চেতনা (Consciousness) কালীতত্ত্বে মূলত শিবচেতনারই প্রকাশ—অর্থাৎ, পরম, নিরাকার, নিরুপাধি চেতনা শক্তির মাধ্যমে নিজেকে চিনে ও প্রকাশ করে। শিব এখানে “চিদাকাশ” বা বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক, যা নিস্তরঙ্গ, অচঞ্চল এবং নির্বিকার; আর শক্তি (কালী) হলো সেই চেতনার বিমর্শশক্তি—যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে প্রত্যক্ষ করে, অভিজ্ঞতা করে এবং “আমি” ও “এই জগৎ” রূপে প্রকাশিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে, চেতনা (cit বা brahman) এক ও অভিন্ন; সমস্ত প্রপঞ্চ তারই আপাত প্রতিফলন। শঙ্করাচার্যের ভাষায়, “চৈতন্যং একমেব তত্ত্বম্”—চেতনা এক, তার বাইরে কিছু নেই। জগৎ সেই চেতনারই মায়াময় প্রতিফলন। কিন্তু কালী-চেতনা সেই নির্জীব প্রতিফলনের ধারণাকে সক্রিয় করে তোলে; এখানে চেতনা শুধু সাক্ষী নয়, স্ব-সচেতন—নিজেকে জানার আনন্দেই লীলাময়। তাই বলা হয়, কালী হলেন “চিদানন্দরূপিণী”—চেতনার সেই রূপ, যেখানে জ্ঞান, শক্তি ও আনন্দ একত্রে বিকশিত।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায়, চেতনা কখনও নিস্ক্রিয় নয়; বরং সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্পন্দমান। শিবচেতনা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় (svātantrya) যখন নিজেকে চিনতে চায়, তখন শক্তি উদ্ভূত হয়। এই শক্তিই কালী। তিনি সেই Vimarśa—স্ব-বিমর্শ, যার দ্বারা চেতনা নিজের সত্তাকে প্রত্যক্ষ করে। শিব যদি হয় “প্রকাশ” (আলোক), তবে কালী সেই “বিমর্শ”—যিনি সেই আলোকের আত্মসচেতনতা। তাই কাশ্মীর শৈব মতে, “শক্তিবিমুখো যঃ শিবঃ, সঃ শবঃ”—শক্তিহীন শিব মৃতদেহের সমান, কারণ কার্যহীন চেতনা নিস্পন্দ। কালী সেই চেতনার চলন, নৃত্য, আত্ম-উন্মোচন—তিনি শিবের নিস্তরঙ্গতায় প্রাণ সঞ্চার করেন।
শাক্ত দর্শনে, চেতনা ও শক্তি অবিচ্ছেদ্য। দেবী মহাকালী চেতনার সেই দিক, যিনি আত্মাকে নিজের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর রূপে চেতনা কোনো দূরবর্তী দর্শক নয়, বরং জীবনের প্রতিটি গতিতে, প্রতিটি অনুভবে, প্রতিটি ধ্বংস ও নবজন্মে নিজেকে চিনে। তাই কালী সৃষ্টিশক্তি নন শুধু; তিনি প্রতিসংহৃত চেতনা—যিনি জগৎকে সৃষ্টি করে, আবার নিজের মধ্যেই টেনে নেন, যেন চেতনা নিজেকে প্রতিফলিত করতে পারে।
মনোবিশ্লেষণাত্মকভাবে দেখলে, কালী-চেতনা হলো Self-awareness-এর গভীরতম প্রতীক। কার্ল ইয়ুং-এর দৃষ্টিতে এটি সেই archetype, যেখানে অবচেতন মনের গভীর অন্ধকার থেকে আত্মসচেতনতা জাগে। অর্থাৎ, মন নিজের Shadow, ভয় ও আকাঙ্ক্ষাকে চিনে নেয় এবং সেই চেনার মধ্য দিয়েই নিজেকে পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে। কালী সেই রূপান্তরের শক্তি—তিনি মনের গহ্বর থেকে চেতনার আলো জ্বালিয়ে দেন।
কালী মানে সেই চেতনা, যা স্থির নয়—যা নিজের শক্তির মাধ্যমে নিজেকে জানে। শিবচেতনা তাঁর মধ্যে নিস্তব্ধ; কিন্তু শক্তি—অর্থাৎ কালী—সেই নিস্তব্ধতার উন্মোচন। তিনি শেখান, চেতনা কখনও বাইরের জগতে নয়—এটি সেই অন্তর্লীন অনুভব, যেখানে দেখার ও দেখা-যাওয়ার ভেদ মুছে যায়, আর থাকে কেবল এক অদ্বৈত অভিজ্ঞতা—“আমি চেতনা, আমি কালী, আমি সেই শিব, যা নিজেকে চিনেছে।”
তান্ত্রিক ও অদ্বৈত দর্শনে “সংহার (Dissolution)” কখনোই কেবল ধ্বংস বা বিনাশ নয়—এটি চেতনার রূপান্তরের প্রক্রিয়া, যেখানে পুরোনো রূপ বিলীন হয়ে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগে। এই ধারণাটি কালী-চেতনার অন্তর্নিহিত মূল নীতি, কারণ কালী নিজেই সংহার-শক্তি—কিন্তু সেই সংহার ভয়ের নয়, বরং মুক্তির।
অদ্বৈত বেদান্তে সংহার মানে মায়াময় জগতের অবসান নয়; বরং মায়ার আচ্ছাদনের অপসারণ—যেখানে জীবাত্মা তার প্রকৃত স্বরূপে, ব্রহ্মচেতনায় জেগে ওঠে। যেমন শঙ্করাচার্য বলেন, “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা”—এই “মিথ্যা” মানে জগৎ বিলুপ্ত নয়, বরং তার আপাত ভ্রান্ত রূপের অপসারণ। সংহার তাই বস্তুর মৃত্যু নয়, ভুল চেতনার মৃত্যু। কালী সেই প্রক্রিয়ার রূপ, যিনি অজ্ঞান ও অহংকারের পর্দা ছিঁড়ে সত্য চেতনার উদ্ভাস ঘটান।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে সংহার (saṁhāra) হলো শিবের পঞ্চকৃত্য বা পাঁচ মহাক্রিয়ার এক ধাপ—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোভাব (tirobhāva) এবং অনুগ্রহ (anugraha)। অভিনবগুপ্তের মতে, এই সংহার কোনো বিনাশ নয়; এটি চেতনার অন্তর্মুখী প্রত্যাহার (pratisaṁhṛti)—যেখানে বাহ্যিক প্রকাশ নিজস্ব উৎসে ফিরে যায়। জগৎ তার প্রকাশিত রূপ হারিয়ে চেতনার মধ্যেই শোষিত হয়, যেমন তরঙ্গ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু জল থেকে আলাদা হয় না। তাই সংহার মানে, জগৎ চেতনার কাছে ফিরে যাওয়া—এক লীলার সমাপ্তি, আরেক লীলার প্রস্তুতি।
শাক্ত দর্শনে, সংহার দেবীর করুণা। দেবী কালী এই করুণার রূপ—তিনি ধ্বংস করেন অজ্ঞান, আসক্তি ও অহংকারকে, কিন্তু তা করেন মুক্তির জন্য। তাঁর খড়্গ জ্ঞানের প্রতীক, যা মিথ্যা ধারণার গ্রন্থি ছিন্ন করে। তাই সংহার কোনো প্রলয় নয়; এটি আত্মজাগরণের সূচনা। দেবী নিজে বলেন—“মরণম্ ন তু নাশঃ, মরণম্ পুনর্জন্মোদয়কারণম্”—মৃত্যু মানে শেষ নয়, নতুন জীবনের সূচনা।
মনস্তত্ত্বে, সংহার মানে psychic transformation—মন যখন নিজের পুরোনো চিন্তাভাবনা, অভ্যাস ও ভয়গুলো ছেড়ে দেয়, তখনই নতুন সত্তার জন্ম হয়। কার্ল ইয়ুং এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন death-rebirth archetype—যেখানে পুরোনো সত্তা বিলীন হয়, আর অবচেতনের অন্ধকার থেকে নতুন চেতনা জন্ম নেয়। কালী সেই রূপান্তরের শক্তি, যিনি এই “মৃত্যু-জনন” প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আত্মাকে পরিপূর্ণ করে তোলেন।
সংহার মানে ধ্বংস নয়—এটি চেতনার পুনরুদ্ধার। পুরোনো পরিচয় ভেঙে পড়ে, যাতে আত্মা নিজের অসীমতা উপলব্ধি করতে পারে। কালী শেখান—“যা বিলীন হয়, তা হারায় না; তা কেবল রূপান্তরিত হয়ে ফিরে আসে চেতনার গভীরতর স্তরে।” তাই সংহারই সৃষ্টি, মৃত্যু থেকেই জাগরণ, আর বিনাশ থেকেই চিরন্তন পুনর্জন্ম।
করুণা (Compassion) কালী-তত্ত্বের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও রহস্যময় দিকগুলির একটি, কারণ তাঁর ভয়ংকর রূপের অন্তরে বিরাজ করছে এক গভীর, সীমাহীন মমতা। এই করুণা কোনো কোমল আবেগ নয়—এটি সেই চেতনার করুণা, যা অজ্ঞান ও বন্ধনের পর্দা ছিঁড়ে মুক্তি দেয়। কালী ধ্বংস করেন, কিন্তু সেই ধ্বংস প্রতিহিংসার নয়; তা চূড়ান্ত কল্যাণের, আত্মার মুক্তির জন্য।
অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে, করুণা হলো “ব্রহ্মচেতনা”-র স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। যিনি জগতকে নিজের মধ্যেই অনুভব করেন, তাঁর জন্য কোনো “অন্য” নেই—তাই তাঁর কর্ম, এমনকি সংহারও, সর্বজনীন মমতারই ফল। শঙ্করাচার্যের ভাষায়, “আত্মবৎ সর্বভূতেষু”—যিনি আত্মাকে সর্বত্র দেখেন, তিনিই প্রকৃত দয়ালু। কালী সেই চেতনারই প্রতীক—তিনি ধ্বংস করেন না অন্যকে, করেন বরং সেই মায়াজনিত ভ্রান্ত সত্তাকে, যা আমাদের সত্য আত্মাকে আড়াল করে রাখে। তাই তাঁর রক্তপান আসলে অজ্ঞানপানের প্রতীক—অর্থাৎ, তিনি জগতের মিথ্যা রূপকে গ্রাস করে তাকে চেতনার আলোয় রূপান্তর করেন। তাঁর করুণা ধ্বংসের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত, কারণ কেবল ধ্বংসই জন্ম দেয় মুক্তির।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে, করুণা (anugraha) শিবের পাঁচটি চিরন্তন ক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোভাব (tirobhāva) এবং অনুগ্রহ (anugraha)। এখানে অনুগ্রহ মানে চেতনার আত্ম-প্রকাশ, আত্ম-পরিচয় এবং আত্ম-উদ্ধার। কালী সেই অনুগ্রহের রূপ—তাঁর ধ্বংস আসলে অনুগ্রহের এক গতিশীল অভিব্যক্তি। যখন জীব নিজ অহং, আসক্তি ও ভয় ত্যাগ করে, তখন কালী-চেতনা তার মধ্যে করুণারূপে প্রবাহিত হয়। অভিনবগুপ্ত এই করুণাকে বলেন mahānugraha—পরম অনুগ্রহ, যেখানে সংহারই মুক্তির মাধ্যম।
শাক্ত দর্শনে করুণা ও সংহার কখনও পৃথক নয়। কালী “সংহার-কারিণী”, কিন্তু সেই সংহার চিরন্তন মাতৃত্বের রূপে আবদ্ধ। তিনি সন্তানকে রক্ষা করতে যেমন বিষ দহন করেন, তেমনি মায়ার বন্ধন দগ্ধ করে আত্মাকে জাগিয়ে তোলেন। তাই তাঁকে বলা হয় “করুণাময়ী ভৈরবী”—ভয়ংকর হলেও তিনি সর্বদা কল্যাণময়ী। তাঁর খড়্গ জ্ঞানের অস্ত্র, কিন্তু তাঁর হৃদয় অনন্ত প্রেমের উৎস। ধ্বংসের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের শেখান—মৃত্যু ভয়ের নয়, সেটিই জীবনের নতুন উপলব্ধি।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়, এই করুণা মানে আত্ম-গ্রহণ ও আত্ম-রূপান্তরের সাহস। আধুনিক মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের দৃষ্টিতে, কালী সেই compassionate destroyer—যিনি ব্যক্তিকে নিজের Shadow-এর মুখোমুখি দাঁড় করান, তাকে গ্রহণ করতে শেখান এবং তার মধ্য দিয়েই পূর্ণতা অর্জন সম্ভব করেন। এই করুণা দয়া নয়; এটি বোধের উন্মেষ—যেখানে ভয় ও মৃত্যু আর বিপরীত নয়, বরং আত্ম-অতিক্রমণের পথ।
কালী-চেতনার করুণা হলো ধ্বংসের অন্তরে নিহিত অনন্ত মমতা—এক এমন প্রেম, যা মুক্তি দেয়, এক এমন মৃত্যু, যা জীবন জাগায়। তাঁর করুণা আমাদের শেখায়—যে-মুহূর্তে আমরা নিজের ভয়, বেদনা, অন্ধকারকে আলিঙ্গন করি, তখনই জীবনের গভীরতম দীপ্তি উদ্ভাসিত হয়। ধ্বংস তাঁর বাহ্যরূপ, কিন্তু করুণা তাঁর আত্মা—কারণ মৃত্যুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিরন্তন জীবন।
কালীর অসংখ্য রূপ কোনো বিচ্ছিন্ন দেবীমূর্তি নয়; এগুলি আসলে চেতনার বহুমাত্রিক স্তর—ব্রহ্মশক্তির ভিন্ন ভিন্ন ছায়া ও প্রকাশ। অদ্বৈত বেদান্ত, কাশ্মীর শৈব ও শাক্ত দর্শনের দৃষ্টিতে এই রূপগুলি এক পরম, অভিন্ন শক্তির নানা গতিশীল অবস্থার প্রতীক, যিনি একই সঙ্গে সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার ও মুক্তির প্রক্রিয়ায় কর্মরত। কাশ্মীর শৈববাদের ক্রম (Krama) প্রণালী বিশেষভাবে এই বহুরূপী কালীচেতনাকে ব্যাখ্যা করে—যেখানে চেতনার এই ক্রমবিকাশ ও প্রত্যাহার (sṛṣṭi—sthiti—saṃhāra) কোনো রৈখিক ক্রিয়া নয়, বরং এক অন্তহীন চক্র, এক স্পন্দ—যেখানে শিবচেতনা ও শক্তিচেতনা পরস্পরে মিশে জগৎ ও আত্মার নৃত্যরূপে প্রকাশ পায়।
দক্ষিণাকালী: ইনি হলেন কালীচেতনার সবচেয়ে জনপ্রিয়, কিন্তু একাধারে সবচেয়ে গভীর দার্শনিক রূপ—যিনি করুণার মধ্য দিয়েই ধ্বংসের সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর রূপ গাঢ় কৃষ্ণবর্ণা, সম্পূর্ণ নগ্ন, চারভুজা, আর তিনি শিবের শান্ত বক্ষের উপর পদার্পণ করে আছেন। বাহ্যদৃষ্টিতে তিনি ভয়ংকর, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিতে তিনি করুণাময়; তাঁর এই “ভয়ংকর করুণা”ই অদ্বৈত জ্ঞানের চাবিকাঠি।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে দক্ষিণাকালীর ধ্বংস মানে কোনো প্রলয় বা শেষ নয়; এটি মায়ার অবসান। মানুষ যতক্ষণ দ্বৈত জগতকে সত্য মনে করে, ততক্ষণ অজ্ঞান ও ভয় তাকে আবদ্ধ রাখে। কালী সেই মায়া-নির্মিত দ্বৈততাকে ছিন্ন করেন, যাতে আত্মা নিজের আসল রূপ—নির্বিশেষ চেতনা—চিনতে পারে। তাঁর কৃষ্ণবর্ণ দেহ সেই অনন্ত চেতনার প্রতীক, যা সব আলো ও ছায়া, সুখ ও দুঃখ, জীবন ও মৃত্যুকে নিজের মধ্যে ধারণ করে, কিন্তু নিজে কিছুতেই পরিবর্তিত হয় না। তাই তাঁর ধ্বংস আসলে মুক্তির প্রস্তুতি—তিনি যা ধ্বংস করেন, তা মিথ্যা; আর যা অবশিষ্ট রাখেন, সেটিই পরম সত্য।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ব্যাখ্যায় দক্ষিণাকালী হলেন চেতনার স্বাতন্ত্র্যশক্তি (svātantrya-śakti)—যিনি নিস্তরঙ্গ শিবচেতনাকে গতিশীল করে তোলেন। শিব হলেন স্থিত চেতনা, আর কালী সেই চেতনার আত্মবিমর্শন (vimarśa)—যা নিজের মধ্যেই নিজেকে অনুভব করে। যখন তিনি শিবের বক্ষে দাঁড়ান, সেটি বোঝায় যে, নিস্তরঙ্গ চেতনা ও গতিশীল শক্তি অবিচ্ছেদ্য। কাশ্মীর শৈব মতে, এই নৃত্য কোনো সংঘর্ষ নয়, বরং পরিপূর্ণ সমন্বয়—প্রকাশ (আলো) ও বিমর্শ (আত্মসচেতনতা)-এর ঐক্য। দক্ষিণাকালী সেই মুহূর্তের প্রতীক, যখন চেতনা নিজের নিস্তরঙ্গ বিশ্রাম থেকে স্পন্দিত হয়ে মহাজাগতিক সৃজন ও ধ্বংসে প্রবেশ করে।
শাক্ত দর্শনে দক্ষিণাকালী “ধ্বংসের করুণা”—যিনি কঠোরতাকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে রূপান্তর করেন। তাঁর খড়্গ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, আর তাঁর অভয়হস্ত আশ্বাস দেয়: “ভয় করো না, ধ্বংসই তোমাকে সত্যে ফিরিয়ে নেবে।” এখানে ধ্বংস মানে চেতনার পুনর্জন্ম। তিনি সেই মাতৃচেতনা, যিনি সন্তানকে নিজের সীমা ভাঙতে বাধ্য করেন—ভয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ দেখান।
তাঁর রূপ মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও এক রূপান্তরের প্রতীক। দক্ষিণাকালী আমাদের শেখান, অন্তরের ভয়, ক্রোধ, দুঃখ, কিংবা মৃত্যু—এসব থেকে পালিয়ে নয়, এগুলির মধ্য দিয়েই আত্ম-অতিক্রম সম্ভব। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি shadow integration—নিজের অন্ধকার দিককে অস্বীকার না করে, তা গ্রহণ ও রূপান্তর করা। কালী তাই অন্ধকারের পরাজয় নন, বরং তার আলোকায়ন।