শেষআলোর রূপকথা

 
অবশেষে, তারা আমাকে ঘিরে জাহান্নাম-রচনা করেই ফেলল!
বোধের সলতে এখানে আগুনে পুড়ছে
এবং এর শিখা অদৃশ্য হয়ে আছে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওটাকে
এতটাই অনর্থক দেখাচ্ছে যে নীলটাকেও অসহ্য লাগছে!


আমি দীর্ঘদিন ধরেই জানি, আমি যাকে
একসময় অতুলনীয়া বলে ভাবতাম,
যার আখরোটের মতন বাদামী দুটি চোখ দেখে
স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম দিনের পর দিন,
সে মূলত অযাচিত স্তম্ভের মতো, অহেতুক যুদ্ধের মতো, অথচ
তার কাছেই কিনা আমি ব্যাকুল হয়ে এতদিন ছুটে এসেছি!
জেনে রাখুন মান্যবর, আমি কিন্তু কেবলই নিজের কথা বলছি না!


শান্ত, সুন্দর দিনগুলি আর নেই।
ওই উঁচুতে যে মসৃণ হ্রদটি ছিল, ওটিও আজ নেই।
আমি সুখে আছি কি নেই, যে আয়নাটি বলে দিতে পারতো,
সেটিও হারিয়ে গেছে।
সবকিছুতেই শূন্যতা দেখে আমার কেবল অশান্তি লাগছিল।
একটি মৃত সন্তানের দায় যখন পিতা নিজের কাঁধেই নিয়ে নেয়,
তখন সূর্যকে দেখে মায়া হয়, কিছু ভুল মানুষের জন্য বেচারা বৃথাই পুড়ছে।


এই দুই ঠোঁটের যতো প্রেমভরা চুম্বন, সবই ব্যর্থ মনে হয়।
এখানে জাহান্নাম বাদে আর কোনো দুনিয়া নেই,
বিবেকের স্ফুলিঙ্গ এখানে অসহায়ভাবে ডানা ঝাপটায়।
এবং কঠোর পাথরগুলি কাতর হয়ে ছুটে আসে
তারই বুকে, যে কখনোই জানতেই পারে না
সে কেন আহত হয়েছিল। এখানে মানবতা মানুষের পায়ের নিচে নীরবে কাঁদে।


রাতে বাড়ি ফেরার পথে লোকটি দেখল,
অচেনা কী যেন কাঁপছে।
ঘরের সামনের বাঁকা বেঞ্চিগুলিতে মেহমানরা বসে নেই,
সেগুলি এক প্রচ্ছন্ন হ্রদে চুপচাপ ভাসছে, অথচ সেখানে কেউ কখনও হ্রদ দেখেনি।
দূরের টাওয়ারগুলি ঝড়ের জন্য প্রার্থনা করছে।
কালো ফ্যাক্টরিগুলির বাসি ধোঁয়া তেতো হয়ে আছে।
এইসব দেখে লোকটি চাঁদের হাসি কিংবা
বাতাসের কান্নাকে খুব সহজেই অবিশ্বাস করতে শুরু করে দিলো।
আজকাল রহস্য সবাইকেই ভয় দেখাতে শুরু করেছে।


ফুলকে শেখানো শেষ যে
এই মহান পৃথিবীতে পাপের কোনও স্থান নেই,
তাই সে নিশ্চিন্তে খুনির কাছেও চলে যায়।
কবিতাগুলি একটি রঙিন গিটারে লুকিয়ে থাকে---
এটা বলাটাও খুব স্বস্তিকর, কেননা এর অর্থই
সুন্দর এক মৃত্যুর দিকে কবির এগিয়েযাওয়া, প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও!
মন্দিরের শোভাযাত্রার মতো দেখতে এক মিছিলে হেঁটে
গীতিকাররা ক্লান্তহাতে মশাল জ্বালিয়ে সমস্বরে বলেন,
“আমরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যেতে ভালোবাসি!”
জ্যান্ত কবিদের অনিবার্য দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়: আজকাল এইসব দেখতেও বেঁচে থাকতে হয়!


মাইলফলকের গোপন রহস্য যারা জানে,
ওরা জেনে গেছে কালো ম্লান রূপকথার গল্পটাও।
দুজন লোক দূর থেকে একে অপরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল
দীর্ঘ সময় আগে থেকেই। তখন রাত, পথে অন্ধকার,
তাদের কান সীসা ঢেলে বধির করে দেয়া হয়েছে।
তারা একটি শীতল সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল,
এবং গভীর অবসাদে ভেজা পাথরের দেওয়াল
হাতের তালুতে কিছুটা ঘষে বুঝে ফেলল, এই পাথরে কখনও আগুন জ্বলেনি।
অগত্যা তারা একে অপরকে খুঁজতে শুরু করলো।


একটু গোপনে খেয়াল করে দেখেছি, নৈরাশ্য সবসময়ই
সে জীবনেই ভর করে, যে জীবন গাছের ছায়ায় বাঁচে।
ধূসর জীবন শুভ্র, নীরব, শীতল আকাশ
খুঁজতে থাকে আর অবধারিতভাবেই
তুষারের গর্জন শোনে।
আগুনের হাওয়া কোনো একাকী গাছ পেলেই পুড়িয়ে দেয়,
আর গাছের ছাদে বেঁচেথাকা আমাদের দুর্ভোগ বাড়ে!


চারিদিকের সমুদ্র অন্তহীন,
কাঁপছে আর ফিসফিস করে নীরবে ফুঁসছে।
হতাশার শব্দগুচ্ছ এখানে এবং সেখানে গল্পশোনাচ্ছে,
তবে সেসব গল্পের সমস্তটাই ঘোলাটে এবং আবদ্ধ।
উপাসনালয়ের ঘণ্টাগুলি দুলছে, ঘন কুয়াশা
ঘরের জানালার শার্সি ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে
এবং গোটা শহরটিই নেই-ঘুমদের দলে নাম লিখিয়ে
একটি বিষণ্ণ রাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।


একটি বা দুইটি পরিসংখ্যান দিয়ে স্বপ্ন মাপা যায় না,
রূপকথার গল্প শুনিয়ে অতীত মোছা যায় না।
জীবন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শান্তও হয়
এবং তারপরেও কখনওই
কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায় বলে মনে হয় না,
বরং জীবনকে আমি বহুবার ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছি।


ফ্যাকাসে ও শ্রান্ত, তবে প্রসন্ন---ছোট্ট মেয়েটির মুখ,
প্রতিটি রোগীর উপর স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে যায়।
এক জাদুকরের রহস্যময় থলের ধোঁয়ার মতো মৃত্যু ফুঁকছে---
ভীষণ মৃদু আঁচে। ছোট্ট মেয়েটির জন্যই
জীবনের শেষ আলোটা হাসপাতালের বেড ছেড়ে বাইরে যায় না,
যদি যেত, আর কখনওই ফিরে আসতো না।
সমুদ্র, কুয়াশা, রাত মৃত মানুষের শেষ সুখস্মৃতিতে ডুবে আছে, যদিও
এই মেয়েটিকে কেউ কখনও শান্তিতে মরণোত্তর নোবেল দেবে না।