ভেদ-অভেদ তত্ত্ব: দুই




জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, তিনি সাক্ষী-আত্মা হিসেবে থাকেন; আর সমগ্র কর্মপ্রবাহ—ব্যক্তিগত হোক বা মহাজাগতিক—প্রকৃতির/ঈশ্বরের লীলা হিসেবে ধরা পড়ে। তাই কোনো কর্মই তাঁকে থেকে পৃথক নয়—এই অর্থে বলা, “উভয়ই তাঁর স্বরূপ”—অর্থাৎ তিনি Self থেকে আলাদা কোনো কর্তা/কর্ম/ফল দেখেন না। যেমন সমুদ্রে অসংখ্য ঢেউ (বিশেষ কর্ম) উঠছে…নামছে; জোয়ার-ভাটা (সর্বজনীন কর্ম) চলছে। সমুদ্রের দৃষ্টিতে সবই তার নিজেরই রূপ—ঢেউকে আলাদা করে ‘করো/কোরো না’ বলে আদেশ দেবার অর্থ নেই।

শ্বাস-প্রশ্বাসকে শাস্ত্রের বিধি-বাক্যের বিষয় করা যায় না—শ্বাস এমন কিছু, যা নিজে নিজেই হয়; আপনি তাকে ‘বিধান’ দিয়ে চালু করেন না। জ্ঞানীর ক্ষেত্রে প্রকৃতি-জাত কর্মও তেমনই—স্বতঃপ্রবহমাণ। তাই “বিধান দিয়ে” জ্ঞানীকে কর্মে ঠেলে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। আগুনকে “গরম হও” বলা অর্থহীন—সে নিজে থেকেই গরম। মহাকর্ষকে “টান দাও” বলার দরকার নেই—টান তো আছেই। ঠিক তেমনই, জ্ঞানীর কাছে কর্মপ্রবাহ তো ঘটছেই—তাই “কর্ম করো” বলে আলাদা করে কোনো আদেশ অর্থহীন।

ধরুন, কেউ ইতিমধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। এখন আপনি তাকে বলছেন—“এবার পৌঁছোও!”—এটা বিধানে পড়ে না; কারণ লক্ষ্য তো অর্জিত। জ্ঞানীর ক্ষেত্রেও কর্তৃত্ব/অর্জন-জাত দৃষ্টিভঙ্গি ঝরে গেছে; তাই “এখন এই কাজটা করো”—এই ভাষা ভিত্তিহীন। এর মানে জ্ঞানী কাজ করেন না, তা কিন্তু নয়, বরং তাঁর ক্ষেত্রে কর্মপ্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই ঘটে—তিনি নিজেকে আলাদা কর্তা মনে করেন না। যে-জিনিস নিজে থেকেই ঘটে, তার বেলায় “বিধান দিয়ে করাও”—এটা ভাবা সম্ভব নয়। তাই বলা হয়, কর্ম—বিশেষ ও সর্বজনীন উভয়ই—একই যোগের স্বরূপ; সুতরাং কর্মকে নিষেধ কিংবা বিধি-বাক্যের বিষয় করা যায় না; ঠিক যেমনটা শ্বাস-প্রশ্বাসকেও যায় না।

ধরা যাক, এখন ভেদাভেদবাদীর নতুন এক দাবি সামনে এল—“দুই দিকের দাবি”। তারা বলে: ব্রহ্ম একই সঙ্গে—অভিন্ন/নির্বিশেষ (undifferentiated)—এই দিকটা বুঝতে জ্ঞান দরকার; বিভিন্ন/বিশিষ্ট (differentiated)—এই দিকটা পালন করতে কর্ম দরকার। ফলে নাকি “জ্ঞান + কর্ম”—দুটো মিলেই ব্রহ্মলাভ সম্ভব।

“ভিন্ন” ধরা পড়ে আগে ‘অভিন্ন’ ধরে নিয়েই—কোনো কিছুর ভিন্নতা ধরতে হলে, একটা অভিন্ন ভিত্তি মেনে নিতে হয়, না হলে “ভিন্ন” কথাটাই অর্থহীন হয়ে যায়। অর্থাৎ ভেদ (difference) বলে কিছু বলতেই পারি, কেবল তখনই, যখন অভেদ (identity)-এর পিঠে দাঁড়িয়ে বলি। এই নীতিটা না মানলে, জগতে—না অভিন্নতা প্রমাণিত হবে, না ভিন্নতা—দুটোই ভেসে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। সোনার অলংকার আংটি, বালা, চেইন—সবই ভিন্ন দেখায়; কিন্তু এই ভেদটুকু বলি এই কারণে যে, আমরা আগে থেকেই জানি—সবই সোনা। “ভিন্ন” বলাটা দাঁড়ায় “একই সোনা”—এই অভিন্ন ভিত্তির ওপর; আমরা নিশ্চয়ই এভাবে বলি না—মানুষ ও ঘোড়া ভিন্ন দেখায়! তাই যদি বলা হয়, ব্রহ্ম “অভিন্ন হিসেবেও সত্য, ভিন্ন হিসেবেও সত্য”—তাহলে মনে রাখতে হবে: ভিন্নতা বলার শক্তি আসে অভিন্নতা থেকে; অভিন্ন ব্যাপারটা মেনে নিয়েই ভিন্ন বলা হচ্ছে।

হাঁড়ি, কলস, থালা—নামে ও রূপে ভিন্ন। কিন্তু অভিন্ন মাটি না মানলে “এই ঘটগুলো ভিন্ন” কথাটারও ভিত্তি থাকে না। ভেদটা নামে আর রূপে, অভেদটা দ্রব্যে। সমুদ্রের ঢেউগুলো আকারে-গতিতে ভিন্ন; কিন্তু “একই উপাদান জল” না মানলে “ভিন্ন ঢেউ” কথাটাই দাঁড়ায় না। ঢেউয়ের ভেদ সমুদ্রে অভেদের ওপরই টিকে আছে। কেউ যখন বলে “অন্য পথ”—তার মানে, আগে থেকেই একটা ‘সাধারণ পথ’-ধারণা আছে, যার ভিত্তিতে ওই পথটাকে সে “অন্য” বলছে। “অন্য” শব্দটি আগে থেকেই “একই শ্রেণি” না মানলে অর্থ পায় না।

তাহলে “জ্ঞান দিক আর কর্ম দিক” ভাগটা কোথায় ভাঙে? জ্ঞান মানে—অভিন্ন/অদ্বৈত সত্যের প্রত্যক্ষতা। কর্ম মানে—ভিন্নতা/দ্বৈততা (কর্তা-কর্ম-ফল) ধরে নেওয়া। যদি বলা হয়—“একই ব্রহ্মের ‘অভিন্ন’ অংশে জ্ঞান, ‘ভিন্ন’ অংশে কর্ম”—তবে ভিন্ন অংশের কথা বলার শক্তিই আসে আগের অভিন্ন ধরে নেওয়া থেকে। একবার অভিন্নতার ব্যাপারটা সত্যজ্ঞানে ধরা পড়লে, ভিন্নতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কর্ম-বুদ্ধি আর স্বতন্ত্র সত্য হিসেবে টিকতে পারে না—কারণ তার ভিত্তি (অজ্ঞতা-জাত ভেদবুদ্ধি) কেটে যায়। উলটোভাবে, যদি ভিন্নতাকেই চূড়ান্ত সত্য মনে করা হয়, তবে অভিন্ন জ্ঞানই মিথ্যা হয়ে যায়। তাই “একই সঙ্গে দুটোই সমান সত্য”—এই যুগল কাঠামো টেকে না; একটিকে মানলে অন্যটির বিলোপসাধন হয়ে যায়।

ভেদ-অভেদের যোগ-বিয়োগ দেখা যাক। অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হলো—এটা ভেদের দেখা (দড়ি আর সাপ ভিন্ন সত্তা)। আলো জ্বালাতেই বোঝা গেল—“এ তো দড়ি” → অভেদ/অদ্বৈত সত্য ধরা পড়ল (দড়িই দড়ি)। এখন যদি কেউ বলে—“দড়ির অভিন্ন দিক-এ জ্ঞান থাক, আর ভিন্ন দিক-এ কর্ম চলুক”—তাহলে তো সাপ-ভ্রমকে (ভিন্নতা) ধরে রাখতে হবে; কিন্তু জ্ঞান/আলো এসে গেলে সাপ-ভ্রম টেকে না। তাই “দুই দিকেই সমান জোর”—এটা নিজেই আত্মবিরোধী।

“ভিন্ন” ধারণা অভিন্নকে মানলেই উঠে আসে—এই যুক্তিটা স্বীকার না করলে কোনো কিছুরই অভিন্ন বা ভিন্ন হওয়া প্রমাণ করা যাবে না। আর স্বীকার করলে, অভিন্ন সত্য জেগে উঠলেই ভিন্নতার উপর দাঁড়ানো কর্ম-ব্যবস্থা চূড়ান্ত সত্য হিসেবে টিকে থাকতে পারে না; বড়োজোর তা ব্যাবহারিক (vyavahāra) স্তরে থাকতে পারে, পরম (pāramārthika) স্তরে নয়। তাই “ব্রহ্ম একই সঙ্গে অভিন্ন-বিভিন্ন, তাই জ্ঞান-কর্ম যুগলসংযোগ”—যুক্তিগতভাবে অসংগত; জ্ঞান জাগলে কর্ম-দ্বৈত ম্লান হয়, আর দ্বৈতকে চূড়ান্ত মানলে জ্ঞান-অদ্বৈতই ঘা খায়। ভিন্নতা বলার শক্তিই আসে অভিন্নতাকে মেনে নেওয়া থেকে; সেই অভিন্নতা জ্ঞান দিয়ে ধরা পড়লে, ভিন্নতার ভিত্তিতে দাঁড়ানো “কর্ম-যোগ” আর চূড়ান্ত সত্য হিসেবে টেকে না।

আরও একটু ভেঙে লিখি। ব্রহ্ম একইসঙ্গে “অভিন্ন” (সব কিছুর সঙ্গে এক) এবং “ভিন্ন” (সব কিছু থেকে আলাদা)—এর মানে, বিশেষ (যেমন আমি, তুমি, গাছ, পাথর) এবং সাধারণ (যেমন জীবমাত্র, জড়মাত্র)—সব স্তরেই ব্রহ্ম—একও এবং আলাদাও। এই দাবির সরাসরি ফল হচ্ছে—যদি অভিন্নতা সত্যি ধরতে হয়, অর্থাৎ ব্রহ্ম সব সত্তার সঙ্গেই এক—তাহলে যত দুঃখ-কষ্ট-রোগ-ক্ষুধা-ভয় সকল জীবে আছে, তার সবই ব্রহ্মেরও হবে; কারণ “অভিন্ন” মানে অভিজ্ঞতা-গুণও অভিন্ন হওয়া—শুধু “আছে” বললেই শেষ নয়। একটা কোম্পানি বলল, “CEO প্রতিটি কর্মীর সঙ্গে অভিন্ন”—তাহলে CEO-কে সব কর্মীর ক্ষুধা, ঘুম, ব্যথা, ভয়—সব একসঙ্গে অনুভব করতে হবে—যা অসংগত। যদি বলি, “আগুনে যার ছোঁয়া লাগে, তার সঙ্গেই আগুন অভিন্ন হয়”—তবে বরফ ছুঁলেই আগুন ঠান্ডা হয়ে যাবে—এটা অসম্ভব।

শাস্ত্রযুক্তি—ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ, নির্দোষ, নির্লেপ (সৎ–চিত্–আনন্দ, অশরীরী, অগতঃসুখদুঃখ)। যদি বলি, ব্রহ্ম সকলের দুঃখও ভোগ করেন, তবে ব্রহ্ম নির্লেপ-আনন্দস্বরূপ—এই স্বরূপের সঙ্গেই বিরোধ তৈরি হয়। ফলে “অভিন্ন এবং ভিন্ন—দুটোই বাস্তব অর্থে একসঙ্গে সত্য”—এই কাঠামো নিজেই ভাঙে। সূর্য অনেক আয়নায় প্রতিফলিত হয়। যদি বলি, সূর্য সব আয়নার সঙ্গেই অভিন্ন, তবে আয়না নড়লেই সূর্য কাঁপবে, আয়না ময়লা হলে সূর্য কলুষিত হবে—এটা তো হয় না। সূর্য অস্পর্শ; প্রতিফলনগুলো আলাদা স্তরে।

“অভিন্নতা” ব্যাপারটা কীভাবে বোঝা উচিত? এর সঠিক সীমা দেখা যাক। সারতত্ত্বে অভিন্ন: যেমন সোনার আংটি-বালা—সোনায় অভিন্ন, আকারে ভিন্ন। নাম-রূপের ভিন্নতা অভিজ্ঞতায় থাকে, কিন্তু স্বরূপে ভিন্নতা জুড়ে দিলে স্বরূপ-সংশ্লিষ্ট দুঃখ-দোষও ব্রহ্মে আরোপিত হবে—এটাই অযৌক্তিক। সব ঢেউ জলে অভিন্ন; কিন্তু ঢেউয়ের ভাঙা-গড়া-ফেনার সৃজন—এই উপাধি-ধর্ম সমুদ্রের মূলে লেগে যায় না। যদি বলি, “সমুদ্র ঢেউয়ের সব উথালপাথাল নিজেও ভোগ করছে”—তাহলে সমুদ্র আর নির্লেপ রইল না—এটা তো ভুল ব্যাখ্যা।

তাহলে কোথায় ভেদ–অভেদ ধরে রাখলে যুক্তি টেকে? অভিন্নতা: স্বরূপ/আত্মতত্ত্বে (substratum)—সত্য। ভিন্নতা: নাম-রূপ/উপাধিতে (appearances)—ব্যাহারিক স্তরে সত্য। কিন্তু দুটোকেই যদি একই বাস্তব স্তরে সমানভাবে সত্য ধরা হয়, তাহলে ব্রহ্মে দুঃখ-আরোপ অবশ্যম্ভাবী—যা অযৌক্তিক। ঘট-কলস-থালা—মাটিতে অভিন্ন। যদি বলি, “মাটি প্রতিটি পাত্রের ফাটল-ধুলো-দাগের সঙ্গেও অভিন্ন”—তবে মাটিকেও ফাটা/ময়লা বলতে হবে। বাস্তবে পাত্রের দোষ পাত্রেই, মাটির স্বরূপে নয়।

“ব্রহ্ম একসঙ্গে অভিন্নও এবং ভিন্নও”—এ কথা বাস্তব/স্বরূপ স্তরে একসাথে ধরে নিলে, অভিন্নতার ফলে ব্রহ্মকে সকল দুঃখের ভোগী মানতে হয়—যা শাস্ত্র ও যুক্তি উভয়ের বিরোধী। তাই ভেদ-অভেদ সঠিক স্তর-বিভাগে ধরতে হবে: স্বরূপে অভিন্ন, উপাধিতে ভিন্ন; না হলে মতটা যুক্তিতেই টেকে না। জ্ঞান ও কর্মকে একত্র করা যায় না। জ্ঞান কর্মের সঙ্গে মিশতে পারে—এমন বলা ঠিক ততটাই অসংগত, যেমন বলা হয়—অন্ধকার সূর্যের সঙ্গে মিশতে পারে, শীতলতা আগুনের সঙ্গে মিশতে পারে, কিংবা উত্তাপ জলের সঙ্গে মিশতে পারে।

অভিজ্ঞতার তিনটি উপাদান: কী, কেমন, কে।

জ্ঞেয়—বাইরে যে-বস্তুটি ধরা পড়ে, যেমন: একটি লাল ফুল, ঘড়ির টিকটিক শব্দ, গরম চায়ের কাপে তাপ। “যাকে জানা হচ্ছে”—বস্তু, শব্দ, স্পর্শ—সবই জ্ঞেয়।

(খ) জ্ঞান—মনের ভেতরের জানা-হওয়ার ঢেউ। যেমন: সন্দেহ (এটা কি গোলাপ?), স্মৃতি (গতকালও দেখেছিলাম), নিশ্চয়তা (হ্যাঁ, গোলাপই), ভাবনা ইত্যাদি। অর্থাৎ মনে ধারাবাহিক পরিবর্তন—এই ওঠানামাগুলিই জ্ঞান।

(গ) জ্ঞাতা—“আমি”, যে জানি। আমি ভাবছি: “আমি ফুলটা দেখছি”, “আমি শব্দটা শুনছি”—এই যে আমি-ভাব, এটাই জ্ঞাতা (empirical knower)। জ্ঞাতা মানে—যে উপলব্ধি করছে।

ধরুন, একটা ঘণ্টা বাজল—জ্ঞেয়: ঘণ্টার শব্দ। জ্ঞান: “শব্দটা জোরে/ধীরে”—মন এই তথ্য নেয়, বদলায়। জ্ঞাতা: আমি শুনলাম—এখানে ‘আমি’-ই জ্ঞাতা।

কিন্তু আরও গভীরে—“সাক্ষী” (আত্মা)—যে সব কিছুর উপস্থিতি জানায়, নিজে অপরিবর্তনীয় থেকে। সে অর্জন-বর্জন করে না; কেবল প্রকাশ ঘটায়—কী দেখা হলো, কী ভাবা হলো, কে ভাবল—সবই যার সামনে ঘটে। অভিজ্ঞতার স্তরে তাকে বলা যায় না জ্ঞেয়/জ্ঞান/জ্ঞাতা—তবু সে সবসময় উপস্থিত।

সিনেমার পর্দার কথা ভাবি। ছবির দৃশ্য (জ্ঞেয়), দর্শকের মনোভাব (জ্ঞান), ‘আমি দেখছি’—এই অনুভব (জ্ঞাতা)—সবই পর্দায় ভেসে ওঠে। পর্দা নিজে দৃশ্যে জড়ায় না, তবু সব দৃশ্যই তাতে দেখা যায়। পর্দাই সাক্ষী। আলোর উদাহরণ আনলে—ঘরে আলো থাকলেই টেবিল, রং, মানুষ—সব দেখা যায়। আলো জিনিসগুলোর সঙ্গে কাজ করে না, তবু সব কিছুকে দেখা যায় আলোর কারণে। এই “সব কিছুকে প্রকাশ করা”-র ভূমিকা—সাক্ষীর মতোই।