ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯০তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো চব্বিশ

……………………………………………………

ফেসবুকে আমার রিলিজিয়াস ভিউস-এ লেখা আছেঃ . . . . . . (Fill in the blank with any Religion as you wish!) এটা নিয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন। আমি খুব মার্জিতভাবে সঠিক উচ্চারণে আসসালামুয়ালাইকুম বলি। ব্যাচের প্রথম হিসেবে চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আমাকেই অনেক জায়গায় প্রতিনিধিত্ব করতে হয়েছে, সবার পক্ষ থেকে কিছু বলতে হয়েছে (এখনো বলি অনেক জায়গায়)। আমি অডিয়েন্স বুঝে কথা বলি, তাই সালাম-ই দিয়েছি। আমার অনেক শ্রদ্ধেয় সিনিয়র বলেছেন, সুশান্ত খুব সুন্দরভাবে সালাম দেয়, যেটা অনেক মুসলিম ছেলেও পারে না। এটা নিয়েও কথা ওঠে, সবসময়ই আদাব কিংবা নমস্কার বলি না কেনো? শুধু মাঝেমাঝে কেনো বলি? আমার খাওয়াদাওয়ায় অতোটা বাছবিচার নেই। আমি খাই, খাবারটা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা সেটা ভেবে, হজম হবে কিনা সেটা ভেবে। নেই কেনো? এটা নিয়েও প্রশ্ন। আমি কারোর সাথে দেখা হওয়ার পর কীভাবে সম্বোধন করবো, এটাকে কোনো ধর্মীয় কালচার দিয়ে বেঁধে ফেলতে চাই না। যাকে সম্বোধন করছি তার ব্যক্তিগত অভিরুচি অনুযায়ী আমি সম্বোধন করে থাকি, এখানে ধর্মের বাধানিষেধ আনার কথা কখনো আমার মাথায়ই আসে না। ধর্ম নিয়ে আমার অল্পবিস্তর পড়াশোনা আছে। বিনয়ের সাথে বলছি, যাঁরা ধর্মকে মানেন বেশি, জানেন কম, অন্তত তাঁদের অনেকের চাইতে বেশি। আমার কাছে কখনোই ধর্মকে এতোটা ঠুনকো মনে হয়নি যে, কিছু সম্বোধনের ধরণ কিংবা ফুড হ্যাবিট-য়েই এটা চেনা কিংবা অচেনা হয়ে যাবে। আমরা ধর্মকে যতটা না হৃদয়ে স্থান দিয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি স্থান দিয়েছি বাকচাতুর্যে, খাওয়ার টেবিলে। ধর্মের এসেন্স কতোটুকু বুঝি আমরা? ভেবে দেখুন তো, আমরা ধর্মটাকে পেয়েছি অনেকটা পৈতৃক সম্পত্তির মতো; জন্মসূত্রে। আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেনো, এতে কিন্তু আপনার কোনো কৃতিত্ব কিংবা অকৃতিত্ব নেই। আমাদের অনুমতি নিয়ে ধর্ম পছন্দ করতে দিলে আমরা অনেকেই অন্য কোনো ধর্ম পছন্দ করে নিতাম। বেশিরভাগই হয়তো জন লেননের মতো নো রিলিজিওন-এর পক্ষে থাকতো। খেয়াল করেছেন কী, ইস্কনের আদর্শ বুঝেশুনে অনেক বিদেশি, যারা ধর্মের প্রধান যে সুর, অর্থাৎ মানবপ্রেম, সেটার দীক্ষা নিয়েছেন, ওদের ডিভোশন দেখুন; দেখবেন, ওরা কিন্তু আমাদের চাইতেও অনেকবেশি ধর্মের মূল কাজগুলো করছেন। ওদের তো আর এটা চাপিয়ে দেয়া হয়নি, ওরাই স্বেচ্ছায়, জেনে-বুঝে আনন্দের সাথে এটা বয়ে চলেছেন। Unlike us, they are Hindus by choice, not by born. আমি কমপক্ষে গত আট বছর ধরে প্রার্থনা করি না। এর জন্যে আমাকে কখনোই কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। মহান ঈশ্বরকে আমার আজ পর্যন্ত কখনোই এতোটা ভিনডিক্টিভ মনে হয়নি যে উনার কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যান না করলে উনি আমার কোনো ক্ষতি করে ফেলবেন। অতি তেলবাজি আর দেখানেপনা তুচ্ছ মানুষের দরকার হয়, ঈশ্বরের না। ঈশ্বর আমার কাছে যতোটা না প্রভু, ততোধিক বন্ধু। আমাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। আমি তাঁর সাথে কোনো ঝামেলায় যাই না, উনিও কখনোই আমার সাথে এখনো পর্যন্ত কোনো ঝামেলায় যাননি। বরং, আমি উনার প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্যে যে, উনি আমার প্রথম জীবনের অনেক প্রার্থনা কবুল না করে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সব কথা উনি শোনেন না বলেই উনি অন্তর্যামী। আমার জন্যে কী ভালো, কী মন্দ একমাত্র উনিই ঠিকঠিক জানেন। আমরা কতোটুকুই বা ভবিষ্যৎ বুঝতে পারি! এটার জন্যে উনাকে এতো বেশি পেইন দেয়ার কোনো মানেই হয় না। আমার কাছে, ধর্মের মূল কথা হলো, নিজে বাঁচো, অন্যকেও বাঁচতে দাও। (Live & let live.) আমরা এটা কম করি। আমরা ধর্মের বাহ্যিকতায় বেশি ব্যস্ত। সব ধর্মেই স্পষ্টভাবেই বলা আছে, কর্মই ধর্ম। সরস্বতী পুজো করলে পরীক্ষায় পাস হয় না, পরীক্ষায় পাসের জন্যে পড়াশোনা করতে হয়। তাই দেখবেন, পাড়ার যে ছেলেরা পুজোর আগেআগে চাঁদার জন্যে বেশি পেইন দেয়, তাদের বেশিরভাগই পড়াশোনার ধারেকাছেও নাই। কারণ, পড়াশোনা করাটা তো কঠিন, পুজো করাটা সোজা। ওরা পুজো করে আর পরীক্ষায় ফেল করে। পুজোটুজো করে পরীক্ষায় পাস করা গেলে অন্তত আমি পড়াশোনা করতাম না; পড়াশোনা করাটা অনেকবেশি কষ্টের কাজ। আমি কাজটাজ ফেলে ঈশ্বরকে ডাকবো, আবার দারিদ্র্যের জন্যেও উনাকে দুষবো, এটা তো হয় না। ঈশ্বর থালায় থালায় স্বর্ণমুদ্রা আর সন্দেশ দিয়ে যান শুধুই নাটক-সিনেমায়। ওতে পেট ভরে না, প্রোডিউসার-ডিরেক্টরের পকেট ভরে। বেশিরভাগ মানুষই শুধুই ধার্মিক হতে চায় কেনো? ভালোমানুষ হতে চায় না কেনো? দু’টো কারণে। এক। ধার্মিক হওয়াটা ভালোমানুষ হওয়ার চাইতে অনেক সহজ। দুই। মানুষ ধার্মিক হয় স্রেফ নিজের প্রয়োজনে। একটু ভেবে দেখুন তো, আমরা ধার্মিক হই নিজের প্রশান্তির জন্যে। যা করে সুখী থাকা যায়, ভালো বোধ করা যায়, আমার সাধারণত তা-ই করি। এতে অন্যের কী ভালো হয়? যদি হয়ও বা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা ধর্মের গুণে, আমাদের গুণে নয়। অনেকে নিজ ধর্ম পালন করতে গিয়ে আরো বড়ো একটা অধর্ম পালন করেন, সেটা হলো, অন্যের ক্ষতি কিংবা অসুবিধে করে ধর্ম পালন করা। আমি ধার্মিক, এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের পছন্দে, নিজের জন্যে, এটার জন্যে আমি কিছুতেই কোনো বাড়তি সুবিধা কিংবা সম্মান দাবি করতে পারি না। এরকম দাবি করাটা নেহায়েত সেইসব স্কুলগোয়িং বালকবালিকার ছেলেমানুষি, যাদের কাছে ধর্ম ব্যাপারটাই ধর্মশিক্ষা বইয়ের পাতায়, পরীক্ষার খাতায়, আর মার্কশিটে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ধর্ম আর দেশ নিয়ে বড় বড় বুলি কপচানো সবচেয়ে নিরাপদ আর লাভজনক। স্বার্থের প্রয়োজনে সবাই ধর্ম আর দেশকে রেপ ক’রতে পছন্দ করে। এবং করে। এটা অনেক রিস্ক-ফ্রি। ইমোশন মিশিয়ে কৌশলে এটা ক’রতে পারলে শাস্তি তো হয়ই না, বরং বাড়তি পুরস্কারও জুটে যেতে পারে। যারা ঠিকভাবে ধর্ম পালন করেন, তারা কখনোই এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন না, অন্যকে অসুবিধেয় ফেলে এটা করেন না, এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানেন। আপনার পরকালের সুন্দর জীবনের জন্যে ইনভেস্টমেন্টের দায় (liability) অন্যের ঘাড়ে চাপাবেন না যেনো! ধর্ম অনুভবের ব্যাপার; কেউ কী অনুভব করবে, কী অনুভব করবে না, সেটা ঠিক করে দেয়ার আমি কে? সবাই তো আর ঠিক একইরকম করে ভাবে না, একইভাবে বাঁচে না। যত মত, তত পথ। ধর্ম আমাদের যতোটা ধারণ করে আছে, এর সিকিভাগও যদি আমরা ধর্মকে ধারণ করতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীতে আজ এতো দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকতো না। আস্তিক্য-নাস্তিক্য নিয়ে হইচই করার মতো ইচ্ছে কিংবা সময় কোনোটাই আমার কোনোকালেই ছিলো না, এখনো নেই। পৃথিবীটিতে অন্য আরো অনেককিছু আছে ভাববার। আমি অমুক ধর্মের, এটা যেমন আমার কোনো গুণ নয়; তেমনি অন্যকেউ অমুক ধর্মের নয়, এটা উনার কোনো দোষ নয়। ধর্ম দিয়ে কারো গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা আর জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি দিয়ে কারো চেহারা বিচার করা একই ধরণের মূর্খতা। কেননা দু’টোতেই ব্যক্তির কোনো হাত থাকে না। যে কৃতিত্ব কিংবা অকৃতিত্ব ব্যক্তির নয়, সেটার জন্য ব্যক্তি কোনো আনুকুল্যের দাবিদার কিংবা বৈষম্যের শিকার হ’তে পারে না। কোনোকিছুর ভালোগুলো গ্রহণ করার সময় যতোটা স্বার্থপর হতে হয়, খারাপগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ঠিক ততোটাই বুদ্ধিমান হতে হয়। তাই, কোনো ধর্মকে হেয় করে কেউ কিছু বললে আমার খুব কষ্ট হয়। কারোর বিশ্বাসকে অশ্রদ্ধা করে কখনোই নিজের বিশ্বাসকে বড়ো করা যায় না। এটা ধার্মিকতা নয়, এটা ধর্মান্ধতা। আর একটা কথা, আমি যা কিছু ভাবি, করি(যেগুলো নিয়ে আমার বন্ধুরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন), সেগুলোর ক্ষেত্রে আমি যে ইউনিক, তা কিন্তু নয়। আসল ব্যাপার হল, আমি কিছুতেই হিপোক্রিট হতে পারি না, হিপোক্রিসি সহ্যও করতে পারি না। আমি যা বলার খুব সরাসরি বলি। হিপোক্রিট হওয়ার চাইতে স্কাউন্ড্রেল হওয়া অনেক ভালো। অনেকেই কতোকিছু করে, চুপচাপ থাকে, সবার চোখে ভালোভালো সেজে থাকে; পেছনের মেরুদণ্ডটা কতো আগেই ক্ষয়ে গেছে বোধ হয়। আমার ব্যর্থতা, আমি এটা করতে পারি না। প্রত্যেকটা ধর্ম আমার কাছে একেকটা দর্শনের মতো, আমি খুব স্বার্থপর ভাবে সব ধর্মের এসেন্সগুলো হৃদয়ে ধারণ করি। এতো ঝগড়া করার সময় কোথায়? আমার কাছে ধর্ম পালন করা খুব সোজা। কারো ক্ষতি না করা, কাউকে ধোঁকা না দেয়া, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের সেবা করা, সম্ভব হলে কারোর উপকার করা, সুন্দরভাবে বাঁচা এবং অন্যকে সুন্দরভাবে বাঁচতে দেয়া, ধর্মের আর্ট-ট্রেডিশন-কালচার-স্থাপত্য-দর্শন-উৎসব এইরকম আরো অনেককিছু নিয়ে জানা-বোঝা-শেখা, অন্য ধর্ম আর ধর্মের মানুষকে যথাযথভাবে সম্মান করা —- এইসবকিছু। ধর্ম পুঁথির পাতায় নয়, ধর্ম মানুষের মধ্যে। পুণ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটা নিজের জীবনটাকে বদলে দেয়ায়, অন্যের জীবনকে বদলাতে সাহায্য করায়, কাউকে মাছ দিয়ে নয়, মাছ কীভাবে ধরতে হয় সেটা শেখানোয়, অনেকের না হোক অন্তত কিছু লোকের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়ায়, নিজে যা পেয়েছি সেটা পাওয়ার রাস্তা অন্তত কিছু লোককে দেখানোয়। একটু ভাবুন তো, যদি কেউ নিষ্প্রাণ পাথরের শিবলিঙ্গের গায়ে পুরোটা দুধ না ঢেলে কিছুটা দুধ কোনো অনাথ শিশুর মুখে দিতো, তাহলে পৃথিবীটা কী আরো সুন্দর হতো না? কিংবা ঈদের পাঞ্জাবিটা ১৫ হাজার টাকায় না কিনে ৫ হাজার টাকায় কিনে বাকি ১০ হাজার টাকায় রাস্তার অসহায় কিছু টোকাইকে জামাকাপড় কিনে দিলে ঈদের আনন্দটা কী আরেকটু বাড়তো না? যে ধর্ম পৃথিবীকে অসুন্দর আর আনন্দহীন করে দেয়, আমি সেই ধর্ম পালন করতে চাই না। আরেকটা ভাবনা শেয়ার করি। আমার মনে হয়, আগে মা-বাবা, পরে ঈশ্বর। দৃষ্টিগ্রাহ্য কিংবা অনুভব করা যায় এমনকিছু কি আছে যা ঐশ্বরিক, অথচ আমরা বাবা-মা’র কাছ থেকে পাইনি কিংবা পাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাইনি? আমি এখনো পর্যন্ত এর কোনো সদুত্তর পাইনি। আপনি পেলে আমাকে জানান। বৃদ্ধ মা-বাবা’কে ওল্ডহোমে কষ্টে রেখে মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে কিংবা গির্জায়-মন্দিরে-প্যাগোডায় সারাদিন প্রার্থনা করলে কী ফল হবে? আমরা অনেকেই ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাবা-মা’কে অনেক যুক্তি দিয়ে ধর্ম পালনে বাধা দিই। আমাদের সাথে যুক্তিতে উনারা পারবেন না। এটাই স্বাভাবিক। একসময় চুপ হয়ে যাবেন, মনেমনে কষ্ট পাবেন। উনারা আমাদের বড়ো করেছেন বলেই কিন্তু আমরা উনাদের চাইতেও আধুনিকমনস্ক হতে পেরেছি। ওরকম হয়ে উনাদেরকেই আহত করা কি ঠিক? আমরা আমাদের মায়েদের উনারা ইন্ডিয়ান হিন্দি-বাংলা সিরিয়াল কিংবা রিয়েলিটি শো দেখেন বলে অনেকসময়েই তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গ করে কতোকিছু বলি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি, উনারা গল্প করার জন্যে তো কাউকে কাছে পান না, বুড়ো বয়সে কথা বলতেও তো কাউকে লাগে, আমরা নিজেরাও তো সময় দিতে পারি না ব্যস্ততার জন্যে; একটু খেয়াল করলেই দেখবো, অন্তত টিভি দেখার সময়টাতে উনারা কীরকম হাসিখুশি থাকেন! মা-বাবা’কে সুখী রাখাটাই সবচেয়ে বড় কথা। তাই ওরা খুশি থাকার সময়টাতে উনাদের মন খারাপ করে দিয়ে কী লাভ? উনারাই বাঁচবেনই বা আর কতোদিন? বাবা-মা’কে সেবা করার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। বেশিরভাগ বাবা-মা’ই তো ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজেরা ফুরোতে ফুরোতে একসময় একেবারেই ফুরিয়ে যান। যাঁদের জীবনের সকল সুখআহ্লাদের বিসর্জনে আমাদের সমস্ত অর্জন, তাঁদের সুখী করার সৌভাগ্য আমাদের কয়জনের ভাগ্যে জোটে? তাই, উনারা যতদিন আমাদের মাথার উপরে ছায়াতরু হয়ে আছেন, উনাদের উনাদের মতো করে সুখেশান্তিতে থাকতে দেয়াটাই ধর্ম।

ভাবনা: ছয়শো পঁচিশ

……………………………………………………

এই মাটিতে আমার পূর্বপুরুষের দেহাবশেষ মিশে আছে। এইখানে আমার জন্ম, এই বায়ুতে আমি প্রথম শ্বাসগ্রহণ করেছি। তাই এই পথটা আমার ঘরের পথ মনে হয়। এই মাটিতে ফিরে আসাটা বড়ো আনন্দের। আমার বাড়ির সামনেই নদী ছিলো, পাশে ফসলের মাঠ। নদীর ঘ্রাণ এখনো আমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। সেসবকিছু মনে হলে মনে হয়, আহা! কী যেন ফেলে গেছি! কী যেন ফেলে গেছি! তাই ফিরে আসতে বড়ো আনন্দ হয়।

বাসে কোনোরকমে একটু ধরেটরে ঝুলেঝুলে বাড়িতে ফিরছি; পড়ে যাবোযাবো এরকম করে। হঠাৎ বাসটা ব্রেক চাপলো, আবার চাপলো না, আমি নেমে যাচ্ছি, মানে নামার চেষ্টা করছি, বাসটা পুরোপুরি থেমে যায়নি, আবার ছুটছেও না, ওরকম অবস্থায়। পড়ে গেলাম, বাসটা ঠিক ওইসময়েই থামলো। থামলো, তাই বেঁচে গেলাম। নাহলে, সেদিনই চাকার নিচে পড়ে যেতাম। আজকের দিনটা পর্যন্ত এই গল্পটা বলার জন্যে বেঁচে থাকাও হতো না। ওইসময়ে কেউকেউ বলে উঠলো, মশায়, আপনার তো মরাই উচিত। এভাবে বাসে উঠেছেন কেনো? আমি ওকথা শুনে একটুও রাগ করিনি। শুধু ভাবছিলাম, মানুষের তো এতোটা অনাদরে থাকার কথা ছিলো না। মানুষ বাড়ছে, সাথে মানুষের অনাদরও বাড়ছে। কিন্তু এরকম হওয়ার তো কথা ছিলো না। মৃত্যুও কতো সহজে চাওয়ার মতো অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। এর শেষ কবে?

আপনারা আমার জীবনের কথা শুনতে এসেছেন। আমি বলবো। অবশ্য আমার জীবন এমন সাংঘাতিক কিছু নয় যে ওটার কথা শুনতেই হবে। যে কাজটা করতে ভালো লাগতো না সেটা আমি করতাম না। এরকম একটা কাজ ছিলো পড়াশোনা। মনোযোগ ছিলো অন্যদিকে, সিলেবাসের বইয়ে নয়। পড়তাম বটে, ক্লাসের বইগুলো না। এতে করে যে ব্যাপারটা ঘটছিলো, সেটা হলো, আমার ক্যারিয়ার বলে কিছু হচ্ছিলো না। অর্থহীন জীবন, নিরর্থক দিনযাপন। আমি প্রেম করতেও ভয় পেতাম। ভাবতাম, আমি কে যে আমাকে কেউ ভালোবাসবে? ফিরিয়ে দেবে, এই ভয়ে ভালোবাসতাম না। তবে একটা বয়সের পর এক মহিলা দয়াপরবশ হয়ে ভুল করে আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। পরে তিনি সেটা বুঝতেও পারলেন, কিন্তু ততোদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। সেই অল্প বয়সের ভুলের মাশুল তিনি এখনো হাসিমুখে দিয়ে যাচ্ছেন।

একটা সময়ে আমি স্বভাবগতভাবেই অবসাদগ্রস্ত ছিলাম। কিছু দার্শনিক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরতো। আমি বড্ডো বেশি ভাবতে থাকতাম কী কেনো কীভাবে হচ্ছে। এইসবকিছু কেমনভাবে যেনো আমার ভেতরবাইরে সবকিছু ফাঁকা করে দিয়ে যেতো। সেইসময় বেঁচে থাকাটা কী ভীষণ নিরানন্দের মনে হতো। একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাকে ছেয়ে ফেলেছিলো। মনে হচ্ছিলো, আমার কোনো আত্মপরিচয় নেই। আমি মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে ফিরতাম। এই অবস্থা আমার জীবনে কয়েকবার এসেছে। এই চরম কষ্টের মুহূর্তে আমি একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আমি এই পৃথিবীতে আর থাকবো না। এই সিদ্ধান্ত আমাকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিলো। মৃত্যুর ভাবনা মানুষকে খুব তৃপ্তি দেয়, শান্তি দেয় যখন সে জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। ক্রিকেট খেলায় যখন কেউ আহত হয়ে খেলা শেষ না করেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যায়, তখন তার যে অবস্থা, আমার অবস্থাও তা-ই। জীবনের খেলা সাঙ্গ না করেই জীবন থেকে বেরিয়ে যাবো ভাবছি। তখন আমার ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের সাথে দেখা। উনি যেন আমাকে পুনর্জন্ম দিলেন। শেখালেন, জীবনের ব্যথা-বেদনা-কষ্ট এসব নিয়েই চলতে হবে। বললেন, যাও, তোমার কিছুই হয়নি। আবার খেলো। Go, and see the light again. উনি আমাকে বিশ্বাস করালেন, ঠিক আছে, আমি যদি অক্ষমও হই, তবে এই পৃথিবীতে আর পাঁচজন উজ্জ্বল মানুষের মতো না হলেও একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে একটু বেঁচে থেকেই দেখি না কী হয়! এরকম করেই বেঁচে থাকলাম। লিখলাম, মানে লেখালেখি শুরু করলাম। সেই ২২ বছর বয়সে। প্রথম গল্পটা দেশ পত্রিকা ছাপলো না। ভাবলাম, আরেকটা পাঠিয়ে দেখি। যদি এটাও না ছাপে, তবে ধরে নেবো, আমার লেখালেখির অধিকার নেই। আমার আর লিখে লাভ হবে না। পরেরটা ওরা দয়া করে ছাপলো। সম্পাদকের ওই প্রশ্রয়েই আমার শুরু। এরপর থেকে চলছে। প্রথমদিকে আমার লেখা কেউ অতোটা পড়তো না। আমি যা লিখতাম, তা ছিলো আমার মনের নির্মাণ। মানুষ আর চারপাশটাকে ভেঙ্গেচুরে টুকরো টুকরো করে ফেলতাম, এরপর আমার নিজের মতো করে জোড়া লাগাতাম। কেউ ওটাকে নিতো না, তাই আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ বিক্রিও হচ্ছিলো না, সব কপি পড়ে থাকলো। কেউ পড়ছে না, অথবা পড়ে বুঝতে পারছে না। কেউ প্রশংসাও করছে না, নিন্দেও করছে না। যখন দূরবীন লিখি, তখনও ধরে নিয়েছিলাম, এটাও কেউ পড়বে না। এটা আরেকটা ঘুণপোকা হতে যাচ্ছে। আমি কখনোই লেখার পর বুঝতে পারি না, আমি কী লিখেছি, কেমন হলো। এভাবে লিখে গেছি, লিখে যাচ্ছি। যা পেয়েছি, তা যতোটা অর্জন, তার চেয়ে বেশি প্রশ্রয়। বেশিরভাগ সময় মনেই থাকে না, আমি লিখি, আমি লেখক। এই যে আপনারা আমার জন্যে দয়া করে অপেক্ষা করে আছেন, তা দেখে আমার মনে পড়ে যায়, আমাকে লিখতে হবে, আমি তো লিখি!

আমাকে ঠাকুরের কাজ করতে প্রায়ই গ্রামেগ্রামে ছুটতে হয়। আমি যাদের কাছে ছুটে যাই, তারা কেউ পড়াশোনা জানে না। ওরা আমায় লেখক বলে চেনে না। লেখক কী, সেটাও হয়তো জানে না। সেবার ভারতের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে গেছি। সকালের জলখাবার খাবো বলে একটা দোকানে গিয়ে বসলাম। সেখানে কুলি-মজুর-ড্রাইভাররা খায়। আমি ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। আমিই ছিলাম একটু ভদ্র পোশাক পরা, যা একটু অন্যভাবে চোখে পড়ছিলো। দোকানটা চালায় যে, সে ৪০-৪৫ বছর বয়সের এক গ্রাম্য অশিক্ষিতা মহিলা। সারাক্ষণই হিন্দিতে একেওকে অশ্রাব্য গালাগাল করছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ঠায় বসে আছি, ও আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমার পরে অনেকে এসে খেয়ে চলে গেলো, আমি কিছুই খেতে পেলাম না। এদিকে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কী করি কী করি ভাবছি, এইসময় আমার ঠাকুর অনুকূলের একটা কথা মনে পড়ে গেলো। ঠাকুর বলতেন, সব মেয়েই মা। মেয়েদের উনি মা বলে ডাকতে বলতেন। কিন্তু ওই মহিলার মুখের ভাষা, পরনের পোশাক, ব্যবহার কোনোকিছু দেখেই উনাকে কিছুতেই মা ডাকতে ইচ্ছে করে না। কেনো জানি না, ভাবলাম, ডেকেই দেখি না! উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, মা বড্ডো খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দেবে? এরপর যা ঘটলো, তা রীতিমতো ম্যাজিকের মতো! সেই মহিলা নিজের হাতে প্লেটে গরমগরম রুটি আর তরকারি সাজিয়ে এনে আমার সামনে বসে বলতে লাগলেন, খা ব্যাটা, খা। তুই পয়সা পুরো দিস না, অর্ধেক দিস। আমি কিছুতেই তাকে পুরো পয়সা দিতে পারলাম না। কোথায় তার দুর্ব্যবহার, কোথায় তার অবহেলা! আসলে, কে যে কোন ক্ষুধায় কাতর থাকে তা আমরা কখনোই জানতে পারি না। এই মহিলার মধ্যেও যে মায়ের স্নেহ দেয়ার চিরন্তন ক্ষুধা লুকিয়ে ছিলো, তা কে কীভাবেই বা জানবে?

শীর্ষেন্দু গত ৩০ তারিখের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলোর মধ্য থেকে ওপরের কথাগুলো কিছুটা আমার নিজের মতো করে লিখলাম। ওপরের কথাগুলো আমার নিজের জীবনের সাথে বেশি মিলে বলেই হয়তো শুধু ওগুলোই লিখে ফেলতে পেরেছি, বাকিগুলো অতো মনে নেই। ২ নভেম্বর জন্ম-নেয়া মানুষগুলো যদি হুট করে সবাই বলে বসে, স্রেফ বেঁচে থেকেও ওরা অনেককিছুই পেয়ে গেছে — অতোটাই, যতোটা পাওয়ার কথা ওদের কিছুতেই ছিলো না; যারা ধরেই নিয়েছিলো, এভাবেই দিনটিন কেটে যাবে আর কি, পরে দেখেছে, দিনগুলো স্রেফ কাটবার জন্যেই কাটছে না; এতে আমি অন্তত একটুও অবাক হবো না।

সেদিন বাতিঘরে শান্তনুদা (উনি গান করেন) বলছিলেন, এই মানুষটা নিজে এতকিছু করেটরে শেষ পর্যন্ত কিনা সব কৃতিত্ব দিয়ে দেন অনুকূলবাবুকে! আমি বলেছিলাম, আর কাউকে সব কৃতিত্ব দিয়েও যদি এতোটা কৃতী হওয়া যায়, তবে তা-ই হোক না, দাদা! আমার মাও ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দীক্ষা নিয়েছেন। মাও ভাবেন এবং বিশ্বাস করেন, জীবনের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তগুলোতে অনুকূলই তাঁকে কূল দিয়েছেন। বেঁচে থাকাটাই তো অনেক বড়োকিছু! সেই বেঁচে থাকার সময়টাতে যদি এতো মানুষেরও বেঁচে থাকার সময়টাতে সাথে মিশে থাকা যায়, তবে ওইটুকু বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু এসে যায় না, দাদা।

পূর্বকথাঃ এই শনিবার সন্ধ্যায় বাতিঘরে আসছেন শীর্ষেন্দু। এর আগে এসেছিলেন সমরেশ। তারও আগে, আরো অনেকেই।

সেইবার ছিলাম। আগেও থেকেছি। এইবারও থাকবো।

বাবার কাছ থেকে শিখেছি, শিক্ষকদের আর বড়ো বড়ো মানুষদের কাছ থেকে শিখতে হয় তাঁদের পায়ের কাছে বসে। নিজের সবটুকু আমিত্ব ঝেড়ে ফেলে মাথা নত করে শিখতে হয়। ওরা শেখাবেন না; অতো সময় ওদের নেইও। থাকলেও, কেনোই বা দেবেন? এই তুচ্ছ আমাকে? আমি কে? আমাকে সময় দিতে হবেই বা কেনো? তবুও শিখে নিতে হয়।

শীর্ষেন্দু আর আমার জন্ম একই দিনে, ২ নভেম্বরে। শেক্সপিয়ার জুলিয়েটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছেন, নামে কী হয়? এটা প্রশ্ন নয়, স্বগতোক্তি। অনেকেই একই ভাবেই জিজ্ঞেস করে বসবেন, জন্মদিনে কী হয়? আমি বলবো, কিছুই হয় না। তবু, জন্মদিনের এই মিলে যাওয়া নিয়ে নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ কাজ করে। অনেক দামি আনন্দ, টাকার চেয়েও দামি। শাহরুখের অভিনয় ভালো লাগে, উনিও ‘দয়া করে’ জন্মেছেন ওই দিনে। আমার নিজেকে ভালো-লাগানোর জন্যে, যদি ওরকমভাবে বলেই ফেলি, তাতে কার কী এসে যায়! এই ভালো-লাগার ব্যাপারটা কাজ করার কোনো কারণই নেই; তবুও। প্রিয় মানুষের সাথে নিজেকে যতোটুকু মিলিয়ে নেয়া যায় আর কি! শীর্ষেন্দু জন্মেছেন বাংলাদেশে, আমিও। উনি জীবনে খুব বিপন্ন অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন; আমিও। ওরকম বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে না গেলে সাঁতারু ও জলকন্যা’র মতো উপন্যাস কেউ লিখতে পারে? আকারে ছোটো অনেককিছুই কিন্তু মাপে ছোটো নয়। “For sale: baby shoes, never worn” হেমিংওয়ের এই ছয় শব্দের কথাকে উপন্যাসের মর্যাদা দেয়া হয়েছে! ভাবা যায়! আমাকে ৬ শতাব্দীর আয়ু দিলেও ওরকম করে লিখতে পারতাম কখনো? এমনকি শত জন্মের বেদনা নিয়েও অতোটা বেদনাভরা কথা লিখে ফেলা যায় না। ভালো লেখকরা আমাদের কষ্টের সমান বড়। এই ছয়টা শব্দ অনেক অলেখকের ১০ শেলফ বইয়ের চাইতেও দামি। আকারে কী হয়? বাংলা সাহিত্যের খুব ছোটো অথচ জীবনদর্শনে বড়ো উপন্যাসের তালিকা করলে শীর্ষেন্দুর সাঁতারু ও জলকন্যা প্রথমদিকেই থাকার কথা। এই বইটার দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১৮ টাকা। বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে, শুধু এই বইটাও জীবন নিয়ে ভাবতে শেখাতে পারে। জীবনটাকে ‘না’ কিংবা ‘গুডবাই’ বলে দেয়ার আগে একবার হলেও এটা মেনে বেঁচে থাকা যায়, “শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়।” এই কথাটা শীর্ষেন্দুর। এই কথাটা বলে-দিতে-পারা মানুষটাকে দূর থেকে অন্তত এক মুহূর্তের চোখের দেখা দেখতেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়।

তাই যাচ্ছি; রাতের গাড়িতে।

Dipankarদা, যে বাতিটা জ্বেলেছেন, জ্বেলে যাচ্ছেন, সেই বাতিটা নেভাবেন না কখনোই, প্লিজ। এভাবেই থাকবেন সবসময়ই, আমাদের একেবারে ভেতরে মিশে থেকে। দাদা, আপনাকে ধন্যবাদ।

ভাবনা: ছয়শো ছাব্বিশ

……………………………………………………

২৭ অগ্রহায়ণ। মানে পৌষ এখনো আসেনি। অথচ শীত এসে গেছে। মেয়ের আগে মা এসে যায়। শীতের সকাল ৬:৩০টা মানে সকাল না, ভোর। ওইসময়ে কলের জল হল ফ্রিজের জল। হাওয়া হল কুয়াশা। জেগে থাকা হল ঘুমঘুম চোখে জেগে থাকা। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলে চোখের পাতা অবশ হয়ে যায়, প্রিয়ার উষ্ণ চুম্বনে জমে-যাওয়া চোখে প্রাণ ফেরাতে ইচ্ছে করে। হায়! প্রিয়া নেই, এয়ারপোর্টের ফ্লাইট আছে; ৮:৩০টায়। প্রিয়া আসে না, প্লেন আসে। প্লেনগুলো এই শীতের ভোরেও আমাকে গোসল করিয়ে নেয়। ৭:০০টায় বাসার সামনে গাড়ি এল।

পথে আসতে আসতে মনে হল, আজকের ভোরটা একটু অন্যরকম বোধ হয়। নাকি, আজকের আমিই একটু অন্যরকম? এই অন্যরকম আমি মাঝেমাঝে কোথায় হারাই তবে?

অভিমানী প্লেনগুলো প্রতিদিন দেরিতে রানওয়েতে নামে। পিচঢালা রানওয়ে প্লেনের চাকাগুলোর স্পর্শসুখের আশায় উবে-না-যাওয়া কুয়াশা বুকে নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। তবুও ঘন কুয়াশা ওদের নামতে দেয় না। গাড়িতে ভাবতে লাগলাম, হয়তো বা আজকেও এমন।

পথের পাশে ৫-৬টা কুকুর বেশ ভাবটাব নিয়ে লেজ উঁচিয়ে ওদের এলাকা টহল দিতে দিতে খোশগল্প করছে। দেখলাম, একটা কুকুরের লেজ নামানো। ওটা বোধ হয় অন্য এলাকার কুকুর। আচ্ছা, এই কুকুরদের শীত লাগে না?

এক জায়গায় কিছু শ্রমিক এই কুয়াশায়ও জড়ো হয়েছে। ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ টাইপ সমাবেশ। ওদের ব্যানারে লেখা আছে, “শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নাও, মানতে হবে।” আমিও ওদের দাবিগুলো সমর্থন করে ওদের আন্দোলনের সাথে মনেমনে একাত্মতা ঘোষণা করেছি। কারণ ওরা ‘ন্যায্য’ বানানে ভুল করেনি। যে দেশে বড়বড় মানুষেরাও ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ দিয়ে সকল শ্রদ্ধাঞ্জলি জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়, সেই দেশে এই ছোটছোট মানুষের এতো বড়ো বানানসাফল্য মুগ্ধ করার মতোই। প্রার্থনা করি, ওরা ভালো থাকুক, শুদ্ধ বানানে প্রতিবাদ করে যাক।

কিছু কিছু মোরগকে দেখলাম, মুরগিগুলোর সাথে ওপেনলি ফ্লার্ট করছে। এদের মধ্যে দুএকটা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে চোখের ইশারা করছে। হায়! মুরগিদের ইভটিজিং দেখার কেউ নেই। ওরাও অ্যাডামচেজিং শুরু করবে, ভাবছে। আমি চাই, মোরগগুলো কিংবা ওরা নিজেরা চিকেনফ্রাই হওয়ার আগেই ওদের কার্যক্রম শুরু হোক।

খেটেখাওয়া মানুষ অনেকসময়ই কোনো কারণ ছাড়াই গালিগালাজ করে। রাস্তায় এক লোক ২-৩জন ড্রাইভারকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে। এসব শুনেটুনে আমি অতিবিব্রত। আমি চাই, কেউ প্রকাশ্যে গালাগালি করলে ওদেরকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাক। কিংবা সবার সামনে ২০ টাকা জরিমানা করুক। এইসব লোক পিটালে মাইন্ড করবে না, কানেধরে উঠবস করালেও দাঁত বের করে হাসতে থাকবে, কিন্তু পকেটের পয়সা খসালে পরেরবার অন্তত দশবার ভেবে কাজ করবে। আমার কথা হচ্ছে, ওরা রাস্তায় গালাগালি করবে কেন? রাস্তাটাকে পার্লামেন্ট পেয়েছে নাকি? আজব!

কিছু ন্যাংটা ছেলে খড়কুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে আগুনের চারপাশে নাচছে। ওরা মহাআনন্দিত। জগতের সকল আনন্দযজ্ঞের আয়োজন এখানেই। ওদের কাস্টমসের সহকারী কমিশনারকে গোনার টাইম নাই। ওরা গোনে শুধু প্রতি মুহূর্তের আনন্দকে। আমি ভাবছি অন্যকথা। ন্যাংটাদের শীত লাগে না নাকি? জগতের সব ন্যাংটারই দেখি হাসিহাসি মুখ। ঘটনা কী? লজ্জা নাই, নাকি শীত নাই?

কিছু কবুতর রাস্তায় পড়ে থাকা শস্যদানা খুঁটিয়ে খাচ্ছে। এক কিশোর ওইসময়ে ওই রাস্তায় দুই হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালাতেচালাতে সাইকেল নিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল। একটু আগের সেয়ানা নায়ক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। নায়কদেরকে মাটিতে লুটাতে দেখলে কষ্ট লাগে। তার উপরে ওই বেচারা বিশেষ জায়গায় ব্যথা পেয়েছে। ওখানে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে, মুখ ব্যথায় বিকৃত। বিশেষ জায়গায় ব্যথা পেলে সবারই ব্যথা লাগে। নায়কেরও কোনো ছাড় নেই। পাশে বেরসিক নিষ্ঠুর কবুতরগুলো বাকবাকুম করেই চলেছে, বন্ধ করেনি। কারোর অগ্রহায়ণমাস, কারোর সর্বনাশ। ও ভাবছে, বাসায় গিয়ে কম মসলায় রান্নাকরা কবুতরের স্যুপ খাবে। শরীরের ব্যথা কমবে, মনের জ্বালাও কমবে। হতচ্ছাড়া কবুতর!

রাস্তায় মাইকিং হচ্ছে, “একটি শোকসঅঅঅঅংবাদ একটি শোকসঅঅঅঅংবাদ………….।” কেউ একজন মারা গেছেন। এর পাশেই একটা সিএনজি’তে এক ছোকরা মাইকে ধেড়েগলায় চিলাচ্ছে, “প্রেমের নাম বেদনা, সেকথা বুঝিনি আগে………..।” একটা মসজিদ বানানো হবে, তাই এরজন্যে রাস্তার পাশে টেবিলচেয়ারে বসে মাইক দিয়ে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন সৌম্য চেহারার এক প্রবীণ। অদ্ভুত দৃশ্য! মৃত্যু আনন্দ আর ধর্মের অভূতপূর্ব সহাবস্থান।

“আমি আর আরএফএল কোয়ালিটির ব্যাপারে আপোষ করি না।” একটা কাভার্ড ভ্যানের গায়ে লেখা দেখলাম। দেখলাম, ওটার গায়ে মৌসুমী লেপ্টে আছে। কেয়ামত থেকে কেয়ামত’য়ের কিউট মৌসুমীকে খুব মিস করলাম। আমরা কি এই কোয়ালিটির ঐরাবত-মৌসুমীকে চেয়েছিলাম?

দূরে দেখা যাচ্ছে, একটা টয়লেটের পেছনের দিকের অংশটা নেই। টয়লেটের পেছনটা জঙ্গলটাইপের বলে কাছ থেকে এই ব্যাপারটা দেখা কিংবা বোঝা যাবে না হয়তো। কিন্তু দেখতে চাইলে দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখা সম্ভব। তাহলে কি ধরে নেবো, সামনাসামনি দেখা যায়, শুধু এমন লজ্জাই মানুষ ঢাকে?

রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সবাই ভিড় করে ঘিরে আছে। এই লোককে এই মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো দরকার। সেদিকে কারোরই খেয়াল নেই। সবাই গাড়ির ড্রাইভারকে ধোলাই দিতে ব্যস্ত। ড্রাইভারকে গালি দিতে দিতে ওর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলছে, আর ওদিকে লোকটার ব্লিডিং হচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে অনেক চেষ্টা করেও আমি উনার কাছে যেতে পারলাম না। একটুপর উনাকে ভ্যানে তোলা হল। লোকের ভিড় ঠেলে ভ্যান যেতে পারছে না। ওরা রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে। সমানে গালাগালি করছে। অতি উৎসাহী ব্যস্ত জনতা। বাঙালিরা অতিকিউট বেকুব বেআক্কেল জাতি।

আচ্ছা, সাগর নামের সব ড্রাইভারই কি অ্যাক্সিডেন্টবিহীনভাবে অতিদ্রুত গাড়ি চালাতে পারে? আমার আগের এক ড্রাইভারের নাম ছিল সাগর। ওর মাথার দুএকটা স্ক্রু ছিল না, কিন্তু ড্রাইভার হিসেবে ও ছিল অসাধারণ! বাংলা সিনেমার গান গাইতেগাইতে খুব দ্রুত গাড়ি চালাতো। আমার শুধু একটাই ভয় কাজ করতো, কোনসময় হঠাৎ রাস্তার পাশের পুকুরটুকুরে নামিয়ে দিয়ে বলে, “স্যার, কী করবো বলেন, গরমে তো আর টেকা যাচ্ছিল না!” এখনকার ড্রাইভারও সাগর, তবে মাথাখারাপ সাগর না, মাথাঠিক সাগর। মিল শুধু এক জায়গাতেই, দুজনেই চমৎকার ‘নেভার লেট’ ড্রাইভার। এয়ারপোর্টের রাস্তা বন্ধ দেখে সাগর অন্যরাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে ৮:০৫টায় এয়ারপোর্টের কাছাকাছি চলে এলো। আমাদের এয়ারপোর্টের কাছেই সাগরতীর। নেভাল বিচ। ওটার পাশ দিয়ে ক্রস করার সময় ড্রাইভারকে থামতে বললাম। গাড়ির জানালা নামালাম। ভোরের শান্ত সাগরতীর দেখতে ইচ্ছে হলো। আমি ‘লাইফ ফর জব’ থিওরিতে বিশ্বাসী নই, আমি ‘জব ফর লাইফ’ মেনে চাকরি করি। এই হিমশীতল নেভাল বিচ দেখার সুযোগ যদি আর কখনোই না হয়, তাহলে? ছোটোবেলার অংকের মতো করে ভাবলাম, “মনে করি, আজকেও ফ্লাইটডিলে।” গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সাগরকে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে সাগরের কাছে গেলাম। বুকভরে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া নিলাম। আহা! ভোরের সাগর আর নদীকে শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষে পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টে এলাম। পথে শিশিরভেজা ঘাস দেখে জুতামোজা খুলে ঘাসের উপরে কয়েক মিনিট হেঁটেছি। অপূর্ব স্নিগ্ধ এক শিহরণ! মনে হচ্ছিলো, ওই নরোম ভেজা ঘাস প্রেমিকার নরোম ভেজা ঠোঁটের মতোই নরোম। পৌনে ৯টার দিকে এয়ারপোর্টে ফিরলাম। এসে জানলাম, আজকেও ফ্লাইট ডিলে। একঘণ্টা; ৮:৩০টার ফ্লাইট নামবে ৯:৩০টায়। কী শান্তি! মাঝেমাঝে চাকরিও একেবারে খালিহাতে ফেরায় না।

পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টে আসার পথে যখন গাছের পাতায় রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা দেখছিলাম, জীবনটাকে তখন বারবারই মনে হচ্ছিলো, শীতের রোদের ঘ্রাণের মতন মাখামাখা মিষ্টি।

এজরা পাউন্ডের মাত্র দুই লাইনের লাইনের একটা পূর্ণ কবিতা আছে, ‘In a Station of the Metro’:

The apparition of these faces in the crowd;

Petals on a wet, black bough.

এই লেখাটা লেখার কোনো মানে ছিলো না। তাই এই লেখাটা পড়ারও কোনো মানে ছিল না। যদি পড়েই ফেলেন, তবে বলবো, পাউন্ডের ওই কবিতায় গাছের কালো ডালে জমে থাকা পাপড়িগুলোর মতো আপনার অনুভূতিকে একটু স্থির করে ভাবুন তো, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কিন্তু জীবনটা নেহায়ৎ মন্দ নয়! কী আছে আর জীবনে! আমি বলছি, জীবন আপনাকে কিছুই দেবে না! উই অল আর ওয়েটিং ফর গডো। এখানে সব ছোটোছোটো সুখগুলি ছড়ানোছিটানো। আপনাকে তা কুড়িয়েকুড়িয়ে নিতে হবে। জীবনটা দামী। কতোটা? ততোটাই, যতোটা আমরা ভাবি।

এই লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার রুম থেকে দেখছি, প্লেন থেকে নেমে দেশে-ফেরা সারিসারি লোক রানওয়েতে হেঁটেহেঁটে এয়ারপোর্টের দিকে আসছে। আমার ল্যাপটপের স্পিকারে বাজছে ডেনভার…………

Life is old there, older than the trees,

Younger than the mountains, growing like a breeze

Country roads, take me home

To the place I belong…………..

কাকতালীয় না? হ্যাঁ, জীবনটা আসলে এরকমই!

ভাবনা: ছয়শো সাতাশ

……………………………………………………

পছন্দ না হলে বিয়ে করতে হবে কেন? ক্যারিয়ার খুব ভাল? সুখে থাকবেন? শিওর? আপনি একজন মানুষকে বিয়ে করবেন, উনার ক্যারিয়ারকে নয়। আমি কোনোদিনও ওরকম করে ভাবি না, ভাববও না।

চাকরি দিয়ে কী হয়? জীবনটাই তো আসল। বাকি সবকিছু ছেলেভুলানো গপ্পো।

আমি ক্যারিয়ারিস্ট মানুষ পছন্দ করি না। আমি নিজে বিন্দুমাত্রও ওরকম নাতো, তাই। যারা ওরকম, ওরা থাক ওদের মতো করে ভাল। আমি একজনকে ফিরিয়ে দিয়েছি, কিংবা ও-ই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কিংবা ভাগ্যই আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কারণ ও ভাবত, আগে ক্যারিয়ার, এরপর জীবন। আমি উল্টোটা ভাবি। আগে জীবন, সময় পেলে, ক্যারিয়ার। বাঁচবই বা কদিন? মরে গেলে এসব দিয়ে কী হবে? জীবনটাকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে। হাসতে ইচ্ছে করে। পাখি আর ফুলের সাথে খেলতে ইচ্ছে করে। ভুল করতে ইচ্ছে করে। নিজের মতো করে বাঁচতে ইচ্ছে করে। আফসোস ছাড়া বাঁচতে ইচ্ছে করে। কারোর প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। বাঁচব, হাসব, ভুল করব, এই একটু ঘুরেটুরে দেখব, এরপর একদিন হুট করে হাসতে হাসতেই নেই হয়ে যাবো। এইতো!

বেঁচে যে আছি, এইতো বেশি!! এটাই বোনাস! আর কী-ই বা চাইবার থাকতে পারে? এমন তো আর নয় যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়েছে ঈশ্বরকে। সবার মতো ভাবতে হবে কেন? আমি হব আমার মতো। আমি অমলকান্তির মতো না হয় রোদ্দুরই হব। কে কবে কোথায় এমন দিব্যি দিয়েছে যে কিছু হতেই হবে? দেয়নি তো! কী হবে কিছু না হলে? হোক, তবুও!

আমি হিপোক্রিসি করতে পারি না। প্রাণ গেলেও না। যা ভাবি, বিশ্বাস করি, সেটাই বলি। সবাই এগিয়ে যাক। কিচ্ছু হবে না। কালকে বাঁচব কিনা তারই তো ঠিক নেই। ১০০ বছরের প্ল্যান গুছিয়ে কী হবে? আমি প্রতি মুহূর্তের পৃথিবীতে বেঁচেথাকা বোকাসোকা মানুষ। যতক্ষণ বেঁচে আছি, বাঁচব। এই ধরুন, যদি আজকের পরই নেই হয়ে যাই, কোনো দুঃখ থাকবে না। চড়ুইয়ের মতো ফুড়ুৎফাড়ুৎ একটা জীবন হবে আমার; ছোট্টো জীবন। খুব বেশিদিন বাঁচতে চাই না। একটাই চাওয়া, যতদিন বাঁচি, যাতে আফসোস ছাড়া বাঁচি। কারোর মনে কষ্ট না দিয়ে, কারোর কোনো ক্ষতি না করে বাঁচি। এইতো!

আমি আসলে এই সিভিল সার্ভিসের জন্য উপযুক্ত না। তেলবাজি করতে পারি না, মনভুলানো মিথ্যে বলতে পারি না, হিপোক্রিসি করতে পারি না। আমাকে বসরা আমাকে যে খুব একটা যে পছন্দ করে, তাও না। আমি ‘ইয়েস স্যার’ ‘ইয়েস স্যার’ করতে পারি না। প্রচণ্ড রকমের আত্মসম্মান নিয়ে চলি। মধ্যবিত্তের আর আছেই বা কী? প্রাণ যায় যাক, তবুও সম্মানটুকু থাক। আমি ভাবি, ওরা যেখানে ইচ্ছে সেখানে পোস্টিং দিক। নোংরাভাবে মাথা নত করতে পারব না। মরে গেলেও না। ছোট্টো একটা জীবন। কাটিয়ে দেয়া যায় তো!

এই যে মুভি দেখি, বই পড়ি, গান শুনি, গান করি, কীসব যেন লিখি……… অনেক ভাল আছি তো! এতটা ভাল না থাকলেই বা কী এসে যেত? আমি এমন কে??? আমাকে ঈশ্বরের বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছেই বা কেন? বেঁচে আছি, এই বেশ! শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। আমার যে কিছুই পাওয়ার কথা ছিল না। পেয়েছি তো! অনার্স পাস করার কথা ছিল না, করেছি তো! বিসিএস’য়ে ফার্স্ট হয়েছি, আইবিএ’র ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি। অনেককিছু পাওয়া হয়ে গেছে! আর কী চাই! আরো দূর যেতে হবে। আমি জানি, আমি যাবই! স্রেফ বেঁচে থাকলেই হবে। বাকিটা এমনিতেই হয়ে যাবে।

এত লোক ভালোবাসে!! ইসসস……..! কষ্ট হয়! খুউব কষ্ট! ওদের ভালোবাসা আমাকে প্রতি মুহূর্তেই অপরাধী করে দেয়। ওদেরকে যে ভালবাসবার সময়ই হয় না আমার। উঁহু, মনে থাকে না প্রায়ই! ওরা তবুও বাসে। কেন বাসে? আমি এমন কে?? আমাকে ভালবাসতে হবেই বা কেন??? তাই আমি ঠিক করেছি, আমি ওদের পাশে থাকব। যারা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে, ওদেরকে স্বপ্ন দেখতে শেখাব। এইতো! যারা বাঁচতে ভুলে গেছে, ওদের বাঁচতে শেখাব। যারা হাসতে ভুলে গেছে, ওদের হাসতে শেখাব। আমি চাই, কেউই হারিয়ে না যাক। আমি জানি, হারিয়ে যেতে কতটা কষ্ট হয়! একদিন আমিও যে ওদের দলেই ছিলাম। আমিও যে নোবডি হয়েই ছিলাম। রাস্তার কুকুরের চাইতেও অবহেলার পাত্র ছিলাম। বেঁচে থাকার কথাও ছিল না আমার। তাই, আর ভয় নেই। বেঁচে আছি, এই বেশি। আর দশটা উজ্জ্বল মানুষের মতো না হোক, অন্তত একটা অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি! একদিন ভেবেছিলাম, ওসব বেঁচে থেকেটেকে কী হবে? ইসস!! কী যে ভুল ভাবতাম!! ছেলেমানুষি আরকি! এ-ই ভাবি এখন।

আমার অনেক সাহস। জীবনটাকে নিয়ে যারা জুয়া খেলতে পারে, তাদের সাহসের অভাব হয় না। এই সাহসের কথা কেউ বিশ্বাসও করবে না হয়তো। এত কেয়ার করে জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে না। আমি ক্ষতিকর লোক সহ্যই করতে পারি না। ওরা বলে, সুশান্ত, একটু সমঝে চল। আমি মনে মনে হাসি। হবেটা কী, শুনি? এসিআর’য়ে মার্কস কম দিবে? দিক। বাজে পোস্টিং দিবে? দিক। পারব না জীবনকে জীবিকার কাছে হেরে যেতে দিতে। যা হয় হোক। জীবন তো একটাই। ওর বলে, না না সুশান্ত, একটু তোয়াজ করে চল। ওসব বিরক্তিকর মানুষ তোমার বস হয়ে যেতে পারে কখনো না কখনো। আমি বলি, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে আমি অতদিন বেঁচে থাকব? অত আয়ু লেখা আছে নাকি আমার কপালে? যতক্ষণ বেঁচে আছি, ভালভাবে বাঁচব। যা হওয়ার তা-ই হবে। ল্যাটিনে বলেঃ Que sera, sera. মানে, Whatever was, was; whatever is, is; whatever will be, will be. এইতো! যা হওয়ার তা-ই হবে। আমি অত ধার্মিক না। কিন্তু গীতার মূল কথায় খুব বিশ্বাস করি। ওটাকে জীবনে ধারণ করি। এভাবে করেই বেঁচে আছি। ওরা জিতে যাক! পারব না আমি! তোমরা দেখো, আমি হেরে গিয়ে একদিন জিতে যাবো। ইঁদুরদৌড় আমার জন্য নয়। কোনদিনও হয়নি। হবেও না, আমি জানি। চাকরি স্থায়ী হলে দুম করে ঘুরতে চলে যাবো। সাথে পিএইচডি’টাও করে আসব। এসে চাকরি করব, সংসার করব। একটু ভুল করে আধটু শুধরে দিয়ে পুষিয়ে দেবো। জীবনের গান শুনব, শোনাবো। এরপর? এরপর কী হবে? আগে ওইটুক আসুক তো!





পুজো না করার শাস্তির চাইতে কিন্তু পুজোয় ভুল করার শাস্তি বরাবরই বেশি।

ভাবনা: ছয়শো আটাশ

……………………………………………………

পাবলিক এ্যাত্তোগুলা খ্রাপ! খুব খুউব খ্রাপ!!

ইনবক্সে লিখেঃ ভাইয়া, আমাদের জেলায় একটা ক্যারিয়ার আড্ডা দেন।

কিন্তু এইটা বলে না, ভাইয়া, আমাদের জেলায় ঘুরতে আসেন।

কনভারসেশন শুরুই করে এভাবেঃ ভাইয়া, বিসিএস রিটেনের জন্য কী কী বই পড়ব?

ভুলেও জিজ্ঞেস করে না, ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় এই বলেঃ ভাইয়া, আমি আপনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ চাই, তাই আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা অ্যাক্সেপ্ট করলে খুশি হতাম।

আমি বলি, শুধু পরামর্শের জন্য ফ্রেন্ড হওয়ার কী দরকার? ওটা তো আমি এমনিতেই দিই।

সেদিন ‘পাত্রী চাই’ টাইপের একটা বিজ্ঞাপন (পড়ুন, স্ট্যাটাস) দিলাম। সেখানেও কমেন্টঃ ভাইয়া, দিনে কত ঘণ্টা করে পড়ব? আপনার নেক্সট ক্যারিয়ার আড্ডাটা কবে? কোথায়?

আর কে নারায়ণের একটা গল্প আছে, Under The Banyan Tree. সেখানে এক লোক গ্রামবাসীদের গল্প শোনায়, মুগ্ধ করে রাখে। এতে ওর শুধুই ভালোলাগা ছাড়া আর কোন স্বার্থ নেই। সে গ্রামটি একেবারে প্রত্যন্ত একটি গ্রাম যেখানে গেলে মনে হবে, জায়গাটি শুধু শহর কেন, যেন একেবারে পুরো পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন। সেখানকার একমাত্র নাগরিক সুবিধা হল, খেয়েপড়ে বেঁচেবর্তে থাকা। গ্রামবাসীরা সংখ্যায় অল্প, ওদের মন ভাল করার আশ্রয় ওই একটাইঃ ওই গল্পবলিয়ের গল্প।

ওই বেচারার নাম নাম্বি। কেউ কখনোই জানতেও চাইলো না, নাম্বি কেমন আছে, ঠিকমতো খেতে পায় কিনা, ঘুমুতে পায় কিনা। ওরও যে মন খারাপ হয়, সেটা তো কারোর মাথাতেই আসত না! শরীর ভাল না, গল্প বলতে কষ্ট হচ্ছে, সেটা কারোরই মাথায় নেই। সবাই শুধু ভাবছে, গল্প কোথায়? আমাদের গল্প চাই, গল্প! ওরা যে শুধু ওর গল্পের জন্যই ওর কাছে আসত, সারাদিনের কাজের শেষে মনটাকে একটু ফুরফুরে করার জন্য নাম্বির কথা মাথায় আনত। আর কিছুই না!

হ্যাঁ, ওরাও নাম্বির কথা একদিন ভেবেছিল, মন থেকে ফিল করেছিল, কী যেন নেই কী যেন নেই! তখন নাম্বি আর গল্প বলতে পারে না। ঈশ্বর তার কাছ থেকে গল্প বানানোর সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। তখন সে যা পারত, তা হল, সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আর মানুষের একটুখানি ভালোবাসা চাওয়া। অবশ্য কেউ তাকে খালি হাতে ফেরায়ওনি; দিয়েছিল; ভালোবাসা নয়, করুণা।

সে গল্পের একটা কথা আমার সবচেয়ে প্রিয় কথাগুলোর একটিঃ What is the use of the lamp when all the oil is gone?

আজকে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে আমার ওপরের লেখাটা পড়ে আমার ছোটভাই কিছু কথা বলল। ওর ফিলসফি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ওর কথাগুলো আমি নিজের কথায় শেয়ার করছি।

দাদা, তোর লেখাটা পড়লাম। কিন্তু, তুই এটা এতদিনে বুঝলি? সবাই তো তোকে বেশ বুদ্ধিমান ভাবে। বুদ্ধু একটা! তুই কালকে থেকে ক্যারিয়ার আড্ডা নেয়া বন্ধ করে দে, লেখালেখি বন্ধ করে দে, লোকজনকে হেল্প করা বন্ধ করে দে; বেশি না, স্রেফ পাঁচ বছর পর দেখ তো কে তোকে এসে জিজ্ঞেস করে, “দাদা, কেমন আছেন?” অথচ তুই তো অনেকেরই মন ভাল করে দেয়ার কাজটা করে দিচ্ছিস, স্বপ্ন দেখতে শিখাচ্ছিস, তাই না? অনেকেই তোর কথায় ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। অনেকেই আছে যারা তোর লেখা পড়ার জন্য ফেসবুকে ঢোকে। আমি বলছি না, কেউই মনে রাখবে না। মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী রে, দাদা! এতই বিচিত্র, নিজের কোন স্বার্থ না থাকলে কারোর এই গুণটা ভাল, ওই গুণটা ভাল, এইটুকু বলার মানসিকতাও নেই কারোর কারোর। কেউ কেউ হয়তো বা ব্যক্তি সুশান্তকেও ভালোবাসে। ওরা রাখবে। এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়াটা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার, দাদা। ভালোবাসা পাওয়াটা পৃথিবীর সবচাইতে বড় উপহার, এটা সরাসরি ঈশ্বরের তরফ থেকে আসে। তুই যখন স্টুডেন্ট পড়াতিস, সেসময় কত স্টুডেন্টকে ফ্রি পড়িয়েছিস, কত মানুষকে টাকাপয়সা দিয়ে হেল্প করেছিস, কে তোকে এখন একটা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “স্যার, কেমন আছেন?” মাশফি ভাইয়ের ওয়ালে দেখি, উনার কোন কষ্টের কথা শেয়ার করলেও লোকজন কমেন্ট করে পুলিশি পরামর্শ চায়। দেখলে আমার খুব রাগ হয়। “কেন ভাই, উনাকে কি তোমাদের মানুষ মনে হয় না? শুধুই পুলিশ মনে হয়?” তোকেও দেখি, লোকজন ফোন করে জিজ্ঞেসও করে না তুই কেমন আছিস, তোর বাসার সবাই কেমন আছে। এয়ারপোর্টে কী হেল্প লাগবে, কাস্টমসের কী ঝামেলা হল, কার কী মাল পোর্টে আটকে গেল, ভ্যাট নিয়ে কী সমস্যা, এসবই বলে। ওরা কে কবে তোর পাশে থেকেছে? তুইই বা কবে ওদের কাছ থেকে কী চেয়েছিস? দাদা, সত্যি বলছি, এসব মানুষ আড়ালে তোর নিন্দে করে। মাশফি ভাইকে দেখি, হেল্প করে, তুইও করিস। আচ্ছা, তোরা এত বোকা কেন?

কেন এরকম হয়? ভেবে দেখেছিস কখনো? আমি বলছি, এটা তোর প্রাপ্য। তাই পাচ্ছিস, ভবিষ্যতেও পাবি। তুই প্রায়ই একটা কথা বলিস না, What goes around, comes around. Everyman is paid back in his own coin. আমার ধারণা, তুই নিজেই এর মানেটা ঠিক বুঝিস না। এখন তোর অনেক মানুষ আছে পাশে দাঁড়ানোর। কিন্তু একদিন তো কেউই ছিল না। হ্যাঁ, আমরা ছিলাম, আমরা তো থাকবই। পরিবারের বাইরেও কিন্তু তখনও কেউ কেউ তোর পাশে ছিল। তোর কি ওদের কথা মনে আছে? আচ্ছা, ওরা কেন ছিল? কোন স্বার্থে? তুই কী দিতে পারতিস তাদেরকে? কিছুই না। তোর কী ছিল তখন? ওরা তো শুধু ভেবেছে, ছোটভাইটা কষ্টে আছে, দুটো ভাল কথা বলি, সাহস দিই, একটু পাশে দাঁড়াই। ওইসময়ে আর কে-ই বা তোর সাথে একটু হেসে বলত, “তুইও পারবি!” তোর অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী স্রেফ তোকে পছন্দ করে বলেই তোর পাশে তোর কষ্টের দিনগুলোতে ছিল। প্রতিদানে কিছুই পাবে না জেনেও অকাতরে দিয়ে গেছে। দাদা, এটাকে কী বলে, জানিস? ভালোবাসা বলে। ওরা এই পৃথিবীর কেউ নয়, ওরা অন্য গ্রহের। ওদেরকে তুই তো এখন একটা ফোনও দিস না। আমার ধারণা, ইনবক্সেও হাই হ্যালো করিস না। একটু সামনে গিয়ে কিছু ফুল হাতে সরি বলে দেখ, ওরা সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার বুকে টেনে নেবে। ভালবাসত যে! কিছু সময় নষ্ট হবে, তোর জনপ্রিয়তার ঘোড়াটা দুদিন ছোটা বন্ধ করে বসে থাকবে। কী এসে যায় তাতে? জনপ্রিয়তার চাইতে ভালোবাসার শক্তি বেশি। কে কে ভালবাসল, তোর তো মনেও থাকে না। আচ্ছা, তুই এমন কেন? দাদা, কেউ ভালবাসলে মনে রাখতে হয়; সবকিছু ভুলে যাস, ঠিক আছে, ওইটুকু অন্তত মনে রাখিস। তোকে আরেকটা কথা বলে রাখি। তোকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে যারা, তাদের বেশিরভাগকেই তুই চিনিস না, হয়তো তোর ফ্রেন্ডলিস্টেও নেই, সামনে এসে তোকে তেলায় না, কিন্তু ভালোবাসে, নীরবে নিভৃতে।

ভাবনা: ছয়শো উনত্রিশ

……………………………………………………

আপনি আমার সাথে পরিচিত হতে চান। খুবই ভাল কথা। নতুন বন্ধু বানাতে আমার খুব ভাল লাগে। নতুন বন্ধু মানে, আরো একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, যার কিছু ভাল দিককে আমি সম্মান করতে পারব। মানুষকে সম্মান দিতে ভাল লাগে, সত্যিই লাগে। আমি মানুষকে সম্মান করি, তাঁর অবস্থানকে মূল্য দিই। যাঁরা আমার সাথে পরিচিত হয়েছেন, মিশেছেন, তাঁরা একথা মানবেন বলেই আমার বিশ্বাস। ভিন্ন কোন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলে, সরাসরি বলছি, কমেন্টে লিখুন, আমি কিছুই মনে করব না। আমি আমার নাম্বার দিয়ে দিই। এ নাম্বারটা অনেক পুরোনো। অনেকেই জানে এটা। এটা দিতে আমার কোন সমস্যা নেই, এর মানে এই নয় যে এটাকে আপনি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে যথেচ্ছাচার করবেন। আপনার মত আমারও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। আপনি যেমন কেউ আপনার সাথে বিরক্তিকরভাবে যোগাযোগ করলে বিরক্ত হন, তেমনি আমিও হই। পরিবারের কিংবা বন্ধুদের সবার সাথে বসে ভাত খাওয়ার সময় কেউ আপনার সাথে ১০ মিনিট কথা বলতে চাইলে আপনি কি বলতে পারতেন? আপনি কি উনাকে অনুরোধ করতেন না পরে ফোন করার জন্য? কারোর প্রতি সেই আচরণটাই করা উচিত, যে আচরণটা আমি ওর কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। আমি তো অনেক ঘুরে বেড়াই। কত কত মানুষের সাথে মিশি, ওদের সাথে ঘুরি, ওদের সাথে বসে খাওয়াদাওয়া করি। এতে আমার কোন অসুবিধে হয় না। আপনি যে-ই হন না কেন, আপনার অবস্থান এবং সম্মান আমার কাছে কিছুতেই কম নয়। আমার মনে পড়ে, আমি যখন রাজশাহীতে গিয়েছিলাম, তখন গাড়িতে করে ঘোরাফেরা করার সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার এক সিনিয়র বন্ধুর জন্য প্রায় ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলাম যে কিনা নিরক্ষর ছিল, পেশায় দর্জি এবং ভালভাবে কথাও বলতে জানত না। তবে ওর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, ও ভালবাসতে জানত। ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ঢাকায় আরেক বন্ধুর মাধ্যমে। তখন থেকেই ও আমাকে প্রায়ই ফোন করে, আমার খবরাখবর নেয়। কেন নেয়, আমি জানি না। ও আমাকে ভালমানুষ ভাবে, বড়মানুষ ভাবে। বড়ই সাংঘাতিক এই ভাবনা। কেউ আপনাকে বড় ভাবলে এর বিপদ এই যে, আপনি কিছুতেই ওর সামনে ছোটকাজ করতে পারবেন না। ছোটলোক হতে না পারারও যন্ত্রণা আছে। মাঝে মাঝে তো ছোটলোক হতেও ইচ্ছে করে। আমি সবার মতোই ভালোবাসার কাঙাল। কেউ শুধু ভালোবাসা দিলে আমি ওর জন্য জীবনও দিতে পারি। আমি চাই না, কেউ শুধু ওর স্বার্থ হাসিল করার জন্য আমাকে ফোন দিক। ফোন দিলে আমি মানুষটা ভাল আছি কিনা, এইটুকু অন্তত জিজ্ঞেস করুক। আমার একটা কথাও যদি ওকে কখনো একটুখানিও সুখের খোঁজ দেয়, ওইটুকু অন্তত বলুক। কারোর একটু উপকার যদি করে থাকি, ওটার জন্য একটা অন্তত শুকনো ধন্যবাদ দিক। ……. ভাবছেন, খুব সস্তা মাহাত্ম্যবর্জিত কথা বলছি, না? আচ্ছা, এরকম সস্তা না কে, বলুন তো? অনেকেই বলে না, মহৎ সাজে; আর আমি বলে দিই, ওসব মহৎটহৎ সাজতে আমার ভাল লাগে না। এইতো! হিপোক্রিসি সহ্য করতে পারি না। মনে যা আছে, বলে দিই। হিপোক্রিটদেরকেও সহ্য করতে পারি না, একটুও না! আমি শয়তান, বদমাশ, হারামজাদা? খুব ভাল কথা। দয়া করে আমাকে ওভাবেই চিনুন, ভিন্নভাবে নয়। আমি অস্বস্তিবোধ থেকে বেঁচে যাবো।

প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫-২০ ঘণ্টা আমাকে কিছু মন-খারাপ-করে-থাকা মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, যাঁরা বিশ্বাস করেন, আমার সাথে কথা বললে উনারা শান্তি পাবেন। কেউ যখন খুব কষ্টে থাকে, মন খারাপ করে থাকে, তখন তাকে দুটো ভাল কথা বলে দেখেছেন কখনো? জানি, বলতে ইচ্ছে হয়নি, কিংবা সময়ই হয়নি, কিংবা এটা ভেবেছেন, ও আমার কে হয় যে ওর জন্য সময় দিতে যাবো? ইনবক্সে আর মেইলে আমাকে প্রায়ই অসংখ্য কথা লিখতে হয় কারোর মন ভাল করে দিতে, ওকে একটু বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে দিতে। ক্যারিয়ার আড্ডাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি, ফেসবুকে ওদের জন্য লিখি। অনেকেই দেখা করে কথা বলতে চায়, ওদের মনের যন্ত্রণার কথা শেয়ার করতে চায়, আমার কাছ থেকে দুটো ভাল কথা শুনতে চায়। সত্যি বলছি, অনেক কষ্ট হয় এসব করতে। আপনার প্রতিদিনের ব্যস্ত সময়ের কিছুটা কাউকে দিয়ে দিন না একেবারে নিঃস্বার্থভাবে! কেমন লাগে দেখুন তো! আপনার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা ছাড়া আর কোন হারিয়ে যাওয়া মানুষকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখেছেন কখনো? কত কত লেখাই তো লেখেন। দুলাইন লিখুন না ওদের জন্য! আল্লাহ্‌ তো আপনাকে অনেক দিয়েছেন। এই উপহারের কিছুটা দিন না বিলিয়ে! আপনার যা প্রাপ্য, এর চাইতে বেশিই তো পেয়েছেন। কেন পেয়েছেন, ভেবে দেখেছেন কখনো? আপনার বেঁচে থাকতে কতটুকুই বা লাগবে? অন্যরাও একটু বাঁচুক। বেঁচে থাকার একটু বুদ্ধি শিখিয়ে দিন না ওদেরকে! আমারও অফিস করতে হয়, বাসায় সময় দিতে হয়, বই পড়তে হয়, মুভি দেখতে হয়, গান শুনতে হয়, ঘোরাঘুরি করতে হয়, লিখতে হয়। আপনারই মত আরকি! এর বাইরে ওই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজগুলো করি। কেন করি? আমি যে জানি মন খারাপ করে থাকতে কতটা খারাপ লাগে, পৃথিবীর সব কষ্টেরা যখন মাথায় ভর করে, তখন রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটানোটা কত কঠিন! ওরা ধরেই নেয়, আমার কথায় ওরা একটু ভাললাগার খোঁজ পাবে। আপনিই বলুন, সে মুহূর্তে শরীরে যত ক্লান্তিই থাক, সেটা ভুলে থেকে কথা বলতে হয় না? মন খারাপ করে থাকা মানুষকে ফিরিয়ে দেয়া যায় নাকি? এরপর আপনার অমার্জিত ব্যবহারে একটু রাগও করতে পারব না? এও কি হয়!

আমার নাম্বার আপনার কাছে আছে। পরিচিত হতে আপনি কল দিলেন। কোথায় কল দিলেন? ভাইবারে; যেখানে কথা বলার সময় কথা আসে থেমে থেমে, কথা বলতে বিরক্ত লাগে, এবং কথা বলতে কোনো পয়সা লাগে না। এমন নয় যে, মোবাইলে নেটওয়ার্ক প্রবলেম কিংবা আপনি দেশের বাইরে। তবুও আপনি পরিচিত হতে চাচ্ছেন এমন কাউকে প্রথম কলটা দিলেন ভাইবারে। অথবা, দিয়েই বসলেন ইমোতে একটা ভিডিও কল! আপনিই বলেন, এর মানেটা কী? আমি বারবার কেটে দিচ্ছি, এতেও আপনার আক্কেলে কুলাচ্ছে না, এটা বুঝতে যে আমি ব্যস্ত আছি কিংবা মহাবিরক্ত হচ্ছি, আপনি দিয়েই যাচ্ছেন দিয়েই যাচ্ছেন! হোয়াটসঅ্যাপে আপনি প্রথমবারের মত নক করেই পাঠালেন একটা সেলফি কিংবা আমার কেয়ার করার কোন কারণই নেই কিন্তু আপনি কেয়ার করেন এমন কিছু একটা! আমি কেন ওটা পছন্দ করবই? আমার জায়গায় আপনি হলে আপনি করতেন? ভাই, আপনার লজ্জাও করে না? নাকি, কমনসেন্স একটু কম আছে বলে ওইটুকুও খরচ করে ফেলতে চান না? প্রয়োজন হলে আমাকে টেক্সট পাঠিয়ে বলুন যে আপনি রাস্তার ফকির, মোবাইলে রেগুলার কল করার পয়সা নেই; কথা দিচ্ছি, কলটা আমি দেবো। দোহাই লাগে, তবুও এভাবে করে বিরক্ত করবেন না। কারোর সাথে পরিচিত হওয়ার একটা কার্টেসি আছে। এটা মেনে চললে আপনার জন্যও সুবিধে, আমার জন্যও সুবিধে। আমি আপনার তালত ভাই, ইয়ারি দোস্ত, কিংবা ন্যাংটাকালের বন্ধু না। আপনি আমাকে ভিডিও কল দেন কোন আক্কেলে? আপনাকে কেউ প্রথম কলটা ভিডিও কল দিলে আপনার মেজাজ খারাপ হতো না? কোন ছেলেকে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে দেখে নেটওয়ার্কে গল্প করার ব্যাপারে আমি কোনদিনও বিন্দুমাত্রও আগ্রহবোধ করিনি। কিছু কিছু লোক এত বেয়াক্কেল কেন? কিছু কিছু লোক কেন অপেক্ষা করেই থাকে কখন তাকে ব্লক করে দেয়া হবে? কেউ কেউ পরিচিত হওয়ার জন্য প্রথম ফোনটাই করে রাত ১২টার পরে। এর মানে কী? বলি, ভাই, একটু বুদ্ধি খরচ করলে কী হয়? আরো বলে, “ভাই, আপনি তো জেগেই আছেন, কথা বলতে প্রবলেম কী?” খুব বলতে ইচ্ছে করে, “আমার প্রবলেম কী, এর কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে নাকি? আপনি কে? আপনাকে তো চিনিই না! আপনি কেন ভেবে নিলেন যে এই রাত ১২টার পর আপনার সাথে গল্প করতে আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি? তাও আবার প্রথম পরিচয়ের গল্প?” ছেলেতে ছেলেতে মধ্যরাতের ফোনালাপ আমার আগ্রহের বিষয় নয়। সরি!

অপরিচিত (কিংবা, হয়তো পরিচিত) কেউ কেউ আননৌন নাম্বার থেকে ফোন করে, এরপর কিছুই না বলে চুপ করে থাকে। সমস্যাটা কী ভাই? আপনি যা বলার বলতে পারেন না? সাহস নাই? সাহস না থাকলে ফোন দিলেন কেন? মানুষের কাজ নাই? দরকার হলে গালাগালি করুন; ইচ্ছে হলে, আই লাভ ইউ বলে ফেলুন, কোন সমস্যা নাই। সত্যি বলছি, কোন সমস্যা নাই। আমারও কি আই লাভ ইউ শুনতে ইচ্ছে করে না? তবুও ফোন করে চুপ করে থাকবেন না। প্লিজ! ভীতুর ডিম টাইপের লোকজনকে আমি দুচোখে দেখতে পারি না। তাছাড়া খুব ব্যস্ত থাকি তো! তাই বিরক্ত লাগে; কত আর নাম্বার ব্লক করা যায়! আর ফ্রি থাকলেও আপনাকে চিনি না জানি না, আপনাকে সময় দেবো কেন? কায়দা করে চিনে চিনে প্রেমে পড়ার বয়স পার করে এসেছি তো! এখন আর সেই কিশোরবয়সের কৌতূহল, সময় কিংবা ধৈর্য্য কোনটাই নেই। একেবারে অপরিচিত কোন মানুষের প্রতি অনুরাগ কিংবা বিরাগ এমন কোন বোধই আমার কাজ করে না। বরং কেউ অহেতুক পেইন দিলে যা জন্মে তা হল প্রচণ্ড বিরক্তি! মাঝে মাঝে দেখি, কিছু কিছু মানুষ এখনো মিসড কল দেয়। কলরেট অনেক কমেছে না? এখন কি আর মিনিটে ৭ টাকা নাকি? নাম্বার চিনি না, এমন নাম্বার থেকে মিসড কল। মেজাজটা কেমন খারাপ হয় বলুন তো? সমস্যাটা কী ভাই? আমি গালাগালি করতে পারি না, এইটা?

দুদিন আগে আমার সিলেটে আসার খবর শুনে অপরিচিত একজন শুভাকাঙ্ক্ষিণী(!) আমাকে একটা টেক্সট পাঠালেন। কী ছিল ওতে? টেক্সটলেখিকা আমাকে সিলেটে আসার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। (কোনরকমের কুশল জিজ্ঞেস করেননি।) পরের কথাটাই হল, “এবারের ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষা ভয়াবহ বাজে দিয়েছি। আপনি সিলেটে এসেছেন, এতে আমি অনেক খুশি, আপনার কাছ থেকে ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার পরামর্শ নেয়া যাবে। আপনি আমাকে ডিটেইলস বলবেন, কীভাবে করে প্রিপারেশন নেবো।” আমি মেসেজ পড়ে অতিবিরক্ত হলাম। কী রে ভাই, আমাকে মানুষ মনে হয় না? শুধুই ক্যাডার মনে হয়? আমি কি আপনাকে হেল্প করতে বাধ্য? নাকি, আপনাকে হেল্প করতেই দৌড়াতে দৌড়াতে সিলেটে ছুটে এসেছি? এভাবে কেউ হেল্প চায়? আরেক টাইপের পাবলিক ফোন করেই প্রথম কথাটাই বলে, “ভাইয়া, আমাকে অমুক ব্যাপারে ডিসিশন নিতে হেল্প করুন।” আমি ব্যস্ত আছি কিনা, ওকে ওই মুহূর্তে দেয়ার মত যথেষ্ট সময় আমার হাতে আছে কিনা, আমি ওই সময়ে বন্ধুদের আড্ডার মাঝে আছি কিনা, ওর এসব নিয়ে ভাববার দরকার নেই। উল্টো আমি বিনীতভাবে পরে ফোন করতে বললে রাগও দেখায়! অদ্ভুত কিসিমের চিড়িয়া!! অনার্স পাস করেছেন, এখনো ম্যানারস জানেন না! আমি চাই, এরকম বলদমার্কা পোলাপান সিভিল সার্ভিসে না আসুক! এদেরকে দেখে পাবলিক ভাবে, সিভিল সার্ভেন্টমাত্রই ‘খ্যাত্’!

ছোটবেলায় একটা ভুল কথা পড়েছিলামঃ গরু আমাদের দুধ দেয়। (আজব! গরু দুধ দিতে যাবে কোন দুঃখে? গরুর কি খেয়েদেয়ে কাজের অভাব পড়েছে?) সত্যিটা হলঃ আমরা কায়দা করে গরুকে দিয়ে দুধ দেওয়াই।

ভাবনা: ছয়শো ত্রিশ

……………………………………………………

“বাবা, তুই চুল কাটাসনি কেন? চুল তো বড় হয়ে গেছে।”

গত পরশু বিকেলে সিলেট থেকে ফিরে ক্যারিয়ার আড্ডায় যাওয়ার আগে বাবাকে দেখতে কিছুক্ষণের জন্য বাসায় এলে বাবা প্রথমেই এ কথাটা বললেন। বাবা এখন আগের মত কথা বলতে পারেন না। খুব আস্তে আস্তে একটু একটু কথা বলেন। বাবা অবশ্য বরাবরই স্বল্পভাষী। স্ট্রোক করার পর এখন কথা আটকে যায়, কথা একটার সাথে আরেকটা মিশিয়ে ফেলেন। পারতপক্ষে তেমন কোন কথাই বলেন না। আমি যখন দূরে ছিলাম, তখন মা বলতেন, “তুই ফোনে তোর বাবার সাথে কথা বল। তোর সাথে কথা বললে উনি একটু খুশি থাকেন মনে হয়।” আমাকে দেখে তো বাবা মহাখুশি! মা’কে বললেন, “মম, বাপ্পিকে কিছু খেতে দাও। ওর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে।” মা চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, “গত দেড় সপ্তাহে স্ট্রোকের পর তোর বাবা এ প্রথম আমাকে নাম ধরে ডাকল।” বাবা নিজে অসুস্থ, সেদিকে খেয়াল নেই। আমি যখন বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বাবা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করছিলাম, তখন বাবা খুব ক্ষীণ কণ্ঠে আমার খবর জানতে চাইছেন। আমি কোথায় থাকি, কী খাই, অফিসে যাই কিনা, খুলনাতে কবে জয়েন করতে হবে, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, আরো কত কী! মুখে সেই পুরনো পরিচিত হাসি। বাবার মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। কখনো রাগেন না। বাবার সাথে ঠাট্টা করলেও রাগেন না, হেসে তাকিয়ে থাকেন, কখনো কখনো লাজুক ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে রাখেন।

ইদানীং বাবাকে আমরা ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করি, “বাবা, কী দিয়ে খেয়েছ? তোমাকে কে কে দেখতে এসেছিল যেন? টিভিতে কী চলছে এখন?” এসবকিছু এবং আরোকিছু। বাবা একটুআগে কী দিয়ে খেলেন ঠিক মনে করতে পারেন না। কে কে দেখতে এল, ভুলে যান। বাবাকে মনে করানোর জন্যই আমরা এটা করছি ইদানীং। এছাড়া কিছু মজাও করি। গতকালকের কথা। মা খাওয়ার টেবিলে বলছিলেন, “আমরা বাপ্পিকে বিয়ে করাবো তো! আমাদের ঘর আলো করে তোমার বউমা আসবে। আমরা একসাথে ঘুরতে যাবো। অনেক মজা হবে।” বাবা, কিছুই বলেন না, মাথা নিচু করে হাসেন শুধু। আমি বললাম, “বাবা, কী বল? বিয়ে করে ফেলব?” বাবা একটুকরে চোখ তুলে বললেন, “হ্যাঁ।” আমি বললাম, “কিন্তু বাবা, সুন্দর মেয়ে তো পাচ্ছি না। সুন্দর মেয়েরা সব প্রেম করে বেড়াচ্ছে। সুন্দর মেয়ে ছাড়া বিয়ে করে কী লাভ, বল! বাবা, তুমি ৩৩ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে না? আমিও ঠিক একই কাজ করব। বাচ্চা বয়সে বিয়ে করা তো ভাল না। সে হিসেবে আমার হাতে এখনো সময় আছে ৩ বছর। একটু অপেক্ষা করলে সুন্দর মেয়ে পাব। এই যে তুমি অপেক্ষা করে সুন্দর আর ভাল একটা মেয়েকে বিয়ে করেছ না? ওরকম।” বাবা সে কী ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলেন! আমি বললাম, “কী বাবা? মা সুন্দর না?” বাবা লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, তোর মা এখনো অনেক সুন্দর।” মার চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পাপ্পুর চোখে হাসির আভা। বেচারা খুব কষ্টে পড়ে গেছে। বাসায় বাজার করা, রান্না করা, মাকে সব কাজে হেল্প করা, বাবা-মা’র ওষুধ কিনে আনা, বাসার সব টুকিটাকি কাজ, নিজের পড়াশোনা, সবকিছুই ওকে করতে হচ্ছে। বাবা সুস্থ থাকতে আমাদের দুই ভাইকে কোনোদিন বাজার করতে হয়নি। খুব কষ্ট হতো, তবুও নিজহাতে সবকিছু করতেন। মা একটু অসুস্থ, তাই বাসায় এসে মাকে ঘরের সবকাজে হেল্প করতেন। বাবাকে কোনদিনও নিজের কোন কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করাতে দেখিনি। এসব কাজ এখন পাপ্পু করে। জীবিকার প্রয়োজনে আমি তো বাসায় থাকতে পারি না। ও-ই সব করে। বেচারার উপর সত্যিই খুব ধকল যাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। এরপরেও ওর সবসময়ই হাসিমুখ। এটা বাবার শিক্ষা। ভাল কথা, পাপ্পু বেশ ভাল রাঁধতে জানে! আজকে মা দুষ্টুমি করে বলছিলেন, তোর বৌভাতের সময় পাপ্পু আর বউমাকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দেবো।

মা-বাবা’র ধারণা, ওরা আমার বউ দেখে যেতে পারবে না। এটা নিয়েই যত টেনশন। আমাদের পরিবারে টেনশন করার মত একেবারে কিছুই নেই। অসম্ভব রকমের সুখী শান্তিপূর্ণ ছিমছাম আদর্শ পরিবার। এই যে বাবা-মা এত টেনশন করেন, এটাকে আমার বিলাসিতা মনে হয়। টেনশন করার সত্যিই কিছু নেই। কিন্তু এরপরেও কথা থাকে। বয়স হলে সব বাবা-মা’ই বোধহয় ছেলেবউ দেখতে চায়। কিন্তু ওদেরকে কীভাবে বোঝাবো যে বিয়েটা তো আর বিসিএস পরীক্ষা কিংবা আইবিএ’র ভর্তি পরীক্ষা নয় যে দিলাম আর ফার্স্ট হয়ে গেলাম। বিয়ে করা বড় কঠিন কাজ! যদি বলা হয়, বিয়ের পরীক্ষা দেবে নাকি আরো ১০বার বিসিএস পরীক্ষা দেবে, আমি সেকেন্ডটাকেই বেছে নেবো। বাবা-মা’কে মজা করে এসব বলছিলাম আর অমনিই পাপ্পু বলে উঠল, “মা, দাদাকে এসব বলে লাভ নেই। আমরা একটা বউদি এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। আর কোন অপশন নেই।” এর মধ্যে আরো একটা মহাসমস্যা যুক্ত হয়েছে। আমাদের কাজের মেয়েটা চলে গেছে, ওর বিয়ে হয়ে যাবে। আধুনিক মানুষের সময় বড় কঠিন সময়। বউ ছাড়াও চলে, কিন্তু বুয়া ছাড়া? কিছুতেই না! যার বাসায় বউ আছে, বুয়া আছে, সে বড় সুখী মানুষ। তার উপর মা অসুস্থ। হন্যে হয়ে বুয়া খুঁজছি, পাচ্ছি না। বিশ্বস্ত কাজের মানুষ পাওয়া খুব কঠিন। পাপ্পুকেই সব রকমের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। একেবারেই ছোট্টো একটা পরিবার, কিন্তু মা অনেক কাজ কীভাবে কীভাবে যেন খুঁজে বের করেন। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে রাখার চেষ্টা করেন। বাসায় বুকশেলফ ২৪টা, মা প্রায়ই ওগুলোর গ্লাস মোছেন আর আমার কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়তে থাকে। ভালকিছু রান্না করলে আমার কথা ভাবেন আর ফোন করে বলেন, “বাবা, খাওয়াদাওয়া করছিস তো ঠিকমতো? তুই বাসায় কবে আসবি?” বাবা আগে বলতেন, এখন আর তেমন কিছুই বলেন না, এখন বাবার বলতে মনে থাকে কম। সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন। “বাবা, কী খাবে? কী খেতে ইচ্ছে করছে?” এটা জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আমার এখন আর কিছুই ইচ্ছে করে না।” ডান হাত আর ডান পায়ে জোর একটু কমে গেছে। তবে আমি বাসায় আসার পর থেকে একটু হাসিখুশি আছেন। ভাবি, “আহা! বাসায় থেকে যেতে পারতাম!” বাবা একেবারে ছেলেমানুষের মত হয়ে গেছেন। যে যা কিছুই বলুক, শুধু হাসেন। একটুআগে কী দিয়ে খেয়েছেন, খুব একটা মনে করতে পারেন না। ছোট্টো শিশুর মতন করে কথা বলেন, নড়াচড়া করেন। বাবার কোনকালেই কারোর প্রতি কোন অভিযোগ কিংবা কারোর কাছে কোন আবদার ছিল না। এ ব্যাপারটি এখন আরো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কাউকে কিছুই বলেন না। প্রায়ই ঘুমিয়ে থাকেন। টিভি দেখলে টিভি দেখতেই থাকেন, আর হাসেন।

বাবা পেশায় আইনজীবী, অনেক বিষয়ে অনেকবেশি পড়াশোনা করেন, পড়াশোনার অভ্যেসটা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবাকে প্রচুর লিখতে হয়। বাবাকে পড়াশোনা কিংবা লেখালেখি ছাড়া কখনোই দেখিনি। এখন উনি পড়তে পারেন না অতটা, লিখতে গেলে অক্ষর মনে আসে না, কিছুক্ষণ লেখার পর মাথা কেমন যেন ধরে আসে। খুব কষ্ট হয় দেখলে। বাবাকে দেখতে আমাদের আত্মীয়স্বজন আর কলিগরা বাসায় আসছেন। বাবা ছিলেন পুরোপুরি আদর্শ সাদা মনের ভালমানুষ, কারোর কোনোদিন ক্ষতি করেননি, মানুষের মঙ্গলকামনা করেছেন, কাউকে কোনদিনও ঠকাননি, খুব সহজভাবে জীবনযাপন করেছেন সবসময়ই। (বাবাকে নিয়ে আমি আগেও অনেককিছু লিখেছি। সেসব লেখা জড়ো করা নেই। সেগুলোকে জড়ো করে আবারও লিখব, দেখি।) বাবা কখনো কারোর সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন, কিংবা রাগ করেছেন, কিংবা কাউকে কোনোদিন অসম্মান করে কথা বলেছেন, কিংবা কারোর সম্পর্কে গীবত করেছেন, এমনটা কখনোই ঘটেনি। অসংখ্য অসহায় লোকের মামলা চালিয়ে নিয়েছেন, বিনে পয়সায় কিংবা কম পয়সায়। কেউ পয়সা নেই, গরীব, এসব কথা বললে বাবা খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন। আমাদেরকে বলতেন, “বাবা, মানুষ নিতান্ত অসহায় না হলে সারেন্ডার করে না। এ পৃথিবীতে তুই যা দিবি, তার চাইতে বহুগুণে ফেরত পাবি। এটাই নিয়ম।” এসব শুনলে তখন ভীষণ রাগ হতো, বাবাকে বিরক্ত লাগত। এখন বুঝি, বাবার জীবনদর্শনই সঠিক। প্রায়ই বলেন, “সবসময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করবি। মানুষের ক্ষতি করার সুযোগ দিনে ১০০টা পাবি, কিন্তু উপকার করার সৌভাগ্য হয়তো ১০০ দিনেও ১টা আসবে না।” বাবা-মা’কে ছোটবেলা থেকেই দেখছি, নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করতে, সুবুদ্ধি দিতে। আমি জানি, বাবা অনেক অনেক মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে আছেন। অনেককেই বলতে শুনেছি, “তোমার বাবা জীবনে কোনদিনই কষ্ট পাননি, কোনোদিন পাবেনও না।” সত্যিই আমরা অনেক ভাল আছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। মানুষের ভালোবাসার শক্তি অনেক অনেকবেশি। জীবনে এটা পেলে আর কিছু লাগে না। কলিগরা বাবাকে দেখতে এসে আবেগে কেঁদে ফেলেন। আমাকে, পাপ্পুকে আর মাকে বলেন, “উনার মতন ভালোমানুষের সান্নিধ্য পেতে ভাগ্য লাগে। খুব ভালোমনের সহজ একজন মানুষ। অনেক মামলা ফিরিয়ে দিয়েছেন, যেগুলোতে উনি লড়লে কারোর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এমনটা দেখা যায় না, বাবা।” এসব শুনলে মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন নেমে এসেছে আমাদের ঘরে। একজন মানুষের জীবনে এর চাইতে বড় সাফল্য আর কী-ই বা হতে পারে? পরিবারের আর সমাজের সামনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারাটা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।

বাবার স্ট্রোক ধরা পড়ে ৭ এপ্রিল। মা আর পাপ্পু দেখে, বাবা শুধু ঘুমিয়ে থাকছেন, কথা বলতে পারছেন না, কোন কাজই নিজে করতে পারছেন না। মা আর পাপ্পু ভাবল, বাবার বুঝি প্রেশার বেড়ে গেছে। সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। উনি বললেন, তখুনি ক্লিনিকে ভর্তি করাতে। পরে চেকআপে দেখা গেল, মাইল্ড স্ট্রোক। ডাক্তারের ধারণা, বাবার স্ট্রোক হয়েছে ৬ এপ্রিল। বাবা সবসময়ই রোগ লুকিয়ে রাখেন। কখনোই কাউকে কিছু বলেন না, এমনকি মাকেও না। খুবই ভীতু স্বভাবের মানুষ, ডাক্তারকে খুব ভয় করেন। পারতপক্ষে কখনোই ডাক্তারের কাছে যান না। এমনকি জোর করেও নিয়ে যাওয়া যায় না। আগেরদিন শরীর খারাপ লাগছিল কিন্তু বাসার সবাইকে বলছিলেন, প্রেশারটা একটু বেড়ে গেছে, আর কিছু না। এমনকি কোর্টেও গেছেন, কাজ করেছেন। তখন সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারলে ব্রেইনে আঘাত পেতেন একেবারেই অল্প। এখন ভাবি, বাসায় একজন ডাক্তার থাকলে বড় ভাল হতো। বাবা এখন আগের চাইতে কিছুটা ভাল। তবে এখনো কোর্টে যাওয়ার মত ভাল হননি। বাবা বড্ডো কাজপাগল মানুষ, বাসায় বসে থাকাটা বাবার জন্য সহজ নয়। বাসায় সবাই বাবাকে দেখতে আসছে। কাউকে দেখলে বাবা কী যে শান্তভাবে হাসেন! সে হাসির তুলনা হয় না। সে হাসির জন্য সবকিছু করা যায়। গতকাল দেখলাম বাবার পা থেকে কিছু জায়গা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বাবা বলছেন, “আমাকে পিঁপড়া কামড় দিয়েছে। তেমন কিছু না।” অথচ সেরকম কোনকিছুই নয়। বাবা চাইছেন, বাবাকে নিয়ে যাতে আমরা কোন দুশ্চিন্তাই না করি। ডাক্তারের সাথে পাপ্পু ফোনে কথা বলল। ডাক্তারের ধারণা, ডায়বেটিস থেকে এ ব্যাপারটা ঘটে থাকতে পারে, ওসব জায়গায় আপাতত ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রাখতে। আজকে সন্ধ্যায় আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। উনার নাম এহসানুল করিম, মেডিসিন স্পেশালিস্ট। বড্ড ভালমানুষ, হাসিখুশি। আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার বলা চলে। উনার সাথে কথা বললে রোগী অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে। আরো একজন ডাক্তার দেখাচ্ছি। হাসানুজ্জামান, নিউরোমেডিসিন স্পেশালিস্ট। আজকে উনার কাছেও যাবো। কথা বলব, দেশের বাইরে নিতে হলে সেটাই করব। একটুআগে মা বললেন, বাবা বোধহয় আরোকিছু সমস্যা লুকিয়ে রাখছেন। কাউকেই বলছেন না উনার ভেতরে কী ঘটছে। আমাদের না বললে আমরা জানব কী করে? উফফ! বাবাটা এমন কেন? শুধু লুকিয়ে রাখেন! খুব রাগ হয়! বাবার সাথে কথা বলতে বাবার রুমে গেলাম। বাবা রুমে নেই, ব্যালকনিতে। একটা মোড়ায় বসে বসে গ্রীষ্মের এই রাগী দুপুরে নিচের রাস্তা ধরে টুংটাং শব্দ করতে করতে চলে-যাওয়া কিছু সাইকেল আর রিকশার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আনমনে হাসছেন। সে হাসিতে কোন অভিযোগ নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন কোলাহল নেই, কোন ভাবনা নেই, এমনকি কোন রহস্যও নেই। সে হাসি একজন সহজ মানুষের হাসি। চোখে জল এসে গেল, বাবাকে কিছুই না বলে চলে এলাম। এমন মানুষের সাথে রাগ করা যায় নাকি!

শেষকথা। আমি কখনোই আমার কোন ব্যক্তিগত কষ্টের কথা ফেসবুকে লিখি না। এই প্রথমবার লিখলাম; লিখতে খুব ইচ্ছে হল, তাই। বিরক্ত হয়ে থাকলে আমার পাঠকরা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

Content Protection by DMCA.com