চিঠিটা হাতে নিয়ে তন্ময় হয়ে বসেছিল নৃপেশ। স্যানেটোরিয়াম থেকে সুজাতা লিখেছে, টাকা চাই।
সত্যি, জোড়াতালি-দেওয়া জীবনটা আর এগিয়ে যেতে চায় না যেন, বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।
জীবনে সেদিন উঠল দারুণ ঝড়, যে-দিন ধরা পড়ল, সুজাতার রক্তের মধ্যে টিবি রোগ বাসা বেঁধেছে।
আর যেন পারে না নৃপেশ। একটানা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। টাকা চাই, টাকা! এইমাত্র ‘নবপল্লব পাবলিশার্স’ থেকে ফিরেছে। বই ছাপতে রাজি তারা, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
না, পারবে না সে তা। সুজাতার চিঠিখানা কালো কালো অক্ষর থেকে উঠে এসে যেন নৃপেশকে দু-হাতে গ্রাস করতে আসছে।
দাদা!
কঠিন ধ্যান ভঙ্গ হয় নৃপেশের। ছোটো বোন রিনা। ধুমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করল, কী? হলো?
: হলো না। ছাপতে রাজি নয়।
: রাজি নয় কেন?
একটু হাসল নৃপেশ, দৃষ্টিভঙ্গিটা আমার খুব বেশি বাস্তব—অতটা বাস্তবতা তারা চায় না।
সন্ধ্যা হবার একটু আগে স্যানেটোরিয়ামে পৌঁছল নৃপেশ। বারান্দায় একটি বেতের চেয়ারে উদাস হয়ে শুয়েছিল সুজাতা। তাকানো যায় না তার দিকে। চোখদুটো কোটরাগত, চুলের ভেতর সেই মিঠে গন্ধ আর নেই। হাত-পা দুটো সরু সরু। যৌবনের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত কালরোগ কেড়ে নিয়েছে। তার খোকার মৃত্যুর পর কী একরকম হিস্টিরিয়া-মতো হয়েছিল সুজাতার। ডাক্তার বলেছিলেন, খাবার চাই, চাই আনন্দ। কিন্তু কী করে দেবে ওসব নৃপেশ? কাগজে গল্প-প্রবন্ধ লিখে কতই-বা পায়! চাকরি অবশ্য করতে পারত, কিন্তু নিজের জীবনের আইডিয়া, সাহিত্যসাধনা সব কিছু ত্যাগ করে আত্মমুগ্ধ বাঙালি সাজতে পারেনি নৃপেশ।
আজ তার মনে হয়, কী হবে এই সাহিত্য, এই আর্ট দিয়ে? এসব কি দেবে তাকে ক্ষুধার অন্ন? হয়তো তার খেয়ালের জন্যই আজ এক বছর ধরে সুজাতাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। দু-বছর আগের সুজাতা তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। ভাসা ভাসা দুটি চোখ তার খুশিতে আনন্দে উজ্জ্বল।
: কেমন আছ?
: ভালোই। তবু ভালো যে মনে পড়ল! যা হোক।
: আসব তো রোজই ভাবি, কিন্তু প্রতিদিন সময় করে উঠতে পারি না যে…
: কেন? অফিসে কাজের বুঝি ভয়ানক চাপ?
বুঝতে পারে নৃপেশ, একটা কঠিন শ্লেষ ছুড়েছে সুজাতা।
একটু বিষণ্ণভাবে হাসল নৃপেশ। তারপর বলল, তুমি তো জানো, সুজাতা, চাকরি আমি করি না। আর ওসব তাঁবেদারি করা আমার পোষাবেও না। তবু জেনেও যদি আঘাত দিয়ে আনন্দ পাও, তবে বলবার আর কী আছে?
: না, সত্যি আঘাত দিতে চাইনি তোমায়। নৃপেশের হাতখানা নিজের শীর্ণ হাতের মধ্যে চেপে ধরে সে। বড়ো শীতল সে স্পর্শ, এতটুকু উত্তাপ নেই।
একটা ক্লান্তিতে যেন মুষড়ে পড়ে সুজাতা।
: রাগ কোরো না, লক্ষ্মীটি, কয়েকটা কথা বলতে চাই।
: বলো।
: আমি বাঁচতে চাই, সেরে উঠতে চাই, তোমাকে চাই আর চাই নীড় বাঁধতে। যা লিখে তুমি কোনো ভালো রোজগার করতে পারবে না, সে পথ থেকে সরে এসো। তুমি চাকরি করো।
চাকরি! সারাজীবনের স্বপ্ন-ছড়ানো পথ থেকে সরে আসতে ডাক দিচ্ছে সুজাতা, তার জীবনসহচরী। একটা কঠিন আঘাতে তার পথ যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এল। আর-একবার তাকাল সে সুজাতার দিকে। এ সেই মর্মভেদী দৃষ্টি, যা একদিন পাগল করে তুলেছিল সুজাতাকে। রোগ কি তবে নিঃসঙ্গতা-জর্জরিত শরীরের সাথে সাথে মনও নিতে যাচ্ছে সুজাতার? হয়তো তা-ই। নয়তো এত দারিদ্র্যের মধ্যেও সুজাতা একমুহূর্তের জন্যও তাকে বলেনি চাকরির কথা। আজ কি বাঁচবার তাগিদ মূর্ত হয়ে উঠল সুজাতার? কী বিচিত্র মানুষের বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা!
: তা হয় না, সুজাতা।
: বিশ্বাস করো, এই মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে আমি হাঁপিয়ে পড়েছি। ঘা খেয়ে খেয়ে আজ এইটুকু ধ্রুব জেনেছি—পৃথিবীতে টাকাটাই সব, টাকার চাইতে বড়ো আর কিছু নয়। তোমার আর্ট বল, সাহিত্য বল, তার গুরুত্বের ওজন হবে টাকার দাঁড়িপাল্লায়।
নৃপেশ প্রতিবাদ করে বলল, আমি আমার সমস্ত লেখনির দরদী স্পর্শ দিয়ে সবাইকে বোঝাতে চাইব, অর্থ মানুষের দরকার—মনুষ্যত্বকে কল্যাণকারী করে তোলার জন্য। মানুষের হৃদয়, রসানুভূতি আর আদর্শের ওপর অর্থের আসন হতে পারে না।
“যাক ওসব কথা!” সুজাতা এই তত্ত্বালোচনার গায়ে একটা সুনিশ্চিত যবনিকা টেনে দেয়। "আমার নাম ওরা কেটে দেবে। ওষুধের জন্য আলাদা টাকা লাগবে। এটা সরকারি হাসপাতাল নয়?"
"তুমি আমাকে বাঁচতে দাও, আমার মেয়ে মিনুর জন্য আমি বাঁচতে চাই। আমি ছাড়া ও যে অসহায়, অন্ধ বোবা মেয়ে আমার।" সুজাতা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সুপারিনটেনডেন্টের সাথে দেখা করে নৃপেশ। প্রথমে অনুমতি পায়নি, অনেক কষ্টে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় পেয়েছে। সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল নৃপেশ: তাহলে চিকিৎসা সেবাটাকেও কি আপনারা টাকার নিক্তিতে ওজন করেন? এখানেও কি শ্রেণিবিভাগ আছে?
পুরু লেনসের চশমা খুলে তাকান সুপারিনটেনডেন্ট নৃপেশের দিকে।
: কী বলছেন?
: আমার স্ত্রীকে নাকি আপনারা ডিসচার্জ করছেন?
: হ্যাঁ। একটা চিঠি যাচ্ছে আপনার কাছে। আমাদের হাসপাতাল দাতব্য চিকিৎসালয় নয়। টাকা দিয়েও এখানে সিট পাওয়া মুশকিল। আপনি আজও আপনার টাকা শোধ করতে পারেননি।
: সে আমার অক্ষমতা, স্বীকার করছি। কিন্তু তাই বলে একজন মৃত্যুপথযাত্রী, যে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচতে চায়, নির্ভর করে আপনাদের ওপর, তাকে তাড়িয়ে দেবেন? হৃদয় বলে কি কিছু নেই?
: বিনে পয়সায় যক্ষ্মা সারে না। যান, টাকা জোগাড় করুনগে। বাজে বকবার সময় নেই।
ম্লান মুখে বেরিয়ে যায় নৃপেশ। টাকা টাকা! সমস্ত সভ্যতাটা যেন টাকার উপর ভর করে এগিয়ে চলেছে। নৃপেশের চুল রুক্ষ, চোখদুটি আরক্ত। গায়ের পাঞ্জাবিটা ধূলিধূসরিত। যেন কতদিন ঘুম হয়নি। ‘নবপল্লব পাবলিশার্স’-এ, যেখানে নবকৃষ্ণ বাবুর অফিস, সেখানে ঢুকল নৃপেশ। হাতে তার একটা বাঁধানো খাতা; পরিষ্কার ঝকঝকে, তাতে বড়ো হরফে লেখা: ভ্রান্তি।
নমস্কার করে বসল নৃপেশ। বলল, ‘ভ্রান্তি’-র বিষয়ে আপনার মতটা একটু জানতে চাই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন নবকৃষ্ণ বাবু। সে দৃষ্টির সামনে ভারি অসহায় মনে হলো যেন নৃপেশকে। বললেন, আমার মত তো বলেই দিয়েছি, নৃপেশ বাবু।
: তবু আর-একটু পরিষ্কার করে...।
: আপনার লেখার তারিফ না করে পারি না। চমৎকার হাত। তবে দৃষ্টিটা চাই একটু সূক্ষ্ম; অর্থাৎ আপনি মানুষের স্থূল জীবনটাকেই বড়ো করতে চেয়েছেন, যা মার্কেটে চলবে না।
: না, এটা ঠিক মানতে পারলাম না। আজকের সভ্যতাকে হাতের মুঠোর মধ্যে করে রেখেছে ক্ষমতাবিলাসী ধনিক, তাদের লালসাই সৃষ্টি করেছে মানুষের লাঞ্ছনা আর মৃত্যু। এইটাই আমি বিশ্বাস করি। তাই আমার আর্ট গর্জন করে।
শুষ্ক মুখে রিনা এসে দাঁড়াল।
: হলো না। আমার দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।
: কেন? দৃষ্টিভঙ্গির কী দোষ?
: মানে, আর্ট সম্পর্কে আমি উগ্রমতপন্থী। টলারেশন নেই। উপন্যাসের কাহিনি ভালো। কিন্তু…
মাথার চুলগুলি দুলিয়ে রিনা বলল, ওরা বোঝে কী আর্টের? যতসব বড়োলোকের ধামাধরা…
: না, না, ও-কথা বলিস না, রিনা। উনি একজন ডবল এমএ। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করতেন। বাজারে যথেষ্ট নাম আছে।
: ওঃ! তুমি নবকৃষ্ণ চৌধুরীর ওখানে গেছিলে? তার চাইতে কয়লার খনির ম্যানেজারের কাছে গেলেই পারতে!
বোনের কথায় একটু হাসল নৃপেশ, ঝিলিক-দেওয়া বিষণ্ণ সেই হাসি, এই মুহূর্তে যার কোনো দাম নেই।
: উপমাটা ভালোই দিয়েছিস, রিনা। সাহিত্যটা আজকাল কিনতে পাওয়া যায়, ঠিক যেন অর্ডার-দেওয়া জামা। পছন্দসই মাপ দিয়ে ছাঁটকাট দিয়ে তাকে তৈরি করে নাও। শিল্পীর মনের আঙিনায় যা তৈরি হবে, তা প্রকাশিত হতে পারে না।
: কিন্তু টাকা যে চাই। বউদির চিঠিটা পড়ো। নৃপেশ পড়ল চিঠিটা, বিষণ্ণভাবে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
: দাদা, তুমি একটা চাকরিই নাহয় করো। গোপালপুর মিলে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির প্রয়োজন। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে নৃপেশের। হ্যাঁ, বাঁচাতে হবে। একটা নিষ্প্রাণ মেয়েকে যখন টেনে এনেছি এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে, নিশ্চয়ই তাকে সব দিক দিয়ে রক্ষা করতে হবে। সত্যিই দুঃখ হয় বেচারির জন্য। কঠিন দারিদ্র্যের জন্যই তো তাকে আজ সইতে হচ্ছে কালব্যাধির মৃত্যুযন্ত্রণা। কী যে গেল তার আঠারো-কুড়ি বৎসরের নারীজীবনে!
ছলছল করে ওঠে নৃপেশের দু-চোখ, আর আশ্চর্য হয় রিনা। তার দাদার চোখে জল, যা কেউ কখনও জীবনেও দেখেনি। হাজারো অত্যাচার, দুঃখ, অনটন, মৃত্যু পারেনি তার দাদার চোখ থেকে একফোঁটাও জল বের করতে। শক্তি আছে বটে বউদির!
: আপনি যে আসবেন, তা জানতাম, নৃপেশ বাবু।
: হ্যাঁ, আমি আসতে বাধ্য হয়েছি, টাকার আমার খুবই প্রয়োজন। অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে চাই একটা।
: হ্যাঁ, দরকার আপনার পুরোপুরি মিটতে পারে অনায়াসেই।
একটা আত্মতৃপ্তির হাসি নবকৃষ্ণ বাবুর ঠোঁটের কোনায়। অসহায় নৃপেশ, যূথভ্রষ্ট কবির মতো পথ হারিয়ে ফেলেছে যেন। সুজাতার বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা তার মনের দরজায় বার বার হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল।
: অ্যাডজাস্টমেন্ট? বেশ! যেখানে আপনি আপনার গল্পের নায়ককে জমিদারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করতে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেখানে আনুন টলারেশন; বলুন, সভ্যতার এই ক্লেদাক্ততার জন্য দায়ী ধনী নয়, ঈশ্বরের আশ্চর্য লীলা। তিনি আমাদের পরীক্ষা করছেন মাত্র। গরিবের এই যে অভাব-অনটন-দুঃখ-কষ্ট, এর জন্য দায়ী বড়োলোকেরা নয়, দায়ী মানুষের জন্ম, যা ভগবানের ইচ্ছে। তারপর তাঁরই করুণায় ঝড় একদিন কেটে যাবে। সূর্য উঠবে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নয়, টলারেশনের মধ্য দিয়ে।
একটা চেকবই নাড়াচাড়া করতে থাকেন নবকৃষ্ণ বাবু। আর নৃপেশের দৃষ্টি তখন স্থির দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে—একটা হরিণশিশু ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ছুটে পালাচ্ছে। একটা ভীষণ ব্যাধ তির-ধনুক নিয়ে পিছে পিছে তাকে ধাওয়া করছে। হিংস্র লকলকে শিকারির দুই চোখ। ছবিটার নাম মৃগয়া।
মনে হলো নৃপেশের, সমস্ত সাহিত্যটাই যেন মুনাফার মৃগয়া। সে ওই ভীত হরিণশিশুর মতোই শিকারির হাতে লাঞ্ছিত।