মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি, হৃদয়ের অনুরণন




“চিরকাল... সময় ও স্থানকে অতিক্রম করা... জ্ঞানী, জ্ঞান আর জ্ঞাত একই সত্তা”—এমন চিন্তা মনে এলেই বুদ্ধি যেন আটকে যায়। কিন্তু হৃদয় সাড়া দেয়। প্রশ্ন জাগে—এর মানে কী? আর, কেনই-বা তা জরুরি?

আমরা মানুষ, অস্থায়ী ও ভৌতিক দেহে জন্ম নিই অল্প ক-দিনের জন্য। পৃথিবীতে আসি প্রায় অসহায় অবস্থায়, অন্যের যত্ন ও আহারে টিকে থাকি। তারপর ধীরে ধীরে অঙ্গভঙ্গি ও শব্দে যোগাযোগ শিখি, পরবর্তীতে ভাষা আয়ত্ত করি। ছোটোবেলায় বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা আপেক্ষিক জ্ঞান অর্জন করি—উপর-নিচ, বড়ো-ছোটো, গরম-ঠান্ডা, আগে-পরে, শৃঙ্খলা-অরাজকতা ইত্যাদি। এসব বুঝতে পারলেই আমরা প্রশংসা, গোল্ডেন স্টার, এ-প্লাস, “ভালো ছেলে/মেয়ে”, “অবশ্যই সফল হবে” এমন সব স্বীকৃতি পাই। একইসাথে কর্তৃপক্ষের বকুনি থেকেও রেহাই মেলে। আমরা শিখি—কীভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়, সিটে বসে থাকতে হয়, এবং ভিড়ে মিশে থাকতে হয়।

কৈশোরে পৌঁছে আমরা খানিকটা স্বাধীন হই। এখানেই অনেকের জন্য ঝামেলা শুরু হয়। একধরনের অজানা অস্থিরতা, বিদ্রোহী সুর, অনির্দিষ্ট বিরক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনে হয়—কিছু যেন হারিয়ে গেছে, বা ভুল বাসে উঠে পড়েছি। কিন্তু বিদ্রোহ করলে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে, তাই অধিকাংশ মানুষ আবার লাইনে ফিরে যায়—কেউ সারাজীবনের জন্য, কেউ-বা সাময়িকভাবে। তবে অন্তরের সেই নিঃশব্দ হতাশা আবার ফিরে আসে, আরও জোরে কানে বাজতে থাকে।

যখন এই চেপে-রাখা হতাশা গভীর হয় বা বিস্ফোরিত হয়, তখন মানুষ এক সঙ্কটে এসে দাঁড়ায়। একাকী মুহূর্তে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ঝরে, অথবা প্রবল হতাশায় কিছু ভাঙচুর করে ফেলে। এর এক রাস্তা নিয়ে যায় বিপথে—অপরাধ বা জেলখানায়। অন্য রাস্তা নিয়ে যায় সেই “অপূরণীয় অভাব”-এর সন্ধানে।

এখান থেকেই শুরু হয় আসল দ্বন্দ্ব—মনের বিভ্রান্তি ও হৃদয়ের সাড়া। এতদিন হয়তো ধর্ম নিয়ে সংশয় ছিল, বিশেষ করে সংগঠিত ধর্ম যে-বিপর্যয় তৈরি করেছে, তার কারণে। কিন্তু হতাশার মুহূর্তে যে-অনুসন্ধান শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের দিকে (বা, যাঁরা আধ্যাত্মিকতার ভাষায় ঈশ্বর মানেন না, তাঁদের কাছে প্রকৃত আত্মার সন্ধানেই) গিয়ে ঠেকে। এই অভ্যন্তরীণ অনুরণনই মনের বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দেয়।

এখানে মস্তিষ্ক—অর্থাৎ অহংকার—ভয় পায়। মনে অশান্ত কথাবার্তা, ব্যঙ্গ, ভয় দেখানো—সব কিছু শুরু হয়, যাতে মানুষ নতুন সন্ধান থেকে সরে আসে। কিন্তু হৃদয় তখন এত জোরে বাজতে থাকে যে, অহংকারের কোলাহল ঢেকে দেয়। এই যুদ্ধ বছরের পর বছর চলতে পারে। এ যুদ্ধের আভাস পেতে চাইলে ভগবদ্গীতার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

এই লড়াইয়ে জেতার একমাত্র পথ হলো—সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং মরতে প্রস্তুত থাকা। (এখানে অনেকেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়।) কিন্তু যতক্ষণ না সব কিছু থেমে যায়, এবং এক নিখাদ নীরবতা নেমে আসে, যুদ্ধ চলতেই থাকে।

এই সম্পূর্ণ নীরবতা থেকে জন্ম নেয় এক নতুন অভিজ্ঞতা—“Transcendence” বা আত্মোত্তরণ। সেখানে ব্যক্তিগত “আমি” বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু তা শূন্যতা নয়, বরং এক পরিপূর্ণ শূন্যতা—যেখানে কিছুই নেই, অথচ সবই আছে। আর সেখানে অনুভূত হয় এক অপরিসীম ভালোবাসা, যেখানে ঈশ্বরের উপস্থিতি বা অদ্বৈত সত্তার উপলব্ধি হয়। তখনই বোঝা যায়—চিরকাল, সময়-অতীত, স্থান-অতীত একতা কী। তখন জ্ঞানী, জ্ঞান আর জ্ঞাত এক হয়ে যায়।

এই অভিজ্ঞতা নিয়ে শুনে, পড়ে, লিখে, কল্পনা করে কেউ হয়তো অনুরণন পেতে পারে, কিন্তু তাতে তৃষ্ণা মেটে না। প্রকৃত অর্থে এটি কেবল ব্যক্তিগত সরাসরি অভিজ্ঞতায় সম্ভব। যদি এই অভিজ্ঞতা কারও জানা থাকে, তবে সে জানেই। আর যদি কারও কাছে এটি এখনও অস্পষ্ট থেকে যায়, তবে জেনে রাখুন—এটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না, কেবল উপলব্ধির মাধ্যমে বোঝা যায়।

মানসিক বিভ্রান্তি, ধর্মীয় ভণ্ডামি, আর অহংকারের বাধা পেরিয়ে হৃদয় যখন সত্যের অনুরণনে জেগে ওঠে, তখনই আসে সেই নীরব উপলব্ধি, যা অদ্বৈত, প্রেম ও অনন্তকালীন শান্তির দিকে নিয়ে যায়।