যখন কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়, অথচ সেই সম্পর্কের কোনও নাম থাকুক, এটা চায় না, আমার কি সরে যাওয়া উচিত তখন? উচিতই তো! আপনাকে জিজ্ঞেস করছি কেন? মনে হচ্ছে, আপনিই পারবেন আমাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। কেন, তা জানি না! সে আমাকে শুধুই হাতে রাখে, আমি সব জেনেও ওকে আমাকে হাতে রাখতে দিই। প্রথম প্রথম ভাবতাম, ওকে কিছু বলব না, বললে যদি ও দূরে সরে যায়! আমি চাইতাম, ও আমার ফোনটা অন্তত রিসিভ করুক। আমি আর কোনও ছেলের সাথে কথা বলে কখনওই এতটা শান্তি পাইনি। ও যখন কথা বলত, মনে হতো, পৃথিবীর সব সুখ যেন আমার মুঠোফোনটাতে ওই মুহূর্তে মিশে আছে; তবে আস্তে আস্তে এই উটকো অধিকারবোধটা এরকম বিশ্রীভাবে জন্মে যাবে, এটা আমি আগে ভাবতেও পারিনি।
জানেন, গত ৩ বছর ধরে এটা চলছে। ও আরও অনেক মেয়ের সাথে কথা বলে, ঘোরাঘুরি করে, আবার আমার সাথেও কথা বলে। আমি সব জানি, সব বুঝি; তবুও মোহ কাটে না, কিংবা আমিই কাটতে দিই না। ও আমার সাথে খুব যে ভালোভাবে কথা বলে, তা নয়; কিন্তু বলে, ৩ বছর ধরে বলে যাচ্ছে। ও আমার কাছে এক অদ্ভুত কথার জাদুকর! আমি সারাটাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি, ও কখন ফোন করবে সে আশায়! মাঝে মাঝে ও আমাকে বলে, অমুক মেয়ে তমুক মেয়ে ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে। ও দেখতে এমন, ও দেখতে তেমন, ও সুন্দর করে কথা বলে, ও সুন্দর গান করে, সাজলে ওকে সুন্দর দেখায় আরও কত কী! অথচ দেখুন, আমিও তো অনেক ভালো কিছু পারি, অনেক ছেলেই বলে এটা, কিন্তু আমি যার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে ভালো কোনও কথা শুনতে চাইতাম মনে-প্রাণে, মানে ওর কথা বলছি, সে কখনও ভুলেও ওরকম কিছু বলত না। আমি সাজগোজ করে ছবি দিলেও ও কখনও লাইক দেয় না, খেয়ালই করে না বোধ হয়, আমার তখন ইচ্ছে করে, যতগুলি লাইক পাই, সবগুলিকে ছুড়ে চোখের সামনে থেকে দূরে ফেলে দিই।
আমি জানতাম, এবং এখনও জানি, ও আমাকে হাতে রেখেছে সব সময়ই, এবং এখনও রেখে যাচ্ছে। আমি সব জেনে বুঝে নিজেকে স্টুপিড করে রাখি, ওকে হারাতে চাই না বলে; যদিও জানি, ওকে কখনওই পাইইনি, হারাব কী করে! কুকুরকে এক রাত বাড়ির বাইরে বের করে দিন, এরপর আবার মেকি আদর করে হলেও ডেকে দেখুন, দেখবেন, ও ঠিকই চলে আসছে। ইদানীং নিজেকে পোষা কুকুরের মতো মনে হয়, তবুও ভালোবাসি, তাই সরে আসতে পারি না। আমি জানি, ও তো সরেই আছে! যে কথাগুলি ওর জন্যে স্বভাবজাত, ও অনেক মেয়েকেই ওরকম কথা বলে হয়তো, সেই কথাগুলিকেই, শুধু আমার জন্যই বলা, এটা ভেবে ভেবে আর বিশ্বাস করে করে আমি আজকের এই দূরে চলে এসেছি! আমি আর কিছুতেই নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে পারি না; মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পতঙ্গ কি আগুনের শিখাকে উপেক্ষা করতে পারে?
ওর নিরাপদ অবস্থান এই যে, ও কখনওই ‘ভালোবাসি’—এটা মুখে বলেনি। আমি আগে জানতাম, এটা মুখে বলতে হয় না; এখন ঠেকে শিখেছি, এটাও বলতে হয়। ও আমার কাছে নেশার মতো, আর কারও কথা মাথায় এলে আমি এতটা এলোমেলো হয়ে পড়ি না। প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে সহজ বন্ধুত্বের অভিনয় করে যাওয়া কঠিন। আমি জানি, ও অভিনয় করছে না, ও তো আমাকে ভালোবাসেইনি, তাই ওকে নিজের সাথে প্রতারণা করে অভিনয় করতেও হচ্ছে না। কিন্তু আমি ভাবি, এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব? আমাকে আশ্রয় দিতে পারবে না জেনেও ও এতদিন ধরে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে? কেন? কেন? কেন? আমি আর পারছি না, ওকে যে-কোনও মূল্যে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করে। আবার ভাবি, ফিরিয়ে আনব কী! ও তো আর এসে চলে যায়নি যে ফিরিয়ে আনতে পারব! কাছে না এনেও ফিরিয়ে আনার এই তাগিদটা বড্ড ভোগায়।
অনেক দিন হলো, রাতে ঘুমের ওষুধ না খেয়ে ঘুমোতে পারি না। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা আছে বলেই বেঁচে আছি। কী আইরনি, না? মাঝে মাঝে অন্য ছেলেদের নিয়েও ঘুরে দেখেছি, ওকে জানিয়েছি কিংবা ও যাতে জানতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছি; ভেবেছি, দেখি এতে যদি একটু হলেও সে ঈর্ষান্বিত হয়। সে কোনও কিছুই হয়নি, ঠিক অন্য দিনের মতোই রাতে গল্প করেছে; নিরুত্তাপ নিরুদ্বিগ্ন নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবলেশহীন ছিল পুরোপুরি! নিজেকে খুব ঘেন্না লাগে আজকাল; তবুও ওকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয় না। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে, ও পাত্রী দেখছে, আবার আমাকেও স্পষ্ট করে বলছে না, তুমি বিয়ে করো, সংসারী হও।
আমি আমার জন্যে ছেলে দেখতে দিই না বাসায়। মা-বাবা’র সাথে ঝগড়া করি, আমার পিঠাপিঠি ছোটো বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে, আর আমি সেই কবে থেকে গোঁ ধরে বসে আছি। কীসের আশায়? কার জন্য? কেউ তো আমাকে অপেক্ষা করতে বলেনি, তবু কেন, কীসের মোহে? কেউ অপেক্ষা করতে বলেনি যদিও, তা-ও আমি বিশ্বাস করে বসে আছি, কেউ একজন চাইছে, আমি ওর জন্যে একটু অপেক্ষা করি—এমন একটা ভূতুড়ে অনুভূতির সঙ্গে বসবাস করাটা খুব কঠিন। আমি ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকলে ওকেই শুধু খুঁজতে থাকি। আমার আশেপাশের সবাইকে শুধু ফাঁকি দিয়েই যাচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি। হাসছি, খেলছি, গাইছি, ঘুরছি, খাচ্ছি, চলছি, ফিরছি; সব কিছুই নিষ্প্রাণ নিস্তরঙ্গ নিস্তেজ নিশ্চুপ নিসাড়! ওকে তো কখনওই পাইনি, অথচ ইদানীং ওকে হারিয়ে ফেলার ভয় হয়। খুব কষ্ট হয়, খুউব! আমি তো কষ্ট চাইনি, আমি তো শুধু ওকেই চেয়েছিলাম। ও আসেনি, কষ্ট এসেছে।