আমাকে মুক্ত হতেই হবে কেন? কে মুক্তি চায়?
…………..জেল থেকে ছাড়া পাবার পর কয়েদি যখন এমন কথা বলে, তখন মনে
প্রশ্ন আসে, পৃথিবীতে এমন কী আছে, যা পেলে মানুষ শেকল পরে থাকতে চায়? কীসের
আশায় কারাগারকেও আপন লাগে, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না? কীসের মোহে মানুষ
মুক্ত পৃথিবীর আলোহাওয়া থেকে স্বেচ্ছায়ই মুখ ফিরিয়ে নেয়?
মালায়ালাম লেখক বশীর রাজদ্রোহের অভিযোগে দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। অন্যান্য বন্দী, গার্ড, জেল কর্মকর্তা সবার সাথে সুসম্পর্ক রেখে তাঁর দিনগুলি ভালই কাটছিল। তাঁর সারল্য, রসবোধ, মানবীয় গুণ, সর্বোপরি তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার জন্য সবাই তাঁকে পছন্দ করত। সবার কাছ থেকে তিনি প্রায়ই সিগারেট, চা, শুঁটকি, লেখার কাগজ সহজেই পেয়ে যেতেন। বিড়ি ফুঁকতেন, বিভিন্ন সেলে ঘুরে বেড়াতেন। গোলাপবাগান করা, টুকটাক লেখাজোকা, আড্ডা এইসব করে দিন ফুরাচ্ছিল। জেলে এক বছর পূর্ণ হবার আগেই তাঁর আশেপাশের সেলের বন্দীরা মুক্তি পেয়ে গেলেন, কোনো এক বিশেষ বিবেচনায় সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিলেন, সে তালিকায় তাঁর নামটা এল না। তিনি একা হয়ে গেলেন। চরম একাকীত্ব ও নৈরাশ্যের মধ্য দিয়ে দিন কাটতে শুরু করল। সে ঘটনার কিছুদিন আগে একদিন এক কয়েদির ফাঁসির আদেশ হল। মৃত্যুর আগে তিনি চা-পান করতে চাইলেন। বশীরের কাছে জেলের গার্ড এলেন চা নিয়ে যেতে। তখন চা বানানোর সময় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান কয়েদির মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলার সময় বশীর গার্ডকে বলেন, “ওকে বলো বুকে সাহস রাখতে। দুইভাবে মৃত্যুকে বরণ করা যায়। কেঁদেকেঁদে। হেসেহেসে। ওকে বলো হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিতে।” অথচ সেই বশীরই যখন মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের তালিকায় নিজের নামটা দেখলেন না, তখন তিনি খুবই বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে পড়েন। জেলের শূন্য করিডোর আর বাগানে হেঁটে উনার সময় কাটে। ফুল আর গাছের সাথে গল্প করেন, কাঠবিড়ালির সাথে ঝগড়া হয়। আর প্ল্যান করতে থাকেন কীকরে জেলপালানো যায়। উনার মনের অবস্থার কথা উনার মুখেই শুনি: অন্যদের উপদেশ দেয়া কত সহজ! ফেস ইট উইথ অ্যা স্মাইল! বলে দিলাম, হয়ে গেল!……..এক ঘণ্টা পরই ফাঁসি হয়ে যাবে, এমন কাউকে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে উপদেশ দেয়া যায়, কিন্তু নিজের বেলায় কারাবরণকেও হাসিমুখে মেনে নেয়া যায় না। এটাই বাস্তবতা!
সেই বশীরই কেন জেলেই থেকে যেতে চাইলেন? মুক্তি পাবার খবরে মুহূর্তেই হতাশ হয়ে গেলেন কেন?
আচ্ছা, এই যে ফেসবুকে বিপরীত লিঙ্গের দুইজন মানুষ ইনবক্সে গল্প করে চলে দিনের পর দিন, কেউ কাউকে কখনো দেখল না, কণ্ঠটা শুনল না পর্যন্ত, প্রোফাইলে যে ছবি দেয়া আছে কিংবা ইনবক্সে যে ছবির নেয়াদেয়া চলছে, সেগুলি আসল কি নকল, ওরা জানেই না, কখনো এমন হয়, প্রোফাইলে অপর প্রান্তের মানুষটির ছবিই নেই, চাইলেও সে কোনো ছবি দেয় না, ওদের মধ্যে আদৌ কখনো দেখা কিংবা কথা হবে কি না ওরা জানে না, তবু কেন ওরা এমনভাবে গল্প করে যায় যেন দুইজন দুইজনের কতদিনের চেনা, ওদের মধ্যে অনুভূতি আর আবেগের বোঝাপড়াও গড়ে ওঠে, স্রেফ সখ্যের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় ভালোবাসায় রূপ নেয় এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ, এমনও হয়, ওরা ফেসবুকে আসেই কেবল দুইজন মিলে গল্প করতে, মেসেঞ্জারে প্রতীক্ষা করে থাকে অধীর আগ্রহে, কখন সে অনলাইনে আসবে, এই যে একটা আইডির জন্য এমন আকুলতা, প্রেম, অভিমান ও টান, এর কি কোনোই অর্থ নেই? আমাদের কাছে থাকুক না থাকুক, ওদের জন্য হয়তো এর মানেই জীবন! মানুষের মন কখন কীভাবে কেন কার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, আর সে ব্যাকুলতাই দিনযাপনের প্রধান অংশ হয়ে যায়, তা বলা শক্ত। যদি প্রোফাইল পিকচার আর পাঠানো ছবিগুলি আসল হয়, কখনোবা ভাবনাগুলিও মিলে যায়, তবে তো ওদের একরকম দেখা হয়েই আছে, ওতে দুইজন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি থাকার উত্তেজনা অনুভব করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই অনুভবের শুদ্ধতা ও তীব্রতা দুইজনকে এক ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে। তখন ওরা কিছুতেই একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হতে পারে না। ইনবক্সের দেয়ালটাই ওদের বাঁচিয়ে রাখে, ফেসবুক-কারাগারে বন্দী হয়ে থাকাই ওদের কাছে জীবন। যদি কখনো এমন হয় যে কোনো কারণে ফেসবুকে আর আসা যাবেই না, তখন সে মুক্তির স্বাদ ওদের কাছে মৃত্যুর সমান মনে হয়। বন্দিত্বের সুখের কাছে মুক্তির শাস্তি অসহ্য লাগে।
বশীর যে জেলটাতে আছে, সেটির পাশের জেলটায় মহিলা কয়েদিদের রাখা হয়। দুই জেলের মাঝে একটা উঁচু সীমানাদেয়াল। দেয়ালের অন্যদিকে থাকে নারায়ণী। একদিন ঘটনাক্রমে ওদের আলাপ হয়। আলাপের মাঝখানে অভেদ্য দেয়াল। তবু আলাপ চলতে থাকে। সে আলাপ যেন বশীরের অবচেতন মনে সুপ্ত শরীরী ও অশরীরী আকাঙ্ক্ষা আর অসহায়ত্বের আন্তরিক প্রকাশ। ওদের বন্ধুত্ব হয়। প্রেম হয়। শুরু হয় পরস্পরের জন্য প্রতীক্ষা, ফুলসহ নানান উপহার বিনিময়, হৃদয়ের যোগাযোগ। দেয়ালের ওইপারে এলে নারায়ণী গাছের একটা মরাডাল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতে থাকে বারবার। তা দেখে বশীর একছুটে চলে আসে। ওরা কেউ কাউকে দেখতে পায় না, তবু যেন সবই দেখে, বোঝে, ছোঁয়। ওদের কেবলই কান্না পায়। সে কান্না ভালোবাসার কান্না। কী এক ভয় থেকে ওদের চোখে জল আসে। সে ভয় নিজেকে। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। হৃদয়ের অবোধ্য ও অবাধ্য ভাষার সমুদ্রে ডুবে মরার ভয়। কাউকে পাবো না জেনেও তাকে ভালোবেসে ফেলা, এর চাইতে বড় কষ্ট আর নেই। একটা কণ্ঠস্বরের জন্য বশীরের যে দুর্নিবার পিছুটান, তা মূলত নিঃসঙ্গ মানুষের আশ্রয়ের চিরন্তন আকুতি।
একদিন। সেদিন দুইজনের দেখা হবার কথা। জেলের হাসপাতালে। তার আগেই বশীর ছাড়া পায়। সেইদিনই প্রথম সে বন্দিত্বের যন্ত্রণা অনুভব করে। ভালোবাসার শেকল খুলে মুক্তপায়ে চলতে বড় কষ্ট হয়।
সিনেমার নাম মাথিলুকাল (১৯৯০)। মালায়ালাম ভাষার। আদুর গোপালকৃষ্ণানের সেরা কাজগুলির একটি। ভৈকম মুহম্মদ বশীরের এ উপন্যাসিকাটির অনুবাদ ‘দেয়াল ও কণ্ঠস্বর’ নামে পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার, সিনেমায় লেখকের নামেই নায়কের নাম রাখা হয়েছে। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে ত্রিবান্দ্রম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন ভৈকম মুহম্মদ বশীর উপন্যাসিকাটি লিখেন, সিনেমাটি বানানোর প্রায় ত্রিশ বছর আগে গোপালকৃষ্ণান এটি প্রথম পড়েন। আবারো পড়েন ’৮৮ সালের দিকে। চিত্রনাট্য লিখতে সময় নেন এক বছরের মতো। এ ছবি এমন একটা নিখাদ প্রেমের ছবি, যেখানে নায়িকার সাথে দর্শকের দেখাই হয় না। এ সিনেমায় কারাগারের পরিবেশ হয়ে উঠেছে জীবনের মতো মধুর, আর তা থেকে মুক্তি হয়ে উঠেছে মৃত্যুর মতো বিষাদময়। সিনেমাদেখা শেষ হলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে………..আসলে স্বাধীনতার মানে কী?
রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতা আছে, মেন্ডিং ওয়াল। ‘মাথিলুকাল’ দেখার সময় সে কবিতার কিছু লাইন মনে উঁকি দেয়:
যেদিন আমাদের হল দেখা সীমানা ভেঙে,
সেদিনই এক উঠল দেয়াল সীমানা জুড়েই।
আমাদের সাথে দেয়াল বাঁচে, একই শ্বাসে।
………………………………………………..
………………………………………………..
এখানে যখন ছিল না দেয়াল, আসত মনে
উঠলে দেয়াল এদিকটাতে আসবে কী আর ওদিকটাতে যাবেই-বা কী,
এই মনেতে মন জুড়লে সুখ দেবো কি দুঃখ দেবো, জানতো কে তা!
দেয়াল এলে আমি কী হবো, সে কী হবে, ভাবতে গিয়েই দেয়াল সরে দেয়াল এল।