: কেমন আছিস, মাধবীলতা? : স্যার, আপনি কী করে চিনে ফেললেন? ‘হ্যালো’ শুনেই…! : তোর নিঃশ্বাসের শব্দে চিনেছি। ওটা এখনও আমার কানে লেগে আছে, যেন মাত্রই শুনলাম! : নমস্কার, স্যার। আপনি এখন কেমন আছেন? : নমস্কার তো কথার শুরুতেই দিতে হয়, এতক্ষণে দিলি যে! ওঃ হ্যাঁ, কথা ঘোরানোর জন্য তো? তাহলে ঠিক আছে! : না, স্যার...মানে...আমি ঠিক... : তুই ঠিক কী? তুই মাধবীলতা, আমার মাধবীলতা। : স্যার, ছাত্রীকে এভাবে বলা কি ঠিক হচ্ছে? : ছাত্রী-শিক্ষকের প্রেম হওয়া কি নিষিদ্ধ কিছু? না কি আমরাই প্রথম এমন কিছু করলাম! শিক্ষকদের ফেরেশতা হতে হবে, এটা কে বানিয়েছে? ওদের কি প্রেমিক হবার অধিকার নেই? : ওসব কথা মনে পড়লে আমার খুব অস্বস্তি হয়। ছাড়ছি…। : ছাড়বি? অ্যাঁ, তা ছাড়তে পারিস চাইলেই। তোর তো ছাড়ার অভ্যেস অনেক পুরোনো। : আমি শুধু আপনার শরীরের খোঁজ নিতে ফোন করেছিলাম। আপনি এখনও আগের মতোই আছেন, একটুও বদলে যাননি। : আমার শরীর খারাপ, একথা তোকে কে বলল? : আমি খবর পেয়েছি। : তা তোর শরীর কেমন? চওড়া কাঁধ, ঢেউ-খেলানো কোমর, বুকভর্তি উপচে-পড়া যৌবন… সবই কি আগের মতন আছে, না কি আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতন বিয়ের পর শরীর নষ্ট করে ফেলেছিস? : আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি একসময় আপনার ছাত্রী ছিলাম। : তুই-ই ভুলে যাচ্ছিস যে, আমি তোর প্রেমিকও ছিলাম। : এগুলো আর বলবেন না। এসব পুরোনো কথা আমি ভুলে গেছি। ওরকম বয়সে কত কিছুই তো থাকে মানুষের! : সত্যিই ভুলে গেছিস? ওসব কেউ ভুলে যেতে পারে? তোর ঠোঁটের স্বাদ, হাতের স্পর্শ, চোখভরা কাজলের খেলা, সাদা শিফনের শাড়িতে তোর নাচ, এসব তো এখনও আমার চোখের সামনে ফুটে আছে রে! তুই আমার সেই অনন্তযৌবনা, মাধবীলতা…। : আমার নাম মাধবী বসু। আমি কোনো মাধবীলতা নই। : তুই মাধবীলতা, আমি অনিমেষ। মনে নেই তোর ‘উত্তরাধিকার’-এর কথা, যেটা পড়ে তুই মাধবীলতা হতে চেয়েছিলি? : মাধবীলতা হতে অল্প বয়সে সবাই-ই চায়। পারে তো না কেউই। অতটা সাহসী মানুষ কখনোই হতে পারে না। : কিন্তু আমি তো অনিমেষ হতে পেরেছি। অনিমেষের মতোই আমি ভালোবাসতে পেরেছি। : আপনার কি মনে নেই, অনিমেষের চরিত্রটা একজন পঙ্গু ব্যর্থ মানুষের চরিত্র? ভালোবাসা ছাড়া দেবার মতন তার আর কিছুই ছিল না। : ওরকম করে ভালোবাসতে জানলে আর অন্য কিছু জানার প্রয়োজনই হয় না! : আপনার স্ত্রী বাড়ি নেই? এসব শুনে ফেলবেন তো উনি। : ওর কানে কোনো কথা যায় না; আমি যা খুশি বলতে পারি, যা খুশি করতে পারি। : মানে উনি কানে কম শোনেন? নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এমন করে কেউ বলে? : স্ত্রী? ওঃ হ্যাঁ, স্ত্রীই হবে! ভুলেই গিয়েছিলাম! মা খুব জোর করলেন…বয়স হলে দেখবে কে? বাড়ির কাজ করবে কে?...এসব বলে বলে। তাই বাঙালি পুরুষসমাজের চিরায়ত নিয়ম মেনে ঝি নিয়ে এলাম, যার নাম দেওয়া হলো স্ত্রী। মানে এমনিতে ঘরের ঝি-ই, কিন্তু বাইরে বেরুলে চুল বেঁধে, কাতান শাড়ি চাপিয়ে পুরোদস্তুর অতনু মল্লিকের স্ত্রী। : হা হা হা…আপনি এখনও এভাবে মজা করেই কথা বলেন! তো, স্ত্রীর ভয়ে হলেও মুখে লাগাম দিন একটু। : তোর স্বামীকে লাগাম দিয়ে রাখিস নাকি রে? ওটা স্বামী, না কি ঘোড়া? : বাজে কথা বলছেন যখন, নিজের স্ত্রী পর্যন্তই থাকুন না, আমার বরকে এখানে টানার তো কোনো মানে হয় না। : ওকে নিয়ে বাজে বকছি, অসুবিধে নেই। ও তো ছবি হয়ে গেছে, এখন খারাপ ভালো যা-ই বলি, সবই সমান। : সেকি...উনি নেই? কবে হলো এরকম? : বছর সাতেক হবে। খুব রোগে-শোকে ভুগত। অত ভোগান্তির চেয়ে চলে গিয়েই বরং বেঁচে গেছে। : আপনার এভাবে বলতে বাধে না? : এক ঝি গেলে অন্য ঝি আসবে। এত বাধাবাধির তো কিছু নেই। : ছিঃ! স্ত্রী কখনো ঝি হয়? বাড়ির কাজ, নিজের সংসারের কাজ করলেই কি কেউ ঝি হয়ে যায়? : বাড়ির কাজ করলে কেউ ঝি হয় না, সেকথা ঠিক; কিন্তু যে শুধু বাড়ির কাজই করে, তাকে ঝি বলব না তো কী বলব? : ইস্, বেচারিকে দিয়ে শুধু কাজই করাতেন? : কাজ করাব, সেকথা জানিয়েই তো বিয়ে করেছিলাম। : উনি কখনো প্রশ্ন করেননি? : প্রশ্ন করবে? আরে, প্রশ্ন করতে জানত নাকি? চুপচাপ সব মেনে নিয়ে সংসারধর্ম করে গেছে, মরার পরে স্বর্গ পাবার লোভে! এখন হয়তো স্বর্গেই আছে, অন্য ঝিয়েদের সাথে। তুইও যেহেতু সংসারধর্ম পালন করছিস, মৃত্যুর পর দেখা হয়ে যাবে ওর সাথে। : আমি তো ঝি নই। : তা-ই বুঝি? সব মেয়েরই ওরকম মনে হয়। ঝিগিরি করাতেই বাঙালি ছেলেরা বিয়ে করে, মুখে স্বীকার করে না যদিও। : আমার স্বামী আপনার মতো নয়। : অবশ্যই আমার মতো নয়। সবাই কি আর অনিমেষ হতে পারে? সবাই কি আর পায় মাধবীলতাকে? : আমি মাধবী! : সেটা তো তোর স্বামীর কাছে। : আপনার শরীরের খবর কিন্তু পেলাম না। সুস্থ আছেন তো? : তোর স্বামী তোকে ভালোবাসে? : ....................................................... : চুপ কেন? : এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। স্বামীরা কখনও দেখিয়ে দেখিয়ে ভালোবাসে না। : আরে, ভালোবাসলেই তো দেখাবে! : আপনি এত নিশ্চয়তা দিচ্ছেন কী করে? ওকে তো আপনি চেনেন না। : তোকে তো চিনি। আমি তোকে ভালোবেসেছি। তুই ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে কেমন শুষ্ক হয়ে গেছিস, সেটা তো বুঝতেই পারছি। : কী করে বুঝতে পারলেন? : তোর গলার আওয়াজ শুনে। তুই মুখে বলছিস একটা, কিন্তু বলতে চাইছিস আরেকটা। : মোটেও না। : আমার কাছে আয় না একদিন। : আমার স্বামী আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। আমি সুখেই আছি। এখন তাহলে রাখি। : এহ্, ভালোবাসে! তোকে আদর করে? : বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? : তোকে কী করে আদর করতে হয়, জানে? তোর শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো আমার মতন করে খুঁজে বের করতে পেরেছে? কী করে তোর রাগ ভাঙাতে হয়, সে জানে? মনে তো হয় না! : আমি তিন সন্তানের মা। এবার আপনিই বুঝে নিন। : সন্তানের সাথে এসবের সম্পর্ক আছে নাকি? হা হা! তুইও তো হাসাতে শিখে গেছিস দেখছি! আমাদের সমাজে সন্তান কি ভালোবাসায় হয় নাকি? যে-সন্তান দু-জনের ভালোবাসা থেকে আসে না, আমি ওই সন্তানকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান’ বলি। ডাস্টবিনে পড়ে-থাকা বাচ্চাদের সাথে ওদের কোন তফাত নেই। : আমার সন্তানদেরকে নিয়েও এবার আপনি যা-তা বলবেন? : না, আমি শুধু তোকে নিয়েই কথা বলব। : আমি বলব না, স্যার। অসুস্থতার খবর শুনে এত বছর পর একটা ফোন করলাম। আর আপনি তখন থেকে যা না, তা-ই বলে যাচ্ছেন! : তুই ফোন করার জন্য ঠিকঠাক বাহানা খুঁজে পাচ্ছিলি না। আমার অসুস্থতাটা তোর বেশ কাজে লেগে গেল। কী বলিস? : বাহানা কেন লাগবে আপনাকে ফোন করতে? আমি তো ইচ্ছে করেই কখনও ফোন করি না। : এই যে, তোর স্বামী যে তোকে ভালোবাসে না, এটা যদি আমি ধরে ফেলি, তাই কখনও ফোন করিসনি। কিংবা হঠাৎ যদি তোর সব ফেলে আমার কাছে চলে আসতে ইচ্ছে করে, তাই ফোন করতে ভয় পাস। : ও আমাকে ভালোবাসে। আপনি সব কথাই আন্দাজে বলে ফেলছেন। : ভালোবাসে? আচ্ছা, তুই যে খুব ভালো নাচতে পারিস, তোর স্বামী জানে? : আমিই নাচ ছেড়ে দিয়েছি। ওসবের সময় হয় না এখন আর। : বল, ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিস। : একই তো হলো। : যে ভালোবাসে, সে কি কখনো তার ভালোবাসার মানুষের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকে মেরে ফেলতে পারে? : নাচ ভালো লাগত। কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় ছিল, এরকম নয়। : প্রিয় না হলে পরে কেউ অতটা প্রাণ ঢেলে দিয়ে নাচতে পারে? মনে তো হয় না। আমার কাছ থেকে তুই নিজেকে লুকোচ্ছিস? পারবি লুকোতে? পেরেছিস কোনোদিন? : ................................................ : সে যে ভালোবাসে না তোকে, আমি আর কতভাবে প্রমাণ করব? এই সত্যিটা তো তুই নিজেও জানিস। কেন নিজেকে মিথ্যে মিথ্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখিস তবে? : ................................................ : তুই কাঁদছিস, মাধবীলতা? : না। : আর কতদিন এমন মিথ্যে বলবি আমাকে?…নিজেকে? : মৃত্যুর আগ পর্যন্ত!