যে সমস্ত যুক্তি অনাত্মাকে অজ্ঞানের আধার হিসেবে অগ্রাহ্য করেছিল, সেগুলো আত্মার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা—আত্মা অজ্ঞানের সঙ্গে অভিন্ন নয়, যেহেতু তার প্রকৃতিই শুদ্ধ চেতনা। আবার, যদি আত্মাকে অজ্ঞানের আধার ধরা হয়, তবে সেখানে জ্ঞানের ভাঙনের আকারে একধরনের ভেদ উপস্থিত হয়—যার দ্বারা আধারে অজ্ঞানের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা তাৎপর্যময় ঘটনা বলে গণ্য করা যায়। আরও, এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জ্ঞানলাভ সম্ভব হয়, কারণ আত্মা, মনের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে, জ্ঞান উৎপন্ন করে। আত্মার সেই অযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই যে, সে অজ্ঞানের দ্বারা জন্মেছে; কেননা আত্মা প্রকৃতিগতভাবেই চিরন্তন, অটল এবং অপরিবর্তনীয়। সর্বশেষে, সচেতন আত্মার একটি স্বতন্ত্র রূপ ও অস্তিত্ব আছে, যা অজ্ঞানের থেকে স্বতন্ত্র (যা অনাত্মার নেই)—ফলে সে অজ্ঞানের আধার হতে পারে।
বলা হচ্ছে: অজ্ঞতার আধার (āśraya) হলো আত্মা। কিন্তু আবার আত্মা হলো চৈতন্যস্বরূপ, কলুষমুক্ত, অপরিবর্তনীয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে—যদি আত্মায় অজ্ঞতা থাকে, তবে কি আত্মা কলুষিত হলো না?
অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হলো। দড়ি আসলে অপরিবর্তিত, শুদ্ধ। ভ্রম (অজ্ঞতা) হলো দর্শকের মনে, কিন্তু সেটি দড়ির ওপরই আরোপিত (অধ্যাস—adhyāsa)। তাহলে বলা যায়: “ভ্রমের আধার” দড়ি; অথচ দড়ি আসলে কখনো ভ্রমে কলুষিত হয়নি। যেভাবে দড়ি সাপ হয়নি, অথচ সাপ-ভ্রম দড়ির ওপরেই ভর করে থাকে—তেমনই আত্মা।
আয়নায় ধুলো পড়ল। আমরা বলি: “আয়না ময়লা হয়ে গেছে।” আসলে ধুলো আয়নার উপরেই আছে, আয়নার প্রকৃত প্রতিফলনশক্তি বদলায়নি। তেমনি আত্মা অজ্ঞতার আধার—কারণ অজ্ঞতা আত্মার চেতনার ওপর ভর করে দাঁড়ায়। কিন্তু আত্মার প্রকৃতি (শুদ্ধ চৈতন্য) কখনো কলুষিত হয় না।
আকাশে সূর্য আছে, কিন্তু ঘন মেঘে ঢাকা। সূর্য বলছে না: “আমি মেঘে ঢাকা পড়ে কলুষিত হয়েছি।” কিন্তু পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষ বলে: “সূর্য দেখা যাচ্ছে না।” মেঘ = অজ্ঞতা, সূর্য = আত্মা। আত্মা সর্বদা আলোকময়, কিন্তু মনের আচ্ছাদনে তার দীপ্তি লুকিয়ে যায়। ফলে আমরা মনে করি, আত্মা যেন “অজ্ঞতায় ঢেকে” আছে।
আত্মা অজ্ঞতার আধার (āśraya) = অজ্ঞতা কেবল সচেতন সত্তার ওপরই টেকে। আত্মা কলুষিত নয় = অজ্ঞতা আত্মাকে আঘাত করে না, কেবল আত্মার প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এটি যেন একটি অস্থায়ী আড়াল—যা সরলেই আত্মার দীপ্তি আগের মতো প্রকাশিত হয়।
আত্মা হলো সিনেমা-স্ক্রিনের মতো—ছবির ভিড়ে ভরা (অজ্ঞতা), কখনো ঝড়, কখনো অগ্নিকাণ্ড, কখনো হাসি-কান্না—সবই স্ক্রিনে ভর করে। কিন্তু সিনেমাশেষে স্ক্রিন আগের মতোই সাদা, অক্ষত। ঠিক তেমনি আত্মা—অজ্ঞতার আধার হলেও, নিজে কখনও কলুষিত নয়।
এই সমস্ত যুক্তি থেকে আমরা উপসংহার টানি যে, আত্মাই অজ্ঞ, অর্থাৎ আত্মাই অজ্ঞানের আধার বা আশ্রয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে: “আত্মা কর্তৃক ধারণকৃত অজ্ঞতা কোন বিষয়কে আড়াল করে রাখে?” উত্তর এ-ই: “আত্মাই সেই বিষয়।” এখন আপত্তি: “তাহলে কি সত্যিই অজ্ঞতা আত্মার সঙ্গে অসংগত নয়? কেননা আত্মার প্রকৃতি তো জ্ঞান, সে সম্পর্কহীন, সে জ্ঞানের বিপরীতকে (অর্থাৎ অজ্ঞতাকে) বিনাশের কারণ, এবং নানা উপায়ে জ্ঞানের বিপরীত।”
এর জবাব: অজ্ঞতা আত্মার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আসলে আত্মা নির্বিশেষ; কিন্তু অজ্ঞতার দ্বারাই সে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়-তে বিভক্ত হয়ে ওঠে—যেমন কেবল অজ্ঞতার দ্বারাই দড়ি সাপে রূপ নেয়, অথচ আত্মা এবং দড়ি বাস্তবে অক্ষুণ্ণই থাকে। অতএব যখন অজ্ঞতা ঝরে যায়, তখন দ্বৈতের সমস্ত অমঙ্গল সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়।
যিনি এভাবে আত্মাকে জানেন, তাঁর জন্য আর “আমি” এবং “আমার” থাকে না—যেমন হাতে জ্বালানো প্রদীপ থাকলে সামনে আর অন্ধকার থাকে না। যেমন জ্ঞানলাভের পূর্বে দ্বৈততার জগৎ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি, তেমনি জ্ঞানলাভের পর বুদ্ধি প্রভৃতির অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে নাকচ হয়, কারণ তখন দৃষ্টিভঙ্গি হয় অন্তরাত্মার।
বলা হয়, জ্ঞানী সবই মানেন, আবার সবই অস্বীকার করেন।—এর মানে কী? এটি বুঝতে দুটি স্তর নিয়ে ভাবা যাক:
ব্যাবহারিক স্তর (ব্যবহার/ব্যাবসা/পারিবারিক জীবন): এখানে আমি-তুমি, লাভ-ক্ষতি, কর্তা-কর্ম-ফল—সবই চলে। এই স্তরে জ্ঞানীও নিয়ম মেনে চলেন—খাবার খান, কথা বলেন, কাজ করেন। এটাকেই বলা হচ্ছে “গ্রহণ”—অর্থাৎ ভেদবুদ্ধিকে ইচ্ছাকৃত ও কৃত্রিমভাবে মেনে নেওয়া, যাতে সমাজ-জীবন সচল থাকে, সংসারে কোনো গোলযোগ না ঘটে।
পরম স্তর (আত্মসত্য): এখানে কেবল একটাই সত্য—আত্মা/ব্রহ্ম। এখানে কর্তা-কর্ম-ফল, সুখ-দুঃখ, আমি-তুমি—সব মিথ্যা/উপাধি-জাত বলে জানা যায়। এটিই “অস্বীকার”—কারণ, আসল বাস্তবতা জানলে স্বাভাবিকভাবেই (প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ায়) ভেদবুদ্ধি অকার্যকর হয়ে যায়।
একটি উপমা দিচ্ছি। সিনেমা হলে বসে আপনি কাঁদলেন/হাসলেন—এটা গ্রহণ (খেলায় অংশ নেওয়া)। কিন্তু আপনি জানেন—সবটাই পর্দার ছবি/অভিনয়/মিথ্যা—এটা অস্বীকার (অন্তরে স্থির জ্ঞান)। জ্ঞানী ঠিক এভাবেই চলেন—বাইরে স্বাভাবিক আচরণ, ভিতরে স্থিত একত্ব-সত্যে।
বাস্তবতার জ্ঞান সংসারকে থামিয়ে দেয়।—কীভাবে?
সংসার হচ্ছে অজ্ঞতা-চালিত ঘূর্ণি। দড়ি-সাপের ভ্রমের মতো: অন্ধকারে সাপ মনে হলো (ভয়-দৌড়-ঘাম—সংসার), আলো জ্বালতেই বোঝা গেল দড়ি (ভ্রম থেমে গেল)। আত্মজ্ঞান হলো সেই আলো—যেখানে ‘আমি কর্তা’, ‘আমি ভোগী’, ‘আমার দুঃখ’—এই ভুল ধারণাগুলো থেমে যায়। ঘূর্ণি ঘোরে (দেহ-মন-প্রকৃতি চলতে থাকে), কিন্তু আমরা আর তাতে জড়িয়ে পড়ি না—এটাই “সংসার থেমে যাওয়া”। উল্লেখ্য, শরীর ও মন তাদের পুরোনো গতিতে চলতেই পারে (প্রারব্ধ-কর্মের ফলে), কিন্তু বন্ধনের বোধ—‘আমি আটকে আছি’—এটা চিরতরে থেমে যায়।
সম্যক জ্ঞান কর্মপথও ভাঙে, সন্ন্যাসপথও।—কীভাবে?
কর্মপথ (যজ্ঞ-আচার-ফলকামনা): জ্ঞানের উদয় হলে ‘আমি কর্তা’ বোধই থাকে না। কর্তা নেই, তাই কর্মপথ (ফল পেতে করতেই হবে) তার সবল ভিত্তিটি হারায়। সন্ন্যাসপথ (সব ছাড়ব, তবেই মুক্তি): জ্ঞান দেখায়—“আসলেই কিছুতে আটকাইনি; সবই তো নাম আর রূপ।” তাই ছাড়ারও কিছু নেই। ফলে “সন্ন্যাস করলেই মুক্তি”—এ পথ-ভাবটাও মুছে যায়। সত্যিকারের সন্ন্যাস হলো জ্ঞান—‘আমি নিঃস্পৃহ, নির্লেপ’—এই ভাব জাগ্রত হওয়া; এ কোনো বাহ্যিক পোশাক/উপাধি নয়। কোনো গন্তব্যে পৌঁছে গেলে মানচিত্রও দরকার নেই (কর্মপথ), ‘একটাই রাস্তা ধরো’—এ নির্দেশও নেই (সন্ন্যাসপথ)। পৌঁছে গিয়েছি—এটাই জ্ঞান।
আত্মা একবার প্রত্যক্ষ হলে অজ্ঞতা কেটে যায়।—এর ধারাটা কী?
দড়ি-সাপ ভ্রমে একবার দড়ি দেখা গেলে সাপ-ভয় আর ফিরতে পারে না। ঠিক তেমনি আত্মা স্বরূপে ধরা পড়লে—“আমি দেহ/মন/ভোগী/কর্তা”—এই ভুল-জ্ঞান আর টেকে না। তাই বলা হয়: ওতে একেবারে অজ্ঞতার মূলেই কোপটা পড়ে; পরে আর ভ্রান্তি উঁকি দিলেও তা ঠিকই ধরা পড়ে যায়—বোধ আসে সহজেই…এটা ভ্রম (এ কেবলই অভ্যাসের ঢেউ, সত্য নয়)।
কাল-দেশ ইত্যাদি ভ্রম; ওসব আত্মায় নেই।—কীভাবে তা বোঝা যায়?
স্বপ্নে পাঁচ ঘণ্টা কেটে গেল মনে হয়; জেগে দেখি মাত্র পাঁচ মিনিট। সময়টা ছিল আসলে মনের অবস্থা। গভীর ঘুমে “সময়-স্থান” বোধ থাকে? থাকে না। তবু ‘আমি ছিলাম’—এই ধারাবাহিকতা থাকে। তাই সময়-স্থান হলো মনের উপাধি; আত্মা সময়-স্থানাতীত—নইলে আত্মা চলে যেত/বদলাত—যা কখনও ঘটে না। আকাশে মেঘ জমে, আবার সরে—সময়/আবহাওয়া হলো মেঘের ধর্ম; আকাশের নয়। আত্মা আকাশের মতো—নির্লেপ।
আত্মাকে জানা হলে আর কিছু জানার বাকি থাকে না।—এটা বলাটা কি বাড়াবাড়ি?
একদমই না। ‘সব জানার জ্ঞাতা’-কেই জানলেন—যার আলোয় সব জানা হয়। আপনি যখন আলোক-উৎসটাকেই পেলেন, তখন যে-কোনো বস্তু তাতে আলোকিত হবে—অতিরিক্ত উৎস খুঁজতে হয় না। তাই “আর কোনো নতুন জ্ঞান বাকি নেই”—এর মানে, নতুন উৎস/ভরসা দরকার নেই; আত্মা-স্বরূপ জ্ঞান স্থির হলে অজ্ঞতার অবকাশই থাকে না। টর্চের ব্যাটারি লাগিয়ে আলো পেলেন। এরপর সেই আলোর মধ্যে বই-টেবিল-মানচিত্র—সব দেখা যাবে। আলো পেয়ে গেলে “আরেকটা আলো” খোঁজার দরকার হয় না।
সব মিলিয়ে জ্ঞানীর জীবনকাঠামো কেমন?
বাইরে: তিনি স্বাভাবিক—কর্তব্য করেন, প্রতিশ্রুতি রাখেন, সম্পর্ক সামলান। (গ্রহণ—ব্যাবহারিক স্তরে নিয়ম মানা, শান্তির প্রয়োজনে উটকো ঝামেলা এড়িয়ে চলা) ভেতরে: তিনি নির্লেপ—কর্তা/ভোগী নন, একত্বে প্রতিষ্ঠিত। (অস্বীকার—পরম স্তরে ভেদবুদ্ধি নীরস) ফলে: কর্মপথ/সন্ন্যাসপথ—দুটোই উপায় হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক; জ্ঞানই লক্ষ্য ও উপায়। অবশেষ: সময়-স্থান-লাভ-ক্ষতি—এসব মনের খেলা হিসেবে দেখা দেয়; বন্ধনের বোধ তবে চিরতরে শেষ হয়।
আত্মজ্ঞানে একবার স্থির হলে—জ্ঞানী ব্যাবহারিক স্তরের সকল নিয়ম মানেন, আর পরম স্তরে সমস্ত ভেদ নিজে থেকেই ঝরে পড়ে যায়; এতে সংসার-বন্ধন থেমে যায়, কর্ম কি সন্ন্যাস—দুটো পথই (কার্যত) সহজেই অতিক্রান্ত হয়, এবং সময়-স্থান-জাত ভ্রম আর তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।