ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা: ১৪৪


ভাবনা: এক হাজার দুই
………………………………………………………………


এক। যোগ্য ব্যক্তির মুখে সত্য শোনায় অহংকারের মতো।
অযোগ্য ব্যক্তির মুখে সত্য শোনায় বিনয়ের মতো।
দুই। মেনে নিতে পারলে চালিয়ে যাও,
মেনে নিতে না পারলে পালিয়ে যাও।

আর হাতে অফুরন্ত সময় থাকলে . . . জ্বালিয়ে দাও!
তিন। খুব কাছের একজন আমার কাছে প্রশ্ন রাখল: তুমি এত পরিশ্রম কেন করো? তোমার কি খুব টাকার প্রয়োজন, না কি তুমি খুব ক্যারিয়ারিস্ট হতে চাইছ?

উত্তর দিলাম: দুটোই। টাকা এবং ক্যারিয়ার দুটোই লাগবে—লাইফে কেউ থাকুক বা না থাকুক। এবং, ট্রাস্ট মি, টাকা আর ক্যারিয়ার থাকলে না চাইতেও লাইফে মানুষের অভাব হবে না। আমার লাইফে আমি হাতেগোনা দু-একজন বাদে বাড়তি কোনো মানুষ রাখি না। বেশি মানুষে বেশি যন্ত্রণা। পজিশন ম্যাটার করে। নিজের একটা পজিশন তৈরি করতে পারাটা অন্য সব কিছুর চাইতে জরুরি।

স্রষ্টা আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এর অর্থ হলো: নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্যেই আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন, এই পৃথিবীতে আমার কিছু করার আছে। আমি সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি। শুধুই খেতে, ঘুমোতে, পরতে, টাকা নষ্ট করতে নিশ্চয়ই কাউকে তিনি পাঠান না; এবং এটা মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যও হতে পারে না।

মানুষ একা থাকলে মরে যায় না, কিন্তু টাকা না থাকলে মরমে মরে যায়, আর একটা মোটামুটি ভালো ক্যারিয়ার না থাকলে মানুষ ধীরে ধীরে আত্মিক মৃত্যুর দিকে যেতে থাকে। বিশেষ করে, সে যদি পরিবারের বড়ো সন্তান হয়, তাহলে এসব নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে নেই। শক্ত একটা অবস্থানের চাইতে সুন্দর আর কী আছে!

আমি যদি ব্যর্থও হই, তবুও আমার কোনো অনুশোচনা অন্তত থাকবে না, কেননা আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা না করার অনুশোচনা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। ব্যর্থ হবার পরও আমি শান্তিতে বাঁচতে পারব, আমি তৃপ্তি নিয়ে বলতে পারব, টিকে থাকার জন্য সব ধরনের লড়াই আমি ধৈর্য ধরে করে গেছি।

না, আমার চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস বা মতামতের সাথে সবার জীবন মিলবে না এবং মেলার কোনো দরকারও নেই। একজনের জীবনদর্শনের পাল্লায় অন্য কারও জীবনের পরিমাপ হয় না—জীবন তো সেই অদ্ভুত সমীকরণ, যার কোনো সমাধানই হয় না!
চার। কারও ঘরে গেলেন। তাঁর স্ত্রীকে আপনার খুব পছন্দ হলো। আপনি কি তখন সেই ভদ্রমহিলাকে বলবেন, "আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। এই 'ভুল ঘরে' আপনাকে মোটেও মানায় না। আপনি আমার সাথে আমার ঘরে চলুন। আপনাকে আমি আমার ঘরে রেখে দিতে চাই।"?

না, বলবেন না। এর নাম ভদ্রতা। এটা শিখতে রকেট-সায়েন্স জানতে হয় না, সামান্য কমনসেন্স থাকলেই চলে। মানুষ তার নিজের জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর।

কিংবা ধরুন, সেই ঘরের একটা শোপিস আপনার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আপনি কি চাইবেন সেটা সাথে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসতে? ভদ্রলোক হলে তা চাইবেন না। ওরকম চাওয়ার নাম যে চৌর্যবৃত্তি! আপনি এটা জানেন।

অথচ কাউকে যখন আপনার ভালো লাগে, তখন আপনি চান তাকে আপনার ধর্মে বা মতে বা পথে নিয়ে আসতে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে কখনো কখনো রীতিমতো পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন।

চানাচুর‌ওয়ালা গলায় চানাচুর ঝুলিয়ে চানাচুউউররর্... বলে চেঁচাতে চেঁচাতে পিছে পিছে ঘোরে; কিন্তু স্বর্ণের কারবারি স্বর্ণ নিয়ে কখনোই পিছে পিছে ঘোরে না, কেননা স্বর্ণ জিনিসটা দামি।

ধর্ম তো ঘরের মতন। যার ঘর, তার শান্তি। পরের ঘর, সবার ডর!

একটু ভাবুন তো! আপনার পথ যদি আপনাকে সুন্দর করত, তাহলে তো আপনাকে দেখে সে-ও মুগ্ধ হতো, ঠিক যেমনটা তাকে দেখে আপনি হয়েছেন। পথ সব‌ই ভালো ও সুন্দর; তার পথ ভুল হলে আপনি তাকে দেখে এতটা আকৃষ্ট হলেন কীভাবে? ক‌ই, আপনার মত-পথ তো আপনাকে অমন আকর্ষণীয় করতে পারল না!

আকর্ষণীয় হবার চেষ্টা করুন। আকর্ষণ করতে জানলে লোকের পিছে পিছে এভাবে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় না।
ফুল পছন্দ হলেই তা ছিঁড়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে হয় না। যার এটুক ভদ্রতাজ্ঞান‌ও নেই, তার কখনও ধর্ম হয় না। ধার্মিকতার প্রথম ধাপ ভদ্রতা। আমি আজ পর্যন্ত এক জন‌ও অভদ্র ধার্মিক মানুষ দেখিনি।
পাঁচ। এতটা ভেঙে পোড়ো না। পার্থিব কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। যা চিরস্থায়ী, তা হচ্ছে: কেবলই তোমার ‘তুমি’-টুকু! মনে রেখো, যে-অনন্তে তোমার ‘তুমি’ বিলীন হয়, তা কখনোই বিলীন হয় না—তবে তুমি কী করে ক্ষণস্থায়ী হবে? চাইলেও কি পারবে তা!

ভেবো না। মিলিয়ে নিয়ো, যেমনি ফিক করে উঁকি দিয়েছিল সময়টুকু, ঠিক তেমনি, মনের গভীরে একদিন ডুব দেবে আজকের সময়টাও। তারপর…আবার সব সহজ-স্বাভাবিক।
ছয়। ভুলে যাবে। ভুলে যাব আমিও।

সময়ের টোটকায় একসময় সেরে যাবে এই সময়কার ক্ষত আর পুঁজের প্রকোপ। স্মৃতির বিড়ম্বনাও একসময় হবে মৃদু।

তুমি এখন অন্য কোথাও অন্য কোনো সঙ্গীর সাথে লোকজীবনের স্বাভাবিকতায় সুখী, তাই অহংকারী; তার সাথে অবশ্যই অস্বীকৃত হয়েছে অনাহুত সব অতীত।

আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি, ভালোবাসাবাসির প্রগাঢ়তা একসময় কায়া থেকে ছায়ার মতো অশরীরী হয়ে যায়। মনের ভেতরে মনও একদিন গুমরানো বেমালুম ভুলে যায়।

তোমার ব্যস্ত জীবনে আগেকার ক্ষোভ, অভিযোগ সব…পাওনা-মেটানো গ্যাসবিলের মতো ওয়েস্ট-পেপার-বাস্কেটে মিনিংলেস রিজেক্টেড আইটেমের ফর্দে পড়ে যায়।

সুখী তুমি ভুলে যাও অতীতের কাব্যময়, 'এই মুহূর্তে অবশ্যই বিস্মরণীয়' প্রেমের সোনালী উপাখ্যান।

“সুখী হও।”—তারপরও বেহায়া মন তোমার দিকে ছুড়ে-দেওয়া এই শুভ অভিসম্পাতে গলা মেলায়। সব মনে রেখেও বেচারা বলে—ভালো থেকো। সুখে থেকো।

রাত বাড়ে। প্লাটিনাম ভায়োলেট রঙের মুঠোফোনটা তা-ও নিঃসঙ্গতার দীর্ঘদিবস দীর্ঘরজনীতে শীতল নিরুচ্চারিত প্রহরে একটা আশ্রয় দেয়, উত্তাপ দেয়।

কাঙালি মনের ক্ষুধার্ত নিঃসঙ্গ মনের ভোজ—নিঃশব্দ অথচ অস্তিত্বময় উপস্থিতি দিয়ে। সে সঙ্গ দেয়, সান্নিধ্য দেয়—বড়ো অসময়ে তুমিহীন তুমিময় একাকী প্রহরে।
সাত। রাত বাড়াতে বাড়াতে কত-কী ভাবি! মনের ভেতরে থাকা মনটা হাজারো প্রশ্নে ক্লান্ত থেকে ক্রমশ হতে থাকে ক্লান্ততর।

কষ্ট বাড়ে। চাপাকষ্ট। বিনা বানে যখন ঘর ভাসে কিংবা বিনা ঝড়ে নৌকো যায় ডুবে, তখন সাঁতার জানা না জানা দুটোই হয়ে যায় অর্থহীন।

কষ্টের কষ্টিপাথরে পরীক্ষা দেবে কে? আমরা তো সব কলুর বলদ। মুখের সামনে যা ধরা হয়, তা-ই নির্বিবাদে গ্রহণ করি।

দিন কাটে। রাত‌ও কেটে যায়।

নিঃশব্দ মুঠোফোন কী আশ্চর্য এক জাদুকর! সে একইসাথে আমায় একদিকে দেয় সঙ্গ, অন্যদিকে করে রাখে সঙ্গীবিহীন।
আট। অপরাধী মনের স্বভাব কেমন? ফোনটা কানে ঠেসে ধরে মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষের মধুকণ্ঠে কান জুড়োই। অচেনা নম্বর থেকে ভণ্ডামির লালনপালন চলতে থাকে ভেতরে-বাইরে।

অসহ্য অতীত মনের আনন্দে ওর দু-পাটি দাঁত মেলে উৎকট হাসি হেসে বর্তমানকে দুর্গন্ধময় করে তোলে; কখনো করে তোলে বেশ কুৎসিত।

বুকের অন্দরমহলে রকমারি আতসবাজি ফোটে। কোথায় কোথায় উড়ে যায় খেয়ালি মানুষ।

আমি আধখানা ক্ষয়ে-যাওয়া চাঁদের আখ্যানের আদ্যোপান্ত ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, যেভাবে মানুষ একজীবনের বারান্দায় বসে অন্যজীবনের স্মৃতির পাতা ওলটায়।

কখনো কখনো দুঃখের সাথে একটু-আধটু মাখামাখি হয়ে যায়—কখনো বোঝায়, কখনোবা না বোঝায়।

মুঠোফোনের সুড়ঙ্গে কোনো সশব্দ যোগাযোগ ঘটে না। মনোযোগের অবাধ্য ঘোড়া তবু ওদিকের কাছাকাছি আকর্ষণীয় বলয়ে ঘোরাফেরা করে আর করতেই থাকে বিনা কারণে।

তোমার দূরালাপনীর ও-প্রান্তে তুমিও তখন কাটাও আমারই মতো অস্থির প্রহর।

ভালোবাসার বানভাসিতে ডুবে যায় হাজার বছরের ঘর-গেরস্থালি। মন ভাঙলে সেখানে নতুন চর সহসা জাগে না।


ভাবনা: এক হাজার তিন
………………………………………………………………


এক। কী ক্ষমাহীন লজ্জা আমরা এক-একটা নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা মানুষ অনুতপ্ত বুকের মধ্যে নির্বিবাদে পুষে যাই!

কী সীমাহীন ক্ষোভ বুকের মধ্যে রাতভর সলতে জ্বালায়! তুষের ঘুনঘুনে আগুনে পুড়তে পুড়তে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চায় মন...সময়ী রোজনামচার বিরুদ্ধে—'জীবন' রেখেছ যার ভুল নাম।

বইমেলায় পসারীরা বসে। মানুষ আসে। ধুলো ওড়ে। মেলা ভাঙে। যে যার পথে হাঁটা দেয়।

ক্ষমাহীন লজ্জা এখনও ভাঙা-হাটে জমে-থাকা অন্ধকারের মতো আটকে থাকে সবখানে।

রাত বাড়ে। মুঠোফোন ধূসররঙা সঙ্গ দিয়ে যায়—রঙে সোচ্চার হলেও বেচারা শব্দে নিশ্চুপ। আপন বলতে এক সে বাদে আমার আর কেউ নেই।
দুই। তুমি সুখী হলে কি?

আমাকে অপমানের সিঁদুরে আপাদমস্তক রাঙিয়ে তোমার চৌহদ্দির আপন-পর সকলকে জানান দিয়ে তোমার বুকের ছাতি ক-ইঞ্চি ফুলে উঠেছিল অবাক শোনালেও আমার মাপতে ইচ্ছে করে।

জানতে ইচ্ছে করে, ভালোভাবে ভালো থাকার জন্য‌ই যখন দূরত্বের শুরু, ভালোবাসাকে যেখানে ভালোভাবে বাঁচানো যেতে পারত, সেখানে কেন এমন সময়জ্ঞানের গলদ ঘটে গেল!

আমি সুখী হলাম কি?

নিষিক্ত নির্জনতার অভিসম্পাতে বদলে-যাওয়া আমি প্রতিশ্রুতিকে বেপথু করে কোন অমূল্য নীলমণিহার খুঁজেছিলাম?

আয়নায় আত্মঅবয়বের প্রতারণায় আজ আমি নিজেই দিশেহারা। এখন সারাদিন বুড়োআঙুল চুষলেও সত্যি-মিথ্যে ওদের স্থান বদলাবে না।

যা ঘটার ঘটেই যায়। নিভাঁজ সত্যি এটুকুই।
তিন। কী কষ্ট! বুকের মধ্যে সারাক্ষণ খোঁচাখুঁচি চলতেই থাকে পৃথিবীর তাবৎ ভাবনায়।

একটা ভীষণ অপমানের ঘুড়ির মাঞ্জা-ধরা সুতোর মতন ধারালো অভিমান একসময় সমস্ত রাগ আর অভিযোগকে পিছে ফেলে কেমন করে যেন মিইয়ে-আসা দুঃখের নেতানো সুতো হয়ে যায়।

মাথা ভর দিয়ে রাখতে রাখতে ডান হাতটায় ঝিঁঝি ধরে যায়। সরানো হয় না। সব‌ই তো সরালাম! আর কত!

পায়ের পাতায় আগুন জ্বলে। তবু শরীরের অর্ধেকটা ঢেকে-রাখা চাদরটাও সরানো হয় না।

ক্যালেন্ডারের গায়ে বোকা তাজমহল আর অস্বাভাবিক নীলরঙের আকাশটা যেমন খামোখা দেয়ালের বুকে জায়গা জুড়ে রাখে, তেমনি করেই আঠার মতো লেগে-থাকা অনড় মনখারাপের এই নিশুতি প্রহরে রাত বাড়তেই থাকে। রাত কমতে শেখেনি।

মুঠোফোনটা তারপরও নিশ্চুপ। এর কারণ ও সত্যতা দুই-ই জানা। তবুও চোখ-কান-মন অবাধ্য হয় কিংবা পুরোনো স্বভাবের মহড়া দেয়।

আজ আমার এমন কেউই নেই, যাকে আমি চাইলেই এই রাতে ফোন করতে পারি। এতটা একলাও মানুষ হয়!
চার। মাথার ওপরে বনবন-ঘুরতে-থাকে নীলরঙা ফ্যান। বাতাসে সশব্দে ঘূর্ণি কাটে ধাতব পাত। আলনায় ঝুলন্ত কাপড়গুলো হাওয়ার নাড়াচাড়ায় বিষণ্ণভাবে একটু একটু দুলে ওঠে। সিলিংয়ে ঝুলন্ত মাকড়সার জালে লেগে-থাকা খসে-আসা পলেস্তরা কেমন নিশ্চিন্তে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে দুলতে থাকে। একটা পলিথিনের ব্যাগে বাতাস ঢুকে ফরফর শব্দ হয়। একটা-দুটো সুযোগসন্ধানী মশা সুযোগ পেলেই গুনগুন করে চামড়ায় বিলি কেটে যায়।

রাত বাড়তে থাকে। একমাত্র সঙ্গী বিছানায় চুপচাপ গুটিসুটি মেরে-থাকা কমলা রঙের জ্যান্ত তবে এই মুহূর্তে নির্বাক মুঠোফোন।
পাঁচ। নিশুতি রাত। তিনটে বাজতে দু-তিন মিনিট বাকি।

মধ্যরাত, এ বড়ো অরক্ষিত সময়। সব খোলস ছেড়ে ভেতরের মানুষটা সামনে বেরিয়ে আসে। বিবেকী রোজনামচায় দু-একটা সত্যিকারের সাক্ষ্য-দলিল লেখা হয়ে যায়। চাই না চাই, উদোম শরীরের এখানে-ওখানে সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বেরিয়ে-আসা গলিঘুপচির অন্ধকারকে অনায়াসেই দেখা হয়ে যায়।

মন ভালো থাকে না, খারাপ হয়। খারাপ মানে খুব খারাপ। কষ্টের সুচ হৃৎপিণ্ডে নকশিকাঁথা বোনে। অবিরাম ভাবনার গাঁথুনিতে নিষ্পলক দৃষ্টি অন্ধকারে মেলে রাখি।

রাত বাড়তে থাকে। এক প্রহর। দুই প্রহর।
ছয়। শেষপর্যন্ত তোমার সাথে থাকা আর হলো না। গলতিটা কোথায় বলো তো? টান ছিল না? না কি ছিল, তবে আরেকটু বেশি থাকতে হতো? আমাদের কী যে মিলল না, তা-ই আমি আজও বুঝতে পারি না।

যখন প্রথম সতেরোর প্রেম, ভালোবাসার নিষ্পাপ পাতাগুলো তোমার ঘোরলাগা ব্যক্তিত্বের ঝলমলে আলোতে ওদের আহ্লাদি শরীর মেলে বাড়তে চেয়েছিল, ওদিকে তখন তুমি অতীতী কথকতায় দারুণ ব্যস্ত। আর মুখ ফেরালে যখন, তখন আমি ‘মানসিক শান্তি’ নামের এক অতিথি-পাখিকে অলীক খোঁজাখুঁজির নেশায় মেতে আছি।

এমনি করে যখন অবিশ্বাসের চোরাবালিতে গলা অবধি ডুবলাম, দেখি, তুমি…সেই দুর্বিনীত তুমিই আমার ভেতরে আকণ্ঠ বুঁদ হয়ে আছ। কেন কে জানে, যখন আমার টাইম-আপ, তখনই কিনা তোমার ফিরে তাকানোর সময় হলো!

অন্তর্ঘাতী অবুঝ কাদা ছোড়াছুড়িতে দু-জন মিলেই ভালোবাসার স্বপ্নিল সাদা ঝকঝকে বাংলোটাকে ততদিনে কেমন মলিন করে ফেলেছি। আমাদের ঘায় আমাদের‌ই দায়!

কী বোকা আর অসহায় মানুষ নামের এই দোপেয়ে অবোধ জন্তুটা! কত না-বোঝা আর বোঝার গেরো কষাকষিতে সুন্দর সময়গুলো অলক্ষে মরে যায় প্রথম অশ্রুবিন্দু ঝরবার আগেই!
সাত। যে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কনফিডেন্ট, সে কি কখনো দ্বারে দ্বারে এটা বলে ভিক্ষা (পড়ুন 'বিরক্ত') করে বেড়ায় যে, "অনুগ্রহ করে আমাকে সুন্দর বলুন।"? স্বীকৃতি তো তার‌ই দরকার, যে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কনফিউজড! মানুষ সৌন্দর্য ভালোবাসে। আপনি সুন্দর হলে মানুষ এমনিতেই আপনাকে সুন্দর বলবে। তার জন্য কাউকে অনুরোধ বা জোর করার দরকার নেই।

"এই যে আমার দিকে তাকান! দেখুন, আমি কত সুন্দর!" এরকম করে বলতে পারে যারা, তাদের সৌন্দর্য তো বহু আগেই ম্লান হয়ে গেছে!
আট। দীর্ঘ আলাপ দীর্ঘতর প্রলাপের জন্ম দেয়।

আমার অফিসরুমের এক জায়গায় লেখা আছে: অনুগ্রহ করে আলাপ সংক্ষিপ্ত করুন।

তবু বেশিরভাগ মানুষ‌ই আমাকে অনুগ্রহবঞ্চিত করে রাখেন। কেন এমন নির্দয়তা, আমি জানি না। আমি দীর্ঘ আলাপ ভয় পাই।
নয়। যে শুয়ে-বসে থাকে, তার ভাগ্য‌ও শুয়ে-বসে থাকে। যে হাঁটে, তার ভাগ্য‌ও হাঁটে; যে দৌড়োয়, তার ভাগ্য‌ও দৌড়োয়। যা ভাগ্যে থাকে না, তা-ও কখনো কখনো শ্রমে থাকে। খাটলেই পাবে। বিনা শ্রমে...বাড়ে মেধা, কমে বাধা—কেবলই রূপকথায়।
দশ। আমি কেবলই দুইটি বিষয়ের প্রতি লয়াল: আমার কাজের প্রতি আর আমার নিজের প্রতি। আমি চাই, আমার কাজে কোনো ফাঁকি না থাক এবং আমি যেন নিজে বুঝতে পারি যে, দিনশেষে আমি একজন ভালো মানুষ। এর বাইরে আর কোনো কিছুর প্রতিই আমি তেমন একটা লয়াল ন‌ই। এই দুইয়ের জন্য আমাকে যা যা করতে হয়, তার সব কিছুই যে-কোনো মূল্যে আমি করি। পৃথিবীর কারও কথাতেই আমার কিছু এসে যায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ওই দুই বিষয়ের প্রতি লয়াল আছি। প্রশংসা শুনলে বিরক্ত হ‌ই, নিন্দা শুনলে উপেক্ষা করি। (স্তাবক ও নিন্দুক, দুই-ই ধান্দাবাজ টাইপের প্রাণী।) মজার ব্যাপার, আমি বিশ্বাস করি, আমি কারও জন্য‌ই অপরিহার্য ন‌ই এবং কেউই আমার জন্য অপরিহার্য নয়। তাই খুব কাছের মানুষ আর পরিবারের বাইরে আর কাউকে নিয়েই আমার বিন্দুমাত্র‌ও মাথাব্যথা নেই। যার যা খুশি করুক, যার যেভাবে ইচ্ছে বাঁচুক। কারও কিছু নিয়েই আমার কিছু এসে যায় না। কখনোই কোনো বিষয় নিয়ে ওভারথিংক করি না, পৃথিবীর কাউকেই ভুল করেও জাজ করি না। আমি ধরেই নিই, আমি কাউকে চিনি না এবং এটা আমাকে স্বস্তি দেয়। যা-কিছু আমাকে বিরক্ত বা বিব্রত করে, তা আমি চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিই কিংবা আমি নিজেই সেখান থেকে সরে আসি; কেননা আমি আমার নিজের কাজ নিয়েই ভয়াবহ রকমের বিজি। এসব রাতারাতি হয়নি, এসব আমাকে চেষ্টা করে অর্জন করতে হয়েছে।

ভাবনা: এক হাজার চার
………………………………………………………………


এক। নিজের ঘরের বালিশে ঘুমোতে পারাটা অনেক আরামের একটা ব্যাপার। সবার সেই সৌভাগ্য হয় না।
দুই। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া, আমি কি চাকরির জন্য এখন থেকে পড়াশোনা শুরু করব? (হলি কাউ!)

উত্তর দিই না। এটার উত্তর কী হয়, আমি সত্যিই জানি না। শুধু এটুক জানি: যার হাগা দরকার, সে কখনও কাউরে জিজ্ঞেস করে হাগে না; ঠিক তেমনি, যার পড়া দরকার, সে কখনও কাউরে জিজ্ঞেস করে পড়ে না। জনাব, কথা কিলিয়ার?

হাগার বেগ আর পড়ার আবেগ সেইম জিনিস।
তিন। আজকের পরীক্ষায় ১১৫ থাকবে তো? তাহলে রিটেনের জন্য পড়তে শুরু করে দাও। সময় নষ্ট কোরো না, যাকে-তাকে বিনা কারণে সময় দিয়ো না। সময় খরচ করো নিজের কাজে, সময় যা দেবার নিজেকেই দাও; দেখবে, কাজ হয়ে গেছে! সাফল্যের শুরুটাই হয় স্বার্থপরতার হাত ধরে। (এখানে স্বার্থপর হবার মানে সচেতন হওয়া।)

১১৫ না থাকলেও পড়তে শুরু করে দাও। চাকরি পেতে চাইলে করার মতো এর চাইতে ভালো কিছু আপাতত তোমার সামনে নেই। আর পেতে না চাইলে যা মন চায় করো। দু-দিনের দুনিয়া! গ্লাসে কোক ঢেলে হাওয়াকে বলো: চিয়ার্স!!
চার। যে-লোক নিজেই সাঁতার জানে না, তার উস্কানিতে কখনও জলে ঝাঁপ দিয়ো না।
পাঁচ। চরম ফালতু ছেলেদেরকে চরম ভালো মেয়েরাই পছন্দ করে, অথচ চরম ভালো ছেলেদেরকে চরম ফালতু মেয়েরাও পছন্দ করে না।
ছয়। যারা তোমাকে খারাপ ভাবে, তাদের চাইতে তারাই বেশি ঝামেলার, যারা তোমাকে ভালো ভাবে। আর যারা তোমাকে চেনেই না, তোমার জন্য তারা সবচাইতে নিরাপদ। Being among the strangers is the best thing.
সাত। বিপদে পড়ার বা বাঁশ খাওয়ার আগপর্যন্ত সবাইকে ভালোই মনে হয়।
আট। কারও সাথে মিশলে এমনভাবে মেশো যাতে তার সাথে পরবর্তীতে কখনো না মিশলেও অসুবিধে কিংবা ঝামেলায় পড়ে না যাও। মাথা খারাপ হলে হোক, হুঁশ তবু ঠিক রেখো। সম্পর্ক যেমন‌ই হোক, কারও উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া যাবে না। সে আসার আগেও জীবন কাটছিল, সে যাবার পরেও জীবন কাটবে। যে-কোনো মূল্যে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখো। অপরিহার্যতা দাসত্বের জননী।
নয়। ভগবান সময়ে সময়ে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বিভিন্ন রকমের আদেশ-নির্দেশ দেন মূলত দুই ধরনের মানুষকে: গরিবদের আর বড়োলোকদের। মধ্যবিত্তদের ঘুম‌ও কম, তাই স্বপ্নও কম।
দশ। এপিটাফের পাশে
যে কয়টি ফুল রেখে গেলে,
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি...
ওদের গায়ে গায়ে লেগে আছে
তপ্ত রোষ।

এ রোষ বড়োজোর
নির্মল টিউলিপগুলোকে
নিস্তেজ করে দিতে পারে।

তবু...এরা আমায় ছুঁতে পারে না কিছুতেই,
ঠিক যেমনি আমার মৃত্যুও
তোমায় ছুঁতে পারেনি।
এগারো। মনে চাইছ যা,
মন চাইছে তা।

পারছি না তাই
বলতে 'না'!
বারো। তারপর বলো, তোমরা আতিফ আসলামের কনসার্টে যাওনি কেন? তোমরা কি সবাই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিচ্ছ? না কি আমাকে ফলো করলে কনসার্টে যাওয়া নিষেধ?
তেরো। মা নিজেই নিজের কন্যা। সন্তান জন্ম দিয়েই তো একজন নারী মা হন; তাকে জন্ম না দিলে কি নারীটি সেই শিশুর মা (বায়োলজিক্যাল মাদার) হতে পারেন? তাহলে মা হিসেবে একজন নারীর আত্মপ্রকাশের জন্য অপরিহার্য কাজ তথা সন্তান-জন্মদানের কৃতিত্ব‌ তো সেই নারীর‌ই। এ কারণেই নারী যখন মা হন, তখন তাঁর সেই মাতৃজন্মের উৎস তিনি নিজেই; তাই তিনি নিজেই নিজের আত্মজা বা কন্যা।
চৌদ্দ। কেন তাকেই দেখে মনে ভাবি,
"সে যেন আমায় না ঠেলে দূরে!",
যে আমায় কখনও টানেনি কাছে?

কেন বলি পড়ে তার‌ই পায়ে ,
"আমায় ছেড়ে যেয়ো না কখনও!",
যে আমার কখনও আসেনি পাশে?

ভালোবাসে যে, সে কি তবে কেবলই নিজের সাথে কথা বলে? সে কষ্ট যা পায়, তার সবটাই কি মনের ভুলে?
পনেরো। সাতাশটা বসন্ত পেরিয়ে, পৃথিবীর কাছাকাছি এসে হঠাৎ দেখি, আজকাল হৃদয়ে পচন ধরেছে। অনুভূতিগুলো এখন জমিয়ে রাখতে হয়, তা যদি না পারি, তবে কীসের শক্ত মানুষ আমি? ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়ে যায় তো যাক, তবু চোখে একফোঁটাও জল আমি কোনোমতেই আসতে দিই না।

এখন স্বপ্নগুলোর দাফন আমি অনায়াসেই দিতে পারি। সমাজের চিত্রকল্পে নিজের উন্নত একটি মস্তক আঁকতে বড্ড সহজেই বিবেকের গলায় ভারী পাথর ঝুলিয়ে নত করে দিই ব্যাটাকে!

আমি এখন বুঝতে শিখেছি, পরিবারের সম্মান ধরে রাখতে কখনো কখনো নিজের অসহায় আদলটিকেও হাসাতে হয়, নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যকে নিয়ে ভাবতে হয়। আমি ভুল না ঠিক, সে চিন্তা শিকেয় তুলে কত বারই তো কত জনের গুণগান গাইতে হয়েছে, হচ্ছে! এর কারণ? খুব সহজ . . . এখন যে আমি বড়ো হয়েছি! পরিবার ফালতু জিনিস, এভাবে বললে সমাজ কখনও মেনে নেয় না। নেবে কীভাবে, মেনে নিলে যে তার নিজের চেহারাটাই সামনে চলে আসে!

হ্যাঁ, বড়ো হয়েছি বলেই তো নিজের সুখের ভাগটুকু ছাড়তে হয়। একবুক তৃষ্ণা নিয়েও জলের ঘটিটা অন্যের সামনে এগিয়ে দিতে হয়। নাহয় প্রাণের একটু ক্ষয়‌ই হলো, তাতে কী! নিজের শুকনো গলা নিজের হাতে চেপে ধরে বলতে হয়: ও দাদা, জল খান...জল! গলাটা শুকিয়ে গেল তো! একটু ভিজিয়ে নিন!

না, না, এ দায় আসলে কারুর‌ই নয়। দোষটা যারই হোক, ঘেন্না আজকাল কেবল নিজেকেই হয়। ভালো না বাসলেও দিনশেষে কারও-না-কারও হাত ধরতে হয়। এর চেয়েও বড়ো পরাজয় আর কী হয়? বোধ হয় পরাজিত হতেই সবার জন্ম হয়।

তাই আমি সব ভুলতে গান গাই, পাখি দেখি। ফেইসবুকে ছবি দিই, কখনোবা বুলি ছাড়ি। আর কীই-বা করার ছিল আমার? তবে কী মশাই জানেন, সাতাশ বছর পেরিয়ে আমি বুঝলাম, কারও কারও স্রেফ বাঁচার তাগিদেই বড়ো হতে হয়! শালার জীবন . . . কী যে বাজে একটা জিনিস!
ষোলো। কেউ তোমাকে তৃণ দিলেও,
যেয়ো না ভুলে . . . ওঠোও যদি চিতায়।
কাউকে তুমি অরণ্য দিলেও,
পরমুহূর্তেও রেখো না মনে . . . বৃথাই।

ভাবনা: এক হাজার পাঁচ
………………………………………………………………


এক। বুঝিই তো না, পড়ে কী লাভ? কিংবা পড়ব কীভাবে?

একটা সহজ বুদ্ধি দিই। বুঝে বুঝে পড়া ভালো, তবে সেটা করতে না পারলে পড়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এতে কাজ হয়। শর্ত একটাই: বুঝুন না বুঝুন, পড়তে মন চাক না চাক, কোনোভাবেই পড়া বন্ধ করা যাবে না। বুঝে বুঝে পড়ে নয়, বরং পড়ে পড়ে বুঝেই আমার বন্ধুবান্ধব ও ছাত্র-ছাত্রী'দের মধ্যে অনেককেই টপার হতে দেখেছি।

(আমার লেখা 'মন বসে না পড়ার টেবিলে' না পড়লে অবশ্যই অবশ্যই পড়বেন এবং সেখানে যা যা বলা আছে, মাত্র ১৫ দিন অবিকল সেভাবেই কাজ করবেন। তাতেও পড়ার মধ্যে ঢুকতে ব্যর্থ হলে আমার অফিসে এসে আপনার সময় নষ্ট করার দায়ে আমার দুইগালে জুতোপেটা করে যাবেন। তবে তা করার আগে ওই লেখার ইন্সট্রাকশনগুলি অবিকল ফলো করতে হবে।)
দুই। নিজের বা স্বামীর বা শ্বশুরের বা বন্ধুবান্ধবের বা পরিবারের কারও পেশাগত, রাজনৈতিক, আর্থিক পরিচয় দেওয়া বাদে আর তেমন কিছুই বলার নেই যাদের, তাদের সাথে কথা বলা পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর কাজ। এদেরকে সহ্য করতে হ‌ওয়া প্রতিষ্ঠিত হবার জাকাত।
তিন। মানুষ তার জীবনের ৬০ ভাগ খরচ করে সম্পদ অর্জনের কাজে, বাকি ৪০ ভাগ খরচ করে সেই সম্পদ রক্ষা করার কাজে।

মানুষ তাহলে বাঁচে কখন?
চার। যে ভাবে, তার হৃদয়ে ভালোবাসা নেই,
সে আসলে এমন কারও সংস্পর্শে কখনও আসেনি,
যে তার ভুলটা ভাঙাতে পারে।

শুষ্ক-নীরস মানুষের হৃদয়েও ভালোবাসা আছে, কিন্তু সে তা জানে না।
পাঁচ। হঠাৎ কইরাই বুঝতে পারলাম, হাত বাড়াইলেও আমার হাতটা ধরার মতন তেমন কেউ নাই। হাতটা বাড়ায় দিয়া যখন দেখলাম, হাতটা ধরার মতন তেমন কেউ নাই, তখনই টের পাইলাম, আমি বড়ো হইছি।

বড়ো হইলে অনেক ঝামেলা, যখন-তখন যেমন-তেমন কইরা কার‌ও কাছে কোনো আবদার করন যায় না, তুলতুইলা বিলাইর লাহান ভরসার কোনো বুকে নাক ডুবান যায় না, কারণে-অকারণে ফিক কইরা হাসন যায় না, চিল্লায় চিল্লায় কান্দন যায় না, মা'র হাতে ভালোবাসায় মাখা দুইলোকমা ভাত খাওন যায় না, মনের কথাগুলান গরগর কইরা কারও সামনে বাইর কইরাও দেওন যায় না।

ছোটো থাইকা বড়ো হওয়ার সময় তা-ও কেউ-না-কেউ থাকে, কিন্তু বড়ো হইয়া গেলে পরে কাছের তেমন মানুষও থাকে না—এমন এক জন‌ও থাকে না, যার লগে মন-ক্যামন-করা কাঠখোট্টা দুপুর মাথায় নিয়া সন্ধ্যার গায়ে গিয়া পড়ন যায়। একটাও বিকাল‌ কল্পনায় কল্পনায় চিন্তা ছাড়া পাড় করন যায় না, পাখির লাহান ডানা মেইলা উড়ন যায় না।

হায়রে বয়স!
ছয়। কেউ কেউ ভালোবেসে সুখ পায়,
কেউ কেউ শেয়ারবাজারে লাভ পায়।

ভাই, ওদের কপালে কপাল ঘষার জন্য টিকিট সিস্টেম চালু করা যায় না?
সাত। - কী রে! এ যে মরণসম্ভবা রোগ! কী বিষ দিল সে তোকে?
- বেশ গুরুত্বের সাথে . . . 'অবহেলা'।
- তবুও পথ চেয়ে আছিস কেন রে?
- একআকাশ অবহেলার বিনিময়ে . . . ফিরিয়ে 'গুরুত্ব' দিতে!
- এতে যে কেবলই নিজের সর্বনাশ!
- তা কি পারবে পেরোতে আমার দীর্ঘশ্বাস?
আট। চেয়েছিলাম হট কাউকে,
আর ভগবান কিনা ফট করে পাঠিয়ে দিলেন হট ওয়েদার!
নয়। আপনি যে ঘাস খান না, এটা যেহেতু আমি জানি, সেহেতু আপনারও জানা উচিত যে, আমিও ঘাস খাই না; যদি এটা আপনি না জানেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই, আমার জানায় ভুল আছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
দশ। কোনো একটা সাবজেক্ট পড়তে ইচ্ছে না করাটা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে যাবার অজুহাত হতে পারে না, বড়োজোর পছন্দের একটা সাবজেক্ট পড়তে আরম্ভ করার অজুহাত হতে পারে।

ফেইসবুকে কী করি? কোনো একটা রিল দেখতে ভালো না লাগলে পরের রিলে যাই। ক‌ই, তখন তো ফেইসবুক ছেড়ে বেরিয়ে আসি না!
এগারো। তোমার শরীরে ভুঁড়ি আছে। ছয় মাস একটু কমিয়ে খাও আর ব্যায়াম করো। দেখবে, তুমি ধরে রাখতে চাইলেও ভুঁড়ি থাকছে না।

তোমার শরীরে সিক্সপ্যাক আছে। ছয় মাস একটু বাড়িয়ে খাও আর ব্যায়াম ছাড়ো। দেখবে, তুমি ধরে রাখতে চাইলেও সিক্সপ্যাক থাকছে না।

তোমার ভেতরে জ্ঞান আছে। জ্ঞানার্জন সম্পর্কিত সকল ধরনের চেষ্টা ছয় মাস থামিয়ে রাখো, বরং পারলে এমন কিছু (তোমার যা মন চায়) করো যাতে অর্জিত জ্ঞান ধ্বংস হয়ে যায় কিংবা কমে যায়। দেখবে, তুমি ধরে রাখতে না চাইলেও জ্ঞান তবু থেকে যাবে। জ্ঞানের স্থায়িত্ব‌ই সবচাইতে বেশি।

এখন তুমিই বলো, পৃথিবীতে সত্যিকারের ঐশ্বর্য কোনটি? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষকে খুন করলেও তার জ্ঞানের মৃত্যু ঘটানো যায় না, উলটো তা আরও ছড়িয়ে যায়! অথচ তোমরা কিনা ভুঁড়ি আর সিক্সপ্যাক নিয়ে দিনরাত গবেষণায় মেতে আছ! রাস্তাঘাটে যাঁরা কুলি-মজুরের কাজ করেন, ওঁদের দিকে তাকাও। ভুঁড়ি কিংবা সিক্সপ্যাক অনেকের শরীরেই পাবে। জ্ঞান পাবে কি?

যে যেখানে অনবরত সময় দেয়, একদিন সে সেখানে রাজা হয়। এখন তুমিই ঠিক করো, তুমি কোন ঐশ্বর্যের রাজা হতে চাইছ।


ভাবনা: এক হাজার ছয়
………………………………………………………………


এক। যাত্রাশুরুর সালটা ১৯২১। বয়স ১০৩ বছর পেরিয়ে গেছে। আসছে জুনের শেষের দিকে ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হবে। প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। অধ্যক্ষ মহারাজের আন্তরিক চেষ্টায় আশ্রমপ্রাঙ্গণে সাততলা আধুনিক দালান উঠেছে। স্বামী বিবেকানন্দের বেশ চমৎকার একটা মূর্তি সেখানকার কনফারেন্স রুমে শতবর্ষের উৎসবে সেই দালানে দোতলার সম্মুখভাগে স্থাপিত হবার অপেক্ষায় আছে। কিছু মাস আগে দিনাজপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শতবর্ষ উদ্‌যাপিত হলো। সে এক বিরাট আয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অনেক সন্ন্যাসী এসেছিলেন; ফরিদপুরেও আসবেন।

জ্ঞানযোগে ঋদ্ধ হবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন বড়ো আদর্শ এক জায়গা। রত্নের এমন সম্ভার তেমন বেশি পাওয়া যায় না। আপনি যে মতের কিংবা পথের‌ই হন না কেন, রামকৃষ্ণ মিশনে এসে পরম স্বস্তি পাবেন। গীতায় বিধৃত সমদর্শিতার অপূর্ব প্রকাশ এখানে খুব ভালোভাবেই ঘটেছে। রামকৃষ্ণ মিশনে এলে আপনার কিছু মজার অভিজ্ঞতা হতে পারে। হয়তো দেখবেন, একজন সন্ন্যাসী বাগানে কাজ করছেন কিংবা পথের ধুলো ঝাঁট দিচ্ছেন। আপনি টের‌ই পাবেন না যে, একটু আগেই আপনি যাঁর কাছ থেকে সেবা পেলেন, সন্ন্যাস গ্রহণের আগে তিনি অক্সফোর্ডে বা এম‌আইটি’তে পড়াতেন। (ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী তো এখানে আছেন অনেকেই।) ওঁরা কখনও কাউকেই নিজের প্রকৃত (পূর্বাশ্রমের) পরিচয় বলেন না। সন্ন্যাসীর একটাই পরিচয়: তিনি একজন সন্ন্যাসী—”পুড়বে সাধু, উড়বে ছাই…তবেই সাধুর গুণ গাই”। ঠিক এমনই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার বুদ্ধগয়াতেও হয়েছে। ঘটনাটি বলছি।

আমরা বোধিবৃক্ষ দেখতে গিয়েছি। ওখানে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। বাইরে একজন সন্ন্যাসী আমাদের সবার জুতো ব্রাশ আর একটুকরো কাপড় দিয়ে ঝেড়ে-মুছে গুছিয়ে রাখছিলেন। তাঁর দিকে স্বাভাবিকভাবেই অতটা খেয়াল না করে আমরা চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। বের হবার পর জুতোগুলি ওরকম সাজানো-গোছানো দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। সেই কর্মীকে ধন্যবাদ এবং কিছু বকশিস দেবার জন্য খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে না পেয়ে ওখানকার এক ভদ্রলোককে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে যিনি জুতো গুছিয়ে রাখছিলেন, তিনি কোথায়? (আমি তখনও জানি না যে, সেই পরিচ্ছন্নতা-কর্মীটি একজন সন্ন্যাসী।) “তিনি তো একটু কাজে গেলেন। কেন?” “না, মানে, ধন্যবাদ আর কিছু বকশিস দেবার জন্য।” “কী বলছেন! উনি তো বকশিস নেবেন না! আপনাদের সেবা করা তাঁর দায়িত্ব, উনি যে সন্ন্যাসী!” এরপর তিনি ইশারায় সেই ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিলেন। একটু দূরে উনি দু-জন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। খেয়াল করে দেখলাম, সন্ন্যাসীটি দেখতে ইউরোপীয়দের মতন। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে জিজ্ঞেস করলাম, উনি এখানে কোথা থেকে এসেছেন? উত্তর এল, আমেরিকা থেকে। “আচ্ছা। আমেরিকায় উনি কী করতেন? তাঁর পরিবার কোথায়?” “স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তাঁর দুটো পিএইচডি আছে। নোবেল পুরস্কারের জন্য‌ও তাঁর নাম‌ উঠেছিল। পরিবার আমেরিকাতেই; উনি এখানে একা থাকেন।”

কেবলই শান্তির খোঁজে অমন যশখ্যাতি, পরিবার-পরিজন সব ছেড়েছুড়ে যে-মহামানবটি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়েছেন, আমি কিনা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি বকশিস দেবার জন্য! নিজের প্রতি সেই অসীম ধিক্কার ও গ্লানিবোধ আমার মধ্যে বহুদিন টিকে ছিল। আমার পরবর্তী অভিজ্ঞতায় শ্রীরামকৃষ্ণকেও দেখি, নিজের মনে যেন অবচেতনেও অহংকার জায়গা করে না নেয়, তার জন্য তিনি চুল বড়ো রাখছেন আর সেই চুল দিয়ে সবার অলক্ষ্যে মেথরদের টয়লেটের ময়লা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। আহা, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলনের প্রাক্‌মুহূর্তে নীরব-নিভৃত বোঝাপড়ার এ কী পরাকাষ্ঠা!

শত বছরের পুরোনো ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনে এর আগে কখনও আসা হয়নি। প্ল্যান করেছিলাম আসার, কিন্তু ব্যাটেবলে মেলেনি। আজ মিলল, তাই এলাম। এখানকার সিদ্ধার্থ মহারাজের সাথে গল্প করলে ময়মনসিংহের ইমন মহারাজের কথা মনে পড়ে যায়; দু-জন‌ই ভীষণ বন্ধুবৎসল। নিত্যানন্দ মহারাজকে দেখে প্রথমে একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম; তাঁর চেহারা দিনাজপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ বিভাত্মানন্দ মহারাজের সাথে অনেকটা মেলে। আরেক জনের সাথে দেখা হলো, প্রকাশ মহারাজ; আলাপ করতে ভীষণ পছন্দ করেন, বাকিদের মতোই বেশ সরল আর আন্তরিক। আশ্রমের অধ্যক্ষ তুলসী মহারাজের সাথে আমার পরিচয় বহুদিনের। দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনের বুকস্টলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তেমন কোনো বুদ্ধিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই তিনি আমাকে বড্ড স্নেহ করেন।

রামকৃষ্ণ মিশন বেশ শান্তির জায়গা, “যত মত, তত পথ” দর্শনের সূতিকাগার ও চর্চাকেন্দ্র। আমার কাছে দারুণ লাগে। সুযোগ পেলেই তাই এখানে আসি। আসি অবশ্য আরেকটা টানে। এই টানের উৎস আমার মনের গড়ন, চৈতন্যের ঘর। রামকৃষ্ণ মিশনের বুকস্টলে যাঁরা ব‌ই ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁরা জানেন, বেদ, গীতা, উপনিষদ, বেদান্ত, ভাগবত, পুরাণ থেকে শুরু করে সনাতন ধর্মদর্শনের অন্যান্য ঘরানার পোকা যাঁরা, ওঁদের জন্য একেবারেই আদর্শ একটি জায়গা এই বুকস্টল। আমি এবং আমার মতন অনেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের বুকস্টলের কাছে ঋণী, নিজেকে তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় রসদের অনেকটুকুই এখান থেকে জোগাড় করেছি বলে। ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের বুকস্টলের কালেকশন সত্যিই খুব চমৎকার। এখানে এলে মুগ্ধ হবেন।

ভালোভাবে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে চাইলে জ্ঞানার্জন এবং তা প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। এসব কি আর এমনি এমনি হাওয়া থেকে হয়? প্রচুর পড়তে হয়, ব‌ইয়ের সাথে দিনযাপন করতে হয়। সনাতন ধর্মদর্শন বয়স নির্বিশেষে জ্ঞানে-বড়ো মানুষের কাছে মাথা নত করতে শেখায়। মাথা নত করলেই বরং উঁচু হয়। যত‌ই নোয়াবেন, ততোধিক বাড়বেন—হিন্দুধর্মের এ এক অদ্ভুত জাদু! এখানেই আমাদের স্বাতন্ত্র্য।

ফরিদপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ঘুরতে আসবেন। এখানকার বুকস্টলের মতন সমৃদ্ধ বুকস্টল অল্প দু-একটি মিশনে আছে।
দুই। জীবনের এতগুলি দিন যার উপস্থিতি ছাড়া পার করেছি, তার উপস্থিতি না থাকলেও জীবনের বাকি দিনগুলি দিব্যি পার করে ফেলতে পারব।

এ কারণেই যে অপরিচিত লোক (এমনকী পরিচিত লোক‌ও) আমাকে বিরক্ত/বিব্রত করে বা বাজে ফিল করায়, আমি তাকে একসেকেন্ড‌ও না ভেবে ব্লক করে দিই। থাকুক যে যার মতো। সবাই শান্তিতে বাঁচুক।

ব্লক না করলে অসুবিধে দুইটি:
তার ওরকম গায়ে-পড়া আচরণের প্রতি নীরব সম্মতি প্রকাশ করা হয়
ভবিষ্যতেও এ ধরনের আচরণ করার সুযোগ তার সামনে খোলা রাখা হয়

ছাগলের জন্য বেড়া লাগে।

হ্যাঁ, ইগনোর করাই যায়। তবে সেক্ষেত্রে বার বার ইগনোর করা লাগতে পারে। এমন লোক তো আপনার উপেক্ষার‌ও যোগ্য নয়! অত সময় কোথায়? সময় যে বড্ড দামি!

কী দরকার! মানুষ যেখানে নিজের সন্তান বা পিতা-মাতাকে ছাড়াও একদমই ঠিকঠাকভাবে বাঁচতে পারে, সেখানে একজন উটকো লোককে নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবার তো কোনো কারণই দেখি না! মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু মাত্র দুই জন: সে নিজে এবং তার ব্যস্ততা। সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য এর বাইরে আর কিছুই অপরিহার্য নয়।

আপনার বড়ো প্রাসাদ থাকতে পারে, কিন্তু আমার কুঁড়েঘরটি আপনার নয়, আপনি চাইলেও এখানে ঢুকতে পারবেন না। কথা ক্লিয়ার?
তিন। মানুষকে কখনও ধর্ম দিয়ে বিচার করবেন না, কেননা অমানুষের কোনো ধর্ম হয় না।
চার। মেধাবী মানুষ আর ভালো স্টুডেন্ট এক জিনিস নয়। বুঝতে শিখুন।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভালো স্টুডেন্ট বানাতে পারে, কিন্তু মেধাবী মানুষ ভিন্ন জিনিস। ভালো স্টুডেন্ট বানানো যায়, আর মেধাবী মানুষ তৈরি হয়।

কোনো পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে যারা, ওদেরকে দেখলেই দুম করে 'মেধাবী মানুষ' বলে ফেলবেন না, 'ভালো স্টুডেন্ট' বলুন।

একজন মেধাবী মানুষ চাইলেই ভালো স্টুডেন্ট হতে পারে, কিন্তু একজন ভালো স্টুডেন্ট চাইলেও মেধাবী মানুষ না-ও হতে পারে।


ভাবনা: এক হাজার সাত
………………………………………………………………


এক। পহেলা বৈশাখ পালন করলেও গরম লাগবে, না করলেও গরম লাগবে; পালন করলেও রসালো আম খাবেন, না করলেও রসালো আম খাবেন।

দিনশেষে, কাহিনি কিন্তু এক‌ই।

যারা পালন করে না, তারা যেমন বুঝে পালন করে না; ঠিক তেমনি, যারা পালন করে, তারাও কিন্তু বুঝেই পালন করে। যার বুঝ তার কাছে।

এত ক্যাঁচাল করে কী লাভ? তার চেয়ে, আসেন, ভাই, দুই ভাই মিলে আইসক্রিম খাই। গরম লাগে, গরম...
দুই। রেজাল্ট দেখে নয়, মন বুঝে বন্ধুত্ব কোরো। দিনশেষে, ওসব রেজাল্ট-ফেজাল্ট কিচ্ছু থাকে না, কেবল মনটাই থাকে। আরও সহজ করে বলি। এমন কারও সাথেই বন্ধুত্ব কোরো, যার মনটা তোমাকে সহ্য করতে রাজি। সে ফেইল করুক, পাশ করুক, টপার হোক, গাধা হোক, তাতে তোমার কী এসে যায়? মানুষকে নিজের ব্রেইন ধুয়েই জল খেতে হয়; পরের ব্রেইন ধুয়ে জল খাওয়ার কোনো সুযোগ তো নেই, তাই না? তাহলে সে টপার, না হার্ভার্ডফেরত, ওসব দিয়ে তোমার কী এসে যায়? যার সাথে মেশার সময় আত্মসম্মানবোধ বিকোতে হয় কিংবা লো ফিল হয়, তার সাথে তোমাকে মিশতেই হবে কেন? যোগাযোগ বাড়াবে যত, যন্ত্রণা বাড়বে ততোধিক। মানুষ চাইলে মানুষ ছাড়ো।

একটা ছোট্ট তথ্য দিই। (মনে হয়, অপ্রাসঙ্গিক হবে না।) আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ ভয়াবহ রকমের ইন্ট্রোভার্ট মানুষ ছিলেন। কখনোই তেমন কার‌ও সাথে মিশতেন না। তাঁর উল্লেখযোগ্য কোনো কবিবন্ধু ছিল বলেও আমাদের জানা নেই। কখনও নিজে থেকে কোনো সাহিত্যসভায় যেতেন না। (নেহায়েত বাধ্য হয়ে গেলেও ঠিকভাবে কথা বলতে পারতেন না বা চাইতেন না, নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন।) সব ধরনের সাহিত্যআড্ডা সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলতেন। তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বড়ো হবার রাস্তা একবার চিনে ফেললে সেই রাস্তার পথিকদের সাথে না মিশেও সেই রাস্তার পথিক হ‌ওয়া যায়। (ওটাই বরং শ্রেয়, কেননা লোকের সাথে বেশি ওঠাবসা করলে অহেতুক‌ই সময় নষ্ট হয়।)

পার্থিব কোনো হিসেবের ফলে সৃষ্ট বন্ধুত্ব সবসময় কষ্টই বেশি দেয়। যার সামনে ইচ্ছেমতো আনসেন্সরড কথাবার্তা বলা যায় না কিংবা প্রাণ খুলে কাঁদা যায় না, তার সাথে বন্ধুত্ব হয় নাকি?
তিন। সঙ্গ না হলে ভালো,
রঙ্গ ভালো হয় কি?
চার। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যথার্থ গুরুকে (তিনি যদি বয়সে ছোটোও হন, তবুও) পূজা করি। এই গুরু মানুষ না-ও হতে পারেন, যেমন শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা আমাদের গ্রন্থগুরু; সেক্ষেত্রেও তিনি সনাতনধর্মে পূজিত হন। এভাবে পূজা করতে করতে একসময় পূজারি ও পূজ্য এক হয়ে যান, ঠিক যেমনি রাহু ও রাহুর মস্তক বস্তুত অভিন্ন সত্তা। (তুলনীয়: এক মননে ও ধ্যানে ব্রহ্মের উপাসনা করতে করতে ব্রহ্মজ্ঞানে তথা ব্রহ্মত্বে অধিষ্ঠিত হ‌ওয়া)

অধ্যাত্ম-দর্শনের এই অভিনব জাদু আপনি অদ্বৈতবাদ ও সুফিবাদ বাদে আর কোথায় পাবেন? ধর্মের সৌন্দর্য এখানেই।
পাঁচ। খাটো, ভূতের মতো খাটো।

খুব বেশি খাটলে খুব বেশি হলে এমন কীই-বা ক্ষতি হবে? শরীরটা চলে যাবে, তাই তো?
স্বপ্ন পুড়ে ছাই হবার চাইতে তো
শরীর পুড়ে ছাই হ‌ওয়া ঢের ভালো।
কী বলো?

খাটো! খেটে যাবার নাম‌ই জেনেছি 'বেঁচে থাকা'।
ছয়। এইমাত্র এক ফ্রেন্ড ফোন দিসে।

: দোস্ত, ইদ মুবারক।
: (হাই তুলতে তুলতে) হ্যাঁ রে দোস্ত, ইদ মুবারক।
: কী করস?
: ঘুমাই।
: এখনও উঠস নই?
: উঠসি তো! চা-টা খেয়ে আবার ঘুমাই।
: ভালো তো! আমিও সেটাই করসি। হঠাৎ মনে হলো, তোরে একটা ফোন দিই। তারপর আজকের প্ল্যান কী?
: দোস্ত, প্রশ্ন কমন পড়ে নাই। সহজ প্রশ্ন কর। নাইলে বিসিএস পরীক্ষার মতো বানায়ে বানায়ে উত্তর বলা লাগবে। আমার কখন‌ও কোনো প্ল্যান-ট্ল্যান থাকে না।
: হা হা হা…কী করবি, সেটাই ক। বের-টের হবি? বাসায় চলে আয়, সেমাই-টেমাই খা।
: কী করব, ক্যামনে ক‌ই? তোর বাসায় আসতে মন চাইতেসে না। এখন ঘুমাইতেসি, বেডে গড়াগড়ি খাইতেসি, এটাই ভালো লাগতেসে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর যদি নড়াচড়া করতে মন চায়, তখন দেখি…
: তোর তো দেখি আমার জামাইয়ের মতন অবস্থা! সে-ও বরিশালে আসলে অনেক গবেষণা করেও বুঝতে পারে না যে, কী করবে!
: বুঝসস, আমরা হ‌ইতেসি নিষ্পাপ কিসিমের মানুষ। নিষ্পাপ মানুষের ঘুমানো বাদে আর কোনো প্ল্যান থাকে না। যত প্ল্যান, তার সব‌ই থাকে খালি পাপীদের।
: ঘুমা তুই, বান্দর! বিকালে চল সবাইরে নিয়া তালতলী ব্রিজের ওদিকে যাই।
: দোস্ত, মাটন রান্না হ‌ইতেসে; দেখা যাক, দুপুরের পর ভুঁড়ির ওজন নড়তে দেয় কি না!
: তোর ভক্তকুলের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করবি না?
: ভাইরে, মাফ চাই, দোয়াও চাই! ওসব ভুয়া জিনিস। একমাত্র ঘুম‌ই আসল। কালকেও সারাদিন ঘুমাইসি। তুই এখন ফোন রাখ্! যা, ভাগ্! বিকালে ফোন দিব। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফুচকা-আইসক্রিম খাব আর শহরে রিকশাভ্রমণ করব।

(ফ্রেন্ডের সাথে বাতচিৎ শেষ করে এখন ব্ল্যাককফি খাই। খাওয়াশেষে হয় লিখব, নয় ঘুমাব। এই তো জীবন!)

ভাবনা: এক হাজার আট
………………………………………………………………


এক। আমাকে ভুল বুঝবেন না।
আমাকে যখন কেউ কেয়ার করত না, আমি তখনও ছিলাম ড্যামকেয়ার টাইপের।
আমাকে এখন অনেকেই কেয়ার করে, আমি এখনও ড্যামকেয়ার টাইপের‌ই আছি।

'ড্যামকেয়ার' ব্যাপারটা আমার কাছে দুইটি স্ট্যান্ড মিন করে: আত্মসম্মানবোধ ও ব্যস্ততা।

হাতে সময় অল্প থাকলেই বরং ভালো: নিজে ফালতু হবার সময় পাওয়া যায় না, ফালতু লোককে সহ্য করার সময় পাওয়া যায় না।

ব্যস্ততা, অসুস্থতা, বিশ্রাম বা বিনোদন...এই তিনেই জীবন।
আরেক জনকে নিয়ে গবেষণা করা কিংবা আরেক জনের পেছনে লাগা? নো ওয়ে!
দুই। রান্না ভালো হলে যে লোক কিছুই বলে না, কিন্তু খারাপ হলে দুনিয়ার খারাপ কথা বলে, তাকে রান্না করে খাওয়াতে কার‌ও ইচ্ছে করে?
তিন। ঘরের ভালোবাসায় যখন অভাব পড়ে, তখনই মানুষ ঘরের বাইরে, একান্ত নিজের ভাবে, এমন কারও কাছ থেকে অ্যাটেনশন চায়, ভালোবাসা চায়। শুধু একটু ভালোবাসবে, তাকে বুঝতে পারবে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু ভরসা দেবে, এমন কাউকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বেড়ায়। এখানে তার মধ্যে কোনো নেগেটিভ চিন্তা কাজ করে না।
চার। প্রাচ্যে যা-কিছু করতে বারণ করা আছে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে, পাশ্চাত্যে তা-ই করতে বারণ করা আছে আইনের অনুশাসনের মাধ্যমে। ওখানকার মানুষ আইন যতটা মানে, ধর্ম ততটা মানে না। এখানকার মানুষের বেলায় ব্যাপারটা উলটো। ওরা মৃত্যুর আগের জীবন নিয়ে যতটা ব্যস্ত, আমরা মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ততোধিক ভীত। আমাদের বেশিরভাগ ভালো কাজের অনুপ্রেরণা মৃত্যুর পর সুখে থাকার লোভ কিংবা শাস্তি পাবার ভয়, যা ওদের মাথাতেই কখনও আসে না। তাই ওদের মনে কর্মের ভয় আর আমাদের মনে ধর্মের ভয়।

শিক্ষিত ও ভদ্র জাতিকে বাঁধতে হয় আইনে, ধর্মে নয়। একজন মানুষ কেবল ভদ্র হলেই তিনি ধর্মের পথে অনেকটা এগিয়ে যান। তবে পলিসি কিন্তু দুটোই ভালো। যাকে যা বললে বা বোঝালে কাজ হয়, তাকে তা-ই বলে বা বুঝিয়ে কাজ হাসিল হলেই তো হলো! ঈশ্বরে বিশ্বাস করে খারাপ কাজ না করা আর আইনে বাঁধা পড়ে খারাপ কাজ না করা—এক‌ই তো ব্যাপার। দি এন্ড জাস্টিফাইস দ্য মিনস। কাজ হ‌ওয়া নিয়ে কথা, তা যেভাবেই হোক—আইনের শাসনে (কর্মের ভয়ে) কিংবা শাস্ত্রের নিষেধে (ধর্মের ভয়ে)। ‘কর্মই ধর্ম’ নীতিতে চলা জাতির জন্য আইন, ‘ধর্মই কর্ম’ নীতিতে চলা জাতির জন্য বিশ্বাস। আইনের রক্ষক কর্ম, আর বিশ্বাসের রক্ষক ধর্ম।

ধর্ম না মানলে আইন,
আইন না মানলে ধর্ম।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম বড়ো, না কি আইন বড়ো? এর সহজ উত্তর: কোনোটিই নয়, বরং মানুষ‌ই বড়ো। মানুষ আইনে বাঁচুক বা ধর্মে বাঁচুক, তাতে কিছু এসে যায় না; যে করেই হোক . . . বাঁচুক।
পাঁচ। যা নিয়ে ব্যাখ্যা বা সময় দেবার ঠ্যাকা পড়ে নাই, তা নিয়ে কখনোই ব্যাখ্যা বা সময় দেবেন না। কিছু লোকের আজাইরা সময় ম্যালা, তাই যে-ব্যাখ্যা তাদের দরকার নাই, তা নিয়েও পড়ে থাকে। অবশ্য আপনার হাতেও সময় ম্যালা থাকলে ভিন্ন কথা।

সহজ করে দিই। যে আপনাকে কখনোই গুড ফিল করায় নাই, সে যদি হঠাৎ উদিত হয় ব্যাড ফিল করাতে, তাকে পুরোপুরি ইগনোর করুন। আপনার পিছে লাগার জন্য আপনাকে তার দরকার, কিন্তু নিজের পিছে লাগানোর জন্য তাকে তো আপনার দরকার নাই, তাই না?
ছয়। বেআক্কেল লোকের ব‌উ বা গার্লফ্রেন্ড হ‌ওয়াটা অনেক দুঃখের।
সাত। আপনার সাথে আমার মূল পার্থক্যটা কোথায়, জানেন?

আপনি আমাকে সহ্য‌ই করতে পারেন না, আর আমি আপনাকে চিনিই না।

তারচে' বরং একদিন অফিসে আসুন, চা খেতে খেতে গল্প করি। যার সাথে পরিচয়‌ই নেই, তাকে এভাবে জাজ করতে আপনার খারাপ লাগে না?

বুঝলাম, আমাকে নিয়ে ভাবার মতো সময়‌ও আপনার হাতে নেই; তাহলে সহ্য করতে না পারার মতো এই রুচি আসে কোত্থেকে? পরিচিত যাদেরকে আমার সহ্য করতে ইচ্ছে করে না, ব্যস্ততার কারণে তাদেরকে মনেই রাখি না; তবুও কখনও কাউকে নিয়ে বাজে কথা বলি না। (আমার পরিচিত কেউ যদি আমাকে কখনো কাউকে নিয়ে একটাও বাজে বা অসম্মানজনক কথা বলতে শুনে থাকেন, দয়া করে কমেন্টে মুখের উপর বলে দিন।)

বাদ দিন এসব! আপনি আমার সম্পর্কে সত্যিই ভুল জানেন। আসুন, একসাথে চা খাই। চায়ের নিমন্ত্রণ নিন কিংবা দিন। মাত্র দু-দিনের জীবন!
আট। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আপনি অনলাইনে না এলে এক আপনার নিজের বাদে আর কার‌ও প্রাণ‌ই ছটফট করে না। তাই অনলাইনে এসে আপনি এক নিজেকে বাদে আর কাউকেই উদ্ধার করে ফেলেননি। আরে ভাই, আপনি সাত দিন অনলাইনে না এলে অষ্টম দিনে তো লোকে আপনাকে ভুলেই যাবে!
নয়। ছেলেরা ঈর্ষা করো,
মেয়েরা ক্রাশ খাও।

বাকিরা হা-হা/অ্যাংগ্রি রিঅ্যাক্ট দাও।

তোমরা আমাকে সহ্য করতে পারো না কেন? তোমাদের চেহারা কি একটু বেশিই খারাপ?
দশ। রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির প্রাঙ্গণে জবার প্লেবয় বয়ফ্রেন্ডের সাথে। এক বিএফ, চার জিএফ। গ্যাবন ছুন্ধর!

গাছটা দেখে মুগ্ধ ও 'অনুপ্রাণিত' হয়েছি; আবেগে চোখে জল এসে গেছে! চার রঙের ফুল, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে...কোথাও কোনো গ্যাঞ্জাম নাই। এই গাছ আগের জন্মে সুপারম্যান ছিল! এই জন্মে অভিমান করে গাছ হয়ে গেছে, কিন্তু সেবাদানের মহান আদর্শ থেকে সরে আসে নাই। নীরবে নিভৃতে সেবার এ কী অপূর্ব মাহাত্ম্য প্রচার করে চলেছে গাছটি!

মেয়েরা, শিখো, বুঝসো? শিখো! খালি খালি ভেজাল করে কোনো লাভ আছে? সবাই মিলে বোনের মতো থাকবা, ভাগাভাগি করে (ফাইভএক্স কোরিয়ান স্পাইসি রামেন) খাবা, বয়ফ্রেন্ডের/জামাইয়ের পকেট থেকে ইচ্ছামতন খসায়ে তারে ফতুর করে দিবা। দেখবা, বেঁচে থাকতে ভালো লাগতেসে, পৃথিবী বড়োই সৌন্দর্য। তোমরা থাকতে যদি তোমাদের বিএফ বা জামাই শান্তিতে থাকে, তাইলে তোমাদের বেঁচে থেকে কী লাভ?

এখন এনায়েতপুরে গোলামি করতে যাই...যদি কিছু আহার মেলে! সকলের দোয়াপ্রার্থী।