(কোনও একদিন নির্বাচন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বপালন নিয়ে কিছু কথা)
পুলিশ-আনসার’রা এ্যাত্তো ডিউটি করে ক্যামনে?! এই দুই দিনে যে পরিমাণ পেইন খাইসি, খালি ভাবসি,
ওরা তো এ-ই করে দিনের পর দিন! অসীম ধৈর্য আর সহনশীলতা না থাকলে ভাল পুলিশ-আনসার হওয়া
যায় না। ক্যামনে সম্ভব ওই লেভের পেইন নেয়া! হ্যাটস্ অফ টু দেম্!!
ভোটকেন্দ্রটি ছিল চট্টগ্রামের এক হাই স্কুল। পুরা কার্যক্রম আগের দিন সকাল ১১:৩০টায় শুরু হইয়া পরের
দিন ৯:০০টায় শ্যাষ হইসে। রাইতে শুইসি স্কুলের বেঞ্চের উপরে। হারামজাদা মশাগুলার শীতও লাগে না।
দুনিয়ার সবচাইতে নিষ্ঠুর জাতি নারী-মশকজাতি। গানের সুরে-সুরে কামড়ায়। পুরা সেন্টারের সব
রেসপনসিবিলিটি আমার ঘাড়ে। একটু ভুল হইলেই খবর আছে টাইপ অবস্থা! একেকবার মনে হইসে নারিকেল
গাছের আগায় উইঠা কান্দি। (আমি যে সেন্টারের দায়িত্বে ছিলাম, সেখানে সত্যিই নারিকেল গাছ ছিলো।
হিহিহি…….)
আমার সাথে যে পুলিশ অফিসার ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন, সে বেচারা পুরাই নিরীহ লাজুক গোবেচারা
টাইপের মানুষ। কবি-কবি চেহারা, মিষ্টি হেসে কথা বলেন। দেখলেই মনে হয়, কাগজ-কলম ধরায়ে দিলে
এখুনি অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে কবিতা লিখতে শুরু করবেন। ভীতু মজার মানুষ, সারাক্ষণই পান চিবুচ্ছেন। “স্যার,
আমার মনে হয়, এইখানে ওরা বোমাটোমা ফুটাবে না। কী বলেন?” বারবার সাহস দিসি, ভাই, কিসু হবে
না, আমি আছি! উনার দলের অন্যান্য সদস্যরাও বেশ দারুণ। কিছুক্ষণ পরপরই এসে-এসে ইয়া লম্বা-লম্বা
স্যালুট দিচ্ছেন আর বলছেন, “স্যার, কেন্দ্র শান্ত। কোনও অসুবিধা নাই।”
আনসারের এক বোকাসোকা সিপাহি ছিলেন, উনি হাসির নাটকে যে বেকুব-বেকুব টাইপ ক্যারেটার দেখায়
সেই টাইপের অরিজিন্যাল বেকুব। একটু বেশিই সোজা! ভয় যে পাইতে হয়, সেটাও বোঝে না! বেচারা
আমারে কয়, স্যার, শুনসি কোথায় জানি এক প্রিসাইডিং অফিসাররে পিটায়ে মাইরা ফেলসে। খুবই কষ্ট
পাইসি, স্যার। আপনি কোনও টেনশন কইরেন না স্যার, আপনারে কিসু করতে পারবে না, আমরা আছি।
এই দুই দিনে খালি মানুষ স্টাডি করসি। বিচিত্র সব কারণে মানুষ কাজ করে। সবাইকে দিয়ে একইভাবে
কাজ করানো যায় না। কাউকে ফুল দিয়ে কাজ করানো যায়, কাউকে লাঠি দিয়ে কাজ করাতে হয়। যাকে
যে উপায়ে কাজ করানো যায়, তাকে সে উপায়ে কাজ করতে উৎসাহিত বা বাধ্য করার নামই মোটিভেশন।
কেউ-কেউ বকা দিলে কাজ করে, কেউ-কেউ সুন্দর ব্যবহার করলে কাজ করে। যারা বকা না দিলে কাজ
করে না, তাদের সাথে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে কোনও কাজ দিলে, ওরা ধরেই নেয়, কাজটা অতোটা গুরুত্বপূর্ণ
নয়, এটা ধীরেসুস্থে করা যাবে, এমনকি না করলেও কিছু হবে না। এই জাতীয় লোকজনের দায়িত্বে অবহেলার
কারণে নিজেকেই অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বকা শুনতে হয়, বিব্রত হতে হয়, কখনও-কখনও
শাস্তিও পেতে হয়। আবার যারা বকাঝকা করলে মন খারাপ করে ফেলে, একটু ভাল করে কথা বললেই কথা
শোনে, তাদেরকে কোনও কাজ দেয়ার সময় বকার সুরে কাজটা দেয়ার কোনও মানেই হয় না। উচ্চপদস্থ
হলেই বকাঝকার সুরে কথা বলতে হবে, এমন তো কথা নেই। এমন তো নয় যে, অনর্থক বকা দিলে দ্রুত
প্রমোশন হয়। অনেক লোক ব্যক্তিগত কোনও ঝামেলার কারণে সৃষ্ট রাগ ঝাড়তে থাকেন অন্য লোকজনের
উপর। বউয়ের সাথে রাগ করে পৃথিবীর সবাইকেই তার বউ বানিয়ে ফেলেন, আর রাগ ঝাড়েন, এমন
মানুষও দেখেছি। প্রত্যেক অফিসারেরই নিকোলাই গোগোলের ওভারকোট গল্পটা অন্তত একবার হলেও পড়া
উচিত। যার যোগ্যতা যতো অল্প, তার গলার স্বর অহেতুকুই ততো চড়া। পদের দোহাইয়ের উঁচু গলায় কি
আর যোগ্যতার অভাব ঢাকা যায়? অযোগ্য বা অল্প যোগ্য লোক বিনা কারণে গলার স্বর যতো উঁচু করেন,
যোগ্যতা অর্জন করার ইচ্ছে তার ততোই কমে যায়। এই কারণেই কোনওকালেই অফিসাররা কখনওই স্মরণীয়
হননি, হওয়ার সম্ভাবনাও অতো নেই। জ্ঞানের অধিকার পদে নয়, বোধে।
যা-ই হোক, সবকিছু ভালোয়-ভালোয় শেষ। সবাই খুশি, আমিও খুশি। ইলেকশনে কে জিতল, কে হারল, তা
নিয়ে আমার কোনওই মাথাব্যথা বা উৎসাহ নাই, আমার যা কাজ, তা আমি ঠিকভাবে করতে পারসি, আমি
এতেই ব্যাপক খুশি! জেলখানা থেইকা মুক্তি পাওয়ার আনন্দ হইতাসে। …… ফিলিং রিলিভড্!
ভাবনা: একশো।
……………………..
বইয়ের দোকানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের সাথে কাটানো পৃথিবীর সবচাইতে আনন্দের কাজগুলির
একটি। বই যতোটা ছুঁয়ে দেয়, অমন করে আর কিছু কি ছুঁতে পারে কখনও? লেখকের কত ভালোবাসা,
আবেগ, কষ্ট, আনন্দ, যন্ত্রণার সঙ্গী তাঁর লেখা বইটা! নিজের লেখা বই নিজের সন্তানের মতো। একেকটা
বইয়ে লেখকের যে অসীম মমতা মিশে থাকে, যতোটা সময় আর ত্যাগ একটা বইয়ের পেছনে থাকে, যতোটা
কষ্ট হয় লিখতে, কয়জন মানুষ পারবে অতোটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে? লেখালেখির রাজ্য বড়ো রহস্যময়
এক রাজ্য। লিখতে পারার ক্ষমতা এক ধরনের যাদুর মতো। এই যাদুটা আসে ভেতর থেকে। যাকে একবার
এই যাদুটা গ্রাস করে, সে বড়ো অসহায় হয়ে পড়ে। যাদুটা কীভাবে নিজের মধ্যে আসে, কেন আসে, কোথা
থেকে আসে, তা কেউ জানে না। তবে যখন আসে, যার মধ্যে আসে, তখন সে হয়ে পড়ে যাদুর আশ্চর্য
মায়ার দাস। সে আর কিছুতেই ওই যাদুর রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ওই রাজ্যে কীকরে হাঁটতে
হবে, রাজ্যের আইন কী, কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সেসব উপায় তার জানা নেই। সে শুধু জানে,
তাকে হাঁটতেই হবে। নিজের রাস্তা নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়। এই রাস্তা বানাতে গিয়ে কেউ-কেউ
নিজের কবর খোঁড়ে, কেউ-কেউ নিজের অমর সমাধি রচনা করে। লেখালেখি ভীষণ আনন্দের, একইসাথে
অসীম যন্ত্রণার। যখন বই হাতে নিয়ে ওলটাতে থাকি, তখন লেখকের প্রতি এক নিখাদ ভালোবাসা আর পরম
মমত্ব কাজ করে। কত কষ্টে একটা বই লেখা হয়!
সেদিন বাতিঘরে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করছি। পুরোনো অভ্যেস। হঠাৎ দেখি, জাস্ট দুহাত দূরে এক অপ্সরা
দাঁড়িয়ে। অসম্ভব রূপবতী। ওকে অপ্সরা বলাটা ঠিক হয়নি। কম হয়ে গেছে। আর কোনও জুতসই তীব্রতর
বাংলা শব্দ অভিধানে নেই কেন? মেয়েটার শান্ত স্নিগ্ধ কোমল চেহারা। কিছুক্ষণ এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে
থাকলে বুকের মধ্যে একধরনের হাহাকার জমে উঠতে থাকে, জগতসংসার তুচ্ছ বোধ হয়। বই—সে তো
কোন ছার! এমন মেয়ে যে মিলনের আগেই বিচ্ছেদের অনুভূতি তৈরি করে দেয়! আমি হারিয়ে গেলাম। ওর
দিকে নির্লজ্জভাবে তাকিয়ে থাকতে একটুও লজ্জা হচ্ছিলো না। এমন মেয়ের দিকে তাকালে পাথরও অনুভূতিশূন্য
হয়ে যেতে বাধ্য! এই টাইপের মেয়েদের দুনিয়াতে পাঠানোই হয় একটা মহান অ্যাসাইনমেন্ট হাতে ধরিয়ে
দিয়ে। সেটা হল, অনেক ছেলের মাথা খারাপ করে দিয়ে অন্য একটা সত্যি-সত্যি মাথাখারাপ ছেলের ঘরে
চলে যাওয়া। যে মেয়ে মাথাখারাপ ছেলে পছন্দ করে না, সে মেয়ে সুন্দরী হতে যাবে কোন দুঃখে? সুন্দরী
মেয়েদের পছন্দ একইসাথে রহস্যময় ও উদ্ভট। দেখলাম, এই মেয়েটিও তা-ই। কোত্থেকে একটা ছেলে এসে
মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরে হেঁটে চলে গেলো। মানুষ যে বানর থেকে এসেছে, এটা ওই ব্যাটাকে দেখলেই
বোঝা যায়। তার জন্যে কষ্ট করে ডারউনের বই পড়তে হয় না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর ব্যাকসাইডে প্রচণ্ড
একটা লাত্থি মারি। পারলাম না। আমাদের বেশিরভাগ ইচ্ছেই অপূর্ণ থেকে যায় বলেই হয়তো পৃথিবী এতো
সুন্দর। যে সুন্দরী আমার নয়, সে সুন্দরীর প্রিয়জন মাত্রই বিকটদর্শন, অসহ্য। সুন্দরীর সাথে যে-ই হাঁটুক,
তাকে দেখলেই খ্যাতখ্যাত লাগে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, অথচ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী
ভাবতে ইচ্ছে করে। বারবারই মনে হতে থাকে, আমি তার চাইতে সবদিক দিয়েই অধিক যোগ্য। যোগ্যতা
প্রেম জাগায় না, প্রেমই যোগ্যতার প্রতীতি তৈরি করে। তবু আমার মনে এলো, আমিই ওই সুন্দরীর পাশে
দাঁড়ানোর একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকেই ওর পাশে একটুও মানায় না। সুন্দরী
মেয়েকে দেখলেই পরস্ত্রীকাতরতার জন্ম হয়। মনে হতে থাকে, সে আমার নয় সে আমার নয়! সে কেন
আমার নয়? কেন ও আমায় ভালোবাসলো না? কেন আরও আগেই ওর সাথে আমার দেখা হলো না?
(ভাবখানা এমন যেন ওর সাথে আমার দেখা হলেই আমাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যেত!) কেন ও আমার দিকে
তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে না? কেন ও আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না? কেন এই মুহূর্তে আমাকে দেখতে
প্রেমময় দেখাচ্ছে না? আমার দিকে একটু তাকালে কী হয়? আমি কি তাকানোরও অযোগ্য? ও কেন আমার
হলো না? ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ও কি কিছু মনে করবে? এমন কী করা যায়, যাতে আমি ওর চোখে
পড়ি? কেন পরস্ত্রীমাত্রই সুন্দরী? যে আমায় ভালোবাসে, সে কেন ওর মতো সুন্দরী নয়? এমনি আরও
অনেক ভাবনা মুঠোয়-মুঠোয় কষ্ট নিয়ে আসে, আসতেই থাকে।
ভাবনা: একশো এক।
……………………..
আমরা কখনওই জানতে পারি না, পৃথিবীর কতো মানুষ আমাদের কতো বেশি ভালোবাসে৷ জানলে বেশ
অসুবিধেয় পড়ে যেতাম আমরা৷ সুন্দরভাবে বাঁচতে ভালোবাসার ভীষণ প্রয়োজন। যে যতো কম ভালোবাসা
পায়, তার মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা ততো বেশি। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যে প্রায়ই অন্যায় করে, অন্য
লোকের ক্ষতি করে, তার ব্যক্তিগত জীবনটা কত দুঃখের! জীবন যাকে কিছু দেয় না, সে ভাবে, অন্যের
সবকিছু কেড়ে নেয়াটা তার অধিকার। দুর্ভাগা মানুষগুলি নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য পুরো পৃথিবীকে দায়ী করে।
যার নিজের গাড়ি নেই, সে অন্যের গাড়ির কাঁচে পাথর ছুঁড়ে আনন্দ পায়। যার সম্পদ নেই, সে অন্যের
সম্পদ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যার চাকরি নেই, সে যখন শোনে, সে যে চাকরিটা পায়নি, ওই চাকরিটা কেউ
দুর্নীতির মাধ্যমে পেয়েছে, তখন সে এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। যুগে-যুগে রবিন হুড দারুণ জনপ্রিয়
হয়েছে; এর কারণ, এ কাহিনিতে এমন একজন নায়কের কল্পনা করা হয়েছে, যে কিনা ধনীদের সম্পদ লুট
করে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। যে মানুষ পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য গড়েছে, সবাই তার প্রশংসা
করে, অথচ নিজেরা চায়, লুট করে ভাগ্য গড়তে। অনেকেই চায়, অন্যরা পরিশ্রম করে ভাগ্য ফেরাক, আর
নিজেরা লুট করে ভাগ্য ফেরাক। শুধু তা-ই নয়, লুটের ধনের উপর মানুষের অধিকারবোধ বেশি জন্মে। যে
মানুষটি নিজের চেষ্টা দিয়ে বড়ো অবস্থানে যায়, মনে-মনে সবাই তার মতো হতে চায়, কিন্তু মুখে বলে
ভিন্ন কথা—যাদের বিত্ত নেই, তারা সকল বিত্তশালীকেই তাদের জাতশত্রু বানিয়ে ফেলে। আসলে, টাকাপয়সা
জিনিসটা ততক্ষণই অরুচিকর মনে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা অন্য কেউ কামাই করছে। এমন প্রবৃত্তি মানুষের
সহজাত। তবে কেউ-কেউ ভাবনার এমন দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভাবতে পারে। তারাই প্রকৃত সুখী।
অন্যের সৌভাগ্যকে যে যতো সহজে নিতে পারে, তার সুখ ততো বেশি। কারও সুখ যখন আমাদের ব্যথিত
করে, তখন তার কিছুই এসে যায় না, কিন্তু কোনও দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই আমাদের দুঃখ বাড়তে থাকে।
অন্যের সুখ যে সহ্য করতে পারে না, সে ধরেই নেয়, তার কাছে যা আছে, তা সুখী হওয়ার জন্য যথেষ্ট
নয়। দুঃখের অস্তিত্বকল্পনা দুঃখের চাইতেও বেশি দুঃখ দেয়। এমন দুঃখবোধ পুরোপুরিই স্ব-আরোপিত। যখন
কেউ আমাদের ভালকিছুকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করে, আমাদের ভালোবাসায় বাঁধে, তখন আমাদের নিজের
প্রতি এক ধরনের কমিটমেন্ট তৈরি হয়। খারাপ ভাবনাগুলো মাথায় যখন-তখন এসে পড়ে না, খারাপ
কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারি না৷ কী এক সংকোচ ছেয়ে ফেলে আমাদের৷ গীবত-টীবতও ঠিকমতো করতে
পারি না৷ আমি ভাল—গভীর প্রত্যয় থেকে সঞ্জাত বিবেকের এই বোধটি অনেক বড়ো আদালত। মানুষকে
শাসিয়ে যতোটা না দায়বদ্ধতার বাঁধনে বাঁধা যায়, ভালোবাসা দিয়ে এর চাইতে অনেকবেশি দায়বদ্ধ করে
দেয়া যায়। ভালোবাসার বড়ো অসুবিধে হলো, এটা মানুষকে পরাধীন করে দেয়৷ ভাল চিন্তা, ভাল কাজ,
ভাল ইচ্ছার প্রতি পরাধীনতার শেকলে মানুষ বাঁধা পড়ে। হুট্ করে মরে-টরে যেতে ইচ্ছে করে না৷ ভাল
হয়ে থাকার জন্য, ভাল একটা জীবন কাটানোর জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে। দুর্ব্যবহারটাও মনের খুশিমতো করা
যায় না৷ বড়োই অস্বস্তিকর ব্যাপার! অন্যকে অপমান করা কিংবা নিজেকে নীচে নামানোর নেশা বড়ো
নেশা৷ নিচে নামতে বড়ো আরাম, বড়ো সুখ। তাও পারা যায় না। ভালোবাসা সবকিছুতেই বিশ্রীভাবে শেকল
পরিয়ে দেয়৷
ভাবনা: একশো দুই।
……………………..
মেয়েদের অল্পে হয় না। ওরা অনেক কিছুই চায়। প্রেম করে এমন কারও সাথে, যার হাত ধরে ঘোরাঘুরি
করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না, কিংবা যে নিজেই চায় না বিয়ে করতে। প্রেম আর বিয়ে এক নয়,
প্রেমিক আর স্বামী এক নয়—এটা বিশ্বাস করেই প্রেম চালিয়ে নেয় ব্রেকাপের আগ পর্যন্ত, আর বিয়ে করবে
বলে ঠিক করে রাখে ভালোমানুষ-টাইপ কোনও ছেলেকে। আবার বেশিরভাগ ভালোমানুষ-টাইপ ছেলেরা
প্রেমিক-টাইপ মানুষ হয় না। এবং ভাইস ভারসা, মানে, দক্ষ পেশাদার বয়ফ্রেন্ডরা সাধারণত ভালোমানুষ হয়
না। মেয়েরা ভাত না খেয়েও থাকতে পারে, কিন্তু প্রেম না করে থাকতে পারে না। তাই, অনেক মেয়েরই
প্রেমিক থাকে দুটো। এক প্রেমিক প্রকাশ্য, অন্য প্রেমিক গোপন। কখনও-কখনও এরও বেশি। কত-কত ছেলে
প্রেমিক হওয়ার জন্য হাঁ করে বসে থাকে! যারা প্রেম বোঝে না, প্রেম জানে না, ওরাই হয় প্রেমের সফল
ফেরিওয়ালা। মজার ব্যাপার হলো, যাদের প্রেমিক একটা না, ওরাও কিন্তু চায় ওদের প্রেমিকের প্রেমিকা
থাকুক একটা। যে যতো বেশি প্রেমময়, সে ততো বেশি বিশ্বস্ত—প্রত্যেকটা সম্পর্কেই সে বিশ্বস্ত হয়ে থাকার
চেষ্টা করে! প্রত্যেককেই সে বিশ্বাস করিয়ে ফেলতে পারে, সে শুধুই তার। তার সুখের জন্য সে জীবন দিয়ে
দিতে পারে। তাকে ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় নেই। ভালোবাসার শক্তির চাইতে বিশ্বাসের শক্তি অনেক
বড়ো। বিশ্বাস যেখানে ক্ষীণ, সেখানে ভালোবাসা কখনওই প্রকট হয়ে উঠতে পারে না। অবশ্য সবাই এমন
নয়, কেউ-কেউ এমন। বাকিরা একটু গাছ-গাছ টাইপের। ফুড়ুত্-ফাড়ুত্ করে ওড়েও না, আবার ওড়ায়ও
না। ভোলেও না, ভোলায়ও না। ওদের সাথে যতোটা না প্রেমে বাঁচা যায়, তার চাইতে বেশি বাঁচা যায়
স্বস্তিতে। ওরা যতোই আবিষ্কৃত হয়, ততোই অন্যপ্রেমের প্রতি উৎসাহের জন্ম দেয়। যখন কেউ একটা সম্পর্কে
থাকার সময়ই অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তার মানে কিন্তু এ নয় যে, সে প্রথম সম্পর্কে অসুখী, বা প্রথম
মানুষটির প্রতি তার ভালোবাসা কমে গেছে। একজন মানুষ একই সময়ে একাধিক জনকে একই পরিমাণে
ভালোবাসতে পারে। গাছের সাথে বসবাস, পাখির সাথে প্রেম—এরই নাম জীবনযাপন। একা-একা লাগার
সাথে একা থাকা না থাকার তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। কেউ কারও সাথে কোনও সম্পর্কে আবদ্ধ থাক না
থাক, যখন সে অনুভব করে, সে একা, তখন সে একাকীত্ব ঘোচাতে চায়। সে যাকে মন-মনে খোঁজে,
তেমন কাউকে পেয়ে গেলে, কিংবা যদি কেউ সামনে এসে তাকে এটা বোঝাতে পারে যে, সে যেমন কাউকে
খুঁজছে, ও তেমন কেউ, তবে সে ওই মানুষটির প্রেমে পড়ে। মানুষের জীবনে প্রত্যেকটা প্রেমই প্রথম প্রেম।
মানুষ যখন নতুন করে কারও প্রেমে পড়ে, তখন নিশ্চয়ই তার মধ্যে এমন এক প্রেমময় অনুভূতির জন্ম
হয়, যে অনুভূতিটা তার জীবনে অভিনব। হ্যাঁ, যদি কেউ একই মানুষের প্রেমে একাধিকবার পড়ে, তখন
পরের প্রেমগুলি আর প্রথম প্রেম থাকে না। এমন প্রেম মুগ্ধতার জন্ম দেয়, এমনি করে ক্রমাগত মুগ্ধ হতেই
থাকার নাম ভালোবাসা। একই মানুষের প্রেমে বারবার পড়ার নামই ভালোবাসা। প্রেম ও ভালোবাসার মধ্যে
এটাই পার্থক্য। ছেলেরা কেমন হয়? তেমন, মেয়েরা ওদের যেমনটা ভাবে। কোনও মেয়ে একটা ছেলেকে
কীভাবে গ্রহণ করছে, তা ছেলেটা আসলে কেমন, তার উপর নির্ভর করে না। মেয়েটা ছেলেটাকে কেমনভাবে
দেখছে, সেটাই বড়ো কথা। মেয়েরা একটা ছেলেকে নিয়ে কী ভাবে? যা ওরা ভাবতে চায়। ওরা কিন্তু
মাঝেমাঝে ঠিকও ভেবে বসতে পারে! সাধু সাবধান! একটা ছেলে খারাপ, কিন্তু ওকে মেয়েটা ভাল মনে
করে; অতএব, ছেলেটা মেয়েটার চোখে ভাল। একটা ছেলে ভাল, কিন্তু ওকে মেয়েটা খারাপ মনে করে;
অতএব, ছেলেটা মেয়েটার চোখে খারাপ। পুরো পৃথিবী এসে মেয়েটাকে সঠিকটা বোঝালেও, ও কিছুতেই আর
কারও কথা শুনবে না। ও যা ধরে বসে আছে, সেটাই ওর কাছে একমাত্র সত্য! ওদের ভোলানো সহজ।
কারণ ওরা ভুলতে চায়।
অন্য ব্যাপারও ঘটে কিন্তু। সুখের বিষয়, বেশিই ঘটে।
ভাবনা: একশো তিন।
……………………..
কী করছ?
খেয়েছ দুপুরে?
চুলগুলি কি এখনও খোলাই রাখ, হুঁ?
কথা বলতে বলতে, এখনও কি, চোখদুটো হুট করে নামিয়ে ফেল, পিটপিট করে?
হাসতে গেলে, এখনও কি টোল পড়ে, ওর সামনেও?
পড়লে পড়ুক!
আর যা-ই কর, আমার দেয়া নাম ধরে আর কাউকে ডাকতে দিয়ো না, কেমন? ওটা শুধুই আমার।
জানি, উত্তর দেবে না, সিন করে ফেলে রাখবে। রাখলে রাখো! আমার কী?
আচ্ছা, আমাকে ব্লক করে দাও না কেন? ভালোওবাসো না, অথচ, সেটা আমাকে বিশ্বাস করতেও দিচ্ছ না।
এসবের মানে কী??
ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে, ঘ্রাণ পাচ্ছি। অসম্ভব সুন্দর ইয়ামি গন্ধ! ভাবছি, রান্না করার আগেই গোটাকয়েক
খেয়ে ফেলবো। আচ্ছা, ঠিক কয়টা ইলিশ মাছভাজি পরপর খেয়ে ফেললে মন ভাল হয়ে যাবে? সাড়ে সাতটা
খেলে হবে না? ওই বাকি অর্ধেকটা বেড়ালটাকে দিয়ে দেবো। ও তোমার চেয়ে অনেক ভাল।
মানুষটাকে, এখন কম ভাবি, কম দেখি, কম ঘাঁটি, কম মনে করি………তবুও, কিছুতেই ভুলতে পারি না।
সমরেশের একটা লেখা পড়ে কোনও এক সম্পূর্ণ অপরিচিতার সাথে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
খুউব!!!
কোন সমরেশ? বসু? নাকি, মজুমদার?
বলব না।
কোন লেখা?
বলব না।
কেউ বলতে পারলে, আপনার পছন্দের তিনটা বই উপহার দিতে রাজি আছি। কিংবা, অন্যকিছু।
To make love with a stranger is the best.
There is no riddle and there is no test. —
To lie and love, not aching to make sense
Of this night in the mesh of reference.
To touch, unclaimed by fear of imminent day,
And understand, as only strangers may.
To feel the beat of foreign heart to heart
Preferring neither to prolong nor part.
To rest within the unknown arms and know
That this is all there is; that this is so.
কবিতাটা মনে এল। আমার খুব প্রিয় ওপরের লাইনগুলো। কার, বলুনতো?
ভাবনা: একশো চার।
……………………..
প্রজেক্ট সুপারভাইজার বেশি-বেশি পেইন দিলে একটা লাভও আছে৷ চাকরির আগেআগে লজ্জাশরম কইম্যা
যায়৷ লজ্জাশরম কম থাকলে চাকরিবাকরিতে ব্যাপক সুবিধা! পাইতেও সুবিধা, করতেও সুবিধা৷ লজ্জা যার
যতো কম, সে ততো ভাল চাকরিজীবী! প্রজেক্ট কমপ্লিট করার সময় জুনিয়র পোলাপানের সামনে প্রতিদিন
স্যারের রুমের সামনে সারাডাদিন দাঁড়াইয়া থাকতে-থাকতে আমার শরমটরম জিরোর কাছাকাছি চইল্যা
গ্যাসিলো৷ পিচ্চিগুলা সেরা বদমাইশ৷ দেখা হইলেই ‘স্লামালিকুম ভাইয়া’ বইলা হাহাহিহি করত৷ পিচ্চিগুলারে
ধইরা পিডাইতে সেইরকম সুখ৷
ওইসময়ে, দুপুরে ‘ভাত খাইসো?’ স্যারে খালি এইটা জিগাইলেও বিরানি খাওনের সুখ পাইতাম৷ কতোবার
ভাবসি, ভিসি স্যাররে কমপ্লেইন দিমু, স্যার বারবার প্রজেক্ট টপিক চেঞ্জ করলে কাইন্দা কাইন্দা কমু, স্যার,
আমি আর পারি না, আমার মায়ে কান্দে, বাপে কান্দে, আমারে এইবার ছাড়েন। আপ্নের ঘরে বাপভাই নাই?
আত্মীয়স্বজন ভালা বুদ্ধি দিতে না পারলেও ফোঁড়ন কাটতে মহাওস্তাদ৷ লম্বালম্বা লেকচার মারে; ভালো যে
চায়, তা কিন্তু সবসময় না, মাইনষ্যেরে উইকপয়েন্টে বাড়ি মারতে এ্যাত্তোগুলা শান্তি, এইজইন্য৷ বাপমা
মাইনষ্যেরে শরমে মুখ দ্যাখাইতে পারতো না, অবশ্য দাঁত বাইর কইরা মহাসুখে ক্যালাইয়া-ক্যালাইয়া মুখ
দ্যাখাইতে আমার নিজের কুনু সমস্যাই ছিলো না, তবুও মাঝেমাঝে বাপমা’র ডরে আর ভদ্রতার খাতিরে
প্যাঁচাপ্যাঁচা মুখ কইরা শরম পাওনের অ্যাক্টিং করতাম।
স্যারের প্রজেক্ট পেপারগুলা যখন আমারে দিয়া করাইয়া লইতো, আর বারবার প্রজেক্টের টপিক চেঞ্জ কইরা
দিত, তখন মঞ্চাইতো কইয়া ফালাই, “স্যার আপ্নের বাসার সব থালাবাসন আমি ধুইয়া দিমু, ঘর কুড়ামু,
মুছমু, কাপড় ধুমু, প্রয়োজনে বাসার কাজের বুয়ারে বিদায় কইরা দ্যান, আপ্নে কুনু টেনশন লইয়েন না স্যার,
আমি আছি, আমি থাকতে বুয়ার কী দরকার; তবুও আর প্রজেক্ট চেঞ্জ কইরেন না৷ ম্যালা কষ্টে আছি স্যার,
কিছু করন লাগবোই৷” হগ্গলে খালি কয়, আমরা কি এই আঞ্জেনেয়ার চেয়েছিলাম? পবিত্র গরু!! সারাদিন
ফকিরাফকিরা ভাব লইয়া স্যারের সামনে হাত কচলাইতে-কচলাইতে হাতের রেখাটেখা ‘নাই’ হইয়া গ্যাসে,
আমার চেহারাসুরতে পর্যন্ত একটা ফকিরাফকিরা ফ্লেভার চইলা আসছিলো৷ আমি ভয়ে থাকতাম, কে কখন
আমার হাতে আটআনা ধরাইয়া দ্যায়!
তবে এইটা ঠিক, স্যার আমারে মানুষ কইরা দিসে৷ অফিসিয়াল অভিমানটভিমান কমাইয়া দিসে; যে পরিমাণ
জিদ আমার মইধ্যে জমা হইসিলো, সেইটা দিয়া লাইফ নিয়া গেম খ্যালা কিছুসময়ের জন্য বন্ধ করসিলাম৷
যারা অনার্স ফোর্থ ইয়ারে আছো, তারা লাজশরমের মাথা খাইয়া যেইভাবেই হোক, ভার্সিটিরে ডিভোর্স দেয়ার
পাক্কা বন্দোবস্ত কর৷ খালি এই একটা ডিভোর্সেই মিলমহব্বত বরং উল্টা আরও বাড়ে৷
ভাবনা: একশো পাঁচ।
……………………..
যারা বেশি বোঝেন, আমি তাদের কম বুঝি। বোঝার চেষ্টাও করি না। সময় নাই। He who can, does;
he who cannot, teaches. আমার ভীষণ পছন্দের একটা টিভি অ্যাডের কথা মনে পড়ে গেলো। চকোলেটের
অ্যাড। একটা চকোলেট সম্পর্কে বিভিন্নজন বিভিন্ন মন্তব্য করছে। কেউ বলছে চকোলেটটা ভালো, কেউ বলছে
খারাপ, কেউ-কেউ বা কনফিউসড্। একজন কিছুই বলছে না। মুখ বন্ধ। সবাই জিজ্ঞেস করলো, কী ভাই,
কিছু বলছেন না কেনো? উনি কোনওরকমে মুখ খুলে উত্তর দিলেন, ভাই, বলবো কীভাবে? আমি তো
খাচ্ছি! . . . . . . . এটা আমার দেখা সেরা অ্যাডগুলোর একটা। আপনি হয় আপেল খাবেন, নতুবা
মুখটা খোলা রাখবেন। মুখ খোলা রেখে আপেলের স্বাদ উপভোগ করা সম্ভব নয়। যারা চেঁচায়, ওরা এক
দলের; আর যারা এগোয়, ওরা অন্য দলের। বুদ্ধিমানরা তর্ক করেন, প্রতিভাবানরা এগিয়ে যান। একথা
সবসময়েই সত্যি। বিল গেটসকে দেখুন, জুকারবার্গকে দেখুন, স্টিভ জবস্কে দেখুন। আরও কতো আছে!
আমরা ওদের নিয়ে কত তর্জমায় মাতি, আর ওদের সময়ই নেই আমাদের নিয়ে ভাববার; ওরা যে ভীষণ
কাজে ব্যস্ত! পৃথিবীর যাবতীয় অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় কাজের জন্যে, সমালোচনার জন্যে নয়। একদল নীরবে
কাজ করে, আরেকদল সরবে সমালোচনা করে। যারা লিখতে পারেন, তারা লিখে যান। যারা লিখতে পারেন
না, তারা বকে যান। দুই দলই আসলে সময় কাটান। যে যেভাবে করে সময় কাটিয়ে সুখ অনুভব করে
আরকি! আমরা যা-ই করি না কেন, আমরা প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকু
কাটাই—আমাদের পছন্দ অনুযায়ী, আমার সুযোগ অনুযায়ী, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী, আমাদের প্রাপ্তি
অনুযায়ী। কারও সময় কাটানোর ধরনই বলে দেয়, উনার দৌড় কতদূর! সম্মানিত স্বীকৃত শ্রদ্ধেয় হন
সাহিত্যিকরা, সমালোচকরা নন। সমালোচকদের জন্যে সান্ত্বনা পুরস্কার শুধুই নিভৃত আত্মতৃপ্তি। ঈশ্বর ওদের
সুবুদ্ধি দান করুন।