মানুষের মন বড়ো অদ্ভুত—সম্পর্কের ভেতর যতটা না বাঁচে, সম্পর্কের শেষে যেন ততটাই মরে যায়। শেষ দেখা, শেষ চাহনি, শেষ আলাপ, শেষ ছুঁয়ে দেওয়া, শেষ বিদায়—এ সবই যেন হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা ভারী করে দেয়, নিঃশ্বাসের জন্য যেটুকু বাতাস লাগে, তার ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ‘লাস্ট মিটিং থিওরি’ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। এই থিওরি বলে, যে-কোনো সম্পর্কের সমাপ্তি আসলে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে শেষ সাক্ষাৎয়ের মাধ্যমে। যদিও মনোবিজ্ঞানে এর পোশাকি কোনো নাম নেই, তবুও মানুষের অভিজ্ঞতার ভেতর এ যেন জীবন্ত সত্য।
শেষ দেখাটা কেন এত জরুরি মনে হয়? আসলে মানুষের মন কেমন জানি closure খোঁজে, সমাপ্তি চায়, যাতে করে মনের ভেতরের হাহাকারগুলোকে কোনো এক বইপ্রেমিকের বুকশেলফের বইয়ের মতো করে সারিসারি গুছিয়ে রাখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সমাপ্তি কি কেবল একবার দেখা করলেই হয়ে যায়? না কি এর পেছনে কাজ করে অন্য কোনো গভীর মনস্তত্ত্ব?
মনোবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। John Bowlby তাঁর ‘অ্যাটাচমেন্ট থিওরি’-তে দেখিয়েছেন ছোটোবেলায় মানুষ কেমন করে তার মা-বাবা তথা আপনজনদের সাথে আবদ্ধ হয়, এবং বড়ো হয়ে যখন কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, তখন সেই নতুন সম্পর্কের ভাঙা-গড়া কেমন করে তার পূর্বের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই প্রায়ই দেখা যায়, কোনো সম্পর্ক শেষ হলে সেই শেষ দেখা যেন শৈশবের স্মৃতিকে বয়ে নিয়ে আসে, পূর্বের কোনো ভরসাহীনতার ব্যথাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে।
অন্যদিকে Elisabeth Kübler-Ross তাঁর বিখ্যাত ‘গ্রিফ স্টেজ’-এ বলেছেন, ক্ষতি মেনে নেবার জন্য মানুষ মূলত পাঁচটি ধাপ পার করে: ১) অস্বীকার, ২) রাগ, ৩) দর-কষাকষি, ৪) দুঃখ এবং ৫) শেষমেশ মেনে নেওয়া। আর শেষ দেখা অনেকসময় (প্রায় সবসময়ই) এই ধাপগুলোকে দ্রুততর করে তোলে—চোখের সামনে সমাপ্তিটিকে তুলে ধরতে পারে বলে।
এত কিছুর পরও বলতে হবে, ‘লাস্ট মিটিং থিওরি’ আসলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো ফল নয়, এটি আসলে মানুষের আবেগের নির্মাণ, যা সাহিত্য, কবিতা, গল্প সব জায়গাতেই এক বিশেষ মর্যাদা ধারণ করে। হয়তো এ কারণেই আমরা শেষ দেখা ভুলতে পারি না।
কোনো সম্পর্কের সমাপ্তি কখনোই কেবল একটি সাক্ষাৎ বা একটা দেখা করার মুহূর্ত থেকে আসে না। তা আসে মূলত নিজের ভেতরের স্বীকৃতি থেকে, মেনে নেওয়া থেকে। নয়তো সম্পর্কের বাঁধন না থাকা সত্ত্বেও জীবন আটকে থাকে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে, একটা সুপ্ত আশা নিয়ে—‘উৎসব’ সিনেমার সেই দৃশ্যের মতো, যেখানে জেসমিন জাহাঙ্গীরের লুকিয়ে-রাখা প্রবেশপত্র খুঁজে পায়। ওই মুহূর্তটা আসলে একটা প্রতীকী চিত্র মাত্র, সম্পর্কে টানাপোড়েন তো এসেছিল অনেক আগেই, আর প্রবেশপত্রের বাহানায় শেষ মিটিংটা সম্পন্ন হয়েছিল সম্পর্কের ইতি টানতে।
তাই শেষ দেখা আসলে সম্পর্কের একটা ছবি মাত্র, তার বাহ্যিক চিহ্ন বা প্রকাশ—যা সত্যিই কখনো কখনো খুব জরুরি হয়ে পড়ে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি শেষ মুহূর্তকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে ভুল করি?