ভালো থাকিস তুই

আমায় মনে পড়ে, ঝিল্লি? আমি তোর শনি।




একদিন সন্ধের পর বাড়ি ফিরছিলি তুই। আমি জানতাম, তুই পুকুরপাড় দিয়ে বাড়ি ফিরবি। একটা কালো কাপড়ে সমস্ত শরীর ঢেকে পুকুরপাড়ের শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই কাছে আসতেই সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলি তুই। আমি কাপড় থেকে বেরিয়ে তোর মুখচাপা দিয়ে বললাম: চেঁচাসনে, আমি তপু।




সে-ই প্রথম আমার তোর শরীর স্পর্শ। তুই আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলি। ঘরে ফিরে দেখি, আমার মায়ের বুকে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছিস। আমার আসা দেখে মা তোকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতে বাবার চকচকে বেতটা। কাছে ডাকলেন আমাকে। যেতেই বাঁ-হাতে আমার চুল ধরে ডানহাতে বেত চালাতে শুরু করলেন। তোর কান্না তখন থেমে গেছে।




আমার কান্না পাচ্ছিল, কাঁদিনি। হয়তো পালাতে পারতাম। পালাইনি। আমি শুধু তোকেই দেখছিলাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি। আমি তোর চোখে সহানুভূতির ছায়া দেখতে চাইছিলাম রে। কিন্তু ওখানে কিচ্ছু পাইনি। মা ততক্ষণে মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আমাকে ছেড়ে দেবার সময় বললেন—শনিটার মরণও হয় না! আমার জন্মের সময় দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছিল বলে রাগের সময় আমাকে ‘শনি’ বলে ডাকতেন।




জায়গায় জায়গায় কেটে গিয়ে শরীর থেকে আমার তখন রক্ত ঝরছে। যন্ত্রণায় অসাড় আমি। তুই কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বললি, খুব লেগেছে? আমি অবাক হয়ে গেলাম। কেন, জানিস? তখন শহরের স্কুলে পড়তাম আমি, আর তোর বেণি ঝুলিয়ে সারাটা বাড়ি মাতিয়ে রাখার সময়। ছোটোকাকার মেয়ে হলে কী হবে, থাকতিস সারাক্ষণই আমাদের ঘরে। তোকে বারে বারে দেখার লোভ সামলাতে পারতাম না। সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে আসতাম। তোর আশ্চর্য শান্ত কালোচোখ আমায় কাছে টানত।




কী ছিল রে তোর ওই চোখে! তাকালেই আমি নিজের ছায়া দেখতে পেতাম। দেখতামও লুকিয়ে লুকিয়ে, তুই বুঝতে পারতিস না। হয়তোবা পারতিস। কী জানি!




তোকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগত। কতদিন রাজপুত্র সেজে তোকে উদ্ধার করেছি রাক্ষসের হাত থেকে আর ভিনদেশি রাজার কাছ থেকে! একদিন দেখি, এক বিরাট অজগর তোকে পেঁচিয়ে ধরেছে। ‘না’ শব্দে আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। রুমমেট অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে, তপু? সেদিন আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। তোর সাথে তাই ভাব করতে ইচ্ছে হতো। কিছু বলতে পারতাম না। মনে মনে প্রার্থনা করতাম। “রোদ নিতে মেঘ জমুক, মেঘ গলে গলে বৃষ্টি নামুক আমার চেনা এই পৃথিবীতে।” তাই তোর মুখে সেদিন সহানুভূতির কথা শুনে আমি যন্ত্রণা ভুলে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, বিশ্বেস কর, আমি তোর শনি হতে চাই না। তুই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললি।




ঝিল্লি, রক্তের ঋণে সেদিন তোর ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম। সেই থেকে সে ঋণই শুধু শোধ করে গেলাম। তোকে তো আর পেলাম না রে!




একদিন বিকেলে পুকুরধারে বসে বসে শান্ত পানিতে ঢিল ছুড়ছিলাম। জলটা কেমন কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে যাচ্ছিল তীরে গিয়ে। বেশ ভালো লাগছিল দেখতে। নিঃসঙ্গতার উর্বরতা তখন চারিদিকে। সজীব গোধূলির আলো আলো খেলা। ওরা দহন করে, তবে পোড়ায় না। হঠাৎ দু-চোখে নরম হাতের স্পর্শ পেলাম। স্পর্শের সুখ তোকে চিনিয়ে দিল। তুই পাশে বসতেই বাতাবি লেবুর গন্ধটা পেলাম। আচ্ছা ঝিল্লি, তুই কি সারাগায়ে বাতাবি নেবুর স্পর্শ নিতিস? সত্যি করে বল তো? তা নাহলে তোর কাছে এলেই সেই পরিচিত গন্ধ পেতাম কেন?




তুই ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে জিজ্ঞেস করলি—কী করছিলে?
“দেখছিলাম তোর চোখের কাঁপন।”




তুই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালি। তারপর অস্ফুট স্বরে বললি ‘নিষ্ঠুর’। গোধূলির শেষআলোয় তোর চোখদুটো চিকচিক করে জ্বলছিল। আলতো করে চুমু খেলাম ওই চোখে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল। আমি তোর চিবুক ধরে বললাম, “আচ্ছা ঝিল্লি, এই মৌন-আঁধার যদি পৃথিবীর একমাত্র ভাষা হয়?” শুনেই তুই মুখ নামিয়ে ফেললি। সে সময় কি কোনো শঙ্কার ছায়া পড়েছিল তোর চোখে? তোকে আমার তখন কোমল কোনো স্কুলের নামে ডাকতে ইচ্ছে করছিল, অথবা সরল কোনো নদীর নামে। তোর কানের কাছে মুখ রেখে আস্তে আস্তে ডাকলাম—বউ!




তুই পালিয়ে গেলি।




আমি বোকা ভাবতেও পারিনি, এমনি করে তুই আমার জীবন থেকেও পালিয়ে যাবি। ভালোই করেছিলি পালিয়ে গিয়ে। নইলে তোকে যে আজ এক পঙ্গু মানুষের বোঝা বইতে হতো!




পঙ্গু কাউকে দেখলে তুই চোখ বুজে ফেলতিস। জানতাম, তুই ভয় পাস। আমাকেও কি আজ ভয় পাবি? থাক। এমনি করে আজ তোর ঝলমলে জীবনে মেঘ জমাতে চাই না।




লন্ডনে এখন শীতকাল, না? খুব বরফ বুঝি? বৃষ্টির সাথে বরফ পড়লে তুই জোর করে আমাকে মাঠে নামাতিস। বরফ কুড়োনোতে তোর উৎসাহ দেখে আমার আনন্দ লাগত। তুই অবুঝ শিশুর মতো সারামাঠ ছুটে বেড়াতিস। আমি না দৌড়োলে অমনিই মুখ ভার হয়ে যেত তোর। রাগলে তোকে ভীষণ সুন্দর লাগে রে, বিশ্বেস কর! শুধু এইটুকুর জন্য আমি অনেক দিন ইচ্ছে করে বসে থেকেছি। তুই ভাবতিস অহংকার। রাগ করে চলে যেতে চাইতিস। আমিও জোরে জোরে বলতাম—আড়ি, আড়ি, আড়ি! পেছন ফিরে ফিক করে হেসে দিতিস তুই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আলতো করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলতিস—না, তোমার উপর রাগ করে থাকা যায় না।




“তাহলে একটা চুমু দে।”
“এঃ মা…!” লজ্জায় লাল হয়ে যেত তোর চোখ-মুখ। তোর সমস্ত শরীর ভর করে জ্যোৎস্না নামত। আমি ভেসে যেতাম জ্যোৎস্নার প্লাবনে।




সেবার বৃষ্টির সাথে ভীষণ বরফ পড়েছিল। পুরো মাঠটাই সাদা হয়ে গেল। মনে পড়ে, সেদিন তুই একটুও দৌড়োসনি। আমার পাশে ধীরে ধীরে হাঁটছিলি। তোকে ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। একসময় থেমে নরম গলায় বললি—আমাদের জীবন এমনই শুভ্র হবে, পবিত্র হবে।
হঠাৎ করে আমি বলে উঠলাম—কিংবা বরফের মতো পিচ্ছিল বা অন্তর্হিতা।
তুই চমকে আমার শরীর ছুঁয়ে বললি—কেন হবে না? তাহলে যে আমি কষ্ট পাবো!
আমার মনে হলো, তুই বড়ো হয়ে যাচ্ছিস।




ঝিল্লি, এখনও কি তুই কষ্ট পাস? ঝুর ঝুর করে যখন বরফ পড়ে, তখনও কি তোর মনে হয়, জীবনটা ওই বরফের মতো শুভ্র, পবিত্র? কার জীবন? তোর, আমার, না তোর স্বামীর?




একবার তোর সাথে ভিজে ভিজে ভীষণ জ্বর এসেছিল আমার। অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। কতক্ষণ, ঠিক মনে নেই। হঠাৎ গালে কিছু পড়তেই জেগে গেলাম। দেখি, তুই মুখ ঝুঁকে নিঃশব্দে কাঁদছিস। আমি চোখ খুলতেই ঝর ঝর করে কেঁদে দিলি। দুরন্ত আবেগে কাঁপছিল তোর শরীর। সামলাতে না পেরে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিলি।




“তপু, তোমাকে আর আমি বৃষ্টিতে ভেজাব না।” “তাহলে আমিও যে কষ্ট পাবো!” আমি বললাম। তুই দু-চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলি। তুই সত্যিই বড়ো হয়ে গিয়েছিলি রে!




সেখানে হঠাৎ জ্বলে উঠল অসংখ্য তারা। বদলে গেল মুখের মানচিত্র। ফুটে উঠল ভালোবাসার লোকান্তরিত আলো। বিশ্বেস কর, ঝিল্লি, সে মুহূর্তে তোকে মনে হচ্ছিল দীপান্বিতা, এক সম্রাজ্ঞী!




আমি আজও চোখ বুজলে সেই তোকে দেখি। সমস্ত স্মৃতির মধ্যে, সমস্ত দুঃখের মধ্যে। পাবো না জেনেও চোখ মেলে তাকাই। দেখি, কেউ কোথাও নেই। পড়ে থাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস।




যুদ্ধকে বড্ড ভয় পেতিস তুই। ঘৃণাও করতিস। শহরে গণ্ডগোল বাধলেই তুই বারে বারে মার কাছে এসে খবর নিতিস, আমি পরে শুনতাম। তোর বড়ো বড়ো কালোচোখে আমার জন্য উদ্‌বেগ ছায়া ফেলে, ভাবতে ভালোই লাগত। মনের ভেতর ভালোবাসার অহংকার জন্ম নিত।




দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শত্রুনিধনের জন্য হাত নিশপিশ করত। তোকে বলতেই কেঁপে উঠেছিলি তুই। সবুজাভ ভূমির ধ্বস আমি আগে দেখিনি, সেদিন দেখলাম। তোর মুখে ফুটে উঠেছিল দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, রাত্রির জল, হৃদয়ের ক্রন্দন। তবু কাঁদিসনি তুই, সামনে থেকে নীরবে চলে গিয়েছিলি। জানতিস, বাধা দিলে তুই ছোটো হয়ে যাবি; অথচ তোকে অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি আমার ছিল না।




তোর জন্য হু-হু করে মনটা আমার কাঁদত রে। মাঝে মাঝে মনে হতো, সব কিছু ছেড়েছুড়ে ফিরে যাই। তোর কোলে মাথা রেখে বলি, এই তো আমার বাংলাদেশ!




না রে, পারতাম না! তোর ভালোবাসাই আমাকে জাগিয়ে দিত। যুদ্ধশেষে দু-পা হারিয়ে যেদিন তোর সামনে এলাম, আশ্চর্য রকমের শান্ত ছিলিস তুই। অবাক হয়ে গেলাম। একসময় কানের কাছে মুখ রেখে আস্তে আস্তে বললি—পা নেই, তাতে কী! আমি তো আছি!




ঝিল্লি সেদিন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। পা হারানোর দুঃখে না, তোর ভালোবাসার ঐশ্বর্যে।




আমি তোকে ভালোবাসতাম। তোর সামনে থেকে চলে আসা ছাড়া তাই আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তুই নাকি সারাদিন মায়ের কাছে বসে বসে কাঁদতিস। আমাকে তুই কাপুরুষ ভেবেছিলি, ভেবেছিলি অমানুষ, না? বিশ্বেস কর, ঝিল্লি, তোর কাছে আমি বারে বারে ফিরে যেতে চাইতাম। পারতাম না। তুই না বুঝলেও আমি তো জানতাম, শুধু ভালোবাসায় সংসার হয় না। জীবনটা শুধু ভালোবাসা নয়। তাই পুরুষ হতে গিয়ে আমাকে কাপুরুষ সাজতেই হলো।




এখন বেশ রাত। আকাশের অনন্ত নিঃসঙ্গতায় ভেজা বাতাসের স্পর্শ একটু একটু করে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। জানিস, যত বার বাতাসের স্পর্শে গা কাঁপছে, তত বার তোর চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি। ঝিল্লি, তুই এক আত্মস্থ শিহরন হয়ে ছিলি আমার কাছে। মিশে ছিলি শরীরের সাথে।




আমার তো সময় প্রায় ফুরিয়ে গেল। যুদ্ধের সময় বুকের বাঁ-দিকে একটা গুলি লেগেছিল। ভেতরে গিয়ে ওটা যে একটা ঘা সৃষ্টি করেছিল, কেউ ভাবতে পারেনি। একটু আগে ডাক্তার বলে গেলেন, ওটা এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে; আরও বড়ো হবে। কিছুই করার নেই রে!




ঝিল্লি, আমিও আজ আর কিছু করতে চাই না। চুপি চুপি শুধু একটা কথাই বলি—তুই কিন্তু ভালো থাকিস!
Content Protection by DMCA.com