মেয়ে, ওঠো!



মেয়ে, তুমি ক্রমেই ধুলোয় মিশে যাচ্ছ, পাথরের আঘাতে আঘাতে তোমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখছ, তুমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছ, খুব চেষ্টা করেও সেগুলি আর জড়ো করতে পারছ না। আজ তোমার পাশে কেউ নেই। তোমার মধ্যে যে তুমিটা ছিল, সে তুমিটা আজ লক্ষ টুকরোয় ছড়িয়ে পড়েছে অবহেলায়; সেখান থেকে কোন টুকরোগুলি রাখার মতন কিংবা কাজে লাগবে, তা বলে দেবার জন্য হাতড়েও কাউকে আজ খুঁজে পাচ্ছ না।


হ্যাঁ মেয়ে, তুমি ঠিক জায়গাতেই আছ! এখন থেকেই তোমার যাত্রার শুরু! যতক্ষণ দরকার, নিজেকে লুকিয়ে রাখো। সবসময় প্রকাশ করতে নেই। ওরা দেখুক, তুমি হারিয়ে গেছ। দেখে খুশি থাকুক। হুট করেই কোথাও চলে যেয়ো না, যাবার আগে রাস্তা চিনে নাও। সময় নাও, নিজের দিকে মন দাও। মাথায় রাখো, তুমি ভেঙে গেছ। তাই তোমার জীবন এখন আর অন্য দশ জনের জীবনের মতো সহজ নয়। এটা বোঝা খুব জরুরি। মনে রেখো, ঈশ্বর তাদেরই দুঃখ দেন, যারা ওটা বহন করার শক্তি রাখে। যতটা দুঃখ তুমি নিতে পারবে না, ততটা দুঃখ তুমি কখনও পাবে না।


ধীরে চলো...তাড়াহুড়ো নেই, সময় আছে।


আমি জানি, তোমার ধারণা, তুমি যখন ভেঙে যাচ্ছিলে, তখনই ছিল তোমার জীবনের সবচাইতে কষ্টের অধ্যায়। আসলে তা নয়। পৃষ্ঠাটা ওলটাও। দেখবে, পরের অধ্যায়টা আরও দীর্ঘ। সেই অধ্যায়ে তুমি নিজেকে সারিয়ে তুলবে, নিজেকে তুলে আনবে, নিজেকে মেলে ধরবে, অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসবে। সেখানেই এক নতুন তুমি'র জন্ম হবে। ধৈর্য ধরো, নিজেকে ধরে রাখার এখনই সময়। জেনে রাখো, তোমার কাজটা সহজ নয়।


সঙ্গে এ-ও জেনে রাখো, এই অধ্যায়টা শেষ করার মতো শক্তি তোমার মধ্যে আছে। তুমি ভেঙে গেছ বলেই আজ জেনে গেছ, নিজেকে কীভাবে আবার গড়তে হয়। তোমার মধ্যে আজ যে বাড়তি ঐশ্বর্য আছে, তা হলো সাহস। অনেকেই সারাজীবন অপেক্ষা করেও তা পায় না। আজ তোমার হারাবার কিছুই নেই। তাই আজ তোমার শুধুই পাবার সময়। সব হারিয়ে আজ তুমি নিঃস্ব। আজ যা পাবে, তা-ই বোনাস! এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়, বলো!


নিজের যা-কিছু অপ্রয়োজনীয়, তার সব কিছুই এখানেই ফেলে রাখো। এগোতে চাইলে ফেলে দিতে হয়। তোমার যা যা তুমি নিজেই তৈরি করেছ, তার সবটুকুর মায়াই ছাড়তে হবে, যদি সেগুলি তোমাকে আজ পথ চলতে বাধা দেয়। মায়া কোরো না, মেয়ে! বাঁচতে চাইলে মায়া ছাড়তে হয়।


তুমি বেঁচে আছ থেমে যেতে নয়, বেড়ে উঠতে। যে জায়গাটা তোমার নয়, সে জায়গায় থেকে যেয়ো না, তা যতই আরামের হোক না কেন! থেকে গেলে আরও কষ্ট পাবে, নিশ্চিত থাকো। যে চেনা বন্ধু তোমাকে খুন করে, তার চাইতে সেই অচেনা শত্রুও ভালো, যে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে।


মেয়ে, তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ? তোমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা কেবলই তোমার সঙ্গে হয়নি। আমাদেরও গল্প আছে, ক্ষত আছে। ক্ষত সারাতে পারে না যারা, ওদের গল্প পৃথিবী শোনে না। জেনে রাখো, পুরো পৃথিবী তোমার গল্পটা শোনার অপেক্ষায়। তোমার আঘাতগুলি গুনে দেখো। প্রতিটি ক্ষত থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। ওগুলি রক্তবিন্দু নয়, নিজেকে ধাক্কা দেবার একেকটি তীব্র অজুহাত। তোমার প্রতিটি অশ্রুকণা সেই হৃদয় থেকেই উৎসরিত, যে হৃদয়টা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার সমস্ত আত্মা আজ চিৎকার করে বলছে, এখনই সময়! এই মুহূর্তেই! ঘুরে দাঁড়াও! মেয়ে, শুনতে পাচ্ছ তুমি আমার কথা?


বিশ্বাস করো, এই আঘাতটার দরকার ছিল। মানুষ আঘাতেই বড়ো হয়। আঘাতটা না পেলে নিজেকে কখনও চিনতেই পারতে না। আজকের তুমিটা আহত হবার পরেই জন্ম নিয়েছে। আজ তুমি জানো, তুমি কে এবং তুমি কে নও; তুমি কোথায় যাবে এবং কোথায় যাবে না। তুমি এ-ও জানো, জীবনের কোন কোন ভুল অধ্যায়ে তুমি আর কোনোদিনই ফিরে যাবে না। আজ তোমাকে শত চাইলেও আর রক্তাক্ত করা যাবে না।


দুঃখ পেয়ো না, ক্ষমা চেয়ো না, অনুশোচনা কোরো না। ওই সময়টা তুমি পার করে এসেছ। তখন কেউ তোমাকে ক্ষমা করেনি, কেউ তোমার পাশে দাঁড়ায়নি, কেউ তোমাকে দুটো ভালো কথা বলেনি। তাই ওসব এখন কেবলই বিলাসিতা, অহেতুকই কালক্ষেপণ। তুমি যা, তার জন্য দুঃখ পাবার কিছু নেই। তোমার ভুলগুলিই তোমাকে তৈরি করেছে।


তোমার জীবনের যা-কিছু তোমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে, তা-কিছু নিয়ে কীসের দুঃখ? কীসের সংকোচ? কীসের অনুতাপ? যে সময় চলে গেছে, তার একটিও বিন্দু নষ্ট হয়নি। তোমার নিজের দামটা বোঝার জন্য এই সময়টার প্রয়োজন ছিল। এ কেবলই সময় নয়, এ তোমার মহান শিক্ষক। শিক্ষকের সামনে মাথাটা নত করে রাখো, শিক্ষককে অভিশাপ দিয়ে কেউ কি কখনও শিখতে পেরেছে?


মেয়ে, তোমার সমস্ত কমফোর্ট-জোন থেকে বেরিয়ে যাও। এক্ষুনি! তোমার যেখানে যেখানে থাকার কথা ছিল, সেসব জায়গা থেকে তোমার মনোযোগ অবিলম্বে সরিয়ে আনো। সময় এখন অন্যরকম। কারও কথা শুনো না; ওরা জানেই না, তুমি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ! তোমার দুঃখ কখনওই ওদের হয়নি, ওরা তাই জানে না, তোমার সুখের রাস্তাটা কোন দিকে। ওরা সুখে আছে, সুখে থাক; ওদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ো না। মানুষ নিজে যে দুঃখ পায়নি, সে দুঃখ বুঝতে পারে না। তবু কিছু মানুষ অচেনা দুঃখ নিয়েও মতামত দেয়। মেয়ে, তুমি তো জানোই, অপদার্থদের কথা কানে নিতে হয় না!


মেয়ে, দেরি হয়ে যাবার আগেই জেগে ওঠো! আজকের এই শক্তিটা তোমার অর্জন, কেউ তা তোমাকে দেয়নি। তুমি নিজের শক্তিতেই আজ বেঁচে আছ, কারও দয়ায় নয়! কারও প্রত্যাশা মাথায় রেখে বাঁচার সময় তোমার আজ নয়। তোমার দামটা কাউকেই আর ঠিক করতে দিয়ো না। মানুষ বড়ো নিষ্ঠুর, বড়ো অবিবেচক; সুযোগ পেলে অন্যের দামটা সে কম করেই ধরে! নিজের দামটা নিজেই জানো, নিজেই বোঝো, নিজেই শেখো। তুমি সত্যি সত্যিই সেই জায়গায় পৌঁছে গেছ, যে জায়গায় ওদের আসতে অনেক সময় লাগবে, যারা আজ তোমাকে বুঝতে পারছে না।


দুঃখকে উদ্‌যাপন করো! উঠে দাঁড়াও, মেয়ে! আর কষ্ট নেই, আজ তুমি কষ্ট সহ্য করতে জানো! পৃথিবীকে দেখিয়ে দাও, পুরো পৃথিবী তোমাকে এতদিন সত্যিই ভুল বুঝেছে!