ট্রেন প্লাটফর্মে এসে পৌঁছল, বেশ খানিকক্ষণ আগে। আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। প্রথম শ্রেণীতে যাতায়াতের ইচ্ছে আমার কখনোই হয়নি। মনে হতো, শুধুই পয়সা নষ্ট। এখন বুঝি, এ কেমন ঝক্কির কাজ। এত লোক, এত লোক, ভাবতেও অবাক লাগে। মনে হচ্ছে, এমন নরকের মাঝে থাকার চেয়ে আমার পকেট থেকে বাড়তি দু-চারশো টাকা উড়ে যাওয়াও ভালো ছিল। তার উপর এত মালপত্র। এত বলতে, বেশি না হলেও ভারী একটা ট্রাঙ্ক।
ইতোমধ্যে কম্পার্টমেন্ট বেশ কিছুটা খালি হয়ে গেছে। নামতে হবে। আবার চিন্তা, কুলি কোথায়? রেলওয়ে কুলিরা কি আছে? এত লোকের মাঝে ওরাও নিশ্চয়ই সবাই মোট-মাথায় এতক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ কানে এল, কুলি লাগব, সাব?
চোখ তুলে দেখি একটি ছেলে। বয়স মনে হলো তেরো কি চৌদ্দ হবে। বললাম: যা, যা, তোর দ্বারা হবে না। রেলওয়ে কুলি দরকার। তোর মতো পুঁচকে দিয়ে আমার কাজ হবে না।
মনে হলো, ছেলেটা আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু আমার চোখের দিকে চেয়ে আর কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে ছেলেটি প্লাটফর্মের একধারে দাঁড়িয়েছে। আমার আবার এমনই স্বভাব, হঠাৎ রেগে যাই। আজকাল আবার একটু বেশি রাগ করে থাকতে হয়, নচেৎ কেউ কাজ করতে চায় না।
কম্পার্টমেন্ট এতক্ষণে সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে। একা আমিই দাঁড়িয়ে। মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। কাউকে স্টেশনে আসতে বলাই আমার উচিত ছিল। অন্যমনস্কভাবে আবার চোখ গিয়ে পড়ল ছেলেটির ওপর। গায়ের রং মিশকালো। চেহারার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, কৈশোরের সজীবতা যেন ছেলেটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। যৌবন আসার আগেই যেন তার চোখে-মুখে প্রৌঢ়ত্বের আভাস। হঠাৎ মায়া লেগে গেল। ওকে কাছে আসতে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, এটা নিতে পারবি?
“পারব, সাব।” ও ক্ষুদ্র জবাব দিল।
আমি বললাম, ওর ওজন তো তোর চেয়েও বেশি হবে। একটু যেন চিন্তিত স্বরে ও বলল, “তুইলা দিলে পারমু, স্যার। কই নিবেন? রিকশায় তুলবেন না?”
আমি জবাব দিলাম, “না, দোকান তো খুব কাছেই। এই তো মসজিদের পাশেই।”
ও মোট তুলে নিতে এগিয়ে এল। আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কত নিবি, বললি না যে?”
“ইনসাফ কইর্যা দিবেন, স্যার। বিনীত জবাব দিল।”
মোটটা আমাকেই তুলে দিতে হলো ওর মাথায়। আশেপাশে তেমন আর কাউকে পেলাম না। আমার বেশ বেগ পেতে হলো। তবে হয়তো তা অনভ্যাস বশত। ওর মাথায় তুলে দেবার পরও ওর তেমন একটা পরিবর্তন দেখা গেলো না। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, "তোর নাম কী রে?"
“লালু মিয়া।” একটু হেসে জবাব দেয় লালু। আসলে কিন্তু মসজিদটা একেবারে কাছে ছিল না। আর আমিও আমার ‘প্রেস্টিজ’-এর জন্য রাস্তা দিয়ে আগে হাঁটতাম না। এখন হাঁটছি ব্যাবসায় মন্দা যাচ্ছে বলে। ওর কাছে অনেক কিছু জানা গেল কথায় কথায়। ও কোথায় থাকে, কে থাকে ওর সঙ্গে, কীভাবেই-বা দিন কাটায়, এমন আরও অনেক কথা।
শুনতে চাইবেন আপনারা, ভরসা পাই না। অনেকেই হয়তোবা ভাবতেও পারেন, এই আধময়লা কাপড়-পরা, প্রচণ্ড শীতেও একটি মাত্র গেঞ্জি গায়ে দেওয়া, মাথার চুল উসকোখুসকো ছেলেটির নিবাস কোন বস্তিতে।
ও বলল পিতৃহীন ওদের ভাই-বোন আর মায়ের কথা। ও-ই সংসারের খুঁটি, আর তিনটি ভাই-বোন খুব ছোটো। বাবা মৃত নন, তবে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। ভাই-বোন’দের মধ্যে ও-ই শুধু এটুকু জানে, অন্যেরা তা-ও না। মা কিছুই বলতে চান না। সংসার চলে না। ও কীই-বা কাজ করতে পারে? তার উপর বেআইনি কুলি। মা-ও কিছু উপার্জন করেন। তবে দুর্মূল্যের দিনে তাতে কীই-বা হয়!
ছেলেটি মোট নামিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণে দেখলাম, ও পরিশ্রান্ত। খুব হাঁপাচ্ছিল। ওর ভাই-বোনের বেদনাক্লিষ্ট চোখগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সইতে পারলাম না। পঞ্চাশ টাকার নোটখানা হাতে দিতেই বলল, “ভাংতি নাই, স্যার।” বললাম, “ভাংতি লাগবে না। তুই পুরোই নিয়ে যা।”
ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চলে যাচ্ছিল। এটা আমার লোহালক্কড়ের দোকান। মালিক আমি, তবে ম্যানেজার অন্যজন। তখন দুপুরবেলা, কর্মচারীদের জন্য ভাত ছিল। ওকে বললাম, “ভাত খাবি?”
ওর চোখ জবাব দিল, বাসার কেউই যে খায়নি এখনও। কী জানি চিন্তা এল আমার মনে। বললাম, বিকালবেলায় আবার আসিস। ছেলেটি চলে গেল।
দোকানটিতে কয়দিন আগে একজন কর্মচারী কাজে ইস্তফা দিয়েছে। পদটা এখনও শূন্য। ম্যানেজার যদিও বলেছিলেন যে, শীতের ধান কাটার দিন গেলেই মফস্বলের তার ভাই এসে কাজ করতে পারে, কিন্তু কথাটা আমার পছন্দ হয়নি। এখানেই লালুকে চাকুরি দিলাম। বলেছিলাম, লোহায় হাতুড়ি পেটানোর সময় বাটাল ধরার কাজটাই ও করবে।
লালুকে দেখলাম, উজ্জ্বল নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রেস ব্যাবসা আবার লাভজনক হয়ে উঠছে। বেশ ব্যস্ত আছি। লালুকে প্রায় ভুলেই গিয়েছি এই এক মাসে। আমার প্রাইভেট কারটি সবে আবার সচল হয়ে উঠেছে। তারই ফাঁকে গিয়ে একদিন দেখলাম, লালু ভারী হাতুড়িটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ম্যানেজার লোকটি দাঁড়িয়ে এবং একটা যুবক বাটাল ধরে আছে। লালু হাতুড়ি পেটাতে প্রস্তুত।
সেখান থেকে চলে এলাম। লালু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এতটুকু ছেলে হাতুড়ি চালাচ্ছে, ভাবতেও পারলাম না। ইচ্ছে হলো, ম্যানেজারকে কষে বকা দিই। কিন্তু একটি ছেলের জন্য আমার এত কী? কর্মচারীরা জানে, আমি খুবই কঠোর। ওর জন্য এত কোমল হব কেন? অন্তত নিজের মর্যাদা রাখতেও তো সচেষ্ট থাকতে হবে।
ভেবেছিলাম, হয়তো রিপোর্ট আসবে, লালু চলে গেছে। এত বড়ো খাটুনির কাজ সে করতে পারছে না। তখন কী উত্তর দেবো? কিন্তু সপ্তাহ দুয়ের মধ্যে কোনো রিপোর্ট আসেনি। আমারও শুধু ওর জন্য স্বেচ্ছায় দোকানে যাওয়া সম্ভব হলো না।
মাসশেষে লোহার দোকানে গেলাম মাসিক হিসাব করতে। সব কর্মচারীকে একত্র করে হিসাব করি এবং তাদের বেতন দিই। আজ সবাই যেন একটু উদাসীন। বেশ কয়েক জন যদিও এসে দাঁড়িয়েছে চেয়ারের সামনে, তাদের মাঝেই দেখলাম, লালুও দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো খুবই চিন্তিত, দৃষ্টিতে দেখা গেল উদাসীন ভাব। একসময় দেখা গেল কর্মচারী রফিককে। সবাই চলে আসতেই রফিক বলল, “স্যার, লালু ছুটি চায়।”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “মানে?”
ম্যানেজারটি এবার উত্তর দিলো বেশ তীব্র কণ্ঠে, “লালু কাজ পারে না, ওকে বাদ দিয়ে দিতে হবে।”
লালুকে তখন দেখলাম, নির্বাক দাঁড়িয়ে সে রাস্তায় স্কুলগামী ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ঘোর তখনও কাটেনি। তাই বললাম, “হঠাৎ?” ম্যানেজারটি বলল, “দেখুন না, সবসময়ই কেমন উদাসীন থাকে! গায়েই-বা ওর বল কতটুকু!”
আমি গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, “আপাতত থাক না। নতুন লোকও তো চাই।” মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত প্রতিপক্ষ উত্তর দিল, “কেন? আমার ভাই চলে এসেছে যে!”
ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হলো, ম্যানেজারকে বিদেয় করাই বোধ হয় উত্তম।