দিনশেষে, মানুষকে নিজের পছন্দ বা সিদ্ধান্ত নিয়েই বাঁচতে হয়—হোক তা স্বেচ্ছায় বা পরেচ্ছায়। দুই নৌকোয় পা দিয়ে চলা অসম্ভব। যিনি সাধনা করতে চান, একসময় তাঁকে সরে এসে দাঁড়াতেই হয়, জীবনমরণ পণ করে, যে-কোনো এক পক্ষে। দুই পক্ষেই থেকে আসলে কোনো পক্ষে থাকা যায় না। আগে দিক ঠিক করতে হয়, তার পরেই শুরু হয় প্রকৃত পথচলা।
আমাদের নিম্নপ্রকৃতির দাবিকে ভগবানের জ্যোতির সামনে মেলে ধরতে হবে যাতে শেষ পর্যন্ত তা রূপান্তরিত হয়ে উচ্চপ্রকৃতির হয়ে ওঠে। এই কাজটি মানুষকে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ বদলে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তার ভাবনা ও কাজ বদলে যায়। ভগবানের কৃপা ছাড়া এমন উত্তরণ সম্ভব নয়। এ কাজ যদি পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে করা না হয়, তাহলে সকল প্রগতি অনিবার্যভাবেই রুদ্ধ হয়ে যাবে। গোড়ার এই প্রাথমিক কাজটি সবার আগে সম্পন্ন করতে না পারলে মানুষ কোনো আধারেই শান্তি, আনন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। বাইরের জাগতিক মানুষটিকেই পরিবর্তিত করতে হয়, পরিবর্তিত মানুষ শুরুতেই পাওয়া যায় না। তার প্রত্যেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গতিবিধিকে দিব্যরূপে রূপদান করাই আমাদের ব্রত—নিজের এবং অন্যের বেলায়। শুরুটা করতে হয় নিজেকে দিয়ে, বাকিটা আপনাআপনিই হয়ে যায়।
জীবনের সমগ্র ধারাকে আমূল রূপান্তর দান করাই আমাদের লক্ষ্য। অন্তর থেকে সাময়িক সময়ের জন্য দিব্যভাবের প্রার্থনা থাকবে, আর বাইরের মানুষটি অদিব্য শক্তির দাসত্বে আত্মসমর্পণ করে চলবে এক অসহায় দুর্বল সত্তার মতো—এ অবস্থা কখনোই বেশিদিন চলতে পারে না। তা ছাড়া এমন সাধনায় সাফল্য আনতে গেলে কী নিদারুণভাবেই-না পরিশ্রম করতে হয়, তা আমরা দেখেছি। সুন্দর পথের দাবি এই: ভেতর-বাহির এক করে চাইতে হয় সত্যকে, যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, তাকে পুরোপুরিই বরণ করে নিতে হবে। সেই একই পুরাতন পরাজয়ের গ্লানিভার দিনের পর দিন চুপচাপ বয়ে বেড়ানো আর কতকাল অব্যাহত গতিতে চলবে! মানুষ নিজেই নিজের মৃতদেহ বহন করে চলে; আন্তরিকভাবে চাইলে সে ওই দেহে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে।
নতুন পথে চলার জন্য পুরোনো স্বভাবের সংশোধন করা চাই। এমন রূপান্তর একান্তভাবে কাম্য। ভগবান যে-হৃদয়মন্দিরে অবস্থান করেন, সেখানে মিথ্যা ও সত্যের সহাবস্থান চলতে পারে না। মানুষকে অবধারিতভাবেই যে-কোনো এক পক্ষে এসে দাঁড়াতে হবে। স্বভাবের এই পরিবর্তন—এই দিব্য রূপান্তর আজ একান্তই প্রয়োজন। এই সত্যকে মর্মে মর্মে এই জীবন-মন ঢেলে দিয়ে অনুভব করতে হবে—সেই পুরাতন পরাজয়ের জগদ্দল পাথরটাকে বয়ে বেড়ানো আর নয়। অননুভূত সত্যও সত্যই। তাই সত্যের সাপেক্ষ-রূপের পেছনে না ছুটে সার্বভৌমিক রূপটি চিনতে হবে। এর জন্য বাইরের এই পোশাকি মানুষটির সব ধরনের গতিবিধির আমূল পরিবর্তন চাই-ই চাই। বাইরের মানুষ না বদলালে ভেতরের মানুষটা বদলাবে কেন?
পরিবর্তন মোটেই সহজ কথা নয়। একটা প্রজ্বলন্ত আস্পৃহাভরা আকুতি অন্তরে সবসময়ই জাগিয়ে রাখা চাই! আগুন জ্বলে ওঠে, আবার নিভেও যায়। স্বভাবের সেই পুরাতন পরাজয়টি কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে বিপুল বিক্রমে মাথা তুলে উঠে সাধককে একেবারে ধুলায় লুটিয়ে দেয়। কিছু পরাজয়, জয় না এলেই, সাথে সাথে ছুড়ে ফেলে দিতে হয়, কিছুতেই সাথে করে বয়ে বেড়াতে হয় না। পরাজয় বন্ধু নয়, শিক্ষক। পরাজয়ের গ্লানি ছেড়ে যাবার বস্তু, সাথে করে নিয়ে বয়ে বেড়াবার বস্তু নয়।
এর জন্য প্রয়োজন অনন্ত ধৈর্যের। আমাদের বাইরের মানুষটিকে বশে আনতে চাই বিপুল অধ্যবসায়—আমাদের সমগ্র সত্তা একাগ্র করে মিথ্যাময় প্রবল প্রতাপের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। মনের কোনো একটি ক্ষুদ্র ভঙ্গুর অংশের যদি সম্মতি থাকে, প্রশ্রয় আসে, তাহলে বাইরের শয়তানকে কাবু করা অসম্ভব। মন এভাবেই আমাদের উঁচুতেও ওঠায়, আবার নিচেও নামায়।
তবে একটা কথা ধ্রুব-নিশ্চিত—যত বাধাই থাকুক না কেন—সত্যের জ্ঞানোদ্ভাসিত আলোর স্পর্শের সামনে স্বভাব চিরকাল বিজয়ী হতে পারে না। হয়তো বার বার প্রাণান্তকর সংগ্রামে জীবন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে, তবু সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। স্বভাব তার নিজস্ব পরাক্রমে জয় করতে থাকে ঠিকই, তবে তা যদি সত্যের অনুগামী না হয়, তবে সেই জয়যাত্রার রথটি বেশিদূর যেতে পারে না।
আমাদের এগিয়ে চলার পথে পথে প্রাণশক্তির সহযোগিতা অপরিহার্য। প্রাণকে যদি বশে আনা গেল—জীবনের পথে অগ্রগামী করা গেল—তাহলে অনেক অহেতুক বিপত্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
তবে প্রাণকে বশ মানানো সহজ কথা নয়। প্রাণের সাগরেই বাসনা-কামনার উত্তাল তরঙ্গ প্রতিনিয়ত উঠছে আর ভাঙছে। জীবনের সমস্ত দুঃখকষ্টের মূল কারণ—এই প্রাণের অশুদ্ধি; প্রাণের ভোগ-বাসনার দাবি যেন মিটতেই চায় না। সাধারণ মানুষের প্রাণে রাবণের চিতার মতন দাউ দাউ করে লেলিহান শিখায় এই অপূর্ণতা অবিরাম জ্বলছে। পূর্ণতার এই অভাব মানুষ যেন চিরন্তন অবয়বেই রেখে দিতে চায়।
প্রাণকে ঠিকভাবে শায়েস্তা করা কোনো মানবীয় প্রয়াসের দ্বারা সম্ভবপর নয়—একমাত্র ভগবদ্করুণাই পবিত্রতা এনে দিতে পারে—তার জন্য আমাদের দিক থেকে চাই অনুক্ষণ সকাতর প্রার্থনা ও তাকে কাজে পরিণত করার চেষ্টা। স্বভাবের রূপান্তরের জন্য অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায় চাই সবচাইতে বেশি। বারবার সাধের স্বপ্ন অতি নিষ্ঠুর আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সামান্যতমও হতাশ না হয়ে হাসিমুখে আবার সেই ভাঙনের বুকে নতুন সৃষ্টির শপথ গ্রহণ করতে হয়। ভেঙে যাবার পরই মানুষের প্রকৃত শক্তি চেনা যায়।
প্রাণকে মেরেকেটে বা গলা টিপে ধরে শাসনে আনা যায় না। আজ পর্যন্ত এ উপায়ে কেউই কৃতকার্য হয়নি। বরং এতে পরিণামে ফল খুবই খারাপ হয়েছে। প্রাণকে নিষ্পেষণ করা নয়, বরং প্রাণের অশুদ্ধির রূপান্তর—এই তো আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র! নিষ্পেষিত প্রাণ ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে—যে-পথে যাওয়া উচিত, ও-পথে সে আর যেতে পারে না—একসময় নিঃশেষিত হয়ে যায় সহজ নিয়মেই।
প্রাণের প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের সমস্ত গতিবিধি সম্বন্ধে আমরা যেন সজাগ ও সচেতন থাকি। কেন আমরা প্রাণের প্ররোচনায় এ কাজ করি, ওইভাবে চলি, এইভাবে ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করি—এসবের প্রতিটি আবেগ-অনুভূতিকে একটি একটি করে চিনে নিয়ে তাদের যেন সংশোধন করতে পারি। এর অন্যথা ঘটলে প্রাণ থেকে প্রাণই হারিয়ে যায়।
এখানে সমস্ত কিছুই নির্ভর করছে আদর্শের উপর—আর সেই আদর্শকে জীবনমাঝে ফুটিয়ে তোলার একান্ত নিষ্ঠার উপর। মনে রাখতে হবে, আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য রূপান্তর। এই রূপান্তরের সাধনাই সাধনা, বাকি সব ফাঁকি।
নিম্নপ্রকৃতিতে সত্যময় চেতনার অবতরণ করাতে চাই একটা নতুন দৃষ্টিলাভের শক্তি। পবিত্রতায় ভরা যেন হয় জীবনের সমস্ত গতিবিধি। সব আবেগ, অনুভব হোক চৈতন্যমুখী। প্রাণের কামনা-বাসনার কেন্দ্রে হোক ভালোবাসার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। দেহের যাবতীয় কলুষ স্বভাবের পরিবর্তে সেখানে স্থাপন করতে হবে দিব্যভাব—এই দেহ-মন-প্রাণ যেন সবসময়ই উন্মুখ হয়ে থাকে সদাজাগ্রত দেবতার অভিমুখে—সারাজীবন ঘিরে বিরাজ করুক সৃষ্টির সব কিছুর প্রতি একটা সুনিবিড় শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-ভক্তি! এ জীবনদানি হয়ে উঠুক ভগবানের কাছে নিবেদিত অর্ঘ্যস্বরূপ। সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে যেন নিজের অন্তরস্থিত সত্তাকেই সব জায়গায় অনুভব করি, দর্শন করি—আমাদের চেতনা যেন দিনে দিনে ঈশ্বরমুখী হয়ে ওঠে। মানুষের শুদ্ধতম রূপটিই ঈশ্বরের রূপ।
নিবিড়ভাবে প্রতিমুহূর্তেই যেন অনুভব করতে পারি, অন্তরের শুভ্র আলোময় শক্তিই আমাদের জীবনসভায় সভাপতির কাজ করে চলেছে নীরবে। আমাদের দিক থেকে যা একান্ত প্রয়োজন, তা হচ্ছে, এই পরমশক্তির উপর অটুট বিশ্বাস স্থাপন করা—দিব্য চরণকমলে আত্মসমর্পণ করা—জীবনের সব কাজই যেন করি ঈশ্বরের চরণে নিবেদিত পূজারূপে। নৈবেদ্য বড়ো পবিত্র বস্তু, ওতেই সাধনার মূলভিত-কাঠামো রচিত হয়।
এইভাবেই ধীরে ধীরে আদিম পাশব জীবন দিব্যজীবনে রূপান্তরিত হয়ে উঠবে, ঊর্দ্ধের এক মহাশান্তি এসে এই দেহ-মন-প্রাণ'কে অধিকার করবে—এই পার্থিব জীবনটা হয়ে উঠবে এক আনন্দময় দেবনিকেতন। আমরা নিজেকে আবিষ্কার করব, আমাদের আত্মাকে ঠিক এভাবেই উপলব্ধি করব একদিন—এই মানুষই ভগবান। মানুষ যখন ভগবান হয়ে ওঠে, কেবল তখনই সে নিজের ও পরের কাছে নিরাপদ।