ভাবনা: একশো ছিয়াত্তর।
……………………………………..
আহা! একএকটা দিন এরকমও হয়। আজকে যেমন হল।
অফিস শেষে আইবিএ'তে। আজকে ক্লাস ছিল।
আইবিএ'তে যে ক্লাস'টাতে আমরা ঘুমাই না, ঘুম আসে না বলে নয়, ঘুমালে স্যার দাঁড় করিয়ে রাখেন তাই,
আজকে সেই ক্লাসটা ছিল। ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে; ঝুম বৃষ্টি নয়, তবে যতটা বৃষ্টিতে কিছুটা
সময় থাকলে কেমন জানি মাদকতা জাগায়, ততোটা বৃষ্টি। আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
সাথে কেউ ছিল না, সাথের ছাতা ছাড়া। ছাতাটা কী যেন মনে করে বন্ধ করে চিৎকার দিলাম। অ্যাই
রিক্সা, অ্যাই!!
কাছে এলে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনার বাড়ি কই?
একটু হকচকিয়ে রিক্সাওয়ালা বলল, বরিশাল।
আচ্ছা, যান।
আপ্নে কই যাইবেন?
এখনও ঠিক করি নাই, ভাই। আপনি যান।
আমারে ডাক দিলেন ক্যান?
বাড়ি কই, এটা জিজ্ঞেস করার জন্য।
এই নেন, বাদাম খান। (পকেটে এক প্যাকেট বাদাম ছিল।)
ভাইজান, গরিবের লগে মস্করা করলেন? আইচ্ছা, যাই।
কিছু বলার আগেই যেভাবে দ্রুত এসেছিল, সেভাবেই সে চলে গেলো। মন মেজাজ দুটোই খারাপ হল। হায়!
দারিদ্র্য ঠাট্টাও কী নির্মমভাবে কেড়ে নেয়! বাদামের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ধ্যাত! আমি পুরাই একটা
রোম্যান্টিক ফালতু!
ঠিক করলাম, আজকে হেঁটেই হোস্টেলে যাবো। নীলক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটছি। মেজাজ কিছুতেই ঠাণ্ডা হচ্ছে
না। একটা দোকানে ভেন্ডিং মেশিন খেয়াল করলাম। কফি নিলাম। ছাতা খুলে আবার হাঁটতে লাগলাম।
কফির উষ্ণ ধোঁয়া আমার ভেজা ঠোঁটযুগল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বৃষ্টির মাদকতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। চুমুক দিতে-
দিতে মনে হল, এই মুহূর্তে যেটা করতে ইচ্ছে করছে, সেটা ইচ্ছে করার মুহূর্ত এটা নয়। ‘দ্য নোটবুক’
মুভিটার সেই দৃশ্যটার কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম, যতটা ওই মুহূর্তে মনে পড়ছিল, তার চাইতে বেশি।
কোনও কাজই হল না, দৃশ্যটা আরও বেশি করে মনে পড়ছিল যেন। প্রকৃতির সাথে অন্তরঙ্গ সঙ্গমমুহূর্তে
কোনও প্রিয় মানুষের প্রতি দুর্নিবার মনোদৈহিক আকর্ষণে প্রকৃতি সেই নারী কিংবা পুরুষের কাছে যে কতটা
অর্থহীন ম্লান হয়ে ওঠে, সেটা আজকে বুঝলাম। এই হেরে যাওয়াতেই প্রকৃতির জিত। …… একা-একা এই
বেশ থাকা/ আলো নেই কোথাও সব মেঘে ঢাকা/ ছায়া-ছায়া সব আবছায়া/ যাকে খোঁজে মন তার নেই
দেখা/ আনমনে এই একা-একা/ সব মেঘে ঢাকা, সব মেঘে ঢাকা ……… শ্রীকান্তের এই গানটার সহজিয়া
প্যাথোস সারাটা শরীরমন আলতো ছোঁয়ায় জাগিয়ে দিচ্ছিল যখন, তখন যেমনটা সবসময়ই হয়, তেমনভাবেই
কফির ধোঁয়া কফি শেষ হওয়ার আগেই শেষ হল। ছাতা বন্ধ করে আবার হাঁটা। হঠাৎ খেয়াল করলাম,
আমি হাত পা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে হেডফোনে যে গান চলছে সেই গানটা গাইতে-গাইতে হাঁটছি। আমার কাঁধের
ল্যাপটপ ব্যাগে ঘড়ি, মোবাইল, মানিব্যাগ। ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসা তারে কানে এখন বাজছে, যদি মন
কাঁদে, তুমি চলে এসো…….. বৃষ্টিতে কফি এর আগেও খেয়েছি; আগে মানে, অনেকদিন আগে, যখন কফি
কিনতে যে ২০ টাকা লাগে সেটা দিতেও কষ্ট হত। কত সুন্দর ছিল সেই না-পাওয়ার দিনগুলো; এখন ভাবি।
এখন সব পেয়ে সব হারিয়ে বসে আছি। এসব ভাবতে-ভাবতে প্রথম ললিপপটা শেষ হল। হ্যাঁ, এরই এক
ফাঁকে ললিপপ কিনেছিলাম; আরেকটা কিনব। আজকে কী হয়েছে, জানি না। কিছু না পাওয়ার কষ্ট কিংবা
সবকিছু পেয়েছি ভেবে কিছু পাওয়ার আগেই সবকিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট আজকের সন্ধ্যায় পেয়ে বসেছিল
আমাকে। আরও একটা সবুজ ললিপপ। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বৃষ্টিভেজা আইসক্রিম খেতে এত চমৎকার
লাগে, আগে জানা ছিল না। আরও ২টা আইসক্রিম বাপ্পায় মিলিয়ে গেল ……. বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারায়
……….. অপূর্ব! এরপর চলল লতা…….বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি!…….আহা আহা!
কাকভেজা হয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। তখনও কানে বেজে চলেছে …………. আমার নিশীথ রাতের বাদল
ধারা। এসো হে… গোপনে… আমার স্বপনলোকের দিশা হারা ………
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, জীবনে অনেককিছুর চেয়েও বৃষ্টিতে ভেজা কফি আর আইসক্রিম অনেকবেশি দামি। এই
পোস্টটা লেখার সময়ে শ্রী রাধা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনছি, আমার স্বপন কিনতে পারে এমন আমীর কই?
আমার জলছবিতে রঙ মিলাবে এমন আবীর কই? ………… ইসসস!! স্রেফ বেঁচে থাকলেও কতকিছু হয়!
এই গানটা শোনার জন্যেও তো বেঁচে থাকা যায়।
ভাবনা: একশো সাতাত্তর।
……………………………………..
বাসায় রাজ্যের টিকটিকি। এগুলানরে ধইরা কারও মাথায় ছেড়ে দিতে মন চাচ্ছে।
কই আপনি? কী করেন? এত লিখেন ক্যান? যতটুকু লেখা হয়েছে, ততটুকু আমাকে দিয়ে দেন না! আমি
পড়ব তো!
আজব! মানুষটা লিখতে-লিখতে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
জানেন প্রিয়, আপনার অনেক অনেক অনেক কিছুই আমার খুব অপ্রিয়! খুব প্রিয় মানুষের মধ্যে খুব অপ্রিয়
কিছু বিদ্যমান থাকলে…….থাকুক না! ভালই তো! অতটা প্রিয়ত্ব সহ্য করা যায় নাকি? তাই প্রিয়ত্বের সাথে
মিলেমিশে থাকুক অপ্রিয়ত্বগুলোও। মাঝেমাঝে অপ্রিয়ত্বে ভর করে একটু নিঃশ্বাস তো নেওয়া যাবে! প্রিয়ত্বের
বদ্ধ ঘরে প্রায়ই দম আটকে আসে। প্রার্থনা করি, প্রিয়রা ভাল থাকুক। তবে অবশ্যই সেভাবে নয়, যেভাবে
ভাল থাকলে একসময় মিথ্যে ভালথাকাটা বড় নির্মমভাবে শোধ নেয়।
এই যে স্যার! এখনও লেখা শেষ হয় নাই? আমার কাছে কিছু তেলাপোকাও আছে কিন্তু! সেগুলাও লেলিয়ে
দিবো! হুহ্!
লিখেন, বেশি-বেশি লিখেন! লিখলে তবেই না হাতের লেখা বাজে হবে। নাহলে তো বুঝবেনই না কত বিশ্রী
আপনার লেখা! আপনার হাতের লেখা সাত রাজার মল! মানে, টয়লেটের ইয়ে। অবশ্য, এমনও হতে পারে,
আপনার লেখা এক আমি গাধাই বুঝি না!
ইয়ে মানে, লাভক্ষতির লেনদেনের মাঝেই এক সেকেন্ড বিশাআআআল লস করে একটা সেলফি দিয়েই দিন
না! আপনাকে দেখতে মঞ্চায়! মনটাকে ধরে থাপড়াইতে মঞ্চায়!
শিয়রে, স্বচ্ছ জলের বোতলে
পূর্ণতার আদিখ্যেতা।
তবুও, পাশের প্রাণের অস্তিত্বে
পিয়াসের তীক্ষ্ণতা!
আজকে রাতেই যদি ঘুমের মধ্যে মরেটরে যাই, তবে আরেকবার যে আপনার কাছ থেকে সেলফি চাইতে
পারব, সে নিশ্চয়তাও তো নেই। হায়…..মন চায় আপনাকে ধরে…..একটা বোরকা গিফট করি, পরে বসে
থাকেন! ছবিইইইইইই…….!এইইইইই যে ইগোম্যান! শুনছেন……?
ছেলেটা একটু উঁচু, মেয়েটা একটু নিচু। খুব করে জড়িয়ে ধরে, বুকে ভর করে……একটা সিনেমায়
দেখেছিলাম। কী দেখেছিলাম, বলা যাবে না। তবে যা দেখেছিলাম, দেখে ভাল লেগেছিল আর সে রাতে
আমার পাশবালিশকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম।
আচ্ছা, আপনার মাথায় কি উকুন আছে? থাকলে প্লিইইইজ আমাকে দিয়ে দিয়েন। আমার (মাথার) চুল সব
পড়ে যাচ্ছে কিনা, তাই আমার খুব ইচ্ছা, একসময় মাথায় যখন কোনও চুল থাকবে না, তখন শুধু উকুন
থাকুক! কারও মাথায় চুল আছে তবু উকুন নেই, আর আমার মাথায় শুধুই উকুন আছে, আমার মাথা
প্রাণওয়ালা মাথা; অতএব, আমি তাদের চাইতে অধিক সম্মানিত।
হায় রে কী অবস্থা….কী করি এ মাথার ব্যবস্থা! আশেপাশে আয়না আছে, আয়না? কিংবা, একবাটি স্বচ্ছ
পানি?—চুলগুলা একটু গুনে দেখি!
ছোটোবেলায় কাউন্টেবল নাউনের উদাহরণ লিখতে হত, কী লিখতাম, মনে নাই। বড়োবেলায় লিখতে হলে
নিশ্চিতভাবেই লিখতাম: অর্পাস্ হেয়ার্স
আপনার একটা কবিতা পড়ে মেজাজে কষ্ট পাইসি, চুলে ব্যথা পাইসি!
মেয়েদেরকে—কাটলে চুল,
ছেলেদেরকে—রাখলে চুল,
একই লাগে!
এই মেয়ে! বাসতে ভালো, চুল লাগে গো, চুল লাগে!
চুলই যদি থাকল না আর, ঘ্রাণটা তবে থাকল কীসে?
যে গ্রীবা চুলে হয় না আড়াল, সেই গ্রীবায় হারায় সে কোন মাতাল?
চুলই যদি হল হাওয়া, হাওয়াটা আর খেলবে কীসে?
পৌঁছতে পিঠে সরে না চুল, পৌঁছে সেথায় কে করে ভুল?
ঐরাবতের, আর খাটচুলের কান—নগ্ন দুটোই, তাই অসুন্দরের বান!
ওষ্ঠে ওষ্ঠ মিলত কি অত, যদি খেলত না চুল মুঠোয় তত?
খোঁপা হলই না এ জন্মে যার, ছোঁয়াটা ফুলের বলো লাগবে কীসে?
এই মেয়ে! শোনো বলি।
লজ্জা পেলে, নাকের ডগায় ঘামটা জমে।
সত্যি বলছি, দেখব না তো, যদি বেণী না লুটোয় সাপের মত!
সিল্কি বাল ছাড়া সিল্কি ভালোবাসা হয় না, তাই না? হ, আপ্নেরে কইসে!
হায়! চুল ছিল না বলে…….ভালোবাসাটা কি ভুল ছিল! বুঝলে না।
(এক টেকো কিংবা প্রায়টেকোর বিরহ-আর্তনাদ)
আপনার মাথাভর্তি চুলে বালতিভর্তি তেলাপোকার ভাল বাসা হউক!
ভাবনা: একশো আটাত্তর।
……………………………………..
একজন লেখকের কাছে তার জীবনের প্রেয়সীর আবেগের চাইতে তার গল্পের নায়িকার আবেগের দাম অনেক
বেশি। আমি কি আপনার গল্পের নায়িকা হতে পারি, স্যার? কিংবা, সাইড নায়িকা? একটু থাকতে চাই
আপনার মাথায়। দিন না আপনার গল্পে একটা রোল? নেগেটিভ রোল হলেও চলবে। নাহয় আমাকে দিয়ে
আপনার নায়িকাকে চা-ই দেয়ালেন! তবু……..একটু রাখুন না! রাখুন না আপনার গল্পের উপেক্ষিতাটি করে
হলেও!
আমি কি আশা রাখতে পারি যে আমার কোনও বিপদে ধীমানের কাছে সাহায্য চাইলে আমি সেটা পাব?
নাকি যেখানে দাঁড়িয়ে এটা আশা করা যায়, সেখান থেকে আমি অনেকককটা দূরে আছি? আপনি আমাকে
হঠাৎ-হঠাৎ ‘কেমন আছ?’ টেক্সটটা কেন পাঠান? ভাগ্যিস ‘কেমন আছ?’ কথাটা ছিল! এটা না থাকলে
কী পাঠাতেন? একটু ভেবে বলবেন, প্লিজ?
ধী, আপনি ভাল আছেন তো?
আমার উত্তরটা দিই…….এই আছি বেশ, শুরুতেই হোক শেষ। ব্যথাতে আছে সুখ—যদিও তো ভাঙে
বুক………(গানটা শুনেছেন না?)
ভালথাকা কী জিনিস?—পৃথিবীর কঠিনতম প্রশ্ন! ভালথাকার বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত সমস্ত উপকরণ
সার্বক্ষণিক জীবনের সাথে মিশে থাকাটা ভালথাকা নয়। খারাপ থাকার সমস্ত আয়োজন যখন জীবনকে
চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেও ভেতরের আমি’টাকে টলাতে পারে না, সেটাই তো ভালথাকা। এই
ভালথাকাটা আসলে একটা বড় গোলকধাঁধা, যার সমাধান হাজার ক্ষেত্রে হাজার রকম। ভেতরের অদেখাকে
যারা টেনে তুলে কাগজে অনায়াসে আছড়ে ফেলতে পারে, তাদের কলম কাগজের উপর মাইলের পর মাইল
হাঁটতে পারবে এটাকে নিয়ে। হয়তো তবু শেষ হবে না হাঁটা।
“আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।”
উজানতলীর গাঁ আছে।
থাকেই তো!
দেখতে যাওয়ার মানুষ— তাও থাকে হয়তো!
দেখার মানুষ? সেও থাকে।
থাকে না শুধু সে মায়াটান—যে টান টানে উজানতলী!
অর্ধলক্ষ লাইক, দেড়শ শেয়ার, আর আড়াইহাজার কমেন্ট—আপনার ‘সে’-এর বাস্তব জীবনটায় সত্যিই
কোনও প্রয়োজন নেই। আপনি যদি ‘সে’-এর জায়গায় থাকতেন, তবুও একই কথা বলতাম। একটু ভেবে
দেখুন তো, এসব না থাকলে ওর সত্যিই কি কিছু হত? জীবনে এসব ভার্চুয়াল জিনিসে কী হয়? হ্যাঁ,
আপনার গ্রহণযোগ্যতা আছে, মেধা আছে, সামর্থ্য আছে—এটা অবশ্যই আনন্দের, গর্বের। তবে যা সত্যিই
ওর জীবনে প্রয়োজন আর যা না থাকলে বা ক্ষয়ে গেলে, প্রকৃতই জীবনে অনেক কিছু এসে যায়, সেদিকে
মনপ্রাণ দিয়ে খেয়াল রাখবেন। এভাবেই ঘরের আর বাইরের মানুষের ভালোবাসায় অনেকটা দূর এগিয়ে যান।
শুভ কামনা নিরন্তর।
আপনাকে অনেক ফ্রি-ফ্রি উপদেশ দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আপনি তো পাত্তাই দেন না। আমাকে এভাবে
অবহেলা করবেন না, চৌধুরী সাহেব! আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু আমারও একটা স্ট্যাটাস আছে—
ফেসবুকে।
ছন্দরা সব ছন্দ হারায়—ছন্দেরই যে খোঁজে!
আম্মা সমাচার অ্যাগেইন!
“আজকে মনে হয় গরমটা একটু বেশি। এই রুমেই থাকি। খামোখা দুইটা ফ্যান ছেড়ে রেখে লাভ কী?”
আম্মার আমার রুমে থাকার পুরনো বাহানা! বাহানা না, আসলে আমি রাতে কী করি, দেখার ধান্দা। অথচ
যদি আমি বলি, “আম্মা, আপনার সাথে আজকে থাকতে ইচ্ছে করছে।” তাহলেই কী যে নয়ছয় ভেবে
কেঁদেকেটে রাত পার করে দেবে! আম্মা জাতটাই হচ্ছে বদ-জাত! বদ না তো কী? নিজেদের জীবনটাকে
শেষ করে-করে, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে-দিয়ে, সন্তানদের জন্য চিন্তা করতে-করতে—জীবনটাকে একেবারে
প্যারাময় করে তুলে—সন্তানদের, নিজেদের! অত্তো প্যারা নেয়া যায় নাকি?
আম্মার সাথে একরুমে থাকি না দুইটা কারণে:
এক। যদি কখনও ভুলেটুলে কোনও ছাগলকে বিয়েটিয়ে করে ফেলি, তাহলে তো আম্মাকে একা-একাই ঘুমাতে
হবে। তাই আগে থেকেই প্র্যাকটিস চলুক!
দুই। আমার আবার চৈত্রের ভর দুপুরের কটকটে রোদেও মাঝেমাঝে শীতটীত লাগে! প্রায় সবসময়ই আমার
রুমে ফ্যান বন্ধ থাকে, এসির কথা ভাবলেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে! আর আম্মা আমার পুরা উল্টা।
শৈত্যপ্রবাহেও উনার কেমন জানি গরম-গরম লাগে! তীব্র শীতেও আম্মা ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে কম্বল
গায়ে দিয়ে পড়ে থাকেন।
প্রতি মুহূর্তে এই বদ মহিলাটার কথা যতই ভাবি না কেন, আর যতই ভেতরে-ভেতরে ভালোবাসি না কেন,
ওই মহিলাটাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “দুনিয়ায় আপনার একমাত্র শত্রু আর দুনিয়ার একমাত্র পাষাণ
মানুষটার নাম কী?” উনি এক মুহূর্তও না ভেবে আমার নামটাই বলে দিবেন!
আম্মাকথন সমাপ্ত। হ্যাপিনেস ইজ…….এই মধ্য রাতে বইয়ের চিপা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা
পাওয়া!!! কবে রেখেছি, ভুলেই গেছি। মাঝেমাঝে এমন চিপাচাপার খোঁজ মিললে তো ভালই! চিপা থেকে
যদি দারুণ কামাই হয়, তাহলে তো চিপাই ভাল!
ভাবনা: একশো ঊনআশি।
……………………………………..
আপনাকে তুলে আড়াই আছাড় মারতে মন চাচ্ছে! আছাড়টা মেরেই দিব নাকি? কিন্তু তাতেও সমস্যা—
তুললে তো আর ফেলতেও ইচ্ছে করবে না! কী করি!
ওহে বৃদ্ধ বালক, একটি ছবি দিয়েই দেন না, দেখেন না কী হয়! অন্য কোনও কারণ ছাড়া শুধু অলসতার
জন্য যদি না দিতে ইচ্ছে করে থাকে, তবে বলব, ডানহাতটা একবার হাওয়ায় ছুঁড়ে নিজের নাকে একটা
জোরে ঘুষি মেরে অলসতা কাটিয়ে ছবিটা দিয়ে দেন। দেবেন কি জনাব? ওয়েট করছি তো! একটা ভিডিও
কল দিই, মাত্র বিশ সেকেন্ডের জন্য?
আচ্ছা ঠিক আছে, লাগবে না, যান! ইচ্ছার বাইরে যা দেয়া হয়, ওটা তো আসলে দেয়া হয় না। ইচ্ছে
করলেই, যা চাইতে ইচ্ছে করে তা চেয়ে ফেলি। না চাইলে মনে হয় যেন, চাইলে হয়তো পেতেও পারতাম!
ত্যান্দোড় সোন্দর বান্দর অবুঝ মন!
আজকে কী হল, বলি। রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম আম্মুর জন্য খাবার আনতে। অর্ডার করে বসে-বসে অপেক্ষা
করছি, এমন সময় দেখি, পাশের টেবিলে তিনটা অতি পিচ্চি ছেলে বসে খাচ্ছে। ভাবলাম, আশেপাশের কোনও
টেবিলে হয়তো ওদের গার্ডিয়ানরা আছে। একটু পর বুঝতে পারলাম, ওরা একাএকাই এসেছে। কাছে গেলাম।
টেবিলে এত-এত খাবার দেখে আঁতকে উঠলাম! ওই তিনজনের মধ্যে যে ছেলেটাকে সবচেয়ে ভদ্র, ইনোসেন্ট
দেখাচ্ছিল, ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, “বাবু, তোমরা কি একা এসেছ?”
“জ্বি, এখানেই তো আমাদের স্কুল, তাই দুপুরের খাবার খেতে এসেছি।”
আদর করে বললাম, “কোন ক্লাসে পড় তোমরা?”
“ফাইভে।”
(ওদের দেখে থ্রি কিংবা বড়জোর ফোর মনে হচ্ছিল, খেয়াল করলাম, ও ‘ফাইভে’ বলার পর ওর বন্ধুরা
নিজেদের দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে।)
“তোমরা মাকে বলে এসেছ?”
“জ্বি, বলে এসেছি।”
“বাবু, যদি কিছু মনে না কর, আমি কি তোমার আম্মুর ফোন নম্বরটা পেতে পারি?”
(চোখেমুখে স্মার্টনেসের ছাপ ফুটিয়ে) “জ্বি অফ কোর্স! ০১৭১……”
দেখি, ওর সাথে অন্য পিচ্চিরা পকেট থেকে মোবাইল বের করে কী একটা যেন দেখে হাসাহাসি করছে। আমি
সাথে করে মোবাইল নিয়ে যাইনি, তাই একটা কাগজে নম্বরটা টুকে নিয়ে পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলিয়ে
বললাম, “বাবু, তোমরা তো এখনও অনেক ছোটো, এভাবে এখানে একা-একা খেতে এসো না, কেমন?
তাকিয়ে দেখো, তোমাদের মত কেউ এখানে একা-একা খেতে আসেনি। যেদিন বাইরে খেতে ইচ্ছে করবে,
সেদিন বাবা-মা’র সাথে এসো। আর যখন এই আন্টিটার মতো অনেক বড় হয়ে যাবে, সেদিন বন্ধুরা মিলে
খেতে আসবে। ওকে?”
লক্ষ্মী ছেলেটা লক্ষ্মীরসোনার মত কথাগুলো শুনল, কিন্তু বাকি দুইটা ছেলে খুবই রুক্ষভাবে আমার দিকে
তাকাচ্ছিল।
খাবার এসে গেছে। আমি খাবার নিয়ে বাসায় চলে এলাম।
এসে ওই নম্বরে ফোন দিলাম। ছেলেটা যদি ভুল নম্বর দিয়ে থাকে, তবে কোনও এক চ্যাংড়া টাইপ ঢ্যাংড়া
ছেলে হয়তো হ্যালুউউউ বলে আমার কান ফাটায় ফেলবে! মেয়ের নম্বর পেয়ে হয়তো রাতে ফোন করে
ডিস্টার্ব করবে। ইদানিং দেখলাম, আমার হাঁটুর বয়সি ছেলেরাও আমাকে প্রেমিকা ভাবে! ইচ্ছা করে,
থাপড়ায়ে দাঁত ফালায় দিই। নয়তো বা, কোন এক আল্ট্রামডার্ন মা, ইংলিশীয় সুরে আধা বাংলা আধা
ইংলিশে খিচুড়ি পাকাবে—“হামার ছেইলে হামার পেইসায় ঝা ইচ্ছা থা-ই খরিবে। ইট্স নান অব ইয়োর
বিজনেস্!” বলেই খট্ করে ফোনটা কেটে দেবে।—এমনই একটা জুতার বাড়ি খেলেও খেতে পারি,
তেমন প্রিপারেশন নিয়েই ফোনটা দিয়েই দিলাম।
না, সাব্বির (ওই পিচ্চির নাম) ভুল নম্বর দেয়নি। আমি সাব্বিরের আম্মুকে বিস্তারিত বললাম। সব শুনে
উনি আকাশ থেকে পড়লেন! ছেলের এমন কাজে খুবই মর্মাহত হলেন। আমার প্রতি অনেক-অনেক কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করলেন। আমি উনাকে সান্ত্বনা দিলাম। উনার ছেলে যে আমাকে সঠিক নম্বরটা দিয়েছে, এজন্য
সাব্বিরকে ধন্যবাদ জানাতে বললাম এবং পিচ্চিটাকে যেন বকাঝকা না করে যতটা পারেন বুঝিয়ে বলেন,
এটা বলে ফোন রাখলাম।
তারপর ফোন দিলাম ‘ভূতের আড্ডা” রেস্টুরেন্টে। বললাম, “কেবলই টাকার বিনিময়ে খাবার দিয়ে দেয়াটাই
নিশ্চয়ই আপনাদের শেষ কাজ নয়। ন্যূনতম সোশ্যাল কমিটমেন্ট তো থাকা লাগেই, তাই না?” “কী হয়েছে,
ম্যাডাম? আপনি এসব কী বলছেন?” উনাদের বিস্তারিত বললাম। উনারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নেক্সট
টাইমে ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন বলে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলেন। তবে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম,
উনারা জাস্ট ভদ্রতা রক্ষা করেছেন। রেস্টুরেন্টে সদ্যোজাত শিশু এলেও উনারা ঠিকই খাবার সার্ভ করবেন।
বাসায় কারেন্ট চলে গেছে। একা-একা বসে ভাবছি, আমার ক্লাস ফাইভের সময়টার কথা। ঠিক মত কথাও
তো বলতে জানতাম না তখন। একা-একা বাইরে ঘোরাঘুরি করার তো প্রশ্নই আসে না! হায়, আধুনিক হচ্ছি
আমরা! সত্যিই কী উন্নত হচ্ছে দেশ, সমাজ, পরিবার! ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছেলেগুলো যদি একা-একা স্কুলের
পাশের ফাস্টফুডের দোকানে একটা শর্মা কিনেও খেত, তাও একটা কথা। তা নয়, বাচ্চা তিনটা ছেলে
রেস্টুরেন্টে চলে গেল দুপুরের খাবার খেতে! ভাবা যায়! ওদের গার্ডিয়ানরাই বা কেমন! এই বাচ্চা-বাচ্চা
ছেলেগুলোর হাতে স্মার্টফোন দেয়ার কী মানে? পয়সা থাকলেই কি পয়সায় যা পাওয়া যায়, তা কিনে ফেলতে
হবে?
আমার ভেতরের কোথায় যেন…….খুব কষ্ট হচ্ছে। কী একটা যেন মেনে নিতে পারছি না। এরকম আমার
প্রায়ই হয়।
ভাবনা: একশো আশি।
……………………………………..
গাঢ় আলতার রঙ
ধুয়ে যায় বৃষ্টিতে।
বৃষ্টির কী দোষ তাতে?
এই মনটা যার বুঝার
সে-ই বুঝে না—
বৃষ্টির কী দায় এতে?
“অ্যাতো একা-একা থাকা যায়?” যায় হয়তো বা! কিন্তু তা-ই বলে অ্যাতো?
একা থাকতে ভুলে যাচ্ছি ইদানীং—একা থাকতে-থাকতে। অনেকদিন ধরে। সবাই-ই কি ভুলে যায়?
এভাবে? আমার মতই?
পোকা প্রজাপতি পাখি ফুল ঘাস পাতা গাছ বৃষ্টি মেঘ। কিংবা, বই মুভি মিউজিক। একাকি কফির মগ আর
ক্র্যাকার্স। এবং, এইরকম অথবা অন্যরকম অথবা কোনও রকমেরই না, এমন আরও অনেক-অনেক কিছু।
ওদের হাসি পর্যন্ত হিম হয়ে গেছে বোধ হয়। এই সময়ে। অন্তত আমার কাছে।
এতটা মসৃণভাবে প্রতারিত হতে ভাল লাগছে না আর—এত দিন যা হয়ে এসেছি, এবং এখনও হচ্ছি। আর
কত?
“একটা চড়ুই পাখি জীবনকে পাল্টে দিতে পারে।” পারে? সত্যি-সত্যি? তা-ই যদি হয়, তবে শুধু কাজ করে
যাওয়া ছাড়াও অন্য কাজও খুঁজে নেবো। ওই প্রতিশ্রুতিতে। হোক মিথ্যে কিংবা সত্যি। আস্তে-আস্তে। মিথ্যের
সাথে সহবাসে আর বসবাসে অভ্যস্ত হতে হবে দেখছি। উপায় কী?
ইদানীং মাঝেমাঝে এমনও হয়, কফির মগ হাতে নিয়ে লো ভলিউমে ইনস্ট্রুমেন্টাল শুনতে-শুনতে বৃষ্টির সুর
আর ততোটা যেনো সাড়া জাগায় না আগের মতো। বৃষ্টির সুরে ছন্দপতন ঘটে, ভেজা হাওয়াটা মনকে আর
ভেজায় না। বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ কোনও খাবার—এই ব্যাপারটাকেই ভেবে বসি হ্যাকনিড্! ভুনা খিচুড়ি,
ইলিশমাছ ভাজা—এই মেন্যু পর্যন্ত ফেল মারবে, একথা ভেবেছিলো কেউ কোনও দিন? কফির ধোঁয়াটা
উষ্ণতা হারায়; কফি ভালো হয়নি, এমন নয়। নেসক্যাফে। সাথে কফিমেট। আগেও কি খারাপ লাগতো
নাকি? মনে তো পড়ে না! যে গানটার ইনস্ট্রুমেন্টাল বাজছে, সেটা ‘মন্দ নয়, চলে’-টাইপেরও না, খুব-খুব
প্রিয় সুরগুলির একটি। এমন করে রবিবাবুও ফেল মেরে বসে থাকবেন, একথা কি কেউ কখনও ভেবেছিলো?
নতুন কোনও রেসিপিতে তো ইলিশ-খিচুড়ি রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করা হয়নি। গড-গিফটেড শেফও বদলায়নি।
হ্যাঁ, মা-ই তো রেঁধেছে। বদলির চাকরি করেও মায়ের হাতের রান্না খাওয়া—কয়জনের ভাগ্যে জোটে,
বলো? তবুও কেন…..!? এ কী তবে? বিষণ্ণতা-বিলাস? নাকি, বেদনার স্বেচ্ছাবরণ? নাকি, সুখের সঙ্কাশে
দুঃখের সাযুজ্য? শোঁ শোঁ হাওয়ার তোড়ে বৃষ্টির মায়াবী সুর হারিয়েই গেলো নাকি হঠাৎ করে? এমন করে
কি হারিয়েছিল আগেও? সেটাই বা হবে কীভাবে? ঈশ্বর নিজেই তো পিয়ানো বাজাচ্ছেন। এটাও কি হারায়?
নাকি, আমি-ই হারিয়েছি? অনুষঙ্গের অভাব নয়তো আবার?
বাইরে তো না আমি। এমন তো নয়, এক হাঁটু জলকাদা সাঁতরে চলতে-চলতে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারা
নির্দয়ভাবে ধুয়ে দিচ্ছে সকল রোমান্টিকতা! বাসায়ই আছি। এইরকম বৃষ্টিতে বারান্দায় বসে কফির মগের যে
ধোঁয়াটুকু ভেজা ঠোঁটযুগলে কী এক ভীষণ শিহরণ জাগিয়েছে পরম বিশ্বস্ততায় এতোদিন ধরে, সেই পুরোনো
ধোঁয়ার আন্তরিক উষ্ণতা কি তবে হারিয়েই গেলো? কেন হারাল? নাকি, আমি-ই হারিয়েছি ওকে? কফির
সাথে শুধু কফিমেট হলেই হয় না, আরও কিছু লাগে বোধ হয়! কী জানি! মেট শুধু কফিরই হলে আর
চলছে না ইদানীং!
শৈশবে ফিরে যাব প্রয়োজনে। মোহ বড়ো বেশি নিরাপদ। যেমন আছি, ঠিক তেমন থাকাটাকে সহজভাবে
মেনে নেয়া ততটা সহজ নয় কেন? সমুদ্রের ধারে অথবা পাহাড়ের ছায়ায় দুদিন বসে থাকতে আর ইচ্ছে হয়
না কেন? চুপচাপ? ভুলে গিয়ে আশপাশ? শুধু মুগ্ধতার শক্তিতে? খানিকক্ষণ বেঁচে থাকব বলে—এইটুকুই
চাওয়ায়? ব্যস্ . . . . . . . “বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয় না। এ কথার পেছনে আজ একটা জিজ্ঞাসার
চিহ্ন জুড়ে দেওয়ার সময় এসেছে।”
পাদটীকা। উদ্ধরণ চিহ্নের ভেতরের কথাগুলি আমার প্রিয় কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর।
ভাবনা: একশো একাশি।
……………………………………..
ক্লাসে না ঘুমিয়ে যে কয়টা বই এ জীবনে পড়ে ফেলেছি, তার একটা জাফর ইকবাল স্যারের 'শান্তা পরিবার'।
অসম্ভব রকমের মায়াজাগানো একটা বই। বইটা পড়েছি আর বারবারই এটা ভাবতে ভাল লেগেছে, আমিও
এই শান্তা পরিবারের মতো একটা পরিবার চাই। তবে দুটো কথা। এক। শান্তাকে অবশ্যই আমার পাশে
থাকতে হবে। ও মরে গেলে চলবে না। কারণ আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিনই ওকে প্রচণ্ডভাবে
ভালোবাসতে চাই। এমন মেয়েকে ভালো না বেসে থাকাটা আমার জন্য খুব কঠিন। তাছাড়া শান্তা চলে গেলে
ওর বাচ্চাদের আমি কিছুতেই ওরকম করে মানুষ করতে পারব না। দুই। বাচ্চারা সংখ্যায় একটু কম হলেও
আমার কোনও আপত্তি নেই। ৬টাই হতে হবে, এমন নয়। শান্তার মেয়ে শাঁওলী। ভাইবোনদের মধ্যে ও সবার
বড়ো। এই মেয়ে পুরোপুরিই মায়ের কার্বনকপি। ওকেও ভালোবেসে ফেলেছি। ও এত মায়াবী কেন? একটু
বোকাও আছে। মেয়েরা একটু বোকা না হলে ঠিক মানায় না। থাক না একটু বোকাসোকা! কিচ্ছু হবে না।
তবে একটা সমস্যা আছে। এ জন্য আমার খুব রাগ হয়েছে। শাঁওলী টাইপের অপরিসীম মায়াবী মেয়েগুলো
জাহিদ টাইপের ভয়ংকর গুণ্ডামার্কা ছেলেগুলোর কোমল দিকগুলো খুঁজে-খুঁজে বের করে ভালোবাসতে চায়
কেন? মেজাজ খারাপ হয়। "জাহিদ আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। সে যখন হাসে তখন তাকে ভারি সুন্দর
দেখায়। সে জানে না।" এটা বইতে আছে। আশ্চর্য! জাহিদ টাইপের ছেলেদের জন্য এরকম করে লিখতে হবে
কেন? আমরা যারা গুণ্ডামার্কা না, তারা হাসলে কি ভারি অসুন্দর দেখায় নাকি? এসব ভাবলে মনে হয়,
লেখকরা মাথায় ছিটওয়ালা সুন্দরীদের চাইতেও বেশি মাথাখারাপ টাইপের হন। এই শান্তা পরিবারের পিচ্চি
হওয়ার কথা ছিল ৬ জন; শান্তার ইচ্ছে। শান্তার অকালমৃত্যুতে সেটা ৫'য়ে থেমে যায়। এদের মধ্যে সবার
ছোটোটি ঝুমুর। ওর কাজই হচ্ছে পাকা-পাকা কথা বলে সবার আক্কেলগুড়ুম করে দেয়া। এই পিচ্চিটা বেশিই
কিউট। আমিও চাই, আমার ওরকম একটা পিচ্চি হবে। আমি ওই পিচ্চিকে পড়াশোনা শেখাব না, শুধু কিউট
হওয়া শেখাব। এরকম আরও কিছু ভাবনার খেলা আছে এই বইটিতে। এসব লেখা পড়ার সমস্যা অনেক।
আমি এমনিতেই ভাল লেখকদের প্রতি অতি অতি অতিমাত্রায় দুর্বল। ওদের সব অপরাধ আমি অবলীলায়
ক্ষমা করে দিতে পারি। ভাল কোন লেখা পড়ার সময় কেবলই মনে হতে থাকে, "এভাবে করে লেখা আমার
পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।" আমার বন্ধুদের আমার লেখা পড়ানোর শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে না। ভাল লেখকরা
পাঠকদের লেখনির আত্মবিশ্বাসের যজ্ঞে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে দেন।
শান্তার কথা বলছিলাম। ওর জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল, পরিবারকে ভালোবাসা, সন্তানদের আদর করা। ওর
রেজাল্ট অনেক ভাল ছিল, চাইলেই ভার্সিটিতে পড়াতে পারত, মোটা মাইনের চাকরি করতে পারত। ওর কিছু
জীবনদর্শন আমাকে ওর প্রেমে ফেলে দিয়েছে। তবে এমন মেয়ে যে নেই, তা কিছুতেই নয়। আমার এমন
একজন মেয়ের সাথে পরিচয়ও হয়েছিল। একজন মানুষ কতটা সুন্দর করে ভাবতে পারে, ওকে না দেখলে
বুঝতে পারতাম না। প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও ওকে আশ্রয় দিতে পারব না জেনে প্রশ্রয় দিইনি। কেন? যেমন হয়
আরকি! যথারীতি মানুষের চেয়েও বড়ো ঈশ্বরের অমোঘ ইশারায় হৃদয়ের দাবি ধর্মের চোখ রাঙানিতে মুখ
থুবড়ে পড়েছে। Heart proposes, religion disposes.
ভাবনা: একশো বিরাশি।
……………………………………..
শালা হারামজাদা মীরজাফরের বাচ্চা!!
যারা সেদিন নাটক দেখছিল, তাদের ছুঁড়ে-মারা জুতা-স্যান্ডেলের আঘাতে দাদুর নাক-কপাল ফেটে রক্ত
ঝরেছিল৷ নাটকটা শেষ পর্যন্ত আর শেষ করা যায়নি সেদিন৷
দাদু কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে বাংলা পড়াতেন৷ দাদুর আবৃত্তির ঢঙে বাংলা পড়ানোর
তারিফ করতে শুনেছি অনেককেই৷ লেখালেখিও ('ও' যোগ করেছি, কারণ সব অধ্যাপকই তো আর লেখেন
না৷) করতেন মাঝেমাঝে৷ উনার বিশাল জমিদারি ছিল মহেশখালীতে৷ কানুনগোপাড়ায় কোয়ার্টারস্'য়ে
থাকতেন, শখের বশে নাটক করতেন৷ মামার মুখে শুনেছি, অনেক দূর থেকেও লোকজন দাদুর নাটক দেখতে
আসত৷ সেদিনের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে দাদুর অভিনয় দর্শকদের খেপিয়ে তোলে৷ সেদিনের ঘৃণা দাদুর
অভিনয়জীবনে অভিনব নয়৷ দাদু নেগেটিভ রোলে অভিনয় করতে বেশি পছন্দ করতেন৷ মঞ্চনাটকে দর্শকদের
ভালোবাসা সবসময় প্রত্যক্ষ না হলেও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই প্রত্যক্ষ৷ এবং সে প্রকাশের বাহ্যিক তীব্রতা
আর্টিস্টের অভিনয় নৈপুণ্যের উপর নির্ভর করে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘হাচি: অ্যা ডগস্ টেল’ মুভিটা যারা এখনও দেখেননি, তাদের দেখতে বলছি৷
কুকুরই বোধহয় একমাত্র প্রাণী, যে নিজের জীবনের চাইতেও অন্যের জীবনকে বেশি ভালোবাসতে পারে৷
মুভিটা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি৷ মেলোড্রামা ধাঁচের মুভি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখেও আকাশে
আর পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত-হওয়া নীতার আকুতি দেখে মন-খারাপের রেশ কাটতে বেশ সময় লেগেছিল;
মনে আছে৷ অন্তত দিন সাতেক প্রচণ্ড বিষণ্ণতা ঘিরে রেখেছিল।
এরকম আরও কিছু মুভি আছে৷ ‘মরণের পরে’ যারা দেখেছেন, তারা জানেন, এ মুভি দেখে নির্লিপ্ত হয়ে
থাকা যে কী কঠিন! কাঁদতে যে কী সুখ, না কাঁদলে তা বোঝা যায় না৷ ওরা বলে, ইমোশনাল গর্দভ!
বলুক না!
এমন কিছু বই আছে, যেগুলি পড়লে লেখককে খুন করতে ইচ্ছে করে৷
আমি বাস্তবজীবনে বেশিরভাগ সময়ই অনেক কষ্ট যতটা সহ্য করতে পারি, অনেক সুখ ততটা পারি না৷
যখন ফিকশন পড়ি, মুভি দেখি, গান শুনি, তখন ঠিক উল্টোটা ঘটে৷ কল্পনায় বোধহয় খুব বেশি দুঃখী
হওয়া যায় না৷ অথচ, হতে ভালও লাগে কখনও-কখনও৷ আমাকে আক্ষরিক অর্থেই কাঁদিয়েছিল (সত্যি-সত্যি
কেঁদে-বুক-ভাসানো'টাইপ কান্না) এমন একটা বই ‘জাগরী’৷ এই বই একটানা পড়া প্রায় অসম্ভব৷ কয়েক
পাতা পড়ার পর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে৷ চোখের পানি বইয়ের পাতায় পড়লে কেমন জানি ছোপছোপ
দাগ পড়ে যায়৷ দেখলে মেজাজ খারাপ হয়৷ টিস্যুবক্স সামনে নিয়ে বই পড়ার আইডিয়া তো কখনও মাথায়ই
ছিল না৷ অগত্যা কী আর করা! কাঁদতে তো হয়েইছিল৷ সতীনাথ বড়ো নিষ্ঠুর নির্দয় নির্মম লেখক! এ
ভদ্রলোক আগেভাগে মরে গিয়ে সেইদিন আমার হাত থেকে বেঁচে গেছেন৷ স্পষ্ট মনে আছে, মা ঘুমিয়ে পড়লে
তবেই আমি বইটা পড়তাম৷ মা'র সামনে কাঁদলে মা কষ্ট পান৷ মায়ের কষ্টটা কান্নার কারণের চাইতেও বেশি
কষ্ট দেয়৷ তার উপরে ওটা তো আমার একান্ত ব্যক্তিগত ছেলেমানুষি কান্না৷ অনেক দামি ওটা৷ অন্যের
সামনে কাঁদলে কান্নার দাম কমে যায়৷
লেখকরা বড়ো অদ্ভুত জাতের৷ ঈশ্বরের চাইতেও নির্মম, এমনকি ঈশ্বরের চাইতেও দয়ালু হতে পারেন তাঁরা৷
সুনীলের পরামর্শেই ‘জাগরী’ পড়ি৷ আমাকেও কাঁদানোর জন্যে সুনীলকে ধন্যবাদ৷
‘হাজার চুরাশির মা’ পড়ার সময়ও কি চাপা কান্নার সুর বুকে হাহাকার হয়ে মুহুর্মুহু বাজেনি?
ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে৷ আহা আহা! নইলে অমন গান কেউ গাইতে পারে? অমন করে? ঈশ্বর
তাঁকে এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দিন৷ ……… রুমালে চোখ মুছতে-মুছতে যখন অনেকেই এই প্রার্থনা
করছিল, তখন জগন্ময় মিত্রের স্ত্রীর কেমন লাগছিল? ………. ওগো, কেন গাইলে এ গান? আমি তো কত
দূরে যাইনি, তবে অত দরদ দিয়ে কেন গাইলে? কীভাবে?? এই সব কথা স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন
সেদিন? …… খুউব জানতে ইচ্ছে করে …….. মনে তো হয় না, করেছিলেন৷
আমার দাদুর যে কয়েকজন বন্ধু, কলিগ ক্ষিপ্ত দর্শকদের সাথে হাঙ্গামা বাধানোর উপক্রম করছিল, দাদু
অনেক কষ্টে নিজেই তাদের বুঝিয়েশুনিয়ে নিবৃত্ত করেন৷ গ্রেট আর্টিস্টের কারিশমা এখানেই! সবাইকে বিশ্বাস
করিয়েই ছাড়েন, হুবহু ওরকমটাই হচ্ছে!
বন্ধুরা, অনেকদিন হলো, হাউমাউ করে কাঁদি না৷ পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছেন, এমন দুএকটা বইয়ের নাম
সাজেস্ট করুন তো৷ মুভির নামও দিন৷ দেখি, কেঁদে যদি হয় সুখ………