করে। ভূতিরাজ ও পরে অভিনবগুপ্ত বলেন—“কালী” শব্দটি এসেছে “কল” ধাতু থেকে, যার অর্থ কর্ম করা, গতি করা, গণনা করা, উচ্চারণ করা। দেবী কালী-এর নামের একটি নিরুক্তি বা ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা বলে, “কলয়তি ইতি কালী”। কলয়তি (Kalayati): যিনি গণনা করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন, ধারণ করেন, অথবা গ্রাস করেন। ইতি (Iti): এটি একটি অব্যয়, যার অর্থ— 'এই কারণে', 'এই জন্য', বা 'এইভাবে'। কালী (Kālī): দেবী কালী, যিনি সময় (কাল)-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
এই উক্তির সম্পূর্ণ অর্থটি দাঁড়ায়: "যিনি (সব কিছু) গণনা করেন/নিয়ন্ত্রণ করেন/গ্রাস করেন, তিনিই কালী।" এই নিরুক্তির মাধ্যমে দেবীর দুটি প্রধান শক্তিকে বোঝানো হয়:
সময়ের নিয়ন্তা: কালীকে কাল (সময়)-এর শক্তি বা রূপ হিসেবে দেখা হয়। তিনি সময়কে গণনা করেন, সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং অবশেষে সমস্ত সৃষ্টিকে সময়ের মাধ্যমে গ্রাস বা সংহার করে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। তিনি মহাকাল (শিব)-এর শক্তি, যা সময়ের অতীত।
মহাপ্রলয়: মহাপ্রলয়ের সময় তিনিই সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে নিজের মধ্যে লীন বা গ্রাস করে নেন। এই অর্থে, তিনি ধ্বংসের এবং নিয়ন্ত্রণের প্রতীক, যা সৃষ্টির চক্র সম্পন্ন করে।
অর্থাৎ, এই উক্তিটি দেবী কালীকে সময়ের সর্বগ্রাসী শক্তি এবং মহাজাগতিক নিয়ন্তা হিসেবে তুলে ধরে। তিনি ক্রিয়াশীল—চেতনার গতিতে বিশ্বে প্রবাহিত।
অভিনবগুপ্ত ব্যাখ্যা করেন, “কল” ধাতুর চারটি প্রধান অর্থ আছে—ক্ষেপ, গতি, সংখ্যান ও শব্দ। ক্ষেপ মানে নিক্ষেপ বা প্রক্ষেপণ—অর্থাৎ প্রকাশ বা সৃষ্টির নীতি; গতি মানে স্পন্দন বা গমন, যা অর্জন ও উপলব্ধি উভয়কেই ধারণ করে; সংখ্যান মানে গণনা, পরিমাপ বা ধারাবাহিকতা নির্ধারণ; আর শব্দ মানে ধ্বনি বা বাক্, যা প্রকাশের মাধ্যম। এর সঙ্গে তিনি আরও দুটি অর্থ যুক্ত করেছেন—ভোগ ও লয়। ভোগ মানে আত্মার অভিজ্ঞতামূলক উপভোগ, আর লয় মানে আত্মায় প্রত্যাবর্তন, চেতনার কেন্দ্রে বিলীন হওয়া।
এই ছয়টি অর্থ—প্রক্ষেপণ, গতি, গণনা, শব্দ, ভোগ ও লয়—ক্রমপন্থায় চেতনার ছয় স্তর বা ধাপের প্রতীক। সৃষ্টি থেকে লয় পর্যন্ত চেতনার এই ছয় ছন্দে প্রকাশ পায় কালী-র পরম নৃত্য, যা চেতনার চিরন্তন আত্ম-উন্মোচনেরই রূপ। এই নৃত্যই বাস্তবতার অন্তর্নিহিত গতি—যেখানে সময়, চেতনা ও শক্তি এক অখণ্ড মহাকালের সুরে মিশে যায়। কালী এই অর্থে সময়ের অধিষ্ঠাত্রী নন, সময়ের হৃদয়—যিনি সময়ের মধ্য দিয়েই সময়কে অতিক্রম করেন, আর যার প্রতিটি গতি, প্রতিটি স্পন্দনেই প্রতিফলিত হয় পরম চেতনার অনন্ত উপস্থিতি।
কালীকে যখন শক্তি হিসেবে দেখা হয়, তখন তাঁর মূল পরিচয় হয়ে ওঠে সেই সর্বজনীন সৃষ্টিশীলতা, যার দ্বারা চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে। “কলয়তি”—অর্থাৎ “তিনি কাজ করেন”—এই ক্রিয়াপদ কেবল কোনো বাহ্যিক কর্ম নয়; এটি চেতনার অন্তর্নিহিত ক্রিয়াশক্তির প্রতীক। কালী এখানে সেই দিব্য শক্তি, যিনি চেতনার মধ্যেই প্রক্ষেপণ, সৃষ্টি, প্রত্যাহার, গণনা ও জ্ঞানের সমস্ত প্রক্রিয়া ধারণ করেন। তিনি সত্তার সেই জীবন্ত গতি, যেখানে জানা ও হওয়া একই জৈব একতা। তাঁর “কলন” মানে শুধু কার্য নয়—এটি সচেতন ক্রিয়া, এমন এক অন্তরবৃত্তি যেখানে জ্ঞান, সৃষ্টি, ভোগ ও লয় পরস্পর অবিচ্ছিন্ন।
এভাবেই কালী হয়ে উঠেছেন সময়ের অতীত সময়ের আত্মা। তিনি চেতনার ক্রিয়াশক্তির চিরন্তন উৎস—যেখানে প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি স্পন্দনই পরম চেতনার আত্ম-প্রকাশ। তাঁর নামেই লুকিয়ে আছে তাঁর স্বরূপ: “কলয়তি ইতি কালী”—যিনি কর্মের মাধ্যমে চেতনা প্রকাশ করেন। এই দৃষ্টিতে ক্রমপন্থায় কালী কোনো স্থির দেবী নন; তিনি অস্তিত্বের জীবন্ত নৃত্য, সেই চিরন্তন সত্তার গতিশীল স্পন্দন, যেখানে কাল, ক্রম ও কলন—এই তিনটি ধারণা একাকার হয়ে যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে “ক্রমণ” ও “কলন” আসলে একই নীতির দুই দিক—চেতনার নিরবচ্ছিন্ন স্ব-উল্লেখযোগ্য গতি। চেতনা কখনো স্থির নয়; সে সর্বদা নিজের প্রতিফলনের দিকে গমন করছে, আবার সেই প্রতিফলন থেকেই নিজের অস্তিত্ব নির্ধারণ করছে। এই স্বপ্রবাহমান গতি বা স্বাতন্ত্র্যশক্তির কারণেই পরম নীতি বা পরমচেতনা “কালী” নামে অভিহিত—যিনি কাল-সংকর্ষিণী, অর্থাৎ সময়কে গ্রাস করেন। এখানে “গ্রাস” মানে ধ্বংস নয়; বরং সময় ও অনুক্রম উভয়কেই নিজের মধ্যে একীভূত করা, সমস্ত ক্রিয়াকে চেতনার আত্মস্বরূপে রূপান্তরিত করা।
ক্রমণ (Kramaṇa) মানে হলো “অগ্রসর হওয়া” বা “ধাপে ধাপে অগ্রগতি”—আধ্যাত্মিক বা চেতনার পথে ধীর, ক্রমবিকাশমূলক যাত্রা। কাশ্মীর শৈব দর্শনে “ক্রম” তত্ত্ব বলে, চেতনা উন্মেষ থেকে লয়ে ধাপে ধাপে নিজেকে প্রকাশ ও প্রত্যাহার করে।
কলন (Kalana) মানে “পরিমাপ করা” বা “সীমা নির্ধারণ করা”—অসীম চেতনা যখন নিজেকে সময়, স্থান ও ব্যক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধভাবে প্রকাশ করে, তখন সেই সীমার প্রক্রিয়াই “কলন।” এটি মূলত মায়ার সূক্ষ্ম ক্রিয়া, যা অনন্তকে সীমিত করে জগতের অভিজ্ঞতা সম্ভব করে তোলে।
এই কালী তাঁর এই নাম পেয়েছেন তাঁর পাঁচটি মৌলিক কলনশক্তির কারণে, যা মহাজাগতিক চেতনার ক্রিয়াশীল রূপ প্রকাশ করে। এই পাঁচটি হলো—ক্ষেপ (Kṣepa) বা প্রক্ষেপণ, গতি (Gati) বা গমন, সংখ্যান (Saṅkhyāna) বা গণনা, শব্দ (Śabda) বা প্রকাশ এবং জ্ঞান (Jñāna) বা আত্ম-উপলব্ধি। এই পাঁচ কলনই কেবল পৃথক প্রক্রিয়া নয়; তারা চেতনার এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ, এক অন্তর্লীন নৃত্য—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় অবিরামভাবে একে অপরের মধ্যে রূপান্তরিত হয়।