মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় আমার আজকের নয়; সেই স্কুলে পড়ার সময় ওর বাবার কাছে যখন প্রাইভেট পড়তাম, তখন থেকেই।
তারও পর ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় নোটের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমাদের পরিচয়টা 'ঘনিষ্ঠতায়' (অবশ্য বন্ধুদের মতে) রূপান্তর ঘটে। সহপাঠিনী মেয়েটির প্রতি অনেকেরই দুর্বলতা ছিল লক্ষ করেছি। কিন্তু আমি জানি, নিতান্ত খেয়ালের বশে না হলে কোনোদিন সচেতনভাবে ওকে ভালোবাসব, এমন ভাবিনি। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা নেহাতই বন্ধুত্বের পর্যায়ে ছিল। তবে এ নিয়ে কথা উঠতে পারে, কাজেই সেসব থাক।
তালেবের অবস্থা আমি জানতাম। ও ভালোবাসত মেয়েটিকে। ছোটো থেকেই ওকে স্বপ্ন দেখে দেখে কল্পনায় অনেক রঙিন ছবি ও এঁকেছে। বয়স বাড়লে কবিতা লিখেছে চুপি চুপি। আমি ওর কবিতার ধৈর্যশীল শ্রোতা। ওর সঙ্গে তাই মিলত ভালো।
দীপ্তিও ওকে ভালোবাসত বলেই জানতাম। সত্যিই দীপ্তিময় চেহারার অধিকারিণী মেয়েটি, প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়ার মতো। বড়ো বড়ো আয়ত চোখ, ধারালো নাক, টানা টানা ভ্রূ—সব মিলিয়ে অপূর্ব বললে হয়তোবা অত্যুক্তি হবে না।
সেই তালেব, ক্লাসে যে কোনোদিন প্রথম থেকে দ্বিতীয় হয়নি, হঠাৎ আমূল পালটে গেল। ক্লাস ঠিকমতো করে না। সারাক্ষণ কী যেন একটা ভাবে। উদাস চোখে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে থাকে সারাদিন। চারদিক ছাপিয়ে আঁধার নেমে আসে। একসময় তালেবকেও গ্রাস করে নেয়। স্যারদের আশংকাকে সত্যি প্রমাণিত করল ও। তৃতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করল তালেব। পড়াশোনার ক্ষেত্রে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী তালেবকে এতটা বাজেভাবে হারিয়ে দিতে পারব ভাবিনি।
দীপ্তির কথা ও আমায় বলত অকপটে। জানলাম, দীপ্তি ওর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। রাশেদকে ভালোবাসে দীপ্তি। তালেবের ভালোবাসাকে ও প্রত্যাখ্যান করেছে। ব্যাপারটা ফাঁস হবার পর তালেবকে আমি দেখেছি। অনেক সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু তালেব হারিয়ে গেছে। তারপর অনেক দিন গড়িয়েছে। মফস্বল শহর ছেড়ে আমরা ঢাকায় এসেছি উচ্চশিক্ষার মানসে। দীপ্তিও ঢাকায় এসেছে। রাশেদের সঙ্গে দীপ্তির বর্তমান সম্পর্কের কথা আমি জানি। রাশেদরা বড়ো লোক। এসব দীপ্তির কাছ থেকেই শুনেছিলাম।
এতদিন পেরিয়েও একটা অভ্যেস আমার এখনও যায়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি গেলেই অন্তত এক বার দীপ্তিদের বাসায় আমি যেতাম। স্যার আর খালাম্মার প্রবল স্নেহই আমায় টেনে নিয়ে যেত ওদের বাসায়।
লক্ষ করতাম, ওখানে গেলেই খালাম্মা কেমন আদরযত্ন করে এটা-সেটা খাওয়াতেন। এরপর কৃতী ছাত্রের বরমাল্য জোটার পর তাঁর স্নেহের মাত্রাটাও একটু চড়ে গিয়েছিল। কাজেই যেতে হতো। আর সেবার স্যারের বাসায় গিয়েই আটকে গেলাম ব্যাপারটায়।
চা-নাস্তা শেষে খালাম্মা প্রশ্ন করলেন, "ঢাকা কবে যাচ্ছ, বাবা?"
বললাম, “কাল যাচ্ছি, খালাম্মা। ক-দিন আগেই দেখা করতে আসতাম। খালাত বোনের বিয়েতে আটকে যাওয়ায় আসতে পারিনি। ভাবলাম, কাল তো যেতেই হচ্ছে, খালাম্মার সাথে দেখাটা করেই আসি।” “বেশ করেছ, বাবা। কিন্তু এদিকে এক মুশকিলে পড়ে গেছি।” “মুশকিল?” উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
"হ্যাঁ, বাবা, দীপ্তির ভার্সিটি খুলেছে আজ। কিন্তু ওর বাবা তো পরীক্ষার জন্যে ছুটি পাচ্ছে না। আর শফিকও পরীক্ষা দিচ্ছে। কার সঙ্গে যে ওকে পাঠাই!"
খালাম্মার মনোগত অভিপ্রায় আমি বেশ বুঝতে পারলাম। সত্যি বলতে কী, বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা আগ্রহও অনুভব করলাম। অনুভূতিটাকে যথাসম্ভব চাপা দিতে চেষ্টা করে সামনে-রাখা দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বললাম, “আমি তো কাল যাচ্ছি, খালাম্মা, কিন্তু…” “আবার কিন্তু কী? কষ্ট করে ওকে একটু নিয়ে যাও না, বাবা। ক-দিন পর ওর একটা পরীক্ষাও নাকি আছে। বাড়িতে তো একদম পড়াশোনা করে না।”
দীপ্তিকে ডেকে নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। বুঝলাম, আটকে গেছি। একধরনের ভালোলাগার মধ্যে ডুবে গেলাম।
দীপ্তিকে নিয়ে স্টেশনে এসেছি। গাড়ি এসে পৌঁছোয়নি। ওয়েটিং-রুমে ইজি-চেয়ারটায় বসে বসে রীতার কথাই ভাবছিলাম। জানি না, রীতা এখন কী করছে। এখনও ও মাত্র আধমাইলের মধ্যে আছে। অথচ মাত্র ক-টি ঘণ্টা, চলে যাব দেড়-শো মাইল দূরে, ওকে ছেড়ে। কাল রীতার সাথে কলেজ পুকুরঘাটে দেখা হয়েছিল। আমিই ডেকেছিলাম। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন শানবাঁধানো ঘাটটাতে পাশাপাশি বসেছিলাম দু-জন। অনেকক্ষণ।
বিরাট পুকুরটার কাকচক্ষু জলে খেলা করছিল এক ঝাঁক পাতিহাঁস, আর এক জোড়া সাদা ধবধবে রাজহাঁস। প্যাঁক প্যাঁক করে হাঁসগুলো একে অন্যকে আদর জানাচ্ছিল। পুকুরে বেড়ানোর নৌকোটা তলা ফুটো হয়ে তীরের কাছে তলিয়ে আছে। শুধু অর্ধনিমগ্ন গলুইটার উপর একটা মাছরাঙা পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আমাদেরই মতো চুপচাপ বসে ছিল। শরতের বিকেলটা এখানে বড়ো শান্ত, স্থির, স্নিগ্ধ।
রীতা তাকিয়েছিল হাঁসগুলোর দিকে, একমনে। আমি কী যেন ওকে বলতে চাইছিলাম। কিন্তু ভাষা খুঁজে পাইনি। বলব বলব করে কিছুই বলা হচ্ছিল না। বুকের ভেতরকার চাপা আবেগটা প্রকাশ পাবার জন্যে আকুলি-বিকুলি করে কেবল অস্বস্তিই বাড়াচ্ছিল।
অবশেষে মরিয়া হয়েই বললাম: “রীতা! অমন চুপ করে কেন? কিছু একটা বলো!”
রীতা কী যেন ভাবছিল। সহসা একটু কেঁপে উঠল। বলল, “কী বলব? তুমিই তো কী যেন বলবে বলে ডেকেছ।” সত্যিই তো। কী বলব ওকে? আমি চুপ হয়ে গেলাম। শুধু ওর হাতটা মুঠোয় তুলে নিয়ে তাকালাম ওর মুখের দিকে। গভীরভাবে দেখলাম ওকে।
নারকেলের পাতার ফাঁক দিয়ে গোধূলি আলোর আভা এসে পড়েছে ওর মুখে। একরাশ কালো চুলের বন্যা বেণীবদ্ধ হয়ে বুকের দু-পাশ দিয়ে নেমে গেছে। কেমন এক অব্যক্ত ক্লান্তি দু-চোখে জড়িয়ে আছে। কচি কলাপাতা রঙের শাড়িতে রীতাকে লাগছিল অপরূপ সুষমাময়ী। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম ধীরে ধীরে। হাঁসগুলো দল বেঁধে উঠে পড়েছে পুকুর থেকে। পালক-ঝাড়া শেষ করে এগিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। নীলাকাশে ঝাঁক বেঁধে বলাকারা ফিরে চলেছে আপন নীড়ে। মুঠোতে-ধরা ওর হাতটাতে একটু মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, “রীতা, সত্যি তুমি আমায় ভালোবাস?”
এক বার ও হাসল, সদ্যপ্রস্ফুটিত শ্বেতগোলাপের ওপর পূর্ণ-চন্দ্রালোক ঝলসে উঠল।
এবার ও লুটিয়ে পড়ল আমার বুকে। মুখে শুধু বলল, “ভালোবাসি, ভালোবাসব চিরদিন।”
অ-নে-ক শুনেছি ওর মুখ থেকে একথা। চিঠিতে পড়েছি। তবুও ভালো লাগে শুনতে।
কিন্তু আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে উঠতেই বুঝলাম, রীতা কাঁদছে। অবাক হলাম।
“রীতা, তুমি কাঁদছ?”
প্রত্যুত্তরে শুধু আর-একটু জোরে আমায় আঁকড়ে ধরল। বুঝলাম, কিছু-একটা হয়েছে। সময় দিলাম কাঁদতে। একসময় শান্ত হয়ে এল রীতা। মুখ আঁচলে মুছে নিজেকে সামলে নিল। বলল, “আজ তোমায় একটা কথা বলা প্রয়োজন, জাহিদ। হয়তোবা কোনোদিন আমায় ভুল বুঝতে পার, সেজন্যেই আজ কথাটা বলতে চাইছি।”
বললাম, “তোমায় আমি কোনোদিনই ভুল বুঝব না, রীতা। কিন্তু বলতে চাইছ যখন, বলো।”
“তুমি হয়তো জানো না, জাহিদ, আব্বা আমার বিয়ে দেবার জন্য কতটা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এরই মধ্যে দুটো বিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছি আমি। কিন্তু আব্বার ভাব দেখে আমার ভয় হচ্ছে, বুঝি তোমায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করতে পারব না। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন!”
ক-ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। রুমালে মুছিয়ে দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরে বললাম, “রীতা, তুমি তো জানো, বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। আমার ওপর সমস্ত পরিবারটাই আশা করে বসে আছে। এমন অবস্থায়…”
“আমি জানি, জাহিদ। খালাম্মা দুঃখ পান, এমন কোনো কাজ তোমায় আমি করতে দেবো না। কিন্তু যদি কোনোদিন হারিয়ে যাই…আমায় ক্ষমা কোরো।”
সহসাই উঠে দাঁড়াল রীতা। সূর্যটা কখন ক্রমশ সন্ধ্যার মাঝে হারিয়ে গেছে বুঝিনি।
পুবাকাশে একরাশ পেঁজা-পেঁজা ভেড়ার পাল মেঘগুলোয় লাল আভা ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে।
বলল, “জানি না, জাহিদ, এ দেখাই শেষ দেখা কি না!”
“এই! শুনছ? কী ভাবছ এত বলো তো!”
চমকে জেগে উঠলাম সম্মোহিত অবস্থা থেকে। অবাক হয়ে তাকালাম দীপ্তির মুখের দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নয়, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। না, কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। রীতার সঙ্গে সাদৃশ্য নেই। রীতা নেই। ট্রেনের ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। হয়তো গাড়ি এল বলে। “কী দেখছ ওভাবে?” “না, কিছু না। চলো, ওঠা যাক।”
খ্যাপা বাঘের গর্জন করছে মেইলট্রেনটা। তেজী ঘোড়ার মতো দুলকি চালে ঢাকার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে। পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে আম-সুপোরি-কলা বন, ঝোপ-ঝাড়, ছোটো স্টেশন। গম্ভীর গম-গম করে ব্রিজ পেরুচ্ছে।
“দেখো, দেখো, কী সুন্দর মাছ ধরছে ছেলে দুটো! জানো, জাহিদ, আমার রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করছে।” কামরাভর্তি লোকেদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দীপ্তি উচ্ছ্বসিত প্রলাপে বকে চলে। ভাবলাম, একটা-কিছু বলা দরকার। ভিক্ষুকটা তীব্র তেজে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভিক্ষে চাইছিল। পাঁচটি টাকা হাতে গুঁজে বললাম, “বাবা, দয়া করে একটু চুপ করো।”
মনের মধ্যে আমার তখনও চলছে তোলপাড়। ভাবছি রীতার কথা। সেই রীতা, এই দীপ্তি, সেই পুকুর, এই ট্রেন, এই পড়ন্ত বিকেল, রীতার নীরবতা, দীপ্তির উচ্ছ্বাস। কুণ্ঠিত কণ্ঠে ডাকলাম, “দীপ্তি!” “বলো। ইস্, কী সুন্দর বিকেলটা, তাই না? অদ্ভুত মনে হচ্ছে ট্রেনটাকে...যদি চলতেই থাকত…” আবার ডাকলাম। “দীপ্তি…!”
কিন্তু ডাকটা চাপা পড়ে গেল তীব্র হুইসেলে। একটা স্টেশন এসেছে। ওঠা-নামার জন্য যাত্রীরা উদ্গ্রীব। রাশি রাশি লাকড়ির বোঝা জানালা দিয়ে লাইনের পাশে গড়িয়ে পড়ছে। হাতে খোঁচা খেয়ে একজন চেঁচিয়ে উঠলেন।
“বাবারা, একটু জায়গা দাও।” বলে ভিক্ষুকটাও পা বাড়াল। কেমন যেন খালি হয়ে গেল কামরাটা। অবাক কাণ্ড! এত লোক এখানে নামে! দীপ্তি খুশি হয়ে পা তুলে আরাম করে বসল। ঠিক করলাম, একটা-কিছু এবার বলব।
“দীপ্তি, একটা কথা বলার ছিল!” সব কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে বলে উঠলাম। “ও হ্যাঁ, তুমি কী যেন বলতে চেয়েছিলে তখন, তাই না?” বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা বোধ হয় খুব ভালো শোনাবে না।” “বলোই না! কী এমন কথা?” “মানে বলছিলাম, আমাদের সম্পর্কটাকে সবাই কেমন যেন একটু ইয়ের দৃষ্টিতে দেখে, আমি বন্ধুবান্ধবদের কথা বলছি। দেখো, কিছু না হলেও আমাদের মনেও তো অমন কোনো ভাব এসে যেতে পারে। দুর্বল মুহূর্ত তো আর বলে-কয়ে আসে না!” “তুমি কী বলতে চাইছ, বুঝতে পারছি না। প্লিজ, একটু খুলেই বলো না!”
আড়চোখে লক্ষ করলাম, কামরার অন্যান্য প্রায় যাত্রীই আমাদের প্রতি নজর রাখছে। স্বরটা নামিয়ে বললাম, “এই ধরো, আমাদের মাঝে তো একটা অলিখিত চুক্তিও হতে পারে! অন্তত আমরা নিজেরা কখনও তেমন ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেবো না। কিছু মনে করলে না তো?” “না, না! মনে করার কী আছে? সত্যি বলতে কী, এমনই একটা কথা আমিও একদিন ভেবেছিলাম তোমায় বলব বলে।” হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে ও বলল, “কিন্তু বলা হয়নি।”
“জানো, তালেবও এমনই একটা দুর্বল মুহূর্তের শিকার হয়ে হারিয়ে গেল।” “প্লিজ, এখন একটু চুপ করো। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই থাকবে, অন্তত আমার দিক থেকে গ্যারান্টি পেতে পারো।”
আরও অনেক কথা হয়েছে। সূর্যটাকে পেছনে ঝোপের আড়ালে ফেলে এগোচ্ছিল ট্রেনটা। ঝোপ পার হলে সূর্যটাকে আর খুঁজে পেলাম না। তালেবের মতোই হারিয়ে গেছে। হারিয়েছে আগামী দিনে পুনরায় ফিরবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু তালেব?
ঢাকায় দু-জনে এরপরও বেড়িয়েছি অনেক। পার্কে, চিড়িয়াখানায়। সিনেমা দেখেছি। আমার হলে মাঝে মাঝেই এসে ও হামলা করত। বলত, “আজ তোমায় পড়তে দেবো না। চলো।” “কোথায়?” “আহা, চলোই না, অস্থানে নিশ্চয়ই নয়!”
যেতে হতো। শুনতে হতো অনেক কথা। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চিঠি বের করে দেখাত। রাশেদের চিঠি। একা একাই বলে চলত সারাক্ষণ। রাশেদ বিলেতে। ওখানে ডাক্তারি পড়বে। দেশে ফিরবে পাশ করে। কত কথা!
একদিন দুর্বল মুহূর্তে আমাকেও বলতে হয়েছিল অনেক কথা। রীতার কথা। রীতার ইদানীংকার চিঠিগুলো হতাশায় ভরা। সবই বলেছিলাম ওকে। এরপর থেকে আমরা আরও একটু সহজ হতে পেরেছিলাম।
বেশ কিছুদিন দীপ্তির দেখা নেই। পরীক্ষার চাপে খোঁজ নিতে পারিনি। অবশ্য নিজে থেকে ওর খোঁজ আমায় নিতে হয়নি। আগে নিয়মিত আমার এখানে ও-ই আসত।
সেদিন হঠাৎ দীপ্তির কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম।
জাহিদ,
আজ বিকেল তিনটেয় 'আনন্দ'-তে আসবে। অপেক্ষা করব। টিকিট কেটে রেখেছি। সময়মতো তোমায় পাই যেন। সংক্ষেপে বলছি, রাশেদ বিয়ে করেছে। কাল ঢাকা আসছে। আরও অনেক কথা আছে। এসো।
দীপ্তি
চিঠিটা হাতে নিয়ে অবাক হলাম। এর আগে কোনোদিন চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানায়নি। ওদের বাসার ছোকরা চাকরটাই চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে গিয়েছিল।
ভাবছিলাম দীপ্তির কথা। তালেবকে প্রত্যাখ্যান করেছিল ও। কিন্তু রাশেদের কাছ থেকে এমন একটা আঘাত ও পাক—এ হয়তো তালেবও চায়নি। কিন্তু দীপ্তিও কি হারিয়ে যাবে তালেবের মতো? তালেবকে হারিয়েছি, দীপ্তিকেও শেষপর্যন্ত হারাব?
চমকে উঠলাম সৎ-সৎ শব্দে। দরজার নিচ দিয়ে একটা বড়ো খাম মেঝেয় এসে থামল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।
রীতার চিঠি। না, শুধু চিঠি নয়, একটা বিয়ের কার্ড। সঙ্গে হাতে-লেখা চিঠিতে ও লিখেছে:
জাহিদ,
ক্ষমা কোরো। বিয়েতে এসো না। শুধু খবরটা জানালাম। অপেক্ষায় রইলাম। আরেক পৃথিবীতে দেখা হবে। বিদায়।
রীতা
দেখলাম, ভেতরে দেওয়া তারিখের পাঁচ দিন পর ওটা পোস্ট করা হয়েছে। বিয়ে ছ-দিন আগে হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটায় একটা মোচড় দিয়ে উঠল। মুহূর্তকালের জন্যে অনুভব করলাম, পড়ে যাচ্ছি…নিচে, অনেক নিচে, শূন্যের মধ্য দিয়ে পড়ছি। দ্রুতবেগে। হাত বাড়ালাম। কিছুই নেই ধরার। শূন্য হাত ফিরে এল।
কিন্তু না। ক্রমে ক্রমে প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলাম। যুক্তি দিয়ে মনকে বোঝাতে চাইলাম, এ ভালোই হয়েছে। রীতা আর কতদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করবে? ও সুখী হোক।
পাশ থেকে দীপ্তির চিঠিটা টেনে নিয়ে আবার পড়লাম। হাতঘড়িতে আড়াইটা। দীপ্তি অপেক্ষা করছে। এক্ষুনি যাওয়া শুরু না করলে দেরি হয়ে যাবে। চিঠি আর কার্ডটা পকেটে ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।
উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল দীপ্তি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল কাছে। চাকর ছোকরাটাকে বিদেয় দিয়ে বলল, “এসেছ তাহলে? শো আরম্ভ হল বলে। চলো!”
তাকিয়েছিলাম দীপ্তির মুখের দিকে। না, রীতার সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ করছিলাম না। দেখছিলাম, দীপ্তি কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের কোণে কালি। কত রাত ঘুমায়নি কে জানে? সারাদেহটাতে জড়ানো একরাশ ক্লান্তি।
“কী? কী ব্যাপার। কী দেখছ? শুকিয়ে গেছি, তাই না? এখন থাক। চলো।” ভালো করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ও থমকে গেল। আরও একমুহূর্ত তাকাল; বলল, “তোমায় এমন লাগছে কেন, জাহিদ? কিছু হয়নি তো?”
কথা বাড়ালাম না। ইতোমধ্যেই ক-জন টিকেট-না-পাওয়া দর্শক বিনে টিকিটেই আমাদের দ্বৈত-সিনেমা উপভোগ করছিল। বাস্তব চলচ্চিত্র। বললাম, রীতার বিয়ে হয়ে গেছে। “কী, কী বললে? রীতার বিয়ে?”
দেখলাম, স্পষ্ট একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছে ওর দু-চোখে। যেন এটা একদম আশা করেনি। কার্ডটা বের করে ওর হাতে দিলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছিলাম ওকে। উত্তেজনায় মৃদু মৃদু কাঁপছিল দীপ্তি। পড়ছিল দ্রুত। একটা আত্মতৃপ্তির ভাব যেন ক্ষণিকের জন্যেই ওর মুখে ফুটে উঠে আবার তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল। মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে। ভাবলেশহীন সে মুখ। স্থির। শান্ত। ওকে একটু নাড়া দিয়ে বললাম, “আচ্ছা, লোকগুলো ভাবছে কী বলো তো?”
কার্ড-ধরা ওর ডান হাতটার কবজি ধরে মৃদু নাড়া দিয়ে বললাম, “এসো, দীপ্তি, সিনেমা বোধ হয় অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে।”