সেদিনকার একটা ঘটনার কথা বলি।
অরবিন্দবাবু গেছেন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বাইরের ঘর খোলা দেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন—বাড়ির ভেতর থেকে কেউ আসে, এই অপেক্ষায়। একটু দূরে আর একটি চেয়ারে অপর একজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন, ধীর শান্তভাবে। স্বভাবতই অরবিন্দবাবু ভাবলেন, ইনিও বোধ হয় কারও অপেক্ষায় বসে আছেন।
কিছুক্ষণ গত হবার পর অপর ভদ্রলোকটি যেন লাফিয়ে উঠলেন। অরবিন্দবাবুকে উদ্দেশ করে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এখানে বসে আছেন কেন, মশায়? যান, বেরিয়ে যান! এখান থেকে দূর হয়ে যান!” এই অপ্রত্যাশিত অভদ্রতায় সকলের যা হয়, অরবিন্দবাবুরও তা-ই হল। প্রথমটায় তিনি কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন, পরে অবশ্য তাঁর শরীর রাগে রি রি করতে লাগল। কিন্তু এত যে তাঁর রাগ, তা একমুহূর্তে উবে গেল, যখন তিনি তাঁর বন্ধুবরের কাছ থেকে জানলেন, অভদ্র ভদ্রলোকটার মাথার একটা স্ক্রু একটু আলগা আছে।
উপরের ঘটনা থেকে দুটো জিনিস আমাদের চোখে পড়ে। প্রথমত, বাইরে থেকে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ব্যতিরেকে আমরা মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের কতটুকুই জানি বা জানতে পারি! দ্বিতীয়ত, যদি কোনো অন্যায় অন্যায়কারীর সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত নয় বলে আমরা স্পষ্ট করে বুঝতে পারি, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত নয় বলে আমরা মনে করি—অন্তত সেই অন্যায়কে হৃদয়ের পটরেখায় ক্ষমার দ্বারা মোলায়েম করে নেওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।
কিন্তু দৈনন্দিন বাস্তবজীবনে আমরা এর কতটুকুই-বা মানি?
এমন লোক অতি অল্পই আছে, যাকে বলতে শোনা না যায়—একটু আড়চোখে দেখে অথবা সামান্য দু-চারটে কথা বলে যে-কোনো মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি পর্যন্ত তার কাছে কেমন আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। মানুষের মনের গতি যে কত জটিল, কত বৈচিত্র্যময়—এই জ্ঞানের অভাবেই ঐ দম্ভ আমাদের মনে বাসা বাঁধে।
সমুদ্রের বুকে বিরাট বরফের চাঁই যখন ভেসে আসে, তার কতটুকুই-বা আমরা দেখতে পাই? তার বেশিরভাগ অংশ তো জলের নিচে থাকে। জীবন-প্রবাহে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো মনের বিভিন্ন আত্মপ্রকাশ সম্পর্কেও অনুরূপ কথা বলা চলে। আমাদের চেতন-সজাগ দৃষ্টির বাইরে মনের বেশিরভাগটাই নিশ্চেতনের অন্ধকারে ঘুপটি মেরে থাকে। দৈনন্দিন সাধারণ জীবনে এর ওপর আমাদের হাত খুব কমই। এই আঁধারের খাপ-খোপ থেকে ভেলকিবাজির মতো কখন কী আত্মপ্রকাশ করে আমাদের চমকে দেবে, তা বলা দুরূহ ব্যাপার।
আমাদের নিজেদেরই মনের প্রকৃতি ও গতি সম্পর্কে আমরা এত অজ্ঞ, তখন পরের সম্পর্কে বড়াই করা আমাদের সাজে না। বস্তুত এমন কাজ বা এমন কথা কি আমরা করি বা বলি না, যা করে বা বলে আমরা নিজেরাই ভাবি, এ কেমন করে আমার দ্বারা সম্ভব হলো?
কাউকে কোনো কাজ করতে দেখলেই তার পরিবেশ ও উদ্দেশ্য না বুঝেই সেই কাজের সোজাসুজি অর্থ করতে যাওয়া নিতান্তই মূর্খামি। একই কাজ বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের দ্বারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হতে পারে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে একই মনে হলেও উভয়ের কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
মনের গতি ও প্রকৃতি যখন এত রহস্যাবৃত, তখন তার প্রত্যেক কাজ বিচারকের আসনে বসে ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ড নিয়ে মানুষের অক্ষমতা ও অপরাধকে একই বাটখারা দিয়ে ওজন করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। বাদ-বিসংবাদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে লেগেই রয়েছে। ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিতে আমরা কত লোককেই-না দোষী সাব্যস্ত করছি। কিন্তু এই ত্রুটিগুলির মধ্যে বেশিরভাগই অন্যায়কারীর অক্ষমতা বা নিছক দুর্বলতা মাত্র, তা আমরা বুঝি না। পাগলকে আমরা ক্ষমা করতে শিখেছি, কিন্তু আমরা সকলেই যে কম-বেশি পাগল অর্থাৎ আমাদের অনেক কাজই আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে হয়ে যায়—স্বাধীন জ্ঞাত ইচ্ছের দ্বারা চালিত নয়, তা আমরা বুঝি না।
মানুষের সাথে মানুষের যথাযথ সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে, কেউ আদৌ কোনো অন্যায় করেছে কি না জানতে হলে অন্যায়কারীকে ঠিকমতো বুঝতে হলে শাসনদণ্ডের পেছনে রক্তরাঙা চোখ থাকলে চলবে না, সমবেদনাপূর্ণ মন নিয়ে তার কাজের বিচার করতে হবে। তবেই আমরা পরস্পরকে ঠিক চিনতে পারব।
কথায় বলে, মানুষ অভ্যাসের দাস। আমাদের বেশিরভাগ কাজ বা আচরণের পেছনে আমাদের অভ্যাসই দ্যোতনা জোগায় না কি? কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা যুক্তিবিচারের স্থান এখানে কতটুকু? যে যেভাবে যে-পরিবেশের মধ্যে শিশুকাল থেকে মানুষ হয়েছে, তার প্রাত্যহিক আচরণ সাধারণত তদনুরূপ নয় কি? মানুষের প্রত্যেকটি কাজের জন্যে সে নিজে কতটুকু দায়ী? অথচ আমরা অন্য লোকের প্রত্যেক কাজ বা আচরণের পেছনে একটা উদ্দেশ্য খাড়া করে হইচই বাঁধিয়ে দিই।
আবার অন্যায় জেনেও অনেকসময় আমরাও সে কাজ করতে বাধ্য হই না কি? এমনকী কেউ চুরি করলেও তাকে ঘৃণা করা অথবা সরাসরি দোষী সাব্যস্ত করা কি উচিত? পরিবেশ কি অনেকসময় অন্যায় কাজ করতে আমাদের উস্কানি দেয় না? বর্তমানে যে অযৌক্তিক বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের বাস করতে হচ্ছে, তাতে নিজের বা নিকট আত্মীয়-স্বজনের জীবিকা অর্জনের জন্য আমরা অন্যায় করতে প্ররোচিত হই না কি?
দৈনন্দিন সাধারণ জীবনে আমরা যা করি বা বলি, অনেক ক্ষেত্রেই তার পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। মানুষের এক বড়ো দুর্বলতা—সে সবসময়ে নিজের স্বার্থস্বভাব ও মর্যাদাকে নিজের কাজ বা কথার ভেতর দিয়ে সমর্থন করবার চেষ্টা করে—তা যতই অযৌক্তিক হোক না কেন। বাংলাদেশে জমিদারি ব্যবস্থা কী ক্ষতিসাধন করেছে, কোনো জমিদারকে তা বোঝানো দুরূহ ব্যাপার। (কিশোরগঞ্জের জমিদার মানববাবুর সাথে কয়েক দিন গল্প করে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।) বড়ো সরকারি চাকরি গ্রহণের লুব্ধতার বিরুদ্ধে যাকে কত কথা বলতে শোনা গেছে, চাকরি গ্রহণের পর দেশের পক্ষে যে সেটা কত কল্যাণকর, তা বোঝাবার পক্ষে তাঁর যুক্তির অভাব হয়নি। সম্মান ও পদমর্যাদার লোভেই তো এটা সম্ভব হয়েছে, তাই না? চিরকাল ব্রাজিলের নাম শুনলেই আপ্লুত নরেশকাকু ব্রাজিলের খেলা যে অনেক পড়ে গেছে, তা বিশ্বাস করতে পারেন না; কারণ তা করলে তাঁর যে আত্মগরিমাতে আঘাত লাগবে! কোনো ব্রাহ্মণ যদি জাতিভেদের অপকারিতা না বোঝে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু আছে কি?
অনেক মতামত আছে, যা আমরা খুব দৃঢ়ভাবে পোষণ করে থাকি, কিন্তু সেগুলি ঠিক যুক্তির ধারা ধরে আমাদের মনে গাঁথেনি। অথচ তর্কক্ষেত্রে তাদের সপক্ষে যুক্তিজালের অবতারণা করে আমরা হুলস্থুল বাধিয়ে দিই। বস্তুত সেগুলি আমাদের কাছে স্বতঃপ্রমাণিত বলে মনে হয়। যে পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে আমরা মানুষ, সেই পরিবারের কতগুলি গতানুগতিক সংস্কার আমাদের মনে গেঁথে যায়। গোমাংসের নাম শুনলে রামের গা বমি বমি করে ওঠে, কিন্তু রহিমের মতে, তা খুব সুস্বাদু। অবশ্য রাম যদি রহিমদের পরিবারে এবং রহিম যদি রামদের পরিবারে মানুষ হতো, তাহলে গোমাংস সম্বন্ধে তাদের মতটাও হতো ঠিক উলটো। রাম তখন গোমাংসের রসাস্বাদন করত অতি পরিতোষ সহকারে, আর রহিম তার নাম পর্যন্ত শুনলেও উঠত রুখে।
শিক্ষা-দীক্ষার পার্থক্যেও, আভিজাত্যের লক্ষণ মিসেস রায় দেখবেন অবাধ মেলা-মেশার মধ্যে, আর কাদম্বিনী দেবী খুঁজবেন ঘোমটার অন্তরালে। গোঁড়া হিন্দু সমাজের আবেষ্টনীর মধ্যে যে লালিতপালিত হয়েছে, ষাট বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধের পক্ষে পত্নী থাকা সত্ত্বেও পুনর্বিবাহ সমর্থন এবং সতেরো বৎসরের মেয়ের স্বামী মারা যাওয়া সত্ত্বেও পুনর্বিবাহে আপত্তি করা তার কাছে কি অযৌক্তিক মনে হয়?
শেষকথা হলো এই—অন্যায় বলে যা প্রতীয়মান হচ্ছে, ঠিকভাবে তার গুরুত্ব বিচার করতে হলে অন্যায়কারীর বাইরের পরিবেশ ও তার অন্তরের প্রকৃত গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার, তবেই আমরা তার কাজকে যথাযথ পটভূমিকায় আলোচনা করতে পারব। আমাদের প্রত্যেক কাজ, কথা বা আচরণকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধরে নিলে আমরা মস্ত ভুল করব। এর ফলে নিছক অক্ষমতা ও অপরাধের মধ্যে যা ব্যবধান আছে, তা আমরা মুছে ফেলব।
অবশ্য অত্যন্ত দুঃখের কথা, মানুষের জীবনে এমন লোকের সন্ধান মেলে, যাদের এমনকী খুঁটিনাটি কাজের পেছনেও থাকে মতলব। এই সব মতলববাজ লোককে বার বার সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের হীন মনোবৃত্তি দমন করে না। এদের সম্পর্কে কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে: নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।