আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে মেয়ে-যেন-লম্বা-হয় কোটায় কঙ্কার বিয়ে হয়ে যায় বর্ষার শুরুর দিকে। এরপর থেকে প্রতিবর্ষায় বিয়ের কথা, নতুন জীবন শুরুর স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়তে থাকে কঙ্কাবতীর। কঙ্কা ইন্টার পাশ করল মোটামুটি একটা রেজাল্ট করে। এর পরে কী করবে, তা আর গুছিয়ে ভাবার সুযোগ পায়নি। সংসারে আসার আগেই ওর মা চারবেলা করে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এখন আর ওসব নিয়ে ভাবাভাবিটাই অহেতুক! প্রত্যেক দিন কত যে মানুষ “নতুন বউ দেখব, নতুন বউ দেখব” করে করে তার লাল শাড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা গুনেই সারা যাচ্ছিল না। ঘরভর্তি লাল শাড়ি, হাতভর্তি চুড়ি আর প্লেটভর্তি লাল-সাদা মিষ্টি—এই তিনটে জিনিস যেন কেউ রুটিনে বেঁধে দিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে-খাটিয়ে কঙ্কাকে দেখে প্রায় সবাই বলত, “বউ কিন্তু ম্যালা লম্বা!” এই কথায় শ্বশুরবাড়ির সবাইকে খুশি হবার সুযোগ দিয়ে কঙ্কা ভাবতে বসত, লম্বা হওয়া ছাড়াও তো আরও কত গুণ নিয়েই সে জন্মেছিল এই পৃথিবীতে! ছবি আঁকত বলে তাকে নিয়ে মা ভয় পেত, বুঁদ হয়ে কবিতা পড়ত বলে ভয় পেত বড়ো ভাইজান। কিন্তু একদিন বিকেলে বউ-দেখতে-চাওয়া ভরা মজলিসে কঙ্কাকে গানের অনুরোধ করতেই সে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ফেলেছিল। মাথা নিচু করে সেদিন সে ভাবছিল, শ্বশুরবাড়ির ঠিক কয়জনকে সে ভয় পাইয়ে দিল! অথচ গান থামতে না থামতেই হাততালি দিয়ে উঠেছিল কঙ্কার শাশুড়ি-সহ আরও কয়েকজন। এরকম কেন হলো, তার হিসেব মিলছে না। কারণ তার বাপের বাড়ির সবাই বলেছিল, রান্না না জেনে গান, কবিতা, আঁকাআঁকি জানলে কঙ্কা কখনও সংসার করতে পারবে না। অথচ কঙ্কার শাশুড়ি ওর কাছ থেকে প্রত্যেক বিকেলে রবীন্দ্রসংগীত আর প্রত্যেক শুক্রবারে কবিতা আবৃত্তি শোনার যে-রুটিন তৈরি করেছিলেন, সেটা ওঁর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত একইভাবে চলেছে। আজ বুড়োবয়সে এসে কঙ্কাবতী ভাবে, বাবা-মা’য়ের বেশিরভাগ দুশ্চিন্তাই অহেতুক। তাঁরা নিজেদের এসব ভিত্তিহীন চিন্তাকে চাপিয়ে না দিলে কঙ্কা আরও বেশি রং-রূপ-মন দিয়ে সংসার করতে পারত।