ভগবানের হিসেব

ভগবানের হিসেবে কখনও ভুল হয় না।

একবার দুই ব্যক্তি সারাদিন পরিশ্রমের পর এক মন্দিরের চাতালে বসে গল্প করছিল। ওদের কথা ফুরোয়‌ই না। এর‌ই মাঝে কোত্থেকে যেন ওদের সমবয়সি এক লোক এসে আড্ডায় বসে পড়ল।

দীর্ঘসময় ধরে খোশগল্প চলছে। সময়ের দিকে কার‌ও কোনো খেয়ালই নেই।

হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সে কী আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি! বৃষ্টি নামলে ওদের মনে পড়ল, বাড়ি ফিরতে হবে! কিন্তু ওরা যাবে কীভাবে? এদিকে আবার বেশ রাত হয়ে গেছে। খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে।

প্রথম জন বলল, “আমার কাছে পাঁচটে রুটি আছে।” জানা গেল, দ্বিতীয় জনের কাছে আছে তিনটে। তৃতীয় জন ইতস্তত করে বলল, “আমার কাছে তো কিছু নেই!”
তা শুনে বাকি দু-জন হেসে বলল, তাতে কী আছে! এই আটটে রুটিতেই আমাদের হয়ে যাবে।

কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্য জায়গায়। আটটা রুটি সমান তিন ভাগে ভাগ করবে কী করে ওরা?

তৃতীয় ব্যক্তি বুদ্ধি বের করল। “প্রতিটি রুটিকে ছিঁড়ে তিন টুকরো করলেই তো চব্বিশ টুকরো হয়ে যায়। তখন তো আমরা প্রত্যেকেই আট টুকরো করে খেতে পারি!”

বুদ্ধিটা বাকি দু-জনের মনে ধরল এবং তা-ই করা হলো।

ওরা ছিল খুব ক্লান্ত, তাই খাওয়াশেষে সবাই মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরের আলো ফুটলে প্রথম দু-জন ঘুম ভেঙে দেখল, তৃতীয় জন কোথায় যেন চলে গেছে। ওরা ধরে নিল, হয়তো তাড়া আছে, তাই সে ভোররাতেই র‌ওনা হয়ে গেছে।

ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছে . . . তখন হঠাৎ ওরা আবিষ্কার করল, যাবার আগে সেই লোক আটটি সোনার মোহর রেখে গেছে।
এত মূল্যবান উপহার পেয়ে তো খুশিতে ওদের রীতিমতো পাগল হবার জোগাড়!

দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রস্তাব দিল, চলো, আমরা দু-জন এই উপহার সমান ভাগে নিয়ে নিই।
শুনে প্রথম ব্যক্তি আপত্তি জানাল: তা কী করে হয়? আমার কাছে ছিল পাঁচটে রুটি, তোমার কাছে ছিল তিনটে। হিসেবে তো তুমি তিনটে মোহর পাও, আর আমি পাই পাঁচটে।

সোনার মোহর ভাগ করা নিয়ে ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আরম্ভ হলো। হঠাৎ পূজারিকে আসতে দেখে ওরা তাঁকে সব খুলে বলল। “আপনি এ সমস্যার সমাধান করে দিন। আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না।”

পূজারি বললেন, আপনাদের দু-জনের কথাই ঠিক। হয় সমান ভাগে ভাগ করে নিন, নয় পাঁচটে আর তিনটে—এটাই ন্যায্য হিসেব।

ওরা দেখল, এর সমাধান করা পূজারির কাজ নয়। তখন ওরা পূজারিকে অনুরোধ করল: আমরা শুনেছি, এ মন্দিরের ঠাকুর খুব জাগ্রত। আপনার ঠাকুরকে বলুন না, এ সমস্যার সমাধান করে দিতে! উনি যা করবেন, আমরা তা-ই মেনে নেব।

পূজারি মন্দিরে প্রবেশ করে ঠাকুরের পায়ের কাছে সেই আটটা সোনার মোহর রাখলেন। আর সেগুলির সামনে দুটো বাটিতে সেই দুই ব্যক্তির নাম লিখে হাতজোড় করে প্রার্থনা করলেন, “হে ভগবান, তুমি এর সুবিচার কোরো।” বলেই মন্দির থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে পূজারি অবাক হয়ে দেখলেন, প্রথম ব্যক্তির নাম-লেখা বাটিতে সাতটি মোহর আর অপরটিতে মোহর রাখা একটি। তিনি আবারও প্রার্থনায় বসলেন। “এ তুমি কী করলে? আমি এখন ওদেরকে কীভাবে বোঝাব?” ঠাকুর তখন স্মিত হেসে তাঁকে হিসেবটা বুঝিয়ে দিলেন।

প্রথম জনের ছিল পাঁচটে রুটি, সেই পাঁচটে ছিঁড়ে পাওয়া গেছে পনেরো টুকরো।

দ্বিতীয় জনের ছিল তিনটে রুটি, সেই তিনটে ছিঁড়ে পাওয়া গেছে নয় টুকরো। তাহলে খাওয়ার সময় প্রথম জন নিজে খেয়েছিল আট টুকরো, আর দিয়েছিল সাত টুকরো; দ্বিতীয় জন নিজে খেয়েছিল আট টুকরো, আর দিয়েছিল এক টুকরো। লোকের পুণ্যফল—তার কতটুক ছিল বা সে কতটুক ভোগ করল—এর উপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে—সে কতটুক নিঃস্বার্থভাবে দান করল, তার উপর।

মন্দির থেকে বেরিয়ে পূজারি যখন ঠাকুরের হিসেবটি ওদের বুঝিয়ে দিলেন, তখন ওরা তা মেনে নিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল।

ভগবানের হিসেবে সত্যিই কখনও কোনো ভুল হয় না। ভগবানের কাছ থেকে লোকে ঠিক ততটাই পায়, যতটা সে দেয়।

এই পোস্টের সাথে একটা ফটো শেয়ার করেছি। ওখানে কী লেখা আছে, দেখুন; মন ভালো হয়ে যাবে।

একটা হাউজিং প্রতিষ্ঠান তাঁদের সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া না নিলে তাতে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের তেমন কিছুই এসে যায় না, কিন্তু ইদের এমন দুর্বহ খরচের সময়ে এক মাসের ভাড়া বেঁচে গেলে তাতে সেবাগ্রহীতাদের অনেক কিছুই এসে যায়। স্রষ্টার সৃষ্টির স্বস্তিবিধানেই ধর্মের মর্ম নিহিত।

উপাস্যের সাথে তাঁর বান্দার সমস্ত ফয়সালা হোক মানবিকতার মধ্য দিয়ে। নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত দান‌ই শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
Content Protection by DMCA.com