ব্রহ্মকথার এপিঠ-ওপিঠ: সাত




“তর্ক (Tarka) – যুক্তি (Yukti) – অন্বেষণ (Anveshana)”-এর সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যাক—

১. তর্ক (Tarka) অর্থ: সম্ভাবনা–অসম্ভাবনা খুঁজে দেখা। ব্যবহার: যখন কোনো বক্তব্য নিয়ে সংশয় হয়, তখন “হতে পারে / হতে না-ও পারে” ভেবে যুক্তি-বিপরীত যুক্তি সাজানো। উদাহরণ: বলা হলো—“ধোঁয়া মানে আগুন।” তর্ক: “হতে পারে, কিন্তু ধোঁয়ার মতো কুয়াশাও তো হতে পারে।” তর্ক হলো বিচারধারার প্রাথমিক খোঁজ।

২. যুক্তি (Yukti) অর্থ: শক্তিশালী ও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা-পদ্ধতি। ব্যবহার: প্রমাণ বা সত্যকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা, যাতে সন্দেহ দূর হয়। উদাহরণ: শাস্ত্র বলে: “তুমি ব্রহ্ম।” যুক্তি: “যা সর্বত্র বিরাজমান ও অবিনশ্বর, তা-ই আত্মা। শরীর নশ্বর, তাই আত্মা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন।” যুক্তি হলো তর্ককে ছেঁকে নিয়ে চূড়ান্ত ব্যাখ্যা তৈরি করা।

৩. অন্বেষণ (Anveshana) অর্থ: গভীর অনুসন্ধান বা অনুসন্ধিৎসা। ব্যবহার: শুধু প্রশ্ন-উত্তর নয়, বরং সত্যকে অন্তর থেকে খুঁজে দেখা—মনন, ধ্যান, অধ্যয়নের মাধ্যমে। উদাহরণ: কেউ শুনল, “আত্মা অমর।” তখন সে শুধু যুক্তি দেয় না, বরং ধ্যান-অধ্যয়ন করে নিজের মধ্যে খুঁজে দেখে—“আমি আসলে কে? আমি কি দেহ, না কি চৈতন্য?” অন্বেষণ এটাই যে—ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরে অনুসন্ধান।

সরল তুলনায়—তর্ক = প্রশ্ন করা, “হতে পারে কি?” যুক্তি = উত্তর সাজানো, “এ কারণে এটা সত্য।” অন্বেষণ = সত্যকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া।

তর্ক (Tarka): সম্ভাবনা-অসম্ভাবনা পরীক্ষা—শ্রুতি বলে: “তত্ত্বমসি”—তুমি সেই (ব্রহ্ম)। তখন সন্দেহ আসে—“কীভাবে আমি, যে সীমাবদ্ধ, শরীর-মন দ্বারা বদ্ধ, সেই অসীম ব্রহ্ম হতে পারি?” “ব্রহ্ম তো সর্বব্যাপী, আমি তো ক্ষুদ্র—এটা কি সম্ভব?” এই প্রশ্ন-সংশয়, পক্ষে-বিপক্ষে ভাবনাই হলো তর্ক।

যুক্তি (Yukti): শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা ও যৌক্তিক প্রমাণ—শাস্ত্র এবং আচার্য যুক্তি দিয়ে বোঝান—“তুমি আসলে শরীর নও, শরীর নশ্বর। তুমি মন নও, মনও পরিবর্তনশীল। তুমি সেই চৈতন্য, যা সব কিছুর সাক্ষী। ব্রহ্মও সেই চৈতন্যস্বরূপ। সুতরাং তোমার প্রকৃত সত্তা—ব্রহ্ম।” এই ধাপে যুক্তি সন্দেহকে কেটে দেয়, নিশ্চিত করে তোলে।

অন্বেষণ (Anveṣaṇa / Nididhyāsana): অন্তর্মুখী অনুসন্ধান—এবার শুধু যুক্তিতে থেমে থাকা নয়। সাধক নিজেকে প্রশ্ন করে: “আমি আসলেই কে?” “শরীর-মন ঘুমিয়ে গেলে, স্বপ্ন মুছে গেলে, সেই যে নিস্তব্ধ ‘আমি’ টিকে থাকে—সেই চৈতন্যই কি ব্রহ্ম নয়?” ধ্যান-মননের মাধ্যমে এই সত্যকে সাধক নিজের মধ্যে অনুভব করে। এটিই অন্বেষণ—যেখানে জ্ঞান—শ্রবণ আর মনন পেরিয়ে অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।

তর্ক = ছাত্র ভাবে, “মেঘ থাকলে সূর্য আছে কি না বোঝা যায় না।” যুক্তি = গুরু বলে, “মেঘ ঢেকেছে, তবু সূর্যের অস্তিত্ব অক্ষত।” অন্বেষণ = ছাত্র নিজে ধ্যান করে, মেঘ সরে গেলে সরাসরি সূর্যালোক অনুভব করে। তাই—তর্ক = সংশয়, যুক্তি = বুদ্ধিগত নিশ্চিতি, অন্বেষণ = অন্তরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।

একজন মানুষ রাতে অন্ধকার ঘরে বসে আছে। হঠাৎ একটা দড়িকে দেখে সে ভাবে—“এটা হয়তো সাপ!”

(তর্ক—সন্দেহ আর প্রশ্ন) সে ভাবে: “সাপ হলে বিপদ হতে পারে, পালানো উচিত।” আবার ভাবে, “দড়ি হলে ভয় পাবার কিছু নেই।” এখানে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক ভাবনা ঘোরে—এটাই তর্ক।

(যুক্তি—শাস্ত্র আর বুদ্ধির আলো) তার বন্ধু আসে আর প্রদীপ জ্বালিয়ে বলে: “ভয় পাস না, এটা আসলে দড়ি। সাপ নয়।” আলো ও যুক্তি দিয়ে সন্দেহ দূর হয়—এটাই যুক্তি।

(অন্বেষণ—অভিজ্ঞতা আর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি) মানুষটা এবার নিজেই প্রদীপ হাতে নিয়ে দড়িটা ভালো করে দেখে। সে আর কেবল বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করছে না—নিজচোখে নিশ্চিত হলো—“হ্যাঁ, এটা দড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।” নিজের অভিজ্ঞতায় সত্য অনুভব করা—এটাই অন্বেষণ।

আধ্যাত্মিক অর্থ: তর্ক = “আমি সীমিত জীব, কীভাবে ব্রহ্ম হতে পারি?”—এই প্রশ্ন। যুক্তি = শাস্ত্র ও গুরু বলেন, “তুমি চৈতন্যস্বরূপ, সীমাবদ্ধ নয়।” অন্বেষণ = সাধক ধ্যানে-মননে নিজেকে প্রত্যক্ষ অনুভব করে—“আমি ব্রহ্মই।” অর্থাৎ, তর্ক সন্দেহ তৈরি করে, যুক্তি সন্দেহ মুছে দেয়, আর অন্বেষণ সত্যকে নিজের অন্তরে অভিজ্ঞতালাভ করায়।