পৃথিবীকে বদলে দিতে হলে প্রথমেই আমাদের নিজেকে বদলাতে হবে; এতে আমাদের চারপাশের সবাই বদলাবে, সমাজ বদলাবে, দেশ বদলাবে, একসময় পৃথিবীও বদলাবে। চেতনার শুরুটা হতে হবে নিজেকে দিয়ে। নিজে জাগলে নিজের পৃথিবীটাও জাগবে। প্রত্যেক ধর্মই মূলত এই জাগানোর কাজটা করে দেয়। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার বা নিজের হৃদয়ের সাথে আমাদের বাহ্যিক সত্তার একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়। চিন্তাভাবনা ও কাজের পরিধি ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে সুস্থির রৈখিক ছন্দে এসে যায়। ধর্ম আমাদের সুন্দর ভাবনা ও ভালো কাজের মধ্য দিয়ে আনন্দের সন্ধান দেয়। ধর্মদর্শন এই দুর্বোধ্য দুর্জ্ঞেয় রহস্যাবৃত স্তরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে।
যে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিজের হৃদয়ে অনুভব করে না, সে পৃথিবীর সকল পবিত্র স্থান ঘুরেও স্রষ্টার অনুগ্রহের সামান্যতম সন্ধানটুকুও পায় না। আমাদের সকল প্রার্থনাই তাই নিজেকে জাগিয়ে তোলার পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যে-খোলসে নিজেদের লুকিয়ে রাখি, যে বাহ্যিক প্রবৃত্তিসমূহ আমাদের হৃদয়কে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে, সেসব মেকি খোলস ছেড়ে বাইরে আসার নাম জাগতিক অনুভূতির মৃত্যু। এমন মৃত্যু আমাদের আলোর পথে জাগিয়ে দেয়, শান্তি ও সুখের জন্য যে-পথে চলা প্রয়োজন, আমরা পার্থিব ভারমুক্ত হয়ে সে পথে চলার মতো করে নিজেদের প্রস্তুত করি। অযাচিত অর্থহীন জীবন ছেড়ে নতুন জীবনে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য এমন পুনরুত্থানের জন্য বর্তমানের সকল অবস্থার মৃত্যুর কোনো বিকল্প নেই। পুনরুত্থান বা নবজন্মের জন্য বর্তমান সত্তার মৃত্যু জরুরি।
আমরা নিজেকে যেমন আছি তেমন রেখে নতুন রূপে দেখার স্বপ্ন দেখি। এটা হয় না। মৃত্যুর মাঝেই নতুন জন্মের সূচনা ঘটে। এই মৃত্যু হলো পুরোনো অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসা, সুখকর অভিজ্ঞতার বলয়ের বাইরে নিজেকে ছুড়ে দেওয়া, অভিনব পথে হাঁটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা—যা কখনোই আমার ছিল না, এখনও নেই, কিন্তু আমার মধ্যে যার উপস্থিতি আমার দরকার, তাকে আলিঙ্গনের দুঃসাহস দেখানো, নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে নিজেকে উন্নীত করা, ক্ষণিকের সুখ ও আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে অবারিত শান্তির পথে যাত্রা করা, মোহনীয় অকল্যাণ ও অমঙ্গলের অথই সমুদ্র থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে কণ্টকাকীর্ণ সত্যের পথে কঠোর পরীক্ষা দেওয়া।
আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন আমরা মূলত আমাদের সাথে স্রষ্টার একত্ব কল্পনা করি এবং নিজেদেরকে স্রষ্টার অনুগ্রহলাভের জন্য প্রস্তুত করি। এ প্রস্তুতি নিজেদের মন ও হৃদয়কে উন্নত স্তরে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির প্রথম ধাপই হলো বর্তমান ভুল সত্তার ইচ্ছামৃত্যু। শিখতে হলে ভুলতে হয়। যা শিখেছি, তা পুরোপুরি বের করে দিতে না পারলে জরুরি কিছু শেখা যায় না। Unlearn to learn.