মৃত্যু এক অসীম সুর




যদি মৃত্যু কোনো সমাপ্তি না হয়ে
এক দরজা হয়—যার কোনো তালা নেই?
যদি কবর আদৌ না হয় কফিন,
বরং আত্মার পুনর্ব্যবহারস্থল,
এক প্রতীক্ষালয়—যেখানে অনন্ত আমাদের পুনর্গঠন করে,
আর আমাদের সত্তাকে তুলে দেয়
অন্য এক দেহে,
অন্য এক কাহিনিতে,
অন্য এক রূপে?

যদি এইসব দেহ, যা নিয়ে আমাদের সকল পূজা কিংবা শোক,
হয় শুধুই মাটির পাত্র—
ভঙ্গুর, ধার-করা সময়ের বাহন,
সাময়িক আশ্রয়… আত্মার জন্য
যে-আত্মা পাহাড়ের চেয়েও প্রাচীন,
নক্ষত্রের চেয়েও জ্ঞানী?
যদি আমাদের ত্বকের প্রতিটি ভাঁজ হয়
অতীত জীবনের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি?
যদি আমাদের স্বপ্নগুলো মায়া নয়,
বরং অতীতযাত্রার খণ্ডচিত্র হয়,
যা স্মৃতির জাল ছুড়ে ফেলেছে?

আর যখন এই ভঙ্গুর দেহগুলো ঝরে যায়,
আত্মা নিঃশব্দে ভেসে থাকে,
হারিয়ে যায় না, হয় না বিলীনও,
বরং অপেক্ষা করে প্রবেশের দ্বিতীয় আহ্বানের—
অস্তিত্বের মহানাট্যমঞ্চে।
নিয়ন্ত্রক যিনি, তিনি অপচয় ঘৃণা করেন;
তিনি পুনরুদ্ধার করেন, নতুন রূপে সাজান,
আবার লেখেন আমাদের জীবনের চিত্রনাট্য,
যেখানে থাকে নতুন চরিত্র,
আমরা যা নিই না বেছে,
অথচ জন্মেই পাই অভিনয়ের গুরুদায়িত্ব… আবারও!

যদি “শেষ সময়” আসলে… পৃথিবীর পতন নয়,
বরং হয় কেবলই তোমার সময়—
নাটকের এই অঙ্কে তোমার পর্দা-নামা;
তার আগে চিত্রনাট্য তোমায় ফের ডাকে
অন্য চামড়ায়, অন্য নামে,
যেখানে তোমার আত্মা বয়ে আনে ফিসফিসে স্মৃতি
আর এমন শিক্ষা, যা শুধু আত্মাই রেখেছে মনে।
যদি স্বর্গ ওপরে নয়,
বরং হয় শুধুই প্রত্যাবর্তনের চক্রে সঞ্চিত জ্ঞান?

তুমি কি কখনো কোনো অচেনা মানুষকে দেখে
ভেবেছ—কোথাও, কোনো শতকে
তুমি তাকে চিনতে?
হয়তো কোনো জন্মে তোমরা সমুদ্র পেরিয়েছ একসাথে,
হয়তো কোনো জন্মে ভাগ করেছ রুটি,
তারপর জন্মের দায় স্মৃতিকে মুছে দিয়েছে।
হয়তো প্রেম প্রথম আবিষ্কার নয়,
বরং পুনঃস্মরণ,
আত্মার পুনর্মিলন
যারা আসলে কখনও হয়নি আলাদা।

যদি পৃথিবীর যাত্রা শেষ না হয় ভুলেও,
বরং ঘুরতে থাকে, অবিরাম ঘুরতে থাকে—
এ এক চক্রাকার নাটক, যেখানে শেষ আসলে ছদ্মবেশী শুরু।
যেখানে মৃত্যু পূর্ণচ্ছেদ নয়, কেবলই কমা,
যেখানে পুরোনো জিনিস মিলিয়ে যায়
শুধু আবার নতুন হয়ে ফিরে আসার জন্য।
যদি অনন্ত দূরে নয়,
বরং লুকোনো থাকে প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে,
যেখানে ভোর পুনর্জন্ম নেয়,
আর সুযোগ ফের আসে।

যদি সত্যিই তা-ই হয়,
তবে মৃত্যু নয় কোনো আয়ু-তস্কর,
বরং শিক্ষক;
নয় কোনো ধ্বংসকারী,
বরং পথপ্রদর্শক;
যিনি আলতো করে আমাদের এগিয়ে দেন
সময়ের এক শ্রেণিকক্ষ থেকে
পরের শ্রেণিকক্ষে।

আর হয়তো, আয়নায় তাকালে
শুধু নিজের মুখই নয়,
দেখতে পাবে এক প্রাচীন যাত্রীকে—
যে পাড়ি দিয়েছে সাগর,
অতিক্রম করেছে শতাব্দী,
পার হয়েছে অগণিত জন্ম,
শুধুই আজ তোমার রূপে আসার জন্য।

আর যখন তোমার ঘণ্টাধ্বনি আবার বাজবে,
তখন নিঃশব্দকে ভয় কোরো না।
নিঃশব্দ কোনো সমাপ্তি নয়।
এ কেবলই এক বিরতি,
নতুন গানের আগে এক স্বচ্ছন্দ শ্বাস,
ওঠার আগে অর্কেস্ট্রার এক টানটান স্থিরতা।
দরজা আবার খুলে যাবে—
অস্তিত্বের সেই অসীম সুরের দিকে।