ভদকা

ওদের বাড়ির লোকেরা ওকে ভদকা বলে ডাকে। ওই নামে ডাকলেই ও দৌড়ে আসে। আমার সঙ্গে ভাব নেই ওর, ঝগড়াও নেই। ভাব বা ঝগড়া না-ই থাকুক, তবু ওকে ভালোবাসি। তবে ও জানে না এই ভালোবাসার কথা। জানাবার জন্যে আমিও কিছুমাত্র চেষ্টা করি না। আমার এই ভালোবাসা আমাকে ভালো রাখে, এটুকুই যথেষ্ট। ভদকাকে ভালোবেসে আমি ভালো থাকি। ভালোবাসা কেবল ভালোবাসাতেই সার্থক, সোচ্চার প্রচারে নয়। হ‌ইচ‌ই সৃষ্টি করে যা, তা আর যা-ই হোক, ভালোবাসা কিছুতেই নয়। নীরব ভালোবাসা পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতি।




পাড়ায় আরও তো অনেক কুকুর আছে, কিন্তু ভদকা শুধু একটাই। পাড়ার কুকুরদের চিৎকারে কানদুটো ঝালাপালা হবার জোগাড় হয়, কিন্তু ভদকা যখন ডাকে, আমার কানে যেন মধুবর্ষণ হয়। সত্যি বলছি, ভদকার গলার স্বরটি আমার বড়ো ভালো লাগে। ওর স্বরে কেমন একটা মাধুর্য আছে! আর দশটা কুকুরের গলায় তা নেই। সাদায় এবং একটু কালোয় মেশানো ছোটোখাটো কুকুরটার নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সহজেই ওকে বাকিদের থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। ওর গায়ের লোমগুলো বেশি বড়ো নয়, তবে ঘন আর চকচকে। ওর চেয়ে সুন্দর কুকুর হয়তো অনেক আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, ওর একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে—সেটা ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না। ওর চোখদুটিও বড়ো সুন্দর। ওর চোখে যেন ওর আত্মা এসে ধরা দেয়—আমার দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে চেয়ে দেখে কিনা, তাই বুঝতে পারি। ওকে ভালোবাসি বলেই ওকে এত ভালো লাগে।




আমাদের বাড়ি থেকে ওই যে সোজা রাস্তাটা দখিনমুখে চার্চের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে, ওই রাস্তার উপর আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ি পরেই ভদকাদের বাড়ি। আমার ঘরের দখিনের জানলা খুললেই ওকে দেখতে পাই। (বোধ হয় আমি ওকে দেখার জন্য‌ই দখিনের জানলাটা খুলে রাখি।) দেখি, ভদকা হয় বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করছে, নয় বাড়ির রোয়াকের উপর সজাগ হয়ে বসে আছে দৃপ্ত ভঙ্গিতে, আর অপরিচিত কাউকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ স্বরে ডেকে বলছে যেন…কে তুমি?




খুব বেয়াড়া চেহারার কাউকে দেখলে ওর গলার স্বর যায় চড়ে, আর যতক্ষণ লোকটাকে দেখা যায়, ততক্ষণ ভদকা ওর সারমেয়ী ভাষায় নিজের মতামত ব্যক্ত করতে ছাড়ে না। অন্য কুকুরগুলি ওদের বাড়ির ত্রিসীমায় ঘেঁষতে পারে না, এমনই প্রতাপ ওই ছোট্ট ভদকার—প্রতাপ জিনিসটা সবসময় আকারে মাপা যায় না। শুধু তা-ই নয়, কোথাও সাইকেলের টায়ার ফেটেছে বা ওরকম বিদঘুটে কোনো আওয়াজ হয়েছে কিংবা পাড়ার লোকেরা কোথাও কোন্দল লাগিয়েছে, অমনিই ভদকা ধমকে বলে উঠবে—আঃ! হচ্ছেটা কী? দেখছ না, আমি বিশ্রাম নিচ্ছি!




আমি চার্চে বা ডাইনিং-রুমে যাবার সময় ওদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাই। ও শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে, কোনো উচ্চবাচ্য করে না। ভদকার আত্মমর্যাদাবোধ চোখে পড়ার মতো। একদিন ডাইনিং-রুম থেকে খাবার নিয়ে ফিরছি; দেখি, ও কখন জানি আমার পেছন পেছন এসে খাবারের থলিটা শুঁকছে। একটা ছোট্ট ধমক দিতেই ও সরে গেল। না, ওকে কোনোদিন একটুকরো রুটিও দিইনি। আমার হাতে খাবারের থলি দেখে ভদকা আর কখনোই কাছে ঘেঁষেনি।




রুটি দিইনি, তার কারণ, আমরা সবাই মিলে যদি শহরের কুকুরগুলিকে রুটি খাওয়াতে বসি, তাহলে আমাদের ডাইনিং-রুমকে ফতুর হয়ে যেতে হবে। ডাইনিং-রুমের নিয়মই হলো, প্রত্যেকে নিজে যেটুকু খেতে পারে, সেইটুকু খাবারই নেবে, তার বেশি নেবে না। অবশ্য আমরা সবাই যে এ নিয়ম মেনে চলি, তা-ও না। আমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ঈশ্বরের পুত্রের উপর দিয়ে দানসত্র চালাবার চেষ্টা করেন। ঈশ্বরের ঘরে বিনে পয়সায় থাকছি-খাচ্ছি, এ-ই তো ঢের—কিছু বিবেক এবং কাণ্ডজ্ঞান খরচ যে এখানে করতেই হয়!




ভদকাকে আমি দিয়েছি কেবলই আমার অন্তরের নীরব ভালোবাসা। আমি একটুকরো রুটি না দিলে ভদকা মরবে না। ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পারি যে, প্রয়োজনীয় খাদ্যটুকু মনিবের কাছ থেকে ঠিকই ও পাচ্ছে। অনুমান করি, নিজের পছন্দের পানীয়ের নামটিই মনিব তাঁর পোষা কুকুরের জন্য ঠিক করেছেন। আর হ্যাঁ, ভদকার কাছে আমিও কিছু আশা করি না—এমনকী ওর ল্যাজনাড়া-টুকুও নয়। ভদকা ল্যাজ না নাড়ালেও আমি ওকে ভালোবাসি; ওর অস্তিত্বটুকুই শুধু আমাকে আনন্দ দেয়। ভদকা ভালো আছে, তাই আমিও ভালো আছি।




আমি চাই, সে তার নিজের স্থানটি অধিকার করে থাকুক আর ঘেউঘেউ রবে তার কুকুরজীবনের আনন্দকে অভিব্যক্ত করুক। অনেকে কুকুরের ডাকে বিরক্ত হয়। আমি হই না। মানুষ তার সভ্যতার গর্বে পৃথিবীর আবহাওয়ায় যে-সব বিকট শব্দের সৃষ্টি করেছে, তার তুলনায় কুকুরের ঘেউঘেউ রব অনেক মিষ্টি। চারিদিকে দিনে-রাতে মাইকের যে-অত্যাচার, তার চেয়ে কুকুরের ডাক অনেক সুশ্রাব্য।




কুকুর, বেড়াল এদের বাদ দিয়ে মানুষের জীবনকে আলাদা করে ভাবা যায় না। কোনো পথহারা আশ্রয়প্রার্থী পথিক দূরে কুকুরের ডাক শুনলে এই ভেবে আশ্বস্ত হয় যে, ওখানে লোকালয় আছে। আর চোরেরা ভয় পায় এই ভেবে যে, ওখানে প্রহরী সজাগ। কুকুরের প্রভুভক্তি মানুষকে ছাড়িয়ে যায়—নিজের জীবনের চেয়েও মনিবের জীবনকে বেশি ভালোবাসে, এমন প্রাণী আর আছে কি? মানুষের যে-ক্ষমতা নেই, কুকুরের তা আছে। আজকাল তাই দেখতে পাই, অপরাধীকে সনাক্ত করার জন্যে পুলিশ কুকুরকে কাজে লাগাচ্ছে। কুকুরের বুদ্ধিমত্তা এবং সংবেদনশীলতা খুব প্রখর। কাজেই কুকুরকে অনাবশ্যক মনে করা বড্ড ভুল। মানুষের সঙ্গে তার গৃহপালিত পশুগুলি না থাকলে জীবন অত্যন্ত অসম্পূর্ণ হতো। মানুষ মানুষের কাছে আশ্রয় পায় না বলেই তো কুকুর-বেড়াল পোষে।




ভদকা না থাকলে ওদের বাড়িটা যেন মানায় না; আমাদের পাড়াটাও। ওদের বাড়িটা আগে ছিল নারকেল পাতায় ছাওয়া পর্ণ কুটির। এখন ওদের ভাগ্য ফিরেছে। নতুন পাকা বাড়ি হচ্ছে; বাড়িটা প্রায় শেষ হয়ে এল। নতুন বাড়ির সিঁড়ির উপরে এখন প্রায়ই ভদকাকে বসে থাকতে দেখি…যেন বাড়িটাকে আগলে রয়েছে। নতুন বাড়ি হওয়াতে ভদকার কেমন লাগছে ভাবতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না। মনে হয়, ও জিনিসটাকে খুব সহজ-স্বাভাবিক'ভাবেই নিয়েছে। ওর চোখে পর্ণ কুটির আর পাকাবাড়িতে খুব বেশি প্রভেদ নেই। ও হল পাহারাদার, তা সে পাকাবাড়িরই হোক বা পর্ণ কুটিরেরই হোক। পাহারাদারের আবার কীসের বাড়িভেদ?




সেদিন সকালে অনেক কুকুরের ডাক কানে এল। ভদকার গলাটাও বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, মিউনিসিপ্যালিটির কুকুর-ধরা খাঁচার গাড়ি আর তার মধ্যে কয়েকটা কুকুর। রাস্তার খেঁকি ও ঘেয়ো কুকুরদের ধরে নিয়ে গিয়ে ওরা মেরে ফেলে। শহরের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু দেখি, ওরা অনেক ভালো-ভালো কুকুরও ধরে নিয়ে যায়। আর কী নিষ্ঠুরভাবেই-না ধরে! দেখলে কষ্ট হয়। দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সেটা ছুড়ে দেয় কুকুরের গলায়। তারপর ঝটকা মেরে ওকে গাড়িতে টেনে তুলে দরজা বন্ধ করে দেয়। যদি সহজে না তোলা যায়, কুকুরটা যদি বেশি বাধা দেয়, তাহলে ওকে লোহার ডান্ডা দিয়ে মেরে আধমরা করে তারপর গাড়িতে তোলে। শহরের মাঝখানে এ রকম নিষ্ঠুর দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। একটা গাড়িতে বস্তাগাদা করে কুকুরদের নিয়ে যায় ওরা।




ওদের শুধু রাস্তার খেঁকি কুকুর ধরারই কথা, বাড়ির কুকুর নয়। কিন্তু দেখলাম, ভদকা যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, তখন ওরা ভদকাকেও দড়ির ফাঁস লাগিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলল। ভদকাদের বাড়ির লোকেরা তখন কেউ কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাদের আপত্তি ওরা শুনল না; উলটো বলল, "বাড়ির কুকুর বাড়িতে বেঁধে রাখলেই পারো, রাস্তায় ছেড়েছ কেন? আমাদের কাজে বাধা দিলে মামলা ঠুকে দেবো।"




গাড়ি চলে গেল। মামলার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। ওরা মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইল। ভীষণ কষ্ট হলো আমার ভদকার জন্যে। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার ভালোবাসা কি আর সরকারের চেয়েও শক্তিশালী!




গাড়ির ভেতর থেকে ভদকার ডাক তখনও কানে আসছে। আমার ভেতর থেকে এক প্রার্থনা জেগে উঠল: "প্রভু, ভদকাকে যেন ওরা না মারে।" প্রার্থনা করলাম বটে, মনটা কিন্তু বিষাদাচ্ছন্ন হয়েই রইল। ওই গাড়িতে যে কুকুর ওঠে, ও আর ফিরে আসে না। আমার প্রার্থনাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে ভদকা আর ফিরে আসেনি। প্রার্থনায় নিজের আত্মা ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি পেয়েছিল—এটুকুই, ব্যস্!




যতবার ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করি, ভদকাকে না দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বেচারা ভদকা! সব যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দিনেরাত্রে আর ভদকার গলা শোনা যাচ্ছে না। সব কিছুই রয়েছে, অথচ একমাত্র ভদকার অভাবেই সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভদকাই পাড়াটা জমিয়ে রাখত। একটিমাত্র শুকতারা যেমন ভোরের আকাশটা ভরে থাকে, ঠিক তেমনই ভদকা ছিল এ পাড়ায়। পাড়াটা আজ মৃত।




ঘুরেফিরে কেবলই ভদকার কথা মনে পড়ে। ভদকার ক্ষুদ্র প্রাণটুকু অনন্ত প্ৰাণসাগরে মিশে গেছে। আহা, বেচারা ভদকা! কখনো ভাবি, দৈবাৎ যদি ভদকা ফিরে আসে? এমন তো হয়, কত হয়েছে! মিরাকল ঘটে তো…ঘটে না? কিন্তু না, এক দিন, দুই দিন করে কয়েকদিন কেটে গেল, ভদকা ফিরল না।




তবু তাকাই বারবার৷ দখিনের জানলা খোলাই রাখি। ওদের ওই নতুন সিঁড়ির উপরে ভদকা ইদানীং শুয়ে থাকত। আর এক বারও কি ও এসে শোবে না ওই সিঁড়িতে? সুন্দর গলায় ঘেউ-ঘেউ করে আর কখনোই কি ডাকবে না ভদকা?




না, বৃথা আশা! যে চলে যায়, সে কি আর ফেরে! হে প্রভু, শুনলে না আমার প্রার্থনা? তবে এ-ই কি ছিল ভদকার অখণ্ডনীয় নিয়তি? না পেলাম ভালোবাসার বস্তুটিকে ধরে রাখার ক্ষমতা, না পেলাম প্রার্থনাকে সত্য করিয়ে নেবার ক্ষমতা! আমার একটাই ক্ষমতা—আমি প্রভুর পায়ের কাছে পড়ে থাকতে পারি, ঠিক যেভাবে ভদকা পড়ে থাকত ওর মনিবের পায়ের কাছে।




সিঁড়িটির দিকে একমনে তাকিয়ে প্রায়‌ই ভাবি,




জীবনেরে কে রাখতে পারে?
আকাশের প্রতি-তারা ডাকছে যে তারে!
তার নিমন্ত্রণ লোকে-লোকে,
নব নব পূৰ্বাচলে, আলোকে আলোকে।




তবু ফাঁকটা ভরে না, ব্যথাটা রয়ে যায়। শূন্যতার চাইতে বড়ো দার্শনিক সত্য আর কী আছে! পৃথিবীর সব দর্শন মিলেও কি ছোট্ট কোনো শূন্যতা পূরণ করতে পারে?




বহুদিন কেটে গেল। আজও অন্যমনস্কভাবে দখিনের জানলাটা খুলে দিই একটু হাওয়ার জন্যে। হাওয়ার বদলে স্মৃতি ভেসে আসে…




একদিন। ও কী! কী দেখছি! এ আমার স্বপ্ন, না মায়া-মতিভ্রম! ওই তো ভদকা ওদের বাড়ির সিঁড়ির উপরে শুয়ে। কখন ফিরল ভদকা? কেমন করে ফিরল? এ-ও কি সম্ভব? প্রভু! তাহলে কি তুমি আমার প্রার্থনা শুনেছিলে? লোকে বিশ্বাস করুক না করুক, আমি যে জানি, তোমার কৃপায় সবই সম্ভব। কিন্তু এ অসম্ভব ঘটনা কেমন করে ঘটল? ঈশ্বর কি তবে আমায় কৃপা করলেন এতদিনে!




এসব কিছুই আমি জানতে চাই না; কেবল জানি, আজ আমি এবং ভদকা একসাথে ভালো আছি।