একটাসময়ে ভার্সিটির টিচার হওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতাম না, অনার্সের রেজাল্ট ছিল অতি খারাপ (২.৭৪), বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বিন্দুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতাও আমার ছিল না। সে সময় এই একটা আফসোস ছাড়া আমার জীবনে আর তেমন কোনও আফসোস ছিল না।
আফসোস কেন? বলছি। একটা সময়ে এই সিক্রেটটা বলার মত সাহস আমার ছিল না। এখন আছে, তাই বলছি।
আমার দাদু অবিনাশ চন্দ্র পাল। বাংলার যশস্বী অধ্যাপক, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে পড়াতেন। উনার বিশাল জমিদারি ছিল মহেশখালীতে৷ এলাকায় দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দাদুকে যে কত মানুষ শ্রদ্ধার সাথে আজও মনে করে! দেখলেই গর্ব হয়! দাদু ছিলেন আবৃত্তিকারও। শৌখিন অভিনেতাও ছিলেন, মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। লেখালেখিও (‘ও’ যোগ ক’রেছি, কারণ সব অধ্যাপকই তো আর লেখেন না৷) করতেন মাঝেমাঝে৷ যুদ্ধের সময় উনার সব পাণ্ডুলিপি আর বইয়ের সংগ্রহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। উনার ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ আর শৌখিনতা ছিল খেয়াল করার মত। দেখতেশুনতে অতি সুপুরুষ ছিলেন। উনার পৌরুষ কিংবা ব্যক্তিত্বের ধারেকাছেও আমরা নাতিরা কেউ যেতে পারিনি। অল্প বয়সে মারা যান। দাদুর মৃত্যুর আগের একটা ঘটনা শেয়ার করছি……
“শালা হারামজাদা মীরজাফরের বাচ্চা!!” যারা সেইদিন নাটক দেখছিল, তাদের ছুঁড়ে-মারা জুতা-স্যান্ডেলের আঘাতে দাদুর নাক-কপাল ফেটে রক্ত ঝরেছিল৷ নাটকটা শেষ পর্যন্ত আর শেষ করা যায়নি৷ দাদুর আবৃত্তির ঢঙে বাংলা পড়ানোর তারিফ করতে শুনেছি অনেককেই৷ কানুনগোপাড়ায় কোয়ার্টারস্-এ থাকতেন, শখের বশে নাটক করতেন৷ মামাদের মুখে শুনেছি, অনেক দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন দাদুর অভিনয় দেখতে আসত৷ সেইদিনের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে দাদুর অভিনয় দর্শকদের খেপিয়ে তোলে৷ সেই দিনের ঘৃণা দাদুর অভিনয়জীবনে অভিনব নয়৷ দাদু নেগেটিভ রোলে অভিনয় করতে বেশি পছন্দ করতেন৷ মঞ্চনাটকে এবং জীবনে দর্শকদের ভালোবাসা সবসময় প্রত্যক্ষ না হলেও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই প্রত্যক্ষ৷ আমার দাদুর যে কয়েকজন বন্ধু, কলিগ ক্ষিপ্ত দর্শকদের সাথে হাঙ্গামা বাধানোর উপক্রম করছিল, দাদু অনেক কষ্টে নিজেই তাদের বুঝিয়েশুনিয়ে নিবৃত্ত করেন৷
দাদু যখন মারা যান, তখন আমার মায়ের বয়স ৪ বছর, আমার ছোটমামার ৬ মাস। ভাইবোন সবাই পড়াশোনা করছে তখনও। সংসারের হাল ধরতে দাদুর মৃত্যুর পর আমার বড়মামা দীপক কুমার পাল একই কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন। পরে আরও কিছু সরকারি কলেজে ছিলেন। উনি চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন। সে রেজাল্ট উনার ছিল। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে উনি অপেক্ষা করতে পারেননি। মামা ফিজিক্স পড়াতেন। চেহারা আর শরীরের গঠন ছিল আলাদা করে চোখে পড়ার মত সুদর্শন। অত্যন্ত আদর্শবাদী নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। অনেক স্টুডেন্টকে ফ্রিতে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। অগণিত মানুষকে সাহায্য করেছেন। বড়মামাকেও বাংলাদেশের অনেকেই চেনেন।
দাদু আর বড়মামা এঁদের কেউই দীর্ঘজীবী ছিলেন না, দুইজনেই অপরিণত বয়সে মারা যান। কিন্তু উনারা এখনও অমর। অনেকেই উনাদের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে চোখের জল মোছেন। দাদু-মামা’র স্টুডেন্টদের অনেকেই সমাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে এসব দেখে-দেখে বড় হয়েছি। সেই শিশুমনের মনের গভীরে এমন বড় হওয়ার একটা বাসনা প্রোথিত ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু উপায় ছিল না। আমি যে একেবারেই নোবডি ছিলাম! তাই আফসোসটুকু বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা আমি করতে পারছিলাম!
এখন তাও আর নেই। বিভিন্ন ভার্সিটিতে, কলেজে, প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে কথা বলতে যাই, স্বপ্ন দেখতে শেখাই। এখনও পর্যন্ত ৭০টা মোটিভেশনাল সেমিনারে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমি এ অনুষ্ঠানটা করি ‘ক্যারিয়ার আড্ডা’ নামে। সবচাইতে বেশি স্টুডেন্ট ছিল বেগম রোকেয়া ভার্সিটির প্রোগ্রামে, অন্তত ৫৫০০। ওরা বসে থাকে, ৬-৭ ঘণ্টা ধরে কথা শোনে। আমি ভাবি, এ বয়সে এত সময় ধরে বসে থাকে কীভাবে? প্রোগ্রামগুলিতে স্যাররাও শোনেন। উনারা বলেন, এসব কিছু ভার্সিটিতে শেখানো হয় না। সে সুযোগও অত নেই। আপনি শেখান, আমরা সাথে আছি। স্যারদের ধন্যবাদ।
কখনও-কখনও চোখের কোণায় জমেওঠা জল লুকাতে-লুকাতে ভাবি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কত কিছু পাওয়া যায়! জীবন কাউকেই খালিহাতে ফেরায় না। As I can’t teach how to get grades, I’ve decided to teach how to live life. সবাই তো আর সবকিছু পারে না। হাতি গাছে চড়তে পারে না বলে যদি আমরা বলি, ও তো কিচ্ছু পারে না, তবে সে দোষ তো আর হাতির নয়!
গতকালকে এক ছেলে ফোন করল। ওর এবং ওর আশেপাশের সবার বিশ্বাস, ও জীবনে কিছু করতে পারবে না। কেন? জন্মগতভাবে ও বাম চোখে কিছু দেখতে পায় না, কানে কম শোনে, ডান পা পোলিও আক্রান্ত হয়ে খোঁড়া হয়ে গেছে। এরকম যারা, ওদের কেউ ভালোবাসে না, শুধু করুণা করে। ওর ক্ষেত্রেও সবসময়ই এ-ই হয়ে আসছে। মানুষের অবহেলা ওকে পথের কাঙাল করে ছেড়ে দেয় প্রতি মুহূর্তেই। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন করে একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে, তেমনি করে একটুখানি ভালোবাসার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে! ওকে কেউ কখনও ভালোবাসেনি। এর ফলে ও সবসময়ই এসব নিয়েই ভাবতে অভ্যস্ত—ওর যা কিছু নেই, কোন-কোন চাকরি ওর জন্য নয়, ওর কাউকেই কোনও কিছুই দেয়ার নেই। ওর সমস্ত ভাবনার শতকরা আশিভাগই কী কী ওর জন্য নয়, তা নিয়ে। প্রচণ্ড হতাশা, কষ্ট আর বিষণ্নতায় ওর প্রায়ই মনে হয়, চলে যাই! যাকে এ পৃথিবীতে কেউই চায় না, সে থাকেই বা কীভাবে? . . . . . . ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। ওকে শেখালাম, কীভাবে করে সেই আশিভাগকে বিশভাগে নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। এ পৃথিবীতে শুধু কান্নাই ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমান। কান্না সবার সাথে ভাগাভাগি করতে হয় না। সবাই আপনার কষ্টের দাম বুঝবে না। থাকুক না কিছু কান্না ব্যক্তিগত! কষ্টের শক্তি অনেক বড়। এর খোঁজ করতে জানতে হয়। . . . . . এমন আরও অনেক কিছু বললাম। ওকে এটা বিশ্বাস করিয়ে দিলাম, পৃথিবীতে ওর মূল্য অনেক। যাদের কাছে ওর দাম নেই, তাদেরকে ইউজ্ড টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। সাহসী হতে শেখালাম, নিজের শক্তি চিনতে শেখালাম। দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলে হেরে যাবে কেন? আমি চাই, কেউই হারিয়ে না যাক। যখন ওকে বললাম, ভাই, তুমি চাকরি পাওয়ার পর প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে কিন্তু! তখন সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আমি জানি, চোখের জল কখনও মিথ্যে বলে না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, ও পারবেই!