যখন ছাড়তে হয় . . .

জীবনটা ঠিকভাবে কাটানোর জন্য দুটো জিনিস বোঝা জরুরি: কখন ধরে রাখতে হবে, কখন হাত ছেড়ে দিতে হবে। জীবনে এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে জীবনটা একেবারে খারাপ না।

মৃত্যুর পর কোনো এক স্বর্গে অনন্ত সুখভোগ কিংবা নরকে নিরন্তর কষ্টযাপন—এই বিশ্বাসে যখন আমরা বেঁচে থাকি, তখন মৃত্যুর পর সেই স্বর্গসুখ পেতে জীবিতাবস্থাতেই আমরা যা যা করি, তাতে মৃত্যুর আগেই সেই সুখ আমাদের পাওয়া হয়ে যায়। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের দিকে মৃত্যু-পূর্ববর্তী এ যাত্রাপথে আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে—কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন বস্তুর মায়া ত্যাগ করার সময় হয়ে গেছে। মায়াই সকল সর্বনাশের মূল।

বাঁচতে হলে ধরতে যতটা জানতে হয়, তার চাইতে ঢের বেশি জানতে হয় ছাড়তে। যখন কোনো কিছু ধরে রাখতে গিয়ে নিজের জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়তে থাকে, তখন তা তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দেওয়াই ভাল। ভালো এবং মন্দ, ভালোবাসা ও ঘৃণা, ক্ষমা ও প্রতিশোধ—এমন পরস্পরবিরোধী সত্তার সহাবস্থানই জীবন। আমার নিজের ও অন্যদের প্রতি দায়িত্ব বুঝে না চললে জীবনে অহেতুক কিছু ঝামেলা এসে ভিড় করে, যা কেবল যন্ত্রণাই দেয়।

আমরা যদি এমন কিছুকে ছেড়ে দিই, যা না রাখাটাই বড্ড ভুল, তবে তা আমাদের অনেক ভোগায়। আমরা যদি এমন কিছুকে রেখে দিই, যা ছেড়ে দিলেই বরং বেঁচে যেতাম, তবে তা কখনো কখনো আমাদের একেবারে নিঃশেষ করে দেয়। আমরা কী ধরে রাখছি, কী ছেড়ে দিচ্ছি, তা নির্ভর করে—আমরা কোনটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি আর তা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তটা কী—এই দুটো বিষয়ের উপর। আমাদের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন, যদি শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তের প্রতি অটল থাকার সামর্থ্য থাকে, তবে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়ে যায় না।

যত কষ্টই হোক না কেন, সব কিছুকে মেনে নিয়ে…কখন ছাড়তে হবে কিংবা কখন ধরে রাখতে হবে—এই সময়জ্ঞান রপ্ত করাটা বেশ কঠিন। অনেকসময় এই আর্ট শিখতে সারাজীবন লেগে যায়। জীবন একবার মৃত্যুকে প্রশ্ন করল, “লোকে কেন আমাকে ভালোবাসে, আর তোমাকে ঘৃণা করে?” মৃত্যু হেসে উত্তর দিল, “কারণ, লোকে তোমায় দেখে মনভোলানো দারুণ সব মিথ্যের জাদুতে, আর আমায় দেখে এক যন্ত্রণাদায়ক সত্য রূপে।”
সুখ কী, তা বোঝার জন্য প্রথমেই দরকার অসীম দুঃখের আবাহন। যন্ত্রণা কমাতে যন্ত্রণা বাড়াতে হয়, স্বস্তির খোঁজ মেলে অস্বস্তির মহাসমুদ্রে ডুবসাঁতার কেটে। যে কোলাহল চেনে না, সে কখনও নীরবতা চিনতে পারে না। জীবনের কঠিনতম কাজগুলির একটা হলো, কোনো কিছুকে ছেড়ে দেওয়া। হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, রাগ কিংবা অভিমান, লাভ কিংবা ক্ষতি, বন্ধু কিংবা শত্রু, কাজ কিংবা আলস্য—পরিবর্তন অত সহজ ব্যাপার নয়।

কোনো কিছুকে ধরে রাখতে, ছেড়ে দিতে—দুটোতেই আমাদের নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। অনেক দিন পরও আমাদের মনে হয়তো একটাই আফসোস থেকে যাবে: হায়! যা আঁকড়ে ধরে এতদিন কাটিয়ে দিলাম, তা আসলে আমার ছিল‌ই না!
Content Protection by DMCA.com