শৈব কালী: আটানব্বই



তত্ত্বের এই গণনা কোনো কঠোর সংখ্যা নয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন—৩৬ প্রধান তত্ত্বের সঙ্গে যদি ১০ মহাবিদ্যা, ১২ কালিকা ও ১৬ নিত্যা যুক্ত করা হয়, তবে তো মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪। কিন্তু আসলে এখানে কোনো গাণিতিক যোগফল বোঝানো হয় না; বরং এই তিনটি স্তর পরস্পর সংলগ্ন এবং ওভারল্যাপিং ধারা। মহাবিদ্যা, কালিকা ও নিত্যা একে অপরের ভেতরে মিশে থাকা তিনটি স্তর—বহির্মুখ শক্তি, অন্তর্মুখ লয় এবং পূর্ণতার কলা।

মহাবিদ্যা, কালিকা ও নিত্যা আসলে চেতনার তিনটি ধারাবাহিক স্তর, যেগুলি একে অপরের ভেতরে মিশে থাকে। মহাবিদ্যা চেতনার বহির্মুখ শক্তি, যেখানে পরম চেতনা নিজেকে জগতে প্রকাশ করে—সৃষ্টি করে, রূপ দেয়, বিকশিত হয়। এই স্তরে কালী, তারা, ত্রিপুরাসুন্দরী প্রভৃতি দেবী চেতনার প্রকাশশক্তি বা সৃষ্টিশক্তি (sṛṣṭi-śakti)-এর প্রতীক।

কালিকা হলো অন্তর্মুখ লয়ের শক্তি, যেখানে সেই প্রকাশিত চেতনা ধীরে ধীরে নিজের উৎসের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। দ্বাদশ কালিকা এই লয়-শক্তি (saṃhāra-śakti)-এর প্রতীক, অর্থাৎ যে-শক্তি সমস্ত রূপ, চিন্তা, আসক্তি ও সময়কে টেনে নিয়ে যায় নিজের অন্তরে, যাতে চেতনা আবার নিজেকে চিনতে পারে।

নিত্যা হলো পূর্ণতার কলা, যেখানে সৃষ্টি ও লয় উভয়ই একীভূত হয়ে এক চূড়ান্ত শান্ত, জ্যোতির্ময় চেতনায় রূপ নেয়। ষোড়শ নিত্যারা এই পূর্ণতা-শক্তি (pūrṇatā-śakti)-এর প্রতীক, যেখানে আর কোনো গতি নেই—কেবল ঐক্য, সৌন্দর্য ও চিরন্তন দীপ্তি।

অর্থাৎ মহাবিদ্যা প্রকাশ, কালিকা প্রত্যাহার, আর নিত্যা স্থিতি। এই তিনটি ধারা মিলে তৈরি করে চেতনার সম্পূর্ণ স্পন্দনচক্র, যেমন শ্বাসের গ্রহণ, প্রশ্বাস ও বিরাম একত্রে জীবনের প্রবাহ তৈরি করে।

এইভাবে ৩৬ প্রধান তত্ত্বের সঙ্গে এই ২৮ সূক্ষ্ম স্তর মিলিয়ে সম্পূর্ণ হয় চেতনার ৬৪ ধাপ—যেখানে শিবচেতনা নিজের প্রকাশের গভীরতম বিন্দু থেকে লয়ে ফিরে আসে নিজের মধ্যে।

আর এই ৬৪ তত্ত্বেরও ঊর্ধ্বে অবস্থান করে পঁয়ষট্টিতম নীতি বা অনাখ্যা স্তর—যা নাম, রূপ ও শব্দের অতীত, চূড়ান্ত নীরবতা ও নিঃস্পন্দ দীপ্তি। এই অনাখ্যা স্তরেই কালী নিজের স্বরূপে প্রকাশিত—কালাতীত, ক্রমাতীত, এবং সমস্ত সৃষ্টির নিঃশব্দ কেন্দ্রবিন্দু।

এইভাবেই “চৌষট্টি তত্ত্ব” কেবল একটি তাত্ত্বিক বিন্যাস নয়, বরং চেতনার জীবন্ত স্পন্দনচক্র—যেখানে সৃষ্টি ও লয়, নৃত্য ও নীরবতা, শক্তি ও শিব, শব্দ ও নাদ—সব এক হয়ে যায় এক অনন্ত পরম চৈতন্যে, যার হৃদয়ে উদ্‌ভাসিত থাকে সেই সর্বব্যাপী বোধ—“অহম্‌ কালী”—আমি-ই সেই কালাতীত চেতনা। চৌষট্টি তত্ত্ব আসলে চেতনার পূর্ণ ভ্রমণপথ—পরম অদ্বৈত চৈতন্য থেকে শুরু করে জগতের বহুত্ব পর্যন্ত, আর পঁয়ষট্টিতম নীতি সেই চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন—যেখানে সব কিছু আবার মিলিয়ে যায় এক নিঃস্পন্দ, অনির্বচনীয়, কালাতীত কালীচেতনায়।

৩৬ তত্ত্বের কাঠামোটি পরম শিবের স্ব-সংকোচনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে। এই তত্ত্বগুলির প্রথম স্তর হলো শুদ্ধ তত্ত্ব, যা শিবের অসীমতার প্রকাশ। এই পাঁচটি তত্ত্ব সেই মহাজাগতিক পর্যায়গুলিকে চিহ্নিত করে, যেখানে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়ের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই—অদ্বৈত চেতনার স্তর।

শিব তত্ত্ব হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা—নিরাকার, স্বপ্রকাশিত চেতনা (Prakāśa) বা আলোক।

শক্তি তত্ত্ব হলো শিবের স্পন্দিত, সক্রিয় ক্ষমতা (Vimarśa) বা আত্ম-প্রতিফলন। শিব ও শক্তি অস্তিত্বের উৎস, যা সমস্ত ৩৬ তত্ত্বকে পরিব্যাপ্ত করে।

সদাশিব তত্ত্ব চেতনার প্রথম স্পন্দন, যেখানে “আমি এই” (Aham Idam) এই প্রাথমিক উপলব্ধির জন্ম হয়; এই স্তরে বস্তুজগৎ বা “এই” দিকটি এখনো অস্পষ্ট থাকে।

ঈশ্বর তত্ত্বে সচেতনতার প্রতিফলন ঘটে বিপরীতক্রমে—“এই আমি” (Idam Aham), যেখানে বস্তুজগৎ বা “এই” দিকটি আরও সংজ্ঞায়িত হয়।

শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্ব হলো জ্ঞান ও কর্মের ভারসাম্যপূর্ণ স্তর—“আমি এই, এই আমি” (Aham Idam, Idam Aham)।

এরপর আসে শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্ব, যেখানে মায়া ও স্ব-সংকোচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সাতটি তত্ত্ব শিবের অসীমতা থেকে সীমিত জীব (Puruṣa) এ পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ—যেখানে চেতনা নিজের অসীম স্বরূপকে সীমার মধ্যে আনতে শুরু করে। এই স্তরেই বন্ধন বা “মলা”-র (আবরণ) সূচনা ঘটে। মায়া তত্ত্ব হলো মূল আবরণ বা বিভ্রমের শক্তি, যা পরিমাপহীন পরমকে পরিমেয় করে তোলে। এটি চেতনার প্রকৃত স্বরূপের বিস্মৃতির সূচনা—যেখানে অসীম একত্ব নিজেকে ভিন্নতা হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে।

পঞ্চকঞ্চুক হলো মায়ার পাঁচটি সূক্ষ্ম আবরণ, যা সীমিত আত্মার জন্ম দিতে পরম শিবের অসীম গুণাবলিকে সংকুচিত করে। এগুলি হলো—

কলা তত্ত্ব: সর্বকর্তৃত্বকে সংকুচিত করে সীমিত কর্তৃত্ব বা কার্যক্ষমতায় রূপান্তরিত করে;

বিদ্যা তত্ত্ব: সর্বজ্ঞানের সংকোচন ঘটিয়ে আংশিক, সীমিত জ্ঞান সৃষ্টি করে;

রাগ তত্ত্ব: সর্বসন্তুষ্টির অবস্থা সংকুচিত হয়ে অভাববোধ ও আকাঙ্ক্ষা জন্ম দেয়;

কাল তত্ত্ব: চেতনার চিরন্তনতাকে সংকুচিত করে সময়কে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ক্রমে বিভক্ত করে; এবং

নিয়তি তত্ত্ব: সর্বব্যাপী স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে স্থান, কারণ ও ভাগ্যের নির্দিষ্টতা সৃষ্টি করে।

এই পর্যায়ের শেষে আসে পুরুষ তত্ত্ব, যা এই সাতটি আবরণের দ্বারা আবৃত সীমিত আত্মা বা জীব, যিনি ভোক্তা হিসেবে জাগতিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র লাভ করেন।

অশুদ্ধ তত্ত্ব বা আশুদ্ধ স্তর (Aśuddha Tattvas) হলো ১৩ থেকে ৩৬ নম্বর তত্ত্ব পর্যন্ত সেই পর্যায়, যেখানে চেতনা জাগতিক রূপ ধারণ করে এবং মানসিক ও বস্তুগত কাঠামোয় পরিণত হয়। এই চব্বিশটি তত্ত্ব জাগতিক অভিজ্ঞতা ও স্থূল বাস্তবতাকে গঠন করে, যা সীমিত পুরুষ বা জীবাত্মার অভিজ্ঞতার জন্য অপরিহার্য।

প্রথমে রয়েছে প্রকৃতি তত্ত্ব (Prakṛti Tattva)—তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম)-এর সাম্যাবস্থা, যা সমগ্র জাগতিক প্রকাশের ভিত্তি। এর মধ্য থেকেই প্রকাশ পায় অন্তঃকরণ (Antaḥkaraṇa), যা বুদ্ধি (বিচারবোধ), অহংকার (‘আমি’-বোধ), ও মন (চিন্তার গতি)—এই তিনের সম্মিলিত মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো।

এরপর ইন্দ্রিয় ও তন্মাত্র (Indriyas & Tanmātras) স্তরে চেতনা জ্ঞানের ও কর্মের সূক্ষ্ম উপকরণ রূপে প্রকাশ পায়। জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা চেতনা জগৎকে উপলব্ধি করে, কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা ক্রিয়া সম্পাদন করে, এবং তন্মাত্ররূপে অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম উপাদানগুলো—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ—সৃষ্ট হয়।

সবশেষে এই সূক্ষ্ম উপাদানগুলো থেকে গঠিত হয় মহাভূত (Mahābhūtas)—আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী—যেগুলি দৃশ্যমান জগতের স্থূল রূপ প্রদান করে।

এইভাবে অশুদ্ধ তত্ত্ব চেতনার সর্বাধিক ঘনীভূত রূপ, যেখানে বিশুদ্ধ চেতনা বস্তু, মন, ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করে।

লয়-ক্রমের দার্শনিক ভিত্তি অনুযায়ী, এই সৃষ্ট জগতের প্রতিটি তত্ত্বই পরে নিজের উৎসে ফিরে যায়। এই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়োজন ২৮ দেবী-তত্ত্ব, যাঁরা চেতনার গতিশীল দিক বা বিমর্শ (Vimarśa)-এর প্রতীক। এঁরাই ৩৬ তত্ত্বের মাধ্যমে সৃষ্ট বন্ধনকে দ্রবীভূত করে—এই প্রক্রিয়াই লয়-ক্রম (Laya-Krama)।

এর প্রথম স্তর দ্বাদশ কালী (Dvādaśa Kāli), যাঁরা লয় ও প্রত্যাহারের শক্তির প্রতীক। দ্বাদশ কালী মহাজাগতিক চক্রের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকে প্রতীকায়িত করেন। ক্রম (Krama) দর্শনে পরম দেবী হিসেবে কালসংকর্ষণী কালী পরিচিত, যিনি সময়কে গ্রাসকারী শক্তি (saṃkarṣaṇī)।

দ্বাদশ কালীর মাধ্যমে চেতনার লয়ের প্রক্রিয়াটি সূক্ষ্মভাবে প্রকাশিত হয়। সৃষ্টি কালী (Sṛṣṭikālī) চেতনার বহির্মুখী প্রক্ষেপণ—যেখানে দেবী বস্তুগত জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। এই স্তরে দেবী নিজের স্বরূপকে বস্তুজগতে লুকিয়ে রেখে একই সঙ্গে বিস্তার (unfolding) ও সংকোচনের (enfolding) আনন্দে লীন থাকেন।

সংহার কালী (Saṃhārakālī) স্তরে সচেতনতা নিজেকে সংহার কালী রূপে ধ্যান করে। দেবী এখানে বস্তুর উপর আরোপিত উদ্‌বেগ, আকর্ষণ বা আসক্তির সমস্ত উপাদানকে গ্রাস করেন। তন্ত্রালোক অনুসারে, এই প্রক্রিয়ায় তিনি সমস্ত বাহ্যিক ঘটনাকে নিজের অন্তর্গত আত্মঅগ্নিতে গলিয়ে দিয়ে প্রত্যাহার করেন। সংহার কালী অনন্ত, মনের অগম্য এবং প্রপঞ্চিক অস্তিত্বের সংহরণে চোখ বন্ধ করে বিশুদ্ধ শূন্যতা (pure and perfect void) রূপে উদিত হন।

মৃত্যু কালী (Mṛtyukālī) স্তরে যোগী অনুভব করেন যে, সংহারের ক্ষমতা, অর্থাৎ devourer, তিনিই নিজে। সচেতনতা তার অন্তর্নিহিত প্রকৃতিকে ধ্যান করে—“এই পুনঃশোষণের শক্তিটিই আমার প্রকৃতি।” এই উপলব্ধিতে দেবী মৃত্যু ও অহংকার উভয়কেই গ্রাস করেন, কারণ উভয়ই এক অনিত্য অভিজ্ঞতা মাত্র।

রুদ্র কালী (Rudrakālī) স্তরে উগ্র কালী সেই শক্তি, যিনি চেতনার গভীরে থাকা সমস্ত সন্দেহ, উদ্‌বেগ ও দ্বন্দ্বকে দৃঢ়ভাবে টেনে আনেন, যাতে তারা স্পষ্টভাবে উদ্‌ভাসিত হতে পারে। এরপর তিনি সেই সব সুপ্ত বাধাকে (rodhana) দ্রবীভূত (drāvaṇa) করে দেন, অর্থাৎ সচেতনতায় রূপান্তর করেন। তাঁর দীপ্তি অসীম; তিনি সমস্ত ভয়, দ্বন্দ্ব ও বিভ্রমকে নিজের মধ্যে গ্রাস করে মহাশক্তির রূপে প্রকাশিত হন।

মার্তণ্ড কালী (Mārtaṇḍakālī) স্তরে দেবী বারোটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের চাকাটিকে—যা সূর্যের মতো চেতনার আলো বিতরণ করে—প্রত্যাহার করেন। এই প্রত্যাহারের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গুলি পুনরায় চেতনার উচ্চ স্তরে মিশে যায় এবং অহংকারের সঙ্গে একীভূত হয়। এখানে ইন্দ্রিয়ের কর্ম ও জ্ঞান উভয়ই আত্মচেতনায় লীন হয়ে যায়—জগতের আলোক তখন অন্তর্লোকের দীপ্তিতে রূপান্তরিত হয়।

ষোড়শ নিত্যা বা ষোলোটি নিত্যা তত্ত্ব আসলে চেতনা ও সময়ের ছন্দময় ঐক্যের প্রতীক। দেবী ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতা এই ষোলো নিত্যা রূপে প্রকাশিত হন, যাঁদের মধ্যে প্রথম পনেরো জন চন্দ্রের পনেরো তিথির সঙ্গে সম্পর্কিত, আর ষোড়শী বা মহা ত্রিপুরাসুন্দরী পূর্ণিমার প্রতীক—চূড়ান্ত ঐক্য ও পূর্ণতার রূপ। চন্দ্রকলার এই পনেরো ধাপ এবং স্বয়ং ষোড়শী চেতনার ষোলো রূপান্তরমূলক অবস্থাকে প্রকাশ করে, যেখানে প্রতিটি কলা চেতনার একটি নির্দিষ্ট দীপ্তি, অনুভব বা উপলব্ধির ধাপ নির্দেশ করে।

নিত্যাদের সঙ্গে সময় ও চেতনার সম্পর্ক গভীরভাবে প্রতীকী। তাঁরা কেবল দেবী-রূপ নয়, বরং কালচক্র বা সময়ের চক্রের শক্তিগুলি, যা প্রতিটি মুহূর্তে চেতনার তরঙ্গ সৃষ্টি করে। তাঁদেরকে সংস্কৃত বর্ণমালার স্বরবর্ণ (vowels)-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়, কারণ স্বরবর্ণ চেতনার মৌলিক স্পন্দন (vibration) বা প্রাণধ্বনি; আর ব্যঞ্জনবর্ণ (যা ৩৬ তত্ত্বের প্রতীক) সেই চেতনার নির্দিষ্ট রূপ ও সীমার প্রতীক। যখন ৩৬ ব্যঞ্জনবর্ণ (তত্ত্ব) ১৬ স্বরবর্ণ (নিত্যা) দ্বারা গুণিত হয়, তখন ৫৭৬ ধ্বনির একটি মহাজাগতিক সংখ্যা তৈরি হয়—এটি নির্দেশ করে যে, সমস্ত সৃষ্টিই চেতনার ধ্বনি-কম্পন ও সময়ের তরঙ্গের গুণিতক।

নিত্যাদের উপাসনা শ্রীচক্রের কেন্দ্রীয় ত্রিভুজে সম্পন্ন হয়। শ্রীচক্র হলো দেবী ত্রিপুরসুন্দরীর প্রতীকী রূপ—যেখানে বিভিন্ন ত্রিভুজ চেতনার স্তরগুলিকে নির্দেশ করে। এর কেন্দ্রীয় উলটো ত্রিভুজটি চেতনার গভীরতম স্তর বা সৃষ্টিশক্তির প্রতীক। এই ত্রিভুজের মধ্যে নিত্যাদের পূজা করা মানে হলো নিজের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে দেবীশক্তির বিভিন্ন রূপকে জাগ্রত করা।

এই কেন্দ্রীয় ত্রিভুজ আসলে চেতনার অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সমস্ত গতি, চিন্তা ও দ্বৈততা বিলীন হয়। সাধক যখন নিত্যাদের ধ্যান করেন, তখন তিনি নিজের অন্তর্লোকের গভীরে প্রবেশ করেন—যেখানে শুদ্ধ চেতনা সর্বত্র বিরাজমান।

'নিত্য ষোড়শার্ণব তন্ত্র' (Nitya Ṣoḍaśārṇava Tantra) হলো হিন্দুধর্মের শাক্ত (দেবী উপাসক) এবং শ্রীবিদ্যা ঐতিহ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক গ্রন্থ। এটি মূলত দেবী ললিতা ত্রিপুরসুন্দরী বা ষোড়শী-এর উপাসনা, মন্ত্র ও যজ্ঞের পদ্ধতি এবং এর দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে রচিত।

এখানে বলা হয়েছে, এই পনেরো নিত্যা দেবীকে বামাবর্তে পূজা করতে হয়, অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। এই বামাবর্ত গতি প্রতীক করে চেতনার অন্তর্মুখ প্রত্যাবর্তন—বাহির থেকে ভিতরের দিকে, বহির্বিশ্ব থেকে আত্মার দিকে যাত্রা। পনেরো নিত্যা দেবী আসলে চন্দ্রের পনেরো কলার প্রতীক, তাই এই পূজাক্রমে চেতনা ধীরে ধীরে নিজের উৎসে ফিরে যায়।