ব্রহ্ম ও সমর্পণ

যদি এমনই হয় যে, সবই ব্রহ্ম, তবে 'সমর্পণ' কথাটি কেন আসছে? 'এক' তিনিই অনন্ত 'বহু' হয়েছেন। তবে সৰ্বস্ব তাঁর মধ্যেই সমর্পণ করার যে-উপদেশ আমরা পাই, সেটার সার্থকতা কোথায়? শাস্ত্র বলছেন, "বাসুদেবঃ সৰ্বম্", অর্থাৎ "সব কিছুতেই বাসুদেব।" তাহলে তো সবই বাসুদেব থেকে এসেছে। তবে কে আর কাকে সমৰ্পণ করবে? সমর্পণ করার আগেই তো সব চিরসমর্পিত হয়েই আছে! এই ‘বহু’র খেলার সবটুকু তো তাঁর! নিজের ভালোতেও অহংকার করার নেই, মন্দতেও নিরাশ হবার কিছুই নেই।




নৈরাশ্য‌ও একপ্রকার অহংকারই। তথাকথিত ভালো ও মন্দ সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইচ্ছারই খেলা, তিনিই অনন্ত ভালো-মন্দ রূপে মুহূর্তের খেলায় আত্মপ্রকাশ করছেন, তাঁরই রঙ্গমঞ্চে একা তাঁরই অনন্ত অভিনয়... ‘সদসত্তৎপরং যৎ’ (গীতা, ১১.৩৭)— সৎ, অসৎ এবং এই দুইয়ের অতীত সবই তিনি। “ভ্রাময়ন্, সর্বভূতানি, যন্ত্র-আরূঢ়ানি, মায়য়া” (গীতা, ১৮.৬১) অর্থাৎ, সমস্ত জীবকে দেহরূপ যন্ত্রে আরোহণ করিয়ে মায়ার দ্বারা ভ্রমণ করান—গীতার এই এক কথাতেই তাঁর ইচ্ছার সর্বময় কর্তৃত্ব স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা হয়েছে।




সব যদি তিনিই করছেন, সব যদি তাঁরই আত্মপ্রকাশ, তবে আর আমাকে সর্বস্ব সমর্পণ করার উপদেশ দেবার অর্থ কী হতে পারে?




'সমর্পণ' কথাটিকে আমরা সাধারণত যে-অর্থে ব্যবহার করি, এই সমর্পণ সেই অর্থে হতে পারে না, কারণ তাতে তাঁর সর্বময় কর্তৃত্ব এবং সূক্ষ্ণ-স্থূল স্বপ্ন, সব কিছুতে তাঁরই স্বপ্রকাশের যে-তত্ত্ব, তার বিরোধিতা করা হয়।




তাই সমর্পণ করার উপদেশের প্রকৃত বক্তব্য একমাত্র এ-ই হতে পারে—সব কিছু যে তাঁরই এবং তিনিই, সবই যে তাঁর চরণে চিরসমর্পিত হয়েই আছে, এই সত্য অবিচ্ছিন্নভাবে স্মরণ রাখা, দেখা এবং এই সত্যের পূর্ণ স্বীকৃতিতে চলা—মনে রাখা, এই দেহ তাঁর; মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, চিত্ত, অস্মিতা, এই বিশ্ব, সবই তাঁর এবং তিনিই—প্রতি ব্যষ্টি এবং সমষ্টি তাঁরই এবং পূর্ণভাবে তিনিই।




এই সত্যের অস্তিত্বে স্বতন্ত্র আমি বা আমার বলতে কিছুই নেই। এই দৃষ্টিতে কাম, ক্রোধ ইত্যাদি কিছুই নেই, সব লুপ্ত হয়ে যায়, কারণ এরা সবই স্বাতন্ত্র্যবোধের সঙ্গেই জড়িত। যাকে কাম বলতাম, তাতে যদি তাঁর ইচ্ছাকেই আন্তরিকভাবে এবং পূর্ণ বিশ্বাসে দেখি, তবে তাতে কাম আর থাকে কোথায়, তাঁর ইচ্ছাই তো থাকে! যেটিকে 'সাপ' বলে ভ্রম করেছিলাম, সেটিকেই যদি 'রজ্জু' বলে বুঝি, বিশ্বাস করি ও স্মরণ রাখি, তবে আর সেটিকেই আবার ‘সাপ' বলার কোনো অর্থ হয় না।




যা স্বতন্ত্র 'আমি'র কল্পিত, তা-ই কাম-ক্রোধাদি রূপ ধারণ করতে পারে। অবিদ্যাপ্ৰসূত স্বতন্ত্র ‘আমি’ই যেখানে নেই, সেখানে আর কাম-ক্রোধাদি কোথায়?—সেখানে শুধু এক তাঁরই ইচ্ছা রয়েছে।




আমাদের প্রার্থনাও তাঁরই ইচ্ছা। এই যে অবিদ্যা বা মায়া থেকে স্বতন্ত্র 'আমি'র কল্পনা আসছে, তা-ও তাঁরই ইচ্ছা। আবার এই অবস্থা দূর করে জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে-আকাঙ্ক্ষা, তা-ও তাঁরই ইচ্ছা, তিনিই যদি 'সব'; তবে ওই অজ্ঞানরূপেও তিনি, আবার জ্ঞানরূপেও তিনিই।




তাই বলছি, 'সমর্পণ' অর্থ, আমার কিছু তাঁকে দেওয়া নয়; ‘সমর্পণ’ অর্থ, সব যে তিনিই, সব যে তাঁরই ইচ্ছা, এই সত্যের অবিচ্ছিন্ন স্মরণ ও গ্রহণ। তাই সমর্পণ ও জ্ঞান একই কথা—যে-জ্ঞানে সবই ব্রহ্মময়!




ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্ম কর্মসমাধিনা।।
(গীতা, ৪.২৪)




অর্থাৎ, আহুতি দানের পাত্রকে ব্রহ্ম, ঘৃতকে ব্রহ্ম,অগ্নিকে ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন, তাঁকেও ব্রহ্ম—এইরূপ জ্ঞানে, ব্রহ্মরূপ কর্মে সমাহিতচিত্ত ব্যক্তির প্রাপ্তব্য ফলও ব্রহ্ম।




সত্যের এই অবিচ্ছিন্ন স্মৃতি আমরা কী করে জাগিয়ে রাখতে পারি? একমাত্র তাঁরই কৃপায়। তাঁর ইচ্ছাতেই স্মৃতি ও বিস্মৃতি। তাই মিথ্যা অহমিকা এই সত্যের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতে পারে না—তাঁর কাছে প্রার্থনা, তাঁর শরণাগতিই সত্যস্মৃতিকে চিরজাগরূক রাখার উপায়, আর এই সত্যস্মৃতি সমৰ্পণ‌ই মুক্তির একমাত্র পথ—




দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে॥
(গীতা, ৭.১৪)




অর্থ:
এই দেবী গুণময়ী, মায়া মম সুদুস্তর,
এ মায়া এড়ায় সাধু, ভজি মোরে নিরন্তর।
(সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর-কৃত অনুবাদ)

Content Protection by DMCA.com