আবার এলাম তোমার কাছে সমস্যা নিয়ে। লোকে আমাকে বলে, “তুমি যদি ঈশ্বরের সঙ্গে একই হলে, তবে তিনি তোমাকে ভালোবাসেন আর তুমি তাঁর উপাসনা করো, এর মানে কী? এক বস্তুতেই ভালোবাসা আর উপাসনা কেমন করে হয়?" লোককে আমি বোঝাই যে অভেদের মধ্যে ভেদ আছে, ভেদের মধ্যেও অভেদ আছে, তাতেই ভালোবাসা, উপাসনা এসব সম্ভব হয়।
লোককে বলি আর আমার মনকেও বোঝাই। মন বোঝে অথচ বোঝে না। দিনকয়েক বোঝে, আবার না বুঝে উতলা হয়। এই উতলা ভাব নিয়ে আজ তোমার কাছে এলাম। আমায় আজ একটু ভালো করে বোঝাতে হবে, আমি তোমার সঙ্গে এক হয়েও কেমন করে ভিন্ন, আর কেমন করেই-বা তুমি আমাকে ভালোবাসো। যখন আমি এই তত্ত্ব বুঝতে পারিনে, তখন আমার মনে হয়, একত্ব ভাবনাটা না থাকলেই তো ভালো ছিল, তোমায় ভিন্ন বস্তু বলে ভালোবাসতাম, তোমার ভালোবাসা নিঃসন্দেহে ভোগ করতাম।
কিন্তু তোমার কাছে এলেই দেখি, সেই ভাব চলে যায়। তোমাকে তো ভিন্ন ভাবতে পারিনে; এই যে তুমি আমার প্রাণরূপে, আত্মারূপে প্রকাশ পাচ্ছ। জাগ্রত অবস্থায় অনেকসময় অহংকারে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে তোমা থেকে ভিন্ন মনে করি। তুমি নিদ্রা এনে আমার অহংকার, আমার ‘আমি, আমি' ঘুচিয়ে দাও। আমার অহংকার, আমার আমিত্ব তোমাতে ডুবে যায়, হারিয়ে যায়। আমি যে তোমা থেকে স্বতন্ত্র কিছু নই, তা স্পষ্ট বুঝতে পারি।
আমি স্বাধীন স্বতন্ত্র হলে আর তুমি আমাকে এমন করে আত্মহারা করতে পারতে না। না না, আমি তোমাকে ছাড়া কিছু নই। তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার আত্মা, আমি তোমাতে, তুমি আমাতে; আমি তোমা থেকে অভিন্ন। আর এই জগৎ, এই রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ এসব তোমার সঙ্গে যুক্ত হয়েই, তোমার ঐশ্বর্যরূপেই আমার কাছে, আমার বিষয়রূপে প্রকাশিত হয়। আমি তোমার সঙ্গে এক না হলে তোমাকে দেখতাম না। তবে তোমা থেকে আমি ভিন্ন কোথায়?
ভিন্নত্বটা আমাকে ভালো করে দেখাও। আমি তোমার সঙ্গে এক হয়েও তো দেখছি, আমি তোমার সব জানিনে। তোমার ঐশ্বর্য তুমি আমাকে একটু একটু করে জানাচ্ছ। এক স্থানে, এক বারে তোমার ঐশ্বর্য কত অল্প জানছি!
আমার জীবন প্রবাহময়। তুমি তোমার অনন্ত রূপ, অনন্ত ঐশ্বর্য আমার নিকট ক্রমাগত প্রকাশিত করছ, ক্রমাগত আমা থেকে সকল দূরত্বভাব তিরোহিত করছ। কেবল তা-ই নয়। আমাকে তুমি বিশেষ সময়ে জন্ম দিয়ে আস্তে আস্তে ফুটিয়ে তুলছ। জ্ঞান, প্রেম, বল ক্রমশ আমার মধ্যে সঞ্চারিত করছ। যেমন আমার মধ্যে, তেমনি আরও অসংখ্য জীবাত্মার মধ্যে। তারা তো আমি নয়। আমি তো তারা নই। এই তো স্পষ্টভাবে ভেদের ভূমি দেখাচ্ছ।
আমার জাগ্রতাবস্থা, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, আমার জ্ঞান-অজ্ঞান, স্মৃতি-বিস্মৃতি সমুদয় প্রবাহের মধ্যেও তোমার ভেতরে আমার সসীমত্ব ও ব্যক্তিত্ব অব্যাহত রাখছে। তোমার সৃষ্টি তবে ঠিক, এ আমার কাল্পনিক ব্যাপার নয়। আমার ব্যক্তিত্ব তুমি কালে কালে সৃষ্টি করছ, এর আরম্ভ আছে, উন্নতি আছে। যা খুঁজছিলাম, এতক্ষণে তা যেন দেখতে পাচ্ছি। তোমা ছাড়া যে 'আমি'কে খুঁজি, তা কখনও পাবো না। আমা ছাড়া যে 'তুমি'কে খুঁজি, তা-ও পাবো না। তোমার ভেতর আমাকে পেলাম, আমার ভেতর তোমাকে পেলাম।
তুমি অনাদি, অনন্ত, এক, অখণ্ড। আমি তোমারই ভেতর জন্মেছি, বাড়ছি। আমার সীমা আছে। আমার ন্যায় অসংখ্য সন্তান তোমার আছে। আমি তোমার জ্ঞানে, তোমার প্রেমে, তোমার শক্তিতে গড়া। তুমি আমার জীবনের উপাদান, অথচ আমি ছোটো, তুমি বড়ো। আমি তোমার ক্ষুদ্র তরঙ্গ, তুমি অনন্ত সিন্ধু। আমি তোমার শিক্ষায় কৃতার্থ হলাম। আমার সমস্যা ফুরোল।
কিন্তু দেখছি, তোমার যোগরাজ্যের ভাষা সংসারের ভাষা থেকে ভিন্ন। তোমার সান্নিধ্য ছেড়ে যখন আমি সংসারে যাই, তখন এই ভাষা আমি লোককে তো বোঝাতে পারিই না, আমার মনও তা বোঝে না। লোকে বলে, আর আমার মনও বলে যে এ ভাষা আপাত-বিরোধযুক্ত! তা হোক। লোকে ভাষা তৈরি করেছে এই জায়গায় আবার ভেদে। এই জায়গার ভাষা এখনও হয়নি। ভাষার দরকার নেই। তুমি আমাকে প্রত্যক্ষভাবে তোমার সঙ্গে আমার অভেদ ও ভেদ দেখালে। আমি তা দেখেই সন্তুষ্ট, ভাষায় যদি বলতে না পারি, বোঝাতে না পারি, তাতে দুঃখ নেই।