ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা: ১৩৭


ভাবনা: নয়-শো তিপান্ন
………………………………………………………

১। যা হবার হয়েছে,
যা হবার হবে।

এসব নিয়ে ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়ে জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করা বোকামি।

২। শুধুই হৃদয় দিয়ে নয়, মাথা দিয়েও কাজ করতে শেখো।

Sometimes your heart is just a piece of shit.

৩। যে মেয়ের চেহারা খারাপ, বাপের পয়সা নেই, নিজেও স্টুডেন্ট খারাপ, কোনোমতে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে বের হয়েছে, সে কেন হাইক্লাস মেধাবী প্রতিষ্ঠিত ভদ্রমার্জিত রুচিশীল শিক্ষিত পরিবারের ছেলেকে স্বামী হিসেবে পেতে চায়?

মেয়েদের এতটা আহাম্মক হবার কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে, ছোটোবেলায় বাবা-মা ওই সন্তানকে ঘি-ভাত খাওয়াননি, এজন্য মেয়ের বুদ্ধি খাটো হয়েছে, সে বোঝে কম।

ভদ্র-মার্জিত-শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত মেধাবী প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিয়ে করতে চাইলে নিজের পরিবারকেও সেই লেভেলটা মেইনটেইন করতে হয়, ছোটো থেকে কার্টেসি আর ম্যানারিজম প্র্যাক্টিস করতে হয়, নিজে-সহ নিজের পরিবারের সদস্যদেরও শিক্ষিত ভদ্র মার্জিত করে গড়ে তুলতে হয়, ঘরের পরিবেশ পরিবর্তন করতে হয়, এলাকায় ভদ্রলোক হিসেবে নামডাক থাকতে হয়, তারপর এসব আশা করা যায়।

নিজে অশিক্ষিত, পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরও এক‌ই অবস্থা, এমন অবস্থায় এসব অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। হ্যাঁ, বাস্তবতা এটাই বলে।

৪। সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে রাখতে একসময় মানুষ নিজের সাথেই সম্পর্ক খারাপ করে ফেলে।

কোনো মানে হয়?

৫। কার‌ও স্বভাব নষ্ট হয় না পেয়ে না পেয়ে,
কার‌ওবা স্বভাব নষ্ট হয় পেয়ে পেয়ে।

স্বভাব নষ্ট হয় দু-ভাবেই:
জরুরি জিনিসের অভাবে,
বাড়তি জিনিসের প্রভাবে।

অভাবে স্বভাব নষ্ট,
প্রভাবে স্বভাব বেশি নষ্ট।

৬। কেউ যখন ক্রমাগত ভুল বোঝে, তখন মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। ইচ্ছে হয়, বারবার নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার চাইতে বরং চুপচাপ সম্পর্কটাই ভেঙে দিই। যার যা ইচ্ছে আমাকে মনে করুক, ওতে আমার কিছু এসে যায় না। ওরাই ঠিক, আমিই খারাপ। নিজেকে আর কতই-বা বোঝানো যায়? অচেনা মানুষকে তা-ও বোঝানো যায়, চেনা মানুষকে কিছুতেই বোঝানো যায় না।

৭। হয়তো তুমি যেখানে পৌঁছতে চাইছ, সেখানে পৌঁছতে পারবে না; তবে যেখানে পৌঁছনো তোমার ঠিক হয়নি, কিন্তু কোনোভাবে পৌঁছে গেছ, সেখান থেকে সরে আসতে তো পারবে, তাই না? পারো যদি, তবে তুমি কিছুতেই ব্যর্থ ন‌ও, তোমার সময় নষ্ট হয়নি কিংবা তোমার যাত্রাটিও অসুন্দর কিছু নয়।

যা রাখার দরকার নেই, তা ছুড়ে ফেলে দিতে পারলে অনেকটুকু পথ হাঁটা হয়ে যায়। পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবার আগেই শুরু করো---ছুড়ে ফেলে দেবার কাজটি। আজ হোক কাল হোক, যা ছুড়ে ফেলতে হবেই, তা ছুড়ে ফেলার একটাই রাস্তা: কিছু না ভেবেই ছুড়ে ফেলে দেওয়া।

৮। If you are always busy with what others should have become, you can never become what you should become.

৯। কষ্ট পেতে হবে, কষ্ট সহ্য করতে হবে...এটাই স্বাভাবিক।

১০। কর্ম তা-ই, গাঁথে না যা নিত্যনতুন বন্ধনের পাশ,
বিদ্যা তা-ই, মুক্তিপথে যা আলোর দিশারি ধরায়;
আর যা কর্ম---শুধু আয়াসের ক্ষণিক বিলাস,
আর যা বিদ্যা---শুধু শিল্পের নৈপুণ্য-সিদ্ধি হায়!

১১। হ্যান্ড‌ওয়াশ দিয়ে হাত পরিষ্কার করার সময় দুই হাত একসাথে পরিষ্কার করলে কাজটা সহজ হয় এবং দুই হাত‌ই ভালোভাবে পরিষ্কার হয়। যে-কোনো একটি হাত পরিষ্কার করলে কাজটা ততটা ভালোভাবে হয় না। দুই হাত এক‌ইসাথে নিজেদের এবং পরস্পরকে পরিষ্কার করলে কাজটা আরামের ও আনন্দেরও হয়।

ঠিক একইভাবে, নিজের বিবেককে শুদ্ধ করার সময় পাশের বা (সুযোগ থাকলে) আশেপাশের মানুষের বিবেক শুদ্ধ করতে পারলে নিজবিবেকের শুদ্ধিকরণের কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজে ও ভালোভাবে হয়। আলো ভাগ করলেই বরং বাড়ে।

তবে এই কাজটি করার সময় খুব সচেতনভাবে মাথায় রাখতে হবে, একেকটা মানুষের বিবেক তথা চৈতন্য তথা আত্মা একেক পথে জাগে। এর সাথে সম্পর্কিত মানুষের বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, অভ্যাস বা অনভ্যাস, অভিজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা, সুযোগ বা সুযোগহীনতা, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা। একেক পথে একেক মত, একেক সৌন্দর্য।

দুই হাত একসাথে পরিষ্কার করার সময় যদি বামহাতের তর্জনির নখের ভেতরে ময়লা আটকে থাকে, তা হলে সেই নখটি পরিষ্কার করতে হবে; কিন্তু সেইসাথে ডানহাতের তর্জনির নখ‌ও পরিষ্কার করার দরকার হয় না। উদ্দেশ্য: সবচাইতে সহজে ও নিখুঁতভাবে দুই হাত একসাথেই পরিষ্কার করা; ঠিক একই উপায়ে পরিষ্কার করাটা এখানে জরুরি নয়।

গন্তব্য হোক এক‌ই, যাত্রাপথ ভিন্ন হয় তো হোক না! এ পৃথিবীর সুন্দরতম কথাগুলির একটি "যত মত, তত পথ।" যিনি বলেছিলেন, সেই মহাপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যে পথে (নির্বিকল্প সমাধি) হেঁটে মহামানব হয়েছেন, সেই পথ কিন্তু রামকৃষ্ণদেব অনুসৃত পথের (সবিকল্প সমাধি) অনুরূপ ছিল না; বিবেকানন্দের চৈতন্য জেগেছিল গুরু রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে, সেই জাগরণের ফলেই তিনি মহাত্মা হয়েছেন, তবে রামকৃষ্ণ কখনোই শিষ্যকে বাধ্য করেননি হুবহু তাঁর নিজের পথে চলতে। ধর্ম এখানেই সুন্দর।

১২। মেয়েটি স্বপ্নে দেখল, ওর বয়ফ্রেন্ড ওদের‌ই ক্লাসের এক মেয়েকে লিপকিস করছে।

সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটার ঘুম ভেঙে মনে পড়ল, রাতে শোবার আগে সে ব্রাশ করেনি।

নিয়মিত ব্রাশ করো, কেননা তোমার মুখের দুর্গন্ধে তোমার প্রিয় মানুষটি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে!

ব্রাশ করো, জীবন বাঁচাও।

১৩। আচ্ছা, আমি মরে যাবার পরেও কি চুঁইয়ে চুঁইয়ে জোৎস্না ঝরবে?
ঠিক নিয়ম করেই চাঁদের পাশে বসে শুকতারাটি একা জ্বলবে?
বন্ধুদের আড্ডায়, কিংবা প্রিয়জনদের মেলায় হুটহাট আমার কথা উঠবে? না কি ভুলেই যাবে?

খুব প্রিয় যে গোপন মানুষটির কথা কাউকেই বলিনি কোনোদিন, সে মানুষটি কি মধ্যরাতে আমায় ভেবে হু-হু করে কেঁদে উঠবে?

চারুলতায় ফুল ফুটবে? জানলার ধারে বাসা-বাঁধা চড়ুইজোড়ার ঘরে নতুন অতিথি আসবে?

আমি না থাকলেও রোজ সূর্য উঠবে, রাত নামবে, বিচ্ছেদের সুর বাজবে।
আমি থাকি না থাকি, দুঃখগুলি দামিই থাকবে।

১৪। Love or marriage cannot be a license for giving pain. Where there is peace, there is love, even if there is no love.

Do not make a cage for your partner. If you make, they will just pretend to love you. It's not love, it's just fear.

Peace is love, love is peace. Period.

১৫। কিছু কিছু মানুষকে খুব চেষ্টা করেও ফেরানো যায় না।

ওদেরকে ওদের মতো করে ছেড়ে দিন।

উপরের বাক্যটির বেশি ভাববেন না যদি কষ্ট বাড়াতে না চান। Overthinking kills.

১৬। Between logic and humanity, I always choose humanity.

১৭। একসময় ভাবতাম, ৬০ পেরোলেই মানুষ বুড়ো হয়ে যায়। এখন আমি নিজেই ষাটোর্দ্ধ। এই বয়সেও আমি নিজেকে একজন যুবক ভাবি, কেননা আমি এখনো সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে পারি। এখন ভাবি, আগে ভুল ভাবতাম।

(কথাটা শুনেই আমার পাপিষ্ঠ মনে এল: ...কিন্তু রাত ১০টার পর কাজ করতে পারেন কি না, সেটাই তো যৌবনের আসল প্যারামিটার!

আমি ভালো হয়ে যেতে চাই।)

১৮। ইস্ ইস্ ইস্! আজকের ওয়েদারটা একদম করার মতন একটা ওয়েদার . . . আই মিন, অফিশিয়াল ট্রেনিং করার মতন; এবং তা-ই করছি!

১৯। শুরুতে যে যত ঠকে,
শেষে সে তত জেতে।

২০। Staying with yourself is much better than staying with an irresponsible person.

২১। সরকারি কর্মকর্তা এবং বিবাহযোগ্য মেয়ের মা, এই দুই ধরনের মানুষকে হতে হয় শেয়ালের মতো ধূর্ত ও শিম্পাঞ্জির মতো কৌশলী।


ভাবনা: নয়-শো চুয়ান্ন
………………………………………………………

১। ফুল দিয়ে তো উদ্ভিদ বংশবিস্তার করে, তাই না? তার মানে, ফুল উদ্ভিদের প্রজননযন্ত্র! না, ইয়ে মানে, ভাবছিলাম আর কি, মানুষ এই উদ্ভিদের প্রজননযন্ত্র দিয়ে অন্যকে ভালোবাসা নিবেদন করে ক্যামনে!

বিষয়টা অদ্ভুত না?

ভাগ্যিস, উদ্ভিদ কথা বলতে পারে না! নইলে কি বলত, অ্যাই! আমার প্রজননযন্ত্র ফিরিয়ে দাও!

ভাবা যায়, কী বিচ্ছিরি অবস্থা!

পুনশ্চ। তোমরা আমাকে একটি সুন্দর প্রজননযন্ত্র দাও, আমি তোমাদের বুকভরা ভালোবাসা উপহার দেবো।

২। একটা ছোট্ট পরামর্শ দিই। Never share your spiritual journey on Facebook. It'll increase your mental power. লালনের এই কথাটি আমরা যেন সবসময়ই মনে রাখি: আপন ভজন-কথা, বলিয়ো না যথা-তথা।

৩। জীবন
একদিকে দেয়,
আরেকদিকে কেড়ে নেয়।

৪। আমাকে নষ্ট করে তুমি কী এমন সুখ পেলে?
আমি তো আগে থেকেই নষ্ট ছিলাম!

৫। কেউ স্বপ্নে বাঁচে,
কেউবা স্মৃতিতে।

৬। কেন থাকতে চেয়েছিলে অমন করে?
থাকতে না চাইলে কি দিতাম যেতে?

৭। যাকে পাবো না জেনেও চেয়েছি পেতে,
তাকে পেয়েছি বলেই দিয়েছি যেতে।

৮। যাকে আজ দিচ্ছ ফিরিয়ে এমন নিষ্ঠুর অবহেলায়,
একদিন তার কাছেই চাইবে ফিরতে বড়ো অবেলায়।

৯। A mistake made once,
pains suffered forever.

১০। সিদ্ধার্থ: দীপা, তুমি আকাশকে এতটা চাও কেন?
দীপা: মানে?
সিদ্ধার্থ: মাঝে মাঝে আমি ভাবি, কেউ কাউকে চায় কেন? কেন চাও ওকে?
দীপা: এটা আমি জানি না... শুধু ওকে চাই।
সিদ্ধার্থ: এটা জানা সত্ত্বেও যে আকাশ...
দীপা: আমাকে চায় না?... হ্যাঁ, তবুও...

দেখি, বলুন তো, কোন মুভির ডায়লগ?

১১। Don't call her stupid; maybe this is the reason she is still with you.

১২। তোমার খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে।

১৩। Respect is the most important sign of love. If someone doesn't respect you, never believe that they love you. Respect is love, love is respect.

১৪। এখনো সময় আছে, খারাপ হয়ে যাও।

১৫। ছেলেদের এই একটা কমন সমস্যা: ঘরের মানুষ কিছু করতে বললে বা কিছু করতে বারণ করলে কথা শুনবে না; অথচ এক‌ই কথা বাইরের লোক বললে তা ঠিকই শুনবে।

১৬। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে একসময় অপরাধীদের জাহাজে কয়েদ রাখার প্রথা ছিল এবং ওদেরকে ‘গ্যালি’ নামক ছোটো ছোটো যুদ্ধজাহাজে দাঁড় টানার জন্য সারি করে দাঁড় করিয়ে দাঁড়ের কাছে বসানো হতো।

একদিন নেপলসের রাজপ্রতিনিধি কোনো একটা গ্যালিতে চড়ে ভ্রমণ করছিলেন। সেই সময় তিনি কৌতূহলবশত কয়েদিদেরকে জিজ্ঞেস করেন যে তারা কে কোন অপরাধের শাস্তি পেয়ে গ্যালিতে কাজ করতে এসেছে।

সকলেই নিজেকে নির্দোষ বলে প্রকাশ করল। কেউ কেউ বলল, মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে শত্রুরা তাদের কয়েদ করিয়েছে; কেউ বলল, বিচারক ঘুষ খেয়ে সাজা দিয়েছেন। সবাই খুব করে চাইছিল ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজেকে নিরপরাধ দেখিয়ে রাজপ্রতিনিধির আনুকূল্য পেতে।

কেবল একজন বলল, সে খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে চুরি করেছিল।

রাজপ্রতিনিধি ক্রোধ প্রকাশ করে তাঁর হাতে-থাকা ছড়িটি দিয়ে সেই কয়েদিকে কাঁধে আঘাত করলেন এবং বললেন, “এমন সব ভদ্রলোকের মধ্যে তুই ব্যাটা চোর এখানে কী করছিস? এখনি এখান থেকে চলে যা!”

সত্য বলার কারণে চোর মুক্তিলাভ করল।

১৭। বিহারে মখদুম শাহের কবর আছে। তিনি রাজগৃহে পাহাড়ের গুহায় তপস্যা করতেন।

সেখান থেকে বিহারে আসার সময় একদিন পথ হতে একটু নেমে প্রস্রাব করছিলেন। সামনেই ফুটির খেত। চাষা ভাবল, কোনো পথিক ফুটি চুরি করতে বসেছে। তাই সে কোনো কথাবার্তা না বলেই ফকিরের মাথায় এক লাঠি মারল।

ফকির সেই প্রহারকারীকে কিছুই বললেন না, বরং নিজেকেই বলিলেন, “কাহে সারফা (তাঁর ডাকনাম ছিল সারফুদ্দিন) চলে হো কু রাহ্‌, কি লাঠি খায়া।” এর অর্থ: কেন সারফা কুপথে গিয়ে লাঠি খেলে!

… এমনভাবে বললেন যেন দোষটা সবই তাঁর নিজের! তিনি যদি কোনো পড়তি জমিতে কি ঝোপঝাড়ের কাছে বসতেন, তাহলে তো কৃষকের ভুল হতো না।

এটাই জীবনের সবচাইতে বড়ো শিক্ষা—অন্যের উপর নয়, বরং নিজের উপরই দোষারোপ করা। এই অভ্যাসের চর্চায় বিবেক ক্রমেই পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। আত্মানুসন্ধানের পথই ইবাদতের পথ।

১৮। পাঞ্জাব জয় করে সিকান্দার শাহ যখন বিজয়োল্লাস করছিলেন, তখন সবার মুখে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর প্রশংসা শুনে তাঁকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সিকান্দার শাহের কর্মচারী সাধুর কাছে গিয়ে তাঁর দিগ্বিজয়ের বিষয় উল্লেখ করে বললেন, “সেই বিজয়ী পুরুষকে দেখতে চলুন।”

সাধু উত্তরে বললেন, “তোমার মনিবকে জিজ্ঞেস করে আসো, তিনি নিজেকে জয় করেছেন কি না; যদি করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই দেখতে যাব।” সাধুর উত্তরে চমৎকৃত হয়ে সিকান্দার শাহ নিজেই সাধুর কাছে গেলেন এবং জানালেন যে, তিনি সাধুর যে-কোনো প্রার্থনা পূর্ণ করবেন। সাধুদের কাছে গেলে সবাই ভালো কিছু শুনতে চায়, নিজের জীবনের জন্য পাথেয় খোঁজে।

সাধু উত্তর দিলেন, যা দিতে পারো না, তা নিয়ো না।

দিগ্বিজয়ী সিকান্দার শাহ বুঝতেই পারলেন না যে এমন কী আছে, যা তিনি দিতে পারেন না অথচ নিয়েছেন!

তখন সাধু বললেন, কাউকে প্রাণ দিতে পারো না, তাই লোকের প্রাণ নিয়ো না। আমাকে তুমি রৌদ্র দিতে পারো না, তাই ছায়া করে দাঁড়িয়ে থেকে আমার কাছ থেকে রৌদ্র কেড়ে নিয়ো না। সহজ করে বলি। মানুষ খুন করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, তা আর কোরো না। আরেকটা পরামর্শ দিই। তোমার জন্য সবচাইতে প্রয়োজনীয় কথাটি যখন কোথাও শুনে ফেলবে, তখনই সেখান থেকে চলে যাও। আরও কথা শোনার আশায় অপেক্ষা করে থাকলে এমন কিছুও শুনতে পারো, যা তোমার জন্য ক্ষতিকর।

১৯। যে তার সবকিছুই ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করেছে, তার অসাধ্য কিছুই নেই। নিজের তো বটেই, এমনকি সে অন্যের বিধিলিপিও বদলে দিতে সক্ষম।

২০। যে গাছ কাটতে এসেছে, তার উপর থেকেও গাছ ছায়া সরিয়ে নেয় না।

আমাদের চোখে, এ গাছের মহানুভবতা।
প্রকৃত বিচারে, এ গাছের অপারগতা।

গাছের এমন অসহায়ত্বকে জোর করে মহত্ত্বের পোশাক পরিয়ে দিলে গাছ কাটতে সহজ হয়।

২১। মানুষের যখন অল্প যন্ত্রণায় আর পোষায় না, ঠিক তখন‌ই সে বিয়ে করে।

২২। বাঙালি এক‌ইসাথে পুলিশের কাজ‌ও করে, বিচারকের কাজ‌ও করে---কাজ থাকলেও করে, না থাকলেও করে। বাঙালি কেবল নিজের কাজটাই ঠিকভাবে করতে পারে না, বাকি সব‌ই করতে পারে।

২৩। If the person you love decides to leave you for the one wrong thing you've done to them ignoring the hundred right things you've done for them, let them leave. Don't keep such an asshole in your life if you are not an asshole as well. Leave and move on. Leave to live.

ভাবনা: নয়-শো পঞ্চান্ন
………………………………………………………

১। কথিত আছে, কোনো একসময়ে কাশীর এক মন্দিরে স্বর্গ হতে একটি সোনার থালা এসে পড়ে। ওই থালায় লেখা ছিল: যার ভালোবাসা সবচাইতে বেশি, তার জন্য স্বর্গীয় পুরস্কার।

কাশীর পাণ্ডারা ঢোল পিটিয়ে চারিদিকে প্রচার করে দিলেন এই বলে: আগামীকাল দুপুরে পুরস্কারপ্রার্থীরা মন্দিরে এসে নিজ নিজ গুণের পরিচয় দেবেন।

পরদিন সব শ্রেণীর‌ই লোক এসে নিজ নিজ গুণকীর্তন করতে লাগলেন।

একজন ধনী ব্যক্তি তাঁর বিপুল বৈভব দরিদ্রদের কল্যাণে দান করে কাশীতে এসেছিলেন। তাঁকে ওই থালা পাণ্ডারা দিলেন। কিন্তু থালাটি তখনই সীসায় পরিণত হয়ে গেল। পুরস্কৃত ব্যক্তি লজ্জায় থালা নামিয়ে রাখলেন; থালা আবার সোনার হলো।

পুরস্কারপ্রার্থীরা মন্দিরের কাছাকাছি আগত দরিদ্রদের মধ্যে মুক্তহস্তে অর্থ বিতরণ করতে লাগলেন। কিন্তু টাকা ছড়ানোই দয়ার লক্ষণ নয়।

মন্দিরের অনতিদূরে একজন বৃদ্ধ রোগক্লিষ্ট ব্যক্তি পড়ে ছিলেন। তার দিকে কেউই খেয়াল করছিল না। একজন চাষা মন্দিরে পূজা নিবেদন করতে আসার পথে ওই ব্যক্তিকে দেখল। দেখে দয়ায় তার হৃদয় ভরে গেল। সে বৃদ্ধের মুখে জল দিয়ে বাতাস করতে লাগল এবং অল্প একটু দুধ কিনে এনে বৃদ্ধকে খাইয়ে ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সেবাযত্নের মাধ্যমে তাঁকে অনেকটা সুস্থ করে তুলল। তারপর দুর্বল বৃদ্ধকে ধর্মশালার একটা কক্ষে পৌঁছে দিয়ে পূজা করার জন্য মন্দিরে গেল।

প্রধান পাণ্ডা পুরো ব্যাপারটি দূর থেকে লক্ষ করছিলেন; হঠাৎ কী মনে করে চাষার হাতেই থালাটি দিলেন। সবাই দেখল, থালাটি দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠল!

উল্লেখ করি, কাশীর রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ধর্ম-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে সেবা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত। কোথাও কোনো নিরাশ্রয় তীর্থযাত্রী, বিপন্ন মানুষ, অসুস্থ রোগী বা সাধু পড়ে আছেন জানলে তাকে খুঁজে এনে ওঁরা আন্তরিকভাবে সেবাশুশ্রূষা করেন।

পৃথিবীজুড়ে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম এমন জনহিতকর কাজ করে যাচ্ছেন। মন চাইলে ওঁদের সাহায্যে কাপড়, কম্বল, খাবার বা বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দান করা ভালো। সেবাশ্রমে দানকৃত অর্থের অপব্যবহার কোনোভাবেই হয় না। এমন আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ বলতে মানুষ---সকল ধর্মের, পথের ও মতের মানুষ।

দিতে পারা ও দেওয়া এককথা নয়। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দিতে সবাই পারে না। দান করতে ধনের প্রাচুর্য নয়, মনের ঔদার্য লাগে। অনেকেই টাকা জমিয়ে পাহাড় করে ফেলে, তবু কাউকে দেয় না; দিলেও, যা দেয়, ওদের সামর্থ্যের বিচারে, তা না দেবার মতোই। আবার অনেক মানুষকে দেখেছি, যেখানে দিলে নিজের প্রচার হয় না, সেখানে কিছুই দেয় না। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সাহায্য করে না, এমন মানুষ আমি ভূরি-ভূরি দেখেছি। সেবা তো অনেকেই করে, তবু উপরের গল্পের 'সোনার থালা' পাবার মতো সেবা করতে জানে কয়জন?

২। চলুন, একজন অসীম আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন দরিদ্র ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সম্পর্কে জানি।

প্রাচীন ভারতে মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীশ্বরকে বলা হতো পেশোয়া। একসময় তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল প্রবাদতুল্য। পেশোয়াদের প্রাধান্যকালে প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে পুনানগরে এক বিরাট ব্রাহ্মণসভা অনুষ্ঠিত হতো। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতবর্গ ওই সভায় উপস্থিত ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তা বিচার করতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। বিবিধ শাস্ত্রের বিষয়ে সবচাইতে জ্ঞানী ব্রাহ্মণ হিসেবে বিজয়ী ব্যক্তিটিকে রাজ্যের পেশোয়া পুরস্কারস্বরূপ এক লক্ষ মুদ্রা দিতেন। শুধু তা-ই নয়, বিজয়ী পণ্ডিতের পালকিতে নিজে কাঁধ দিয়ে তিন-পা হেঁটে নিজেকে এবং তাঁকে মহাসম্মানিত জ্ঞান করতেন।

রঘুনাথ রাও পেশোয়াও প্রচলিত রীতি রক্ষা করছিলেন, কিন্তু পূর্বসূরিদের মতো তাঁর হৃদয়ে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতে তেমন ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল না। তাঁর রাজত্বকালে একজন মৈথিল পণ্ডিতের ওরকম এক সভায় প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। কিন্তু পেশোয়া রঘুনাথ রাও ওই তেজস্বী পণ্ডিতের ধরনধারণে একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, "এই পণ্ডিতের বিনয় কম, তাই এঁকে এক টাকা কম দেওয়া হবে।"

পণ্ডিত বললেন, "এক লক্ষ মুদ্রা পেলে আমি এখানেই তার পুরোটাই মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু আমার কোনো ত্রুটি ধরে নির্ধারিত অর্থের এক টাকাও কম দিতে চাইলে আমি ওই অপমানসূচক পুরস্কার গ্রহণ করব না। আমি সম্মানের জন্যই এতদূরে এসেছিলাম। সম্মানের অণুমাত্র ত্রুটিতেও আমি রাজি নই।"

পেশোয়া বললেন, "পণ্ডিতজি! কথাটা বলেই যখন ফেলেছি, তখন কোনোভাবেই হুকুম বদলাব না, আপনি এক টাকা কমই নিন। অত টাকা দেবার লোক আপনি আর কোথায় পাবেন?"

পণ্ডিত উত্তর দিলেন, "মহারাজ! ব্রাহ্মণের ব্যবস্থা নিয়ে যে-কোনো প্রকারের অন্যায় হুকুম রদ করায় আপনার কোনো দোষ হবে না। আরও বলি, মহারাজ! এক কম লক্ষ মুদ্রা দেবার সক্ষম ধনীলোক ভারতে এখন কম বটে, কিন্তু ওই পরিমাণ টাকা নিতে অস্বীকার করতে পারে, এমন দরিদ্র ব্যক্তি আরও কম নয় কি?"


পেশোয়া নিজের হুকুম বদলাননি। ব্রাহ্মণও তাঁর কাছ থেকে কিছুই গ্রহণ করেননি।

পুনশ্চ। জীবনের প্রথম টিউশনিতে সাড়ে তিন মাস পড়ানোর পর অপমানসূচক মিথ্যা মন্তব্য করে কিছু টাকা কম নিতে বলায় আমি এক টাকাও না নিয়ে সেই বাসা থেকে চলে এসেছিলাম। স্টুডেন্টটি ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশন টেস্টের ক্যান্ডিডেট। প্রচণ্ড পরিশ্রম ও আন্তরিকতার পুরস্কার সেদিন না পেলেও পরবর্তীতে অনেক বেশিই পেয়েছিলাম। ভালোবাসা ও প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির কথা বাদ দিলেও, স্টুডেন্ট পড়িয়ে আমার চাইতে বেশি অর্থোপার্জন আমার জানামতে চুয়েটের আর কেউ সেই সময় করতে পারেনি।

আগ্রহীরা আমার 'জীবনের প্রথম টিউশনির গল্প' লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।

৩। দুধ কিনতে গিয়ে দেয় মদের দোকানে উঁকি,
পড়াশোনায় বসে করে ফেইসবুকে ঝোঁকাঝুঁকি।

৪। অনেক দিন আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি-পেরোনো এক আমেরিকান যুবক খুব অর্থকষ্টে পড়ে একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মের মালিকের কাছে কাজ চাইতে গেল।

মালিক যুবকের পড়াশোনা সম্পর্কে জেনে বললেন, "উপযুক্ত কাজ খালি নেই।" শুনে যুবক বলল, "যে-কোনো কাজ দিন। আমি খুবই কষ্টে আছি, টাকার অভাবে খাবার কিনতেও পারছি না।" তখন ফার্মের মালিক বললেন, "শুরুতে এমন কথা সবাই-ই বলে; পরে কাজ দিলে তা মনমতো হয় না, আর কাজ ছেড়ে চলে যায়।"

যুবকটি উত্তরে বলল, "আমার সেই ইগো এখন আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দিয়ে আমি কী করব, যদি পেটে ভাত‌ই না জোটে? আপনি আমাকে যে-কোনো একটা চাকরি দিন। আপনি আমাকে যে কাজই দিন না কেন, আমি ধরে নেব, ঈশ্বর আমার ভাগ্যে তা-ই রেখেছেন।"

মালিকের মনে হলো, এটাও কেবল কথার কথা। ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কারণে বেচারা আবেগতাড়িত হয়ে এসব বলছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ-করা ছেলে যে-কোনো কাজ দিলে করতে চায় না। তবু তিনি ছেলেটার মন পরীক্ষা করার জন্য বললেন, "খেয়াল করো, অফিসে ঢোকার রাস্তাটা মেরামত করার জন্য মজুরেরা খুঁড়ছে। তুমি কি ওদের সাথে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করতে পারবে?"

তাঁকে অবাক করে দিয়ে যুবক বলল, "হ্যাঁ স্যার, আমি তা-ই করব।" ছেলেটির হাতে হাতুড়ি-শাবল-গাঁইতি দিয়ে তাকে কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য মালিক দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন।

সেই যুবক খানিকটা রাস্তা চিহ্নিত করে নিয়ে খুঁড়তে লাগল। কাজশেষে পাথরের খোয়াগুলি একদিকে সরিয়ে পরিষ্কারভাবে সাজাল এবং কোদাল ও হাত দিয়ে নুড়ি সরিয়ে ওই খোঁড়া-স্থানটিও পরিষ্কার করে রাখল।

অন্যান্য মজুর যেখানটায় খুঁড়েছিল, সেখানটায় নুড়িপাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায়, প্রতিদিনের মতোই, সেদিন বিকেলে অফিস হতে বাড়িতে ফেরার সময় মালিক তাঁর গাড়িতে ঝাঁকুনি অনুভব করলেন; তবে ওই যুবক রাস্তার যে অংশে কাজ করেছিল, সেখান দিয়ে গাড়ি চলার সময় কোনো ঝাঁকুনি লাগল না।
যুবকের এই আলাদা কাজটিই মালিকের খুব পছন্দ হলো। যুবকের কাছ থেকে তিনি এমন কিছু পেলেন, যা তিনি আশা করেননি, যা না করলেও যুবকের চলত, যা না করেও যুবক তার মজুরি ঠিক‌ই পেত; তবে তা করার কারণে যুবকটি মালিকের মনে তার জন্য সহানুভূতির একটা জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হলো।

যুবকের এই বাড়তি কাজে মালিক মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও রুচির পুরস্কার হিসেবে পরদিন‌ই তিনি তাকে মজুরদের সর্দার হিসেবে নিয়োগ দিলেন। ফলে যুবকের দৈনিক মজুরিও গেল বেড়ে।

দেখা গেল, ওই রাস্তা এতটাই নিখুঁতভাবে প্রস্তুত হলো যে, অন্য রাস্তাগুলিকে সেটির সামনে চোখেই লাগছিল না। নবনিযুক্ত সর্দার সব জায়গায় নিজের হাতে উঁচু-নিচু-ঢালু সবকিছু ঠিক করে দিয়েছিল। যত্ন ও পরিশ্রমের কোনো ত্রুটিই হয়নি।

ধীরে ধীরে মালিক সেই ছেলেটিকে অন্যান্য কাজের পরিদর্শনের ভার দিলেন। সব কাজই নিখুঁত হতে লাগল৷ বিশ্বস্ততা ও নৈপুণ্যের গুণে যুবকটি একসময় মালিকের ব্যাবসার অংশীদার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হয়েছিলেন!

কাজ সবাই-ই করে, তবে পুরস্কার পায় কেবল সে-ই, যার কাজে চোখে পড়ার মতো আলাদা কিছু আছে।


ভাবনা: নয়-শো ছাপ্পান্ন
………………………………………………………

১। কোনো এক কারিকরকে তার মনিব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার টাকা তুমি কীভাবে খরচ করো? কারিকরের উত্তর ছিল: অর্ধেক খরচ করি, সিকিভাগ ধার দিই এবং বাকি সিকিভাগে দেনা শোধ করি। মানে, অর্ধেক টাকা খাওয়া-পরা'তেই যায়; সিকিভাগে ছেলে-মেয়ে'র পড়াশোনার খরচ চালাই এবং অবশিষ্ট সিকিভাগ বাবা-মা'কে পাঠাই।

বলে রাখি, ছেলে-মেয়ে কখন ওই 'দেনা' শোধ করবে, তার আশা এ যুগে না রাখাই ভালো! তবে বাবা-মা'য়ের ভরণপোষণের সকল দায়িত্ব নেওয়া মানুষ মাত্রের‌ই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

২। আমাদের জীবনে কিছু মানুষ ফুচকার মতন। যত যা-ই কিছু খাই না কেন, দেখা যায়, ঘুরেফিরে ওই ফুচকাই ভালো লাগে। আমাদের জীবনেও একজন ফুচকামানব থাকে। হাজার মানুষের সাথে মিশেও, দিনশেষে, শান্তির খোঁজে ওই একটা মানুষের কাছেই ফিরতে হয়। ভালোবাসার মানুষ সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু শান্তির মানুষ পাওয়া খুব কঠিন; কেননা ভালোবাসতে অনেকেই জানলেও ভালো রাখতে তেমন কেউ জানে না।

৩। কোনিগ্রাটজের যুদ্ধে প্রুশিয়রা অস্ট্রিয়ার সামরিক শক্তি ভেঙে চূর্ণ করে দেয়। সেই যুদ্ধের দিনে অনবরত ছোটাছুটিতে পরিশ্রান্ত প্রুশিয় মন্ত্রী প্রিন্স বিসমার্ক পকেটে একটি চুরুট বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এটা ভেবে যে, যুদ্ধশেষে কোথাও হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে চুরুটটা ফুঁকতে ফুঁকতে শ্রান্তিদূর করিবেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে একজন জার্মান সৈনিক গুরুতরভাবে আহত হয়ে পড়ে ছিল। তার হাত-পা ভেঙে গিয়েছিল। সৈনিকের সতৃষ্ণ দৃষ্টি দেখে বিসমার্ক ঘোড়া হতে নামলেন, কিন্তু সেই মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিককে কী দেবেন ঠিক করিতে পারলেন না। পকেটে টাকা-মোহর ছিল। কিন্তু যার মৃত্যু সন্নিকটে, তার টাকায় কী হবে?

চুরুটটার কথা মনে পড়ল। ওটি ধরিয়ে বিসমার্ক তার মুখে দিলেন। সৈনিক চুরুটটা টানতে আরম্ভ করলেই তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে যে আনন্দের রেখা এল এবং দু-চোখে যে কৃতজ্ঞতার সজল-দৃষ্টির আকস্মিক উদয় হলো, তা উল্লেখ করে আধুনিক জার্মানির সকল উন্নতির মূল প্রিন্স বিসমার্ক বলতেন, "যে চুরুটটির ধূম আমি পান করিনি, ওটি আমাকে যে আনন্দ সেদিন দিয়েছিল, আজ পর্যন্ত কোনো চুরুট আমাকে তা দিতে পারেনি।"

৪। চেন্নাইয়ের একটা স্কুল। স্কুলের প্রায় পরীক্ষাতেই এক বন্ধু প্রথম হয় তো আরেক বন্ধু হয় দ্বিতীয়। এভাবেই চলছিল।

ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার আগে ওদের একজনের মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ মায়ের সেবা করতে গিয়ে প্রায় দুই মাস ছেলেটার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবু শেষমেশ মাকে আর বাঁচানো গেল না।

মায়ের মৃত্যুর পর পরই পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। সবাই ধরে নিল, সে এবার প্রথম হতে পারবে না, অন্যজন‌ই প্রথম হবে।

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। দেখা গেল, মাতৃহারা ছেলেটিই প্রথম হয়েছে; বন্ধুটি হয়েছে দ্বিতীয়।

ওদের ক্লাস টিচারের এটা নিয়ে খুব কৌতূহল হলো। তিনি ভাবতে লাগলেন, ব্যাপারটা কী! দুই জনের খাতা কষ্ট করে মিলিয়ে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। দেখলেন, যে ছেলেটা সেকেন্ড হয়েছে, প্রায় প্রশ্নের উত্তরই সে অতটা ভালো করে লেখেনি। খুবই সহজ দু-একটা প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে এসেছে। কঠিন সব প্রশ্নের উত্তর লিখলেও হয়তো ইচ্ছে করেই ওই সহজ প্রশ্নগুলির উত্তর করেনি।

শিক্ষক এই কথাটি একান্তে ডেকে জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বলল, "ও আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ছাত্র। ওর মায়ের রোগ ও মৃত্যুর জন্যই এবারে আমি হয়তো পরীক্ষায় প্রথম হতাম। কিন্তু এটা কি উচিত? তার চেয়ে বড়ো কথা, এমন সময়ে এই রেজাল্টটা ওর দরকার ছিল। আমার মনে হয়েছিল, এবারে প্রথম হলে ওর একটু হলেও ভালো লাগবে। আমার মা আছে। ওর মা তো আর নেই। কিন্তু স্যার, এ কথাটা অনুগ্রহ করে কাউকেই বলবেন না। আপনি এত খোঁজ নিতে গেলেন কেন? যা হয়েছে, তা-ই ঠিক।”

শিক্ষক বললেন, "সবচেয়ে বড়ো যে পরীক্ষা---মহত্ত্বের পরীক্ষা---ওটাতে তুমি প্রথম হয়েছ এবং আজীবন প্রথমই থাকবে। স্কুলের পরীক্ষা তার কাছে অতি নগণ্য।"

৫। ঘটনাটি জার্মানির। যুদ্ধের সময় কয়েক জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে সেনাপতি বেরিয়েছেন ঘোড়ার জন্য ঘাস, ভুসি ও শস্য সংগ্রহে। কোথাও খাবার নেই, চারিদিকে ধু-ধু মাঠ।

অগত্যা সেনাপতি একজন চাষাকে ধরে বললেন, "কোথায় ফসল আছে, দেখিয়ে দে।" চাষা নিরুপায় হয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।

একটা জঙ্গলের পাশে নিচুভূমিতে ফসল ছিল। সেনাপতি ওটাই কাটতে চাইলেন। চাষা বলল, "আর-একটু আগে চলুন।" অনেকটা পথ যাবার পর চাষা খেত দেখিয়ে দিল। সৈন্যরা সমস্ত ছোলার গাছ উপড়ে নিয়ে বোঝা বেঁধে ঘোড়ার উপর তুলে ছাউনির দিকে চলল।

অনর্থক হাঁটানোতে অসন্তুষ্ট সেনাপতি রেগে বললেন, "প্রথম খেতের ফসলও তো ভালো ছিল। অনর্থক এতটা হাঁটালে কেন?" চাষা উত্তর দিল, "স্যার! এ খেতটাই আমার, আগেরটা অন্য লোকের। যখন শস্যের দাম দেওয়া হবে না, তখন পরের খেত দেখাই কীভাবে?"

৬। হাত বাড়ালেই যা পাওয়া যায়, তা থেকে মানুষ বেশি আনন্দ পায় না। যা কিছুটা হলেও দুর্লভ, তার আনন্দ দেবার ক্ষমতা থাকুক না থাকুক, মানুষ তা থেকেই বেশি আনন্দ খুঁজে নেয়। সুলভে আনন্দ হত।

৭। খুললে মনের দুয়ার, সতী সে কি রয়?
সতীত্বের মৃত্যু সবার অগোচরেই হয়!

৮। সেদিন বরিশালে রিকশাভাড়া হঠাৎ কমে গেল।
কেন?
কারণ শহর ফাঁকা; সবাই কক্সবাজারে গেছে ঘূর্ণিঝড় দেখতে।

৯। বাঙালি কারা?
তারাই, যারা 
শরীর খারাপ হলে নাপা খায়,
মন খারাপ হলে বিয়ে করায়।

১০। কী করলে আমার ভালো হয়, কী করলে আমার খারাপ হয়, ওসব না ভেবে কী করলে আমরা একসাথে থাকতে পারি, তা ভাবো। আমি ভালো থাকতে চাই না, আমি শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। তোমাকে না পেলে ভালো থেকে আমি কী করব?

১১। Successful people learn from the people they admire.
Unsuccessful people try to teach the people they don't admire.
This is what time means to these two groups.

১২। ভালোবাসা অল্প থাকতেই ব্রেক‌আপ করে ফেলা ভালো। অল্প ভালোবাসা ব্রেকআপেই সেরে যায়, গভীর ভালোবাসা মৃত্যুতেও সারে না।

১৩। ছেলে যখন বাবার কাঁধে চড়ে আর বলে, "বাবা, দ্যাখো, আমি তোমার চেয়ে বড়ো!", তখন বুদ্ধির পরিপক্বতার অভাবে ছেলে এটা বুঝতে পারে না যে, বাবার কাঁধে চড়ার ফলে তার মাথা বাবার মাথার চাইতে উঁচুতে উঠে গেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে বাবার চেয়ে ছোটো।

একবার মজা পেয়ে গেলে সে বারবার জোর করে হলেও বাবার কাঁধে চড়ে বসে এবং নিজেকে ভাবে বাবার চেয়ে বড়ো। বাবাও সময়ের দাবিতে ছেলের দাবি মেনে নেন। এতে সে খুশি হয়। বাবার নীরব সম্মতিই এখানে সময়ের চাওয়া।

ছেলে যখন একদিন বুদ্ধি, মেধা, প্রজ্ঞা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানে বাবার চেয়ে সত্যি সত্যি বড়ো হয়ে যায়, তখন সে আর ভুল করেও নিজেকে বাবার চেয়ে বড়ো ভাবে না এবং বলে না। কেননা সে তখন মানসিকভাবে পরিপক্ব। বড়োত্ব বিষয়টি আপনাআপনিই চোখে দেখা যায়, গায়ের জোরে বড়োত্ব দাবি করে ছোটোরা।

ভাবনা: নয়-শো সাতান্ন
………………………………………………………

১। যখন লোকের কাছে প্রেমের কথা বলি, তখন লোকে ভাবে, ওসব আমার জীবনের কথা।
যখন প্রেয়সীর কাছে প্রেমের কথা বলি, তখন প্রেয়সী ভাবে, ওসব আমার বানানো কথা।

ভালোবাসতে জানে সবাই-ই, তবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানে গুটিকয়েক মানুষ। ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা খুবই দুর্লভ। এই সহজ সত্যটি না বোঝে লোকে, না বোঝে প্রেয়সী।

২। মশা যখন রক্তপান করতে এসে গান ধরে,
তখন তার মধুর সংগীত কে সহ্য করে?

৩। নিজের অর্থে, অথচ পরের শর্তে জীবন কাটাতে বাধ্য হ‌ওয়ার চাইতে কষ্টের আর কিছু হয় না।

৪। ঢাকলে কি আর ঢাকা পড়ে গনগনে আগুন?
মুখ চাপলেই খুন কি চাপে --- সত্যিকারের খুন?
আপনি সে গো দেয় যে ধরা,
মিছেই তাকে গোপন করা...
সত্যের কল হাওয়ায় নড়ে,
যিনি যা-ই বলুন!

লোকের কাছে বুক ফুলিয়ে
বেড়াও যত‌ই চুলবুলিয়ে,
দু-দিন বাদেই পড়বে তোমার
জোঁকের মুখে চুন!

৫। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন দেখা যাক। ভারতীয় রেলের পূর্ব রেলওয়ে অঞ্চল এই বিজ্ঞাপনটি প্রচার করেছিল:

"আপনি কি জানেন?

যে আসন আপনার নামে সংরক্ষিত নয়, তাতে ভ্রমণ করা অপরাধ।

অন্যের নামে সংরক্ষিত আসনে ভ্রমণ করে হয়তো সময়ে সময়ে পার পেয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তায় কণ্টকিত এই বেনামি ভ্রমণের কথা নিশ্চয়ই আপনি মনে রাখতে চান না। যে-কোনো সময়েই তো ধরা পড়তে পারতেন! ঝঞ্ঝাটের শেষ থাকত না!

ভাড়া এবং জরিমানা দেওয়া কিংবা মাঝপথেই বাধ্য হয়ে নেমে যাওয়া; অথবা ২৫০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা তিনমাস পর্যন্ত হাজতবাস, ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো দুই-ই একসঙ্গে!

অথ‌ই জলে শুধু শুধু ঝাঁপ দিতে যাবেন কেন? মান-সম্মানের প্রশ্নও তো রয়েছে!

১৯৭৩ সালে পূর্ব রেলওয়ে-তে অন্যের সংরক্ষিত আসনে ভ্রমণ করতে গিয়ে অসংখ্য লোক ধরা পড়েছেন।

টাকা দিয়ে ঝঞ্ঝাট পোহাবেন না। অনুমোদিত সংস্থা থেকেই শুধু আপনার টিকিট কিনবেন।

আপনাদের আরও ভালোভাবে সেবা করতে আমাদের সাহায্য করুন।"

বিজ্ঞাপনটিকে একটু ভিন্ন কায়দায় প্রচার করা যাক:

"আপনি কি জানেন?

যে ধর্ম সৃষ্টিকর্তা কার‌ও নামে সংরক্ষণ করেননি, তাতে তাকে নেবার চেষ্টা করা অপরাধ।
নিজের নামে সংরক্ষিত ধর্মে অন্যকে টানাটানি করে হয়তো সময়ে সময়ে পার পেয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তায় কণ্টকিত এই অযাচিত অনধিকার-চর্চার কথা নিশ্চয়ই আপনি মনে রাখতে চান না। বিরক্ত করতে গিয়ে যে-কোনো সময়েই তো ধরা পড়তে পারতেন! ঝঞ্ঝাটের শেষ থাকত না!

নাকাল এবং নাজেহাল হ‌ওয়া কিংবা অপমানিত হয়ে পালিয়ে যাওয়া; অথবা সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের উপর খবরদারি (খোদার উপর খোদকারি) করার শাস্তি বা অন্যকে হেনস্থার অভিযোগে হাজতবাস, ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো দুই-ই একসঙ্গে!

অথ‌ই জলে শুধু শুধু ঝাঁপ দিতে যাবেন কেন? মান-সম্মানের প্রশ্নও তো রয়েছে!
পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অসংখ্য লোক নগদে ধরা খেয়েছেন।

মাথায় ঘিলু থাকলে ঝঞ্ঝাট পোহাবেন না। যার যার ধর্ম তাকে তাকে পালন করতে দিয়ে নিজেরটা নিজে পালন করবেন।

সৃষ্টিকর্তাকে আরও ভালোভাবে সন্তুষ্ট করতে নিজেকে আলোকিত করুন।"

৬। ধার্মিক --- নিজধর্ম করে যতনে পালন,
ধর্মান্ধ --- পরধর্মে করে বিদ্বেষ লালন।

৭। সময়। এই সময়ের কোনো বিশ্বাস নেই। এমন কোনো কাজ নেই, যা সময়ের আবর্তনে ঘটে না। এই সময়‌ই এককালে অসংখ্য মানুষকে অসংখ্য ধরনের পরিস্থিতিতে ফেলেছে, আবার এই সময়‌ই সময় হলে সেখান থেকে তুলেও এনেছে। ধন, মান, পদ, সম্ভ্রম, রাজ্য, ঐশ্বর্য, সম্পত্তি, বিপত্তি, এ সব‌ই সময়ের অধীন। মানুষের অবস্থা ও অবস্থানের উৎপত্তি, বৃদ্ধি, ক্ষয়, সবকিছুই সময়ে ঘটছে। সময়‌ই সাক্ষাৎ ঈশ্বর।

সময় আমাদের একবার হাসায় তো একবার কাঁদায়; আবার হাসায় তো আবার কাঁদায়। চিরকাল কেউই হাসতেও পারে না, কাঁদতেও পারে না। এই পরম সত্যটির কোনো অন্ত নেই, কোনো বিশ্রাম নেই। সময়কে ধর্ম হিসেবে ধারণ করেই আমরা নিজ নিজ জীবন যাপন করছি। এই কালের মাহাত্ম্য সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারা নির্বোধ; যারা জানতে চায় না, তারা নিশ্চেষ্ট। সময় যখন নিজেই ধর্মে পরিণত হয়, তখন তা আর শোক বা সুখ থাকে না, কেবলই সত্যে প্রতিভাসিত হয়।

মানুষের অবস্থা সময়ের সাথে বদলায়। তাই বিত্তে বিভোর কিংবা চিত্তে কাতর হ‌ওয়া অসারতা ছাড়া আর কিছু নয়। একা এসেছি, একাই তো ফিরে যাব, তবে কেন কেবলই আঁকড়ে ধরার প্রয়াস? মৃত্যুর আগেই যদি সবকিছুর উত্তর দিয়ে দিতে হবে, তবে কেন এত প্রশ্ন জমাচ্ছি, যার উত্তর পরিশোধ করতে ঘাম ছুটে যাবে? সময়ের কাজ সময়‌ই করে এবং তা করে কেবল সময় হলেই; এর আগেও নয়, পরেও নয়।

জনম, বাড়ন, মরণ
সময়ের তিন ধরন।

৮। ঈশ্বর কে?

মন যাঁকে চিনতে পারে না,
তবে যিনি আছেন বলেই
মন সবকিছু চিনতে পারে,
তিনিই ঈশ্বর।

৯। The crown you could wear makes you an enemy of the people who couldn't.

১০। বেশিরভাগ ছেলেই আদতে কামের পাঠশালার গুরু, যদিও দেয় প্রেমের পাঠ।
বেশিরভাগ মেয়েই আদতে প্রেমের পাঠশালার শিষ্যা, যদিও পায় কামের পাঠ।

কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, ভূমিকাটা উলটো হলে কী হতো? এখন যা প্রেমের গোলাপ, তখন তা-ই হতো প্রবঞ্চনার কাঁটা। সুখটাও তখন আর হতো না এমন গণহারে ছদ্মবেশী।

প্রণয়, প্রেম, ভালোবাসা --- এ সকল‌ই তো কেবল কথার কথা, প্রায়‌ই শর্তের কথা। সুস্থ মস্তিষ্কে হয় না যা, তা বিকার নয় তো কী? আত্মসুখ, স্বার্থ আছে যেখানে, তা কি প্রেমের সম্পর্ক, না কি প্রবঞ্চনার কেনা-বেচা?

১১। আশা, নিরাশার সাথে,
সান্ত্বনা, শোকের সাথে
বাঁধা যদি সমসূত্রপাতে,
তবে কেন আমার বেলায়
অন্ন, কাঁকরের সাথে?

১২। যে লোক মদ না খেয়েও আশেপাশের সবাইকে আপন করে ফেলতে চায়, তার ব্যাপারে সাবধান!

১৩। দেহের সাথে দেহের, মনের সাথে মনের... বড়ো সহজেই মিলন হয়,
আত্মার সাথে আত্মার যে মিলন...রয় দূরে রয়, সে যে সহজ কিছু নয়!

দেহের মানুষ দেহের কাজে,
মনের মানুষ মনেই সাজে,
আত্মার মানুষ আত্মায় বাজে।

১৪। অনুগ্রহ করে আমাকে আপনার স্বর্গে নেবার দায়িত্ব নেবেন না। বেঁচে থাকতে আমার ভালোই লাগছে।


ভাবনা: নয়-শো আটান্ন
………………………………………………………

১। যাকে ভালো লাগে, তার ঘরের কুকুরটাকেও ভালো লাগে।
আর যাকে ভালো লাগে না, তার ঘরের ঠাকুরকেও ভালো লাগে না।

২। আমার এক বন্ধু মজা করে বলে, আমি সপ্তাহে মাত্র দুই দিন মদ খাই: যেদিন বৃষ্টি হয়, আর যেদিন বৃষ্টি হয় না।

ওর মতো করে বলি, দুই ধরনের লোকের প্রশংসা কখন‌ও সিরিয়াসলি নেবেন না: যারা আপনার জুনিয়র কলিগ, এবং যারা আপনার জুনিয়র কলিগ নয়।

ভালো থাকার ভালো একটা বুদ্ধি হলো: প্রশংসা ও নিন্দায় নিস্পৃহ থাকা। অন্যের সম্পর্কে মানুষের আবেগ বদলাতে সময় লাগে না। তাই লোকের আবেগকে আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে দেখুন।

৩। কার‌ও কপালে পড়ে বয়সের রেখা,
কার‌ওবা কপালে পড়ে দারিদ্র্যের রেখা।

৪। কেউ ভালোবাসে, কেউ ভালোবাসা সহ্য করে। বাকিরা বিনা টিকিটে সিনেমা দেখে।

৫। একজন সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অনেক সহজ একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চেয়ে। সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রেই একজন অসুখী মানুষ এবং তাঁর এই সুখের অভাবটি সংক্রামক।

সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে চাইলে আমৃত্যু এই বোধটা নিজের ভেতরে গেঁথে ফেলতে হয় যে, আমি একটা শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে যাচ্ছি এবং এখানে এফর্টটা সারাজীবন আমাকেই দিতে হবে। যতদিন আমি একতরফা এফর্ট দিয়ে যেতে পারব, ততদিন সম্পর্ক থাকবে, অন্যথায় থাকবে না; কিন্তু যদি মাথা থেকে অন্য সবকিছু ডিলিট করে এটুকু সেট করে নেওয়া যায়, তাহলে একতরফা ভালোবাসায়ও শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

আর এরকম করতে না পারলে সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর কোনো মানে নেই। জড়ালে কষ্ট পেতে হবে। সৃষ্টিশীলতা স্বাভাবিক কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, তাই সৃষ্টিশীল মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলিও আর দশটা মানুষের সাথে মেলে না।

৬। সুখে থাকার জন্য বাঙালির কেবল নিজে সুখে থাকলেই চলে না, তার সাথে অন্যের সুখ নষ্ট করা লাগে। বাঙালি সুখ সহ্য করতে পারে না; নিজেরটাও না, অন্যেরটাও না।

৭। অল্প বকো,
অল্প ঠকো।

৮। শুভ গাধা দিবস

(উইশ করতে একটু দেরি হয়ে গেল, কিছু মনে করবেন না।)

৯। যা গরল, তা-ই সুধা,
খাদকের যেমন ক্ষুধা।

১০। কেউ কেউ কুত্তা পালে,
কাউকে কাউকে কুত্তায় পালে।

১১। সাধনার ভার একমনে নিলে কাঁখে,
আশার ফল ফলেই ফলে শ্রমশাখে।

১২। তুমি যার চোখে বড়ো, তার কাছে কখনোই ছোটো হয়ো না। নিজের সাময়িক ক্ষতি করে হলেও তার চোখে বড়োই থেকে যেয়ো। যে তোমার সামনে মাথা নুয়ে কথা বলে, তাকে যদি একবার মাথা উঁচিয়ে কথা বলতে দাও, তাহলে নিজের কাছেই মানসিকভাবে বিপন্ন হয়ে যাবে।

১৩। Weak people feel jealous,
Strong people feel inspired.

Period.

১৪। Wine unites,
Water divides.

১৫। ভোগবাসনা ঘোচালে আমার,
ত্যাগের মহিমা শেখালে না;
জ্ঞানের যা দর্প, করলে চূর্ণ,
ভক্তির সুধা তবু পিয়ালে না।

মিথ্যা যা-কিছু, মুছেছ যদিও,
সত্যের কিছুই জানালে না;
জীবনের যা সাধ, পুরল সব‌ই,
প্রাণের তৃষ্ণা তবু মিটল না।

১৬। জীবনের অনেক সমস্যার সহজ সমাধান পেতে 'কথামৃত' ব‌ইটির কাছে আমাকে বারবার ফিরতে হয়। এই ব‌ইয়ের পাতায় পাতায় গভীর দর্শনের দেখা মেলে, এবং তা এখানে বিধৃত হয়েছে খুব সহজ ভাষায়। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ সহজবোধ্য দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে 'কথামৃত' অন্যতম। মন চাইলে কথামৃত-এর পাশাপাশি ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত ডায়েরিগ্রন্থ 'শ্রীম-দর্শন' উলটে দেখতে পারেন।

পাঠক মাত্রেই অবগত, কথামৃত-এ পুনরুক্তি আছে---এক‌ই কথা শ্রীরামকৃষ্ণ পাঁচজনকে বলেছেন পাঁচজায়গায়। দেখা যায়, নরেনকে যা বলেছেন, তা অন্যদের‌ও বলেছেন।

"মামা, তুমি গোটাকয়েক কথা বাছাবাছি করে রেখে দাও; সব বলে ফেললে, আর বারে বারে এক কথা বললে বেশি লোক আসবে না।"

রামকৃষ্ণের ভাগ্নে হৃদয় মুখুজ্যে মামাকে উপরের কথাটি বলে কয়েকবার সাবধান করে দিয়েছে।

একদিন রামকৃষ্ণ ভাগ্নের এই কথাটির উত্তর দিয়ে বসলেন একটু রাগত স্বরেই: তবে রে শালা, আমার কথা আমি পঞ্চাশ বার বলব! তাতে তোর কী?

এই কথামৃত-এর বিস্ময়কর পাঠকপ্রিয়তা প্রমাণ করে, ভালো কথা পঞ্চাশ বার বললেও লোকে তা গ্রহণ করে, মন্দ কথা এক বার বললেও কেউ গ্রহণ করে না।

আমাকে অনেকেই বলেন, এক কথা বারবার বলেন কেন? সব ক্যারিয়ার আড্ডাতে তো ঘুরেফিরে এক‌ই কথা বলেন। কী দরকার?

বেঁচেছি মাত্র একটি জীবনে, ঘটনা ও অভিজ্ঞতা তাই এক রকমের, তাহলে কথাও এক রকমের হবে না কেন?

তবে হ্যাঁ, এই ক্ষেত্রে আপনার একটা করণীয় আছে। আমার দিকে তাকাতে বা আমার কথা শুনতে বা আমার লেখা পড়তে কেউ তো আপনাকে বাধ্য করছে না। (মন বাধ্য করলে অবশ্য ভিন্ন কথা; মনের উপর তো কারুর হাত নেই।) ভালো না লাগলে এড়িয়ে চলুন, চোখটা অন্য দিকে ফেরান, তাকানোর মতো অনেক কিছুই ছড়িয়ে আছে আপনার চারিদিকে। খুঁজুন, খোঁজার অভ্যেস করুন।

যে জানে না খোঁজা,
তার নাম‌ই খোজা।

গুরু রামকৃষ্ণের মতো করে বলি: আমার কথা আমি যতবার খুশি বলব। তাতে কার কী? মন চাইলে শুনুন, মন না চাইলে রাস্তা মাপুন।

১৭। খুব পছন্দ এবং সম্মান করি, এমন একজনের সাথে আজ সন্ধ্যায় দেখা হলো, চট্টগ্রামের বাতিঘর-এ। তিনি কবি এবং অনুবাদক; পড়াশোনার দৌড় বেশ চমৎকার। আমি তাঁর লেখা ব‌ই কিনেছি, লোকজনকে কিনে দিয়েছি এবং কিনতে বলেছি। এসব তিনি জানেন না। এসব জানানোর কিছু নেই।

কিছু ব‌ইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলাম মুখ নিচের দিকে রেখে। আমি এমনটাই করি। ব‌ইয়ের দোকানে গেলে আমি কখনোই চাই না, অপরিচিত কেউ আমাকে খেয়াল করুক কিংবা খেয়াল করলেও এসে গল্প জুড়ে দিক। এতে অহেতুক সময় নষ্ট হয়। ব্যক্তিগতভাবে, আমি একজন মানুষ এড়িয়ে চলা মানুষ। নিজের সাথে থাকাই বেশি আনন্দের।

উনি কাছে এসে হাসিমুখে কথা বললেন। কেমন আছি জিজ্ঞেস করার পরপর‌ই জানতে চাইলেন, আমার পোস্টিং এখন কোথায় এবং মজার ব্যাপার, উনি সঙ্গে সঙ্গে নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দিলেন এইভাবে: "এখনো তো বান্দরবানেই আছেন, তাই না?" আমিও হাসিমুখে বললাম, "বান্দরবানে তো অনেক দিন আগে ছিলাম; সরকার আর কতদিন রাখবে ওখানে? ওখান থেকেই রিটায়ার করব নাকি? আমাদের তো বদলির চাকরি। হা হা হা..."

একসময় চাকরিসূত্রে বান্দরবানে ছিলাম। সে-ও অনেক দিন হয়ে গেল। অবশ্য এটা নিয়ে মনগড়া নানান অরুচিকর কথাবার্তা বলতে ও গল্প বানাতে ইতরের দল আজ‌ও আনন্দ পায়। সুশান্ত পালকে নিয়ে চুলকানি থাকলে সহজেই স্বর্গে যাওয়া যায় বোধ হয়! কার আনন্দ যে কীসে বোঝা মুশকিল! কিছু মানুষের হাতে বেকার-সময় অফুরন্ত।

পোস্টিং কোথায়, তা বলার পর উনি উপকার করতে চাওয়ার আন্তরিক সুরে ব্যস্ত হয়ে বললেন, "গুরুদয়াল কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপালকে তো চেনেন, না?" আমি চিনি না বলাতে উনি অবাক হয়ে জানালেন যে, স্যারের সাথে তাঁর ভালো পরিচয় আছে। আমার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেবেন। আরও বললেন, "আপনি তো ক্যারিয়ার আড্ডা-ফাড্ডা করেন, পরিচয় থাকলে আপনার অনেক সুবিধে হবে।"

গায়েপড়া স্বভাবের লোক আমি এমনিতেই পছন্দ করি না। তার উপর তাঁর কথায় মনে হলো, আমার ঠেকা পড়ে গেছে কোথাও গায়ে পড়ে গিয়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং করার! কতশত মানুষকে ফিরিয়ে দিই সময়ের অভাবে নয়, কেবল অ্যাপ্রোচ পছন্দ হয় না বলে। টাকা নিই না যে কাজ করে, তা নিয়ে চাপ নেবার কী আছে? মন যেখানে একটুখানিও পেছনের দিকে টানে, সেখানে আমি নেহায়েত দায়ে না পড়লে কখনোই সামনে এগোই না। মনের শান্তি সবার আগে।

পরিচয় করিয়ে দেবার ওই 'লোভনীয় প্রস্তাব' তিনি খুব একটা সম্মান রেখে দিয়েছেন বলে তাঁর কণ্ঠস্বর ও বলার ভঙ্গি দেখে আমার কাছে মনে হয়নি। এত বছর পর দেখা হবার পর যার কুশল বিনিময়ের শুরুটাই হয়েছে অমন খুঁচিয়ে বাঁকা প্রশ্ন করে, তাঁর কাছ থেকে অবশ্য অপরকে সম্মান দেখাতে জানাটা আশা করা যায় না।

উল্লেখ করি, তাঁর সাথে আমার দেখা বা কথা কোনোটাই কখনও হয় না, আমি দূর থেকেই তাঁর গুণমুগ্ধ। এর অর্থ, আমরা পরস্পরের অপরিচিত।

আমি বিনয়ের সাথে বললাম, ভাই, আমি নিভৃতচারী মানুষ, কার‌ও সাথে যোগাযোগ তেমন রাখি না। খুব দরকার না হলে রাখতে চাইও না।

অনেকটা প্রতিবাদের সুরে নিজের কানকে অবিশ্বাস করার অভিব্যক্তি চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলে তিনি তীব্র আপত্তি জানালেন: না না, আপনি কোনোভাবেই নিভৃতচারী নন। আপনাকে আর যা-ই হোক, নিভৃতচারী বলা যায় না। আপনি তো লোকজনের সাথে মিশে বেড়ান!

আর ভালো লাগল না। তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিয়ে উত্তর দিই, ভাই, আমাদের মধ্যে দেখা এবং কথা তো তেমন হয়‌ইনি; ফেইসবুকে মাঝে মাঝে ইনবক্সে কথা হয়েছে শুধু। আমার সম্পর্কে রায় দেবার জন্য ওটুকুই কি যথেষ্ট? আমরা পরস্পরের অপরিচিত; আপনিও আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। চেনার প্রয়োজন বা ইচ্ছে আমাদের কখনও হয়নি। আপনি তাহলে কীভাবে আমাকে জাজ করছেন? কেবল দূর থেকে দেখেই? আমরা যেখানে সারাজীবনেও পাশের লোকটাকেই চিনতে পারি না, সেখানে দূরের কাউকে চিনব কী করে? আমরা তো নিজের স্ত্রী, স্বামী, বাবা, মা, ভাই, বোন এসব মানুষকেও ঠিকভাবে চিনতে পারি না, তাই না? এতটা আত্মবিশ্বাসী আপনি আমার মতন একটা অপরিচিত লোকের বেলায় হচ্ছেন কীভাবে?
"ঠিক আছে, ভাইয়া, ভালো থাকবেন।"

এর বেশি আর একটিও কথা না বলে তিনি আমার সামনে থেকে দ্রুত চলে গেলেন।
"আপনিও খুব ভালো থাকবেন, ভাইয়া।" এই কথাটি আমি হাসিমুখে তাঁর কানে পৌঁছে দিতে পেরেছি কোনোমতে।

তাঁকে সমীহ করে চলব আগের মতোই, তবে আমার সামনে পড়ে গেলেও আলাপ জমানোর জন্য তিনি সময় খরচ করুন, এটা আর চাইব না ভুলেও। আমি দুই ধরনের মানুষ সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি: জাজমেন্টাল এবং কনজারভেটিভ। ওদের সাথে মিশতে যাদের আপত্তি নেই, ওরা তাদের সাথে মিশুক; আমি এখানে ক্ষমা চাই।

সম্পর্ক নষ্ট করতে খারাপ লাগে। তার চেয়ে বরং যোগাযোগহীনতা শ্রেয়।


ভাবনা: নয়-শো উনষাট
………………………………………………………

১। আর কেন ভাবো বন্ধু, বৃথা এত ভেবো না।
ভেবে কী ফল বলো, সে তো তোমায় ভাবে না।
তুমি এত ভাবে যারে,
সে ভাবে শুধু অন্যেরে,
তবে ভেবে কী হবে, বাড়বে কেবল ভাবনা।
তুমি তাকে ভাবো যত,
সে যদি কিছুও ভাবত,
আর কী এমন ভাবতে হতো, যেত ভাবার এ যন্ত্রণা!

২। একদিন মা ছিল বলেই ছেলেটি জীবনে আরও অনেকদূর যাবার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিল এবং গেছেও।
আজ স্ত্রী আছে বলেই ছেলেটি জীবনে আর বেশিদূর যাবার স্বপ্ন দেখতে পারে না এবং দেখেও না।

মানুষ স্বপ্নে বাঁচে, বিয়েতে মরে। বিয়ে সকল সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটায়। সংসার সকল সুখের মূল যদি তা না করা হয়। বন্ধন মানেই ক্রন্দন।

"বিয়ে করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।"-বলা মানুষগুলোর জীবন বেঠিক হয়ে গিয়েছিল বিয়ে করার ফলেই, খোঁজখবর নিলে জানতে পারবেন।

বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে ছেলে ও মেয়ে উভয়েই একটি অদৃশ্য চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে; আর ওতে লেখা থাকে: এসো, আমরা দু-জন মিলে পরস্পরের জীবনকে ধ্বংস করে দিই।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে সবাই ঘুরে ঘুরে তালি দিতে দিতে নাচতে থাকে, যারা ওদের ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।)

৩। দুঃখের দিন যখন মানুষের অদৃষ্টে চেপে বসে, সুখের দিন তখন পালাতে পারলেই যেন বাঁচে। আর দুঃখের দিন যখন চলে যায়, তখন পড়ে থাকে শুধু স্মৃতি... পুরোনো সুখ আর ফিরে আসে না।

৪। এসেছি বন্ধু কিছুই নয় তো নিতে,
ভয়ে কম্পিত তোমায় অভয় দিতে।
দানের মধ্যে জানো শ্রেষ্ঠ কী দান?
সংশয়ে ভীত চিত্তে অভয়-প্রদান।

৫। বৈষ্ণবসাহিত্য বলে, অন্তরে কৃষ্ণ, বাইরে গৌরাঙ্গ।
হিন্দুরা বলে, অন্তরে ঈশ্বর, বাইরে দেবতা।

আর যারা এত বিচারে না গিয়ে শুধুই প্রার্থনা, সাধনভজন, ধর্মাচরণের মধ্যে ডুবে থাকে, অর্থাৎ নিজেকে সমর্পণ করে দেয় ঈশ্বরের পায়ে, তারাও শান্তিলাভ করে। গীতায় বলা হয়েছে, যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবে ভজনা করি। এই জায়গা থেকে বলা যায়, বিজ্ঞানী তাঁর অন্তরে যেভাবে ঈশ্বরকে ধারণ করেন, কৃষক সেভাবে করেন না। মূল সুরটা এক হলেও সুরের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন; তাই ওঁদের ঈশ্বরদর্শনের প্যাথোস অভিন্ন হলেও প্রকাশ অভিন্ন নয়। আধারের ধারণ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে আধেয়ের বাহ্যিক প্রকৃতি পালটে যায়।

'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের দশম পরিচ্ছেদের মধ্যভাগে দেখতে পাই:

"প্রভু কহে, ঈশ্বর হয় পরম স্বতন্ত্র।
ঈশ্বরের কৃপা নহে বেদপরতন্ত্র।"

আহা, এই পঙ্‌ক্তিদুটি অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্নের বড়ো সহজ সমাধান! অশিক্ষিত, মূর্খ, শাস্ত্রজ্ঞানশূন্য মানুষ‌ও যদি নিজের ভেতরটাকে জাগাতে পারেন ক্রমাগত সাধনার মাধ্যমে, তবে তিনিও ঈশ্বরের কৃপা লাভ করতে পারেন। ঈশ্বরের কৃপা বলতে বোঝাচ্ছি আত্মা তথা চৈতন্যের উদ্‌বোধন।

যুগে যুগে লালন-কবির-তুলসিদাস-দাদু-রামদাস-চণ্ডীদাস প্রথাগত শিক্ষার আলো থেকে বহুদূরে থেকেও অন্তরের আলোয় উজ্জ্বল করেছেন নিজেকে এবং পুরো পৃথিবীকে। তাঁদের নানান সত্যবদ্ধ উচ্চারণের পায়ের কাছে এসে শান্ত হয়ে বসে পৃথিবীর সমস্ত বিদ্যাভিমান, জ্ঞানগরিমা। ঠিক এই মহাসত্যটাই বৈষ্ণবসাহিত্য উচ্চারণ করেছে নানান পদের মধ্য দিয়ে। যে পথ জাগায়, সে পথ কিছুতেই ভুল নয়।

মহাত্মা রামকৃষ্ণের সেই অমর বাণী... যত মত, তত পথ... পৃথিবীতে মানুষ যতদিন বাঁচবে, ততদিন সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। মত ও পথের বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতার মৃত্যু মানেই সভ্যতার মৃত্যু। আমিই ঠিক, তুমি ভুল... এই বিশ্বাসের লালন মানুষকে মানুষ হিসেবে পরাজিত করে দেয়।

পৃথিবীর সমস্ত গ্রন্থ পাঠ করেও যে ব্যক্তি নিজের আত্মার সন্ধান পেল না, চৈতন্যকে জাগাতে পারল না, সে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের কাছাকাছিই পৌঁছোতে পারল না। নিজের ভেতরের আমি'কে দূরে সরিয়ে রেখে জগতের সকল আমি'র খোঁজ করে বেড়ানো মানুষগুলি তাই অধার্মিক। কাঠামোই যদি ঠিক না থাকে, তবে পোশাকের কী প্রয়োজন?

(সময় পেলে এ নিয়ে বিশদে লেখার ইচ্ছেটুকু জাগিয়ে রাখলাম। আহা জীবন! আহা জীবিকা!)

৬। ছেলেরা ব্রেক‌আপ ঠেকায়,
মেয়েরা রিলেশন টেকায়।

ছেলেরা বুদ্ধিতে ব্রেক‌আপ না ঠেকালে এবং মেয়েরা আবেগে রিলেশন না টেকালে কোনো সম্পর্কই সুন্দর পরিণতি পায় না।

৭। লড়াইটা শেষ হলেই শান্তি এসে যাবে, এমন নয়। আত্মার শক্তি না এলে শান্তি কিছুতেই আসে না---লড়াই সেখানে থাকুক বা না থাকুক; যার আত্মা দুর্বল নয়, চৈতন্য জেগে থাকে, সে এমনকি লড়াইয়ের মধ্যে থেকেও শান্তিতে বাঁচতে পারে।

এমন অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে লড়াই করে বাঁচতে হয় না, যাদের জীবনে সুখের পসরা অফুরন্ত, তবু ওরা শান্তি পায় না কেবল আত্মার শক্তির অভাবে। আত্মার শক্তির নাম‌ই শান্তি।

৮। কেউ বললেন, কী আশ্চর্য তাঁর রূপ, তা আমি দেখেছি।
কেউ বললেন, কী আশ্চর্য তাঁর বাণী, তা আমি শুনেছি।
কেউ বললেন, কীভাবে তিনি গল্প করেন নীরবতায়, আমি তা অনুভব করেছি।
তবু কেউই বলতে পারলেন না, আমি তাঁকে জেনেছি।

৯। কাজ তো তা-ই, যা বাঁধে না নিত্যনতুন শেকলে,
জ্ঞান তো তা-ই, যা মুক্তি দেখায়, স‌ইতে শেখায়;
আর যা-কিছু কাজ, তার সব‌ই অপচয়-বিলাস,
আর যা-কিছু জ্ঞান, তার সব‌ই পুঁথির অপপ্রচার।

১০। আমি সেই লোকটা, যার সাথে আপনি আপনার প্রেমিকাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইবেন না।

১১। ভালোবাসে না যে, তার জিভে জড়তা নেই।

১২। গভীর বিরহ-নদী,
দুই তীরে চখাচখি;
রজনী আঁধার অতি,
তবু ওরা সখাসখি।

১৩। পাপ করলেই যে পুণ্য করতে হবে না, এমন কোনো কথা নেই।
পুণ্য করলেই যে পাপ করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই।
পাপে পুণ্য তেমন না কাটলেও পুণ্যে পাপ কাটে।
পাপাসক্ত মানুষ যেমনি পুণ্যে মুক্তি খোঁজে, ঠিক তেমনি পুণ্যক্লান্ত মানুষ পাপে শান্তি খোঁজে।

১৪। সংসারের প্রতি যেদিন থেকে মানুষ আর টান অনুভব করে না, সেদিনই তার আত্মিক মৃত্যু ঘটে। ধীরে ধীরে একসময় তার সমস্ত শক্তিই নিঃশেষিত হয়ে যায়।

১৫। "সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা,
তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা।"

'সুজন সখী' সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় এই গানটি খান আতাউর রহমান লিখেছিলেন বৈষ্ণবসাহিত্যের নৌকাখণ্ডের একটি গান থেকে কনসেপ্ট নিয়ে।

"পার করো হে ধীবর মাঝি বেলাপানে চেয়ে।
দধি-দুগ্ধ নষ্ট হলো, বিকী গেল বয়ে।

(কৃষ্ণ) সব সখীকে পার করিতে নেব আনা আনা।
শ্রীরাধাকে পার করিতে ল‌ই কানের সোনা।"

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশাল একটি অংশ দাঁড়িয়ে আছে বৈষ্ণবসাহিত্যের উপর ভর করে।

১৬। দূরে ছিলে, দূরেই আছ,
তবু কেন কাছে আসো?

জীবনকে মেপে মেপে
যদি করা যেত যাপন,
এই বুকে রাখতাম কি
করে তোমায় আপন?

প্রেম করে কেউ বুঝি
সরায় মুনাফা গোপনে?
আমি তো মার খেলাম
হারিয়ে সব‌ই মূলধনে!

টেনে টেনে দিন‌ই ফুরোয়
জীবন তবু ফুরোয় না তো...

১৭। অদৃষ্টে মেলে সব‌ই,
শুধু সুখ মেলে না।