যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে

দাদা, তিনটা কাজ কখনও করবি না।

এক। কারওর শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে ওর মানসিকতা বিচার করবি না।

দুই। কারওর পরীক্ষার গ্রেড দিয়ে ওর মেধা যাচাই করবি না।

তিন। দুর্জন যতই বিদ্বান হোক, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ওর কাছ থেকে সরে আসবি, শুধু বিদ্বান বলে সাথে থেকে যাবি না।

একটু আগে খাওয়ার টেবিলে অকালপক্ব কিংবা বয়সের তুলনায় ত্রিগুণপক্ব ছোটভাইয়ের ওপরের অমৃতবচনত্রয়ের পেছনের কাহিনীটা খুব দীর্ঘ নয়। প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। কোনও একটাসময়ে আমাদের বাসায় এক পাত্রীর প্রস্তাব আসে। ওকে দেখে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল। ভালোলাগা মানে, ভালোবাসাও, আই মিন, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। ঠিক করেছিলাম, ওকেই বিয়ে করব। পাত্রীদেখার দিনে আমার মা ওকে আশীর্বাদ করে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। (এ খবর আমি জেনেছি অনেক পরে। আগে জানলে মাকে ওই টাকা কিছুতেই দিতে দিতাম না, বরং ওটা দিয়ে বই কিনে ফেলতাম। একটা মেয়েকে দশ হাজার টাকা দেয়ার দরকারটা কী? দশ টাকার ফুচকা খাওয়ালেই তো মেয়েরা অনেক খুশি হয়। আহা! মা’টা এত বোকা কেন? অবশ্য এ কথা মা’কে বলার পর সেইরকম ঝাড়ি খেয়েছি। সেকথা থাক।) জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে— এই ৩ তো ঈশ্বরের হাতে। বিয়েটা যেকোনও কারণেই হোক, হয়নি। ওদের শিক্ষাদীক্ষা আর মানসিকতা ছিল পরস্পর বিপরীতমুখী। বড় হলে বড়বড় ভাব নিতেই হবে, আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আমাদের দুই ভাইকে এটা কোনওদিন শেখায়নি। বাবা বলেন, “মানুষ বড় কি ছোট, বুঝবি কীভাবে? যে যত বড়, তার মাথা তত নত।” যা-ই হোক, যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা চলছিল সে ছিল খুব ভালো আর অতি-আঁতেল ‘আব্বুকে বলে দিবো’ টাইপ অতি ভালো-রেজাল্টের স্টুডেন্ট। সম্প্রতি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বাবার ইচ্ছে, ওই টাকাটা যেন আমরা ফেরত নিই। খুবই অদ্ভুতধরনের নীচ মানসিকতাসুলভ ইচ্ছে। আমরা এখন যে বাসায় ভাড়ায় থাকি, সেটির মালিক ওদের বৈবাহিক, মানে বিবাহসূত্রে আত্মীয় হন। উনার মাধ্যমে এ ইচ্ছেটি আমার ছোটভাই বাড়িভাড়া দিতে গেলে জানানো হয়। আমাদের বাসার মালিক ভদ্রলোকটি পেশায় একজন নামকরা চিকিৎসক। এ প্রস্তাব শুনে আমার ছোটভাইয়ের খুব মেজাজখারাপ হলেও ও শান্তভাবে বলে, “আঙ্কেল, এটা তো মা উনাকে আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। গুরুজনদের ব্যাপার, আমি কীভাবে কিছু বলি? তবে আমি মাকে আপনার কথাটা জানাব।” ওই সময়ে উনার চেম্বারে বসেছিলেন একজন মহাফাজিল বান্দরটাইপের ভদ্রলোক। উনি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এরপর উনি মাঝখান থেকে কথা বলতে শুরু করলেন। কথাগুলোর কিছু অংশ আমার নিজের মতো করে শেয়ার করছি:

: তো, ব্যাপারটা হল, আপনারা একটা মেয়ে দেখে পছন্দ করেছিলেন। তাই তো?

: আজ্ঞে হ্যাঁ।

: তো, টাকাপয়সা দেয়ার কী দরকার ছিল? পছন্দ হলে তো বিয়েই হয়। এর মধ্যে আবার টাকাপয়সা কেন, বাপু?

: আসলে এটা আশীর্বাদস্বরূপ……..

: আরে বাবা, আশীর্বাদস্বরূপ তো গয়নাটয়না দেয় শুনেছিলাম। টাকাও……..

: (ডাক্তার আঙ্কেল কথাটি কৌশলে কেড়ে নিলেন)……… আরে মশাই! বুঝলেন না? আংটিটাংটি অনেকসময় ছোটবড় হয়ে যেতে পারে, আঙুলে ঠিকমতো আটকাবে না। তাই টাকা দিয়ে দিলেই তো ভালো, তাই না? পছন্দ করে কিছু কিনে নেয়া যায়…….

: ও আচ্ছা! তা বাবা, আপনারা তো পছন্দ করেই আংটিটা দিয়েছিলেন, তাই না? বিয়েটা হল না কেন? দশটি হাজার টাকা! কম নয় কিন্তু! শুধু এর জন্যও তো বিয়ে করা যায়!

: আরে ওরকম তো কত হয়! বিয়েটিয়ে তো বিধাতার বন্ধন। উনি না চাইলে হবে কীকরে? সেসময় নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কারণে বিয়েটা হয়নি আরকি! আর তাই তো, টাকাটা ফেরত দিতে চাইছে। তাছাড়া মেয়েটার বিয়েও হয়ে গেছে।

: ও আচ্ছা, বুঝলাম! মেয়ের বাপ ঋণ দায়গ্রস্ত থাকতে চাইছেন না। খুব ভালো! খুব ভালো! তা, এই ঋণ দায়গ্রস্ততা থেকে উনি তো চাইলেই আরও এক বছর আগেই মুক্ত হয়ে যেতে পারতেন। এত বড়োলোক, এ কটা টাকা দিতে এত সময় নিলেন? এই এক বছর ধরে সে টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছিলেন বুঝি?

: আহা, আহা! আপনি কী যে বলেন না, মশাই! হয়তো ওদের অন্য সমস্যা ছিল, তাই…….

: সমস্যা? ও আচ্ছা! বুঝেছি, বুঝেছি! উনি টাকাটা পাওয়ামাত্রই গলাধঃকরণ করে ফেলেছিলেন। আর পরবর্তীতে সেটা যোগাড় করতেই বেচারার এক বছর লেগে গেল! স্বাভাবিক। এতগুলো টাকা………(এ কথার পর ৩ জনই হাসতে লাগলেন।)

: তা শোনো, বাবা! তোমাদের কিন্তু উচিত টাকাটা নিয়ে নেয়া! এ কলিকালে কে কাকে অতোগুলো টাকা নগদে ফেরত দেয়, বলো? বুঝলাম, তোমার মা হয়তো সেটা আশীর্বাদ করেই দিয়েছেন। সে আশীর্বাদেই তো মেয়েটার অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়েও হয়ে গেল! ভালোই! টাকাটা নিয়ে নিয়ো, বাবা।

: না মানে, আঙ্কেল, আসলে ওটার কথা আমাদের মনেই নেই। তাছাড়া ওর মঙ্গলকামনা করেই মা……….

: বুঝলাম তো বাপু! মঙ্গল তো ওর হয়েছেই! টাকাটা আর পড়ে থাকবে কেন? আর তোমরা নিতে না চাইলে আমাকে দিয়ে দিয়ো। একটা বড়সড় ছাগল কিনে বারবিকিউ পার্টি হয়ে যাবে! কী বলেন, ডাক্তার বাবু? আমরা আমরাই তো!

: উফফ! থামুন না, মশাই! কী বলছেন এসব?

: আহা, রেগে যাচ্ছেন কেন, ডাক্তার বাবু? আচ্ছা, বারবিকিউ বাদ! টাকাটা নিলে তো আমরা লায়ন্স ক্লাবের পক্ষ থেকে আর্তমানবতার সেবায় সেটা নেপালে পাঠিয়ে দিতে পারি। কী বলেন? আর তোমাকে বলছি। সামনে থেকে তোমার মাকে বলো, টাকাপয়সা যা দেয়ার বিয়ের পর দিতে। আশীর্বাদ বিয়ের পর করাই ভালো। নাহলে তো পুরোটাই লস!

দুপুরে খাওয়ার সময় আমার ছোটভাইয়ের কাছে এসব কথা শুনে আমার হাসতে-হাসতে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা! ও এমনিতেই খুব মিমিক্রি করে করে এসব বলে। প্রথমে মানুষের ছোটলোকিতে মেজাজখারাপ হয়েছিল। ওদের পুরো পরিবারই অতি উচ্চশিক্ষিত! সবাই-ই একেবারে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া-টাইপ! একইসাথে ঔদ্ধত্য এবং অহংকারও ছিল পুরোমাত্রায়! ওদেরকে কখনও মানুষকে খুব একটা সম্মান দিয়ে কথা বলতে দেখিনি, যা আমাদের পরিবারের সাথে একটুও যায় না। আমার, আমার অনেক সিনিয়র আইনজীবী বাবার, আমার মায়ের, কিংবা আমার ছোটভাই, কারওরই অতো ভাবটাব ধরার কিংবা সহ্য করার ইচ্ছে কিংবা সময় কোনওটাই নেই। ওরা চাইছিল, ঘরজামাইটাইপ গৃহপালিত ছেলে যে ধনী শ্বশুরের কথায় উঠবে, ধনী শ্বশুরের কথায় বসবে। ঠিকই আছে। এরকম কোরবানির গরুটাইপের ছেলে পাওয়া যায় বলেই তো মেয়ের বাবারা এরকম ছেলে খোঁজে। কিন্তু আমার সমস্যা ছিল, আমি প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাবো, তবুও কিছুতেই ওরকম হতে পারব না! মানসিকতার ভিন্নতার কারণেই বিয়েটা আর হয়নি। নাহলে আর সবকিছুই ঠিক ছিল। এখন বুঝতে পারছি, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি! এমন অসম মানসিকতার বিয়ে খুব একটা টেকে না। ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তো, তাই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারতাম না। আবারও স্বীকার করছি, গীতার মূল কথাটিই ঠিক: “যা হয়েছে, তা ভালোই হয়েছে। যা হচ্ছে, তা ভালোই হচ্ছে। যা হবে, তা ভালোই হবে।” ল্যাটিনে বলেঃ Que sera, sera. মানে, Whatever was, was; whatever is, is; whatever will be, will be. আমি এখনও পর্যন্ত এই দর্শনের কোনও ব্যত্যয় দেখিনি। একমাত্রই সৃষ্টিকর্তাই জানেন, কোনটা আমাদের জন্য ভালো, কোনটা খারাপ। আমরা প্রত্যেকেই একটা বিশাল মাস্টারপ্ল্যানের অতিক্ষুদ্র অংশমাত্র! মাঝেমাঝে সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা শোনেন প্রার্থনা না শোনার মাধ্যমে।

Content Protection by DMCA.com