ব্রহ্মকথার এপিঠ-ওপিঠ: দুই



বেদান্তের মূল প্রতিপাদ্য—আত্মার চূড়ান্ত স্বরূপ। সকল বেদান্ত-বাক্যের শেষ কথা: ব্যক্ত আত্মা (জীব/আত্মন)—যাকে আমরা সংসারী বলে জানি—তার পরম/চূড়ান্ত স্বরূপ হলো—এক ও অভিন্ন আনন্দ (ānanda), অস্তিত্বের সার (sat), অপরিবর্তনীয় (nitya/avikāri), এবং পূর্ণ চৈতন্যময় (cit)। অর্থাৎ “জীব” বলে যাকে ধরি, তার গভীরতম সত্য সচ্চিদানন্দ—এটাই বেদান্তের দাবি।

ভাষ্যের প্রশ্ন—“বিষয় (viṣaya)–বিষয়ী (viṣayin) অভিন্নতা” কি যুক্তিসঙ্গত? বিষয় (viṣaya) = যে-বস্তুটিকে জানা হচ্ছে (অবজেক্ট)। বিষয়ী/জ্ঞাতা (viṣayin/pramātā) = যে জানছে (সাবজেক্ট)। ভাষ্যে যা আপত্তি: বিষয় ও বিষয়ীর পারস্পরিক অভিন্নতা (একই সত্তা) ধরা যায় না, কারণ এরা স্বভাবে বিপরীত—যেন অন্ধকার ও আলো। এখানেই তিনটি প্রশ্ন উথ্থাপন করা হয়—এই বিপরীততা (virodha) বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে? অভিন্নতা (indistinguishability/tādātmya) বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কেন “আলো–অন্ধকার” উপমা আনা হলো?

আপত্তিকারীর পালটা-উদাহরণ—“সহাবস্থান” দেখিয়ে—যদি বিরোধ মানে হয় “একই আধারে সহাবস্থান না হওয়া” (mutual exclusion), তাহলে যেখানে আলো আছে, সেখানে অন্ধকার থাকা উচিত নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে: আধো-আলো ঘরে বস্তুর রং/আকার অস্পষ্ট—মানে কিছু মাত্রার অন্ধকার আছে; আর যেখানে বেশি আলো, সেখানে স্পষ্ট দেখা যায়। তেমনি, ছায়ায়ও কিছু উষ্ণতা থাকে—মানে সূর্যালোকের প্রভাব। এখান থেকে আপত্তিকারীর দাবি: সহাবস্থান (co-presence) দেখা যায়—তাই “বিরোধ = একসঙ্গে না-থাকা” সংজ্ঞা টেকে না। এভাবেই সে “তাপ-শৈত্য”-এর সহাবস্থানের কথাও বলে।

সিদ্ধান্তপক্ষের উত্তর—বিরোধ = “অভিন্নতার অনুপস্থিতি”—“বিরোধ” (virodha) বলতে আমরা তাদাত্ম্য (tādātmya) বা পারস্পরিক অভিন্নতার অনুপস্থিতি বুঝি; কেবল সহাবস্থানের কথা নয়। অর্থাৎ: বিষয় (অবজেক্ট) আর বিষয়ী/জ্ঞাতা (সাবজেক্ট) বাস্তব সম্পর্কিত জিনিস নয়—যেমন জাতি-ব্যক্তি (jāti-vyakti) সম্পর্ক হয়। “গাছ” (জাতি) ও “এই আমগাছ” (ব্যক্তি)–এখানে জড়িত সত্তা/সম্পর্ক আছে। কিন্তু সাবজেক্ট (আমি যে জানছি) ও অবজেক্ট (যাকে জানছি)—এই দুইয়ের মধ্যে এমন তাদাত্ম্য-সম্পর্ক হয় না। তাই বিষয়-বিষয়ীর অভিন্নতা অযৌক্তিক; তাদের পারস্পরিক সমীকরণ (একই বলে ধরা) সমর্থনযোগ্য নয়।

সহজ ভাষায় বললে, একটি ঘরে মৃদু আলো ও কিছু অন্ধকার একসঙ্গে থাকতে পারে—এটা সহাবস্থান; কিন্তু এরা অভিন্ন নয়। তেমনি, জ্ঞাতা (আমি) আর জানা বস্তু (ওটা) একই ঘরে/একই অভিজ্ঞতায় থাকলেও—তারা একময় সত্তা নয়।

বেদান্ত বলছে: জীবের চূড়ান্ত স্বরূপ সচ্চিদানন্দ। কিন্তু জানার কর্তা (সাবজেক্ট) আর যাকে জানা হচ্ছে (অবজেক্ট)—এই দুইকে এক সত্তা ভাবা ভুল; এরা তাদাত্ম্য-সম্পর্কে পড়ে না। আলো-অন্ধকার উদাহরণটায় সহাবস্থান দেখালেই অভিন্নতা প্রমাণ হয় না—এটাই যুক্তির সূক্ষ্মতা। ফলে “বিষয়–বিষয়ী একই” বলা দার্শনিকভাবে টেকে না—এটাই ভাষ্যের নির্যাস।

এক বাটিতে কুসুম-গরম জল—আপনি বলবেন, “গরমও আছে, ঠান্ডাও একটু আছে”—এটা সহাবস্থান। কিন্তু গরম = ঠান্ডা—এমন নয়। তেমনি, ‘আমি’ (সচেতন) আর ‘ওটা’ (জ্ঞেয় বস্তু) একই অভিজ্ঞতার দৃশ্যপটে থাকতে পারে; কিন্তু, আমি = ওটা নয়।

জ্ঞাতা (Subject/viṣayin) কী? জ্ঞাতা মানে “আমি”—যে জানছে। তার প্রকৃত স্বরূপ হলো চৈতন্যময় (pure consciousness, cit)। তাই জ্ঞাতা সর্বদা সচেতন, অপরিবর্তনীয়, আর নিজেই জ্ঞানরস (cidekarasa)।

জ্ঞেয় (Object/viṣaya) কী? জ্ঞেয় মানে বস্তু—যাকে জানা হয়। প্রকৃতিতে এটি জড় (insentient), পরিবর্তনশীল, রূপ-রঙ-ধর্মযুক্ত। যেমন পাথর, গাছ, দেহ, এমনকি মনের ভাবনাও জ্ঞেয় হতে পারে।

কেন এরা অভিন্ন হতে পারে না? জ্ঞাতা চৈতন্যস্বরূপ → সে সবসময় জ্ঞানী, অপরিবর্তনীয়। জ্ঞেয় জড়স্বরূপ → জ্ঞাত হওয়ার জন্য নির্ভরশীল, পরিবর্তনশীল। তাই জ্ঞাতা আর জ্ঞেয়ের মধ্যে তাদাত্ম্য (অভিন্নতা) সম্ভব নয়।

চোখ (দ্রষ্টা) আর টেবিল (দৃশ্য) একই জিনিস নয়। “চোখ = টেবিল”—এমনটা মানা যায় না। ঠিক তেমনি “আমি = দেহ” বা “আমি = এই জড়জগৎ”—এটা ভুল অভিন্নতা।

“অন্যের দ্বারা অভিন্নতা” কেন অসম্ভব? কেউ যদি বলে: “ঠিক আছে, নিজের দ্বারা নয়, তবে অন্যের দ্বারা (অর্থাৎ জ্ঞেয়কে টেনে এনে বা জ্ঞাতাকে জড়িয়ে দিয়ে) এক হওয়া সম্ভব”—তবে ভাষ্যকার বলেন: না, সম্ভব নয়। এর কারণ: জ্ঞাতা অপরিবর্তনীয় (nirvikāra) → সে জড়তে পরিণত হতে পারে না। জ্ঞেয় চৈতন্যে রুপান্তরিত হতে পারে না → তা হলে তার জড়ধর্ম হারিয়ে যাবে। দড়ি আর সাপের বিভ্রম ধরা যাক। দড়ি কখনও সত্যি সত্যি সাপে রুপান্তরিত হয় না। শুধু ভ্রম বা অধ্যাস (superimposition) হয়।

জ্ঞাতা (আত্মা) আর জ্ঞেয় (জগৎ/বস্তু)—তাদের মধ্যে তাদাত্ম্য হয় না। যেমন “আলো = অন্ধকার” বলা ভুল, তেমনি “আমি (চৈতন্য) = এই দেহ/বস্তু (জড়)” বলা ভুল। এরা একই অভিজ্ঞতায় সহাবস্থান করতে পারে, কিন্তু এক সত্তা নয়। সুতরাং, বেদান্তের দৃষ্টিতে “আমি = চেতনা (আত্মা)”—এটাই সত্য। আর “আমি = দেহ, আমি = জগৎ”—এসব অধ্যাস, ভ্রান্ত ধারণা।

কীভাবে এমন বলা হলো যে, তাদের অভিন্নতা সম্ভব নয়? কারণ তাদের স্বরূপের দিক থেকে (অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে—svataḥtāvat), বিষয়ী বা আত্মার (self) বাস্তবিকভাবে কোনো অভিন্নতা নেই—বিষয় বা অনাত্মার (non-self) সঙ্গে। কারণ আত্মা সম্পূর্ণরূপে চৈতন্যের সারস্বরূপ (cid-eka-rasa); আবার অনাত্মার দ্বারাও আত্মা প্রভাবিত নয়, কারণ আত্মা রুপান্তর (pariṇāma)-অক্ষম এবং আসক্তিহীন।

অন্যদিকে, বস্তু (object বা viṣaya)-ও তার স্বভাব অনুযায়ী আত্মার সঙ্গে অভিন্নতা অর্জন করতে পারে না—নিজের রূপান্তরের মাধ্যমে (চেতনায়—cit), কারণ তাতে সে নিজের বস্তু-ধর্ম হারাবে, চৈতন্যের সমান মর্যাদা লাভ করবে, এবং আর বস্তু হিসেবে অবশিষ্ট থাকবে না। তেমনি আত্মার দ্বারাও (অর্থাৎ আত্মা যদি অনাত্মাকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়) অনাত্মা আত্মার স্বরূপে অংশ নিতে পারে না, কারণ আত্মা নিস্ক্রিয় (niṣkriya)।

এখানে মূলত বলা হচ্ছে: আত্মা (বিষয়ী) আর বস্তু/অনাত্মা (বিষয়) মৌলিকভাবে কখনো অভিন্ন হতে পারে না। আলো-অন্ধকার যেমন আংশিকভাবে একসঙ্গে উপস্থিত মনে হয়, তবু প্রকৃতিতে অভিন্ন নয়, ঠিক তেমনি আত্মা-অনাত্মার সম্পর্ক। আত্মা = চিরন্তন চৈতন্য, নিস্ক্রিয়। অনাত্মা = পরিবর্তনশীল, জড়। এদের মধ্যে কোনো সত্যিকারের একত্ব (tādātmya) সম্ভব নয়।

অধ্যাস (superimposition) মানে হলো—যে-সত্তার মধ্যে কোনো একটি ধর্ম নেই, সেখানে অন্য কিছুর ধর্ম প্রকাশিত হওয়া। এই প্রকাশ, যুক্তির দিক থেকে বলতে গেলে, মিথ্যা (mithyā)। “মিথ্যা” শব্দের দ্বৈত অর্থ আছে—১) এটি কোনো কিছুর অস্বীকৃতি (negation) নির্দেশ করে, ২) আবার এটি অবর্ণনীয়তা (anirvacanīyatā) নির্দেশ করে। অধ্যাসে “মিথ্যা” শব্দটি মূলত অস্বীকৃতির অর্থে ব্যবহৃত।

বেদান্তে “মিথ্যা” মানে হলো—যা না একেবারে সত্য, না একেবারে অসত্য। একে বলা হয় “সদসৎবিলক্ষণ” (sat + asat = উভয়ের বাইরে)।

১) মিথ্যা ≠ সত্য (sat)—সত্য মানে যা কখনও পরিবর্তিত হয় না, যা সব কালে, সব স্থানে, সব অবস্থায় এক রকম থাকে। উদাহরণ: ব্রহ্ম।

২) মিথ্যা ≠ অসত্য (asat)—অসত্য মানে যা একেবারেই নেই। যেমন—“বন্ধ্যা নারীর পুত্র” (son of a barren woman)। এটা কখনও কোনো অবস্থায় দেখা যায় না।

৩) মিথ্যা = অবিদ্যার ফল (appearance under ignorance): মিথ্যা জিনিস স্বপ্ন বা মরীচিকার মতো। থাকে বলেই মনে হয়, কিন্তু সত্য নয়। দেখা যায়, ব্যবহার করা যায়, কিন্তু আসলে তা চিরন্তন সত্য নয়। উদাহরণ: দড়িকে সাপ বলে ভুল করা। সাপটা কিছুটা আছে বলে মনে হয় (সংস্কারে বা অভিজ্ঞতায় ধরা দেয়), আবার আসলেই নেই (কারণ সেটা দড়ি)। তাই একে মিথ্যা বলা হয়।

মরুভূমিতে জল দেখা যায়, কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়—ওটা বালিই। ‘জল আছে’ বলাটা অসত্য নয় (দেখা যাচ্ছে), আর ‘আসলেই আছে’ বলাটাও সত্য নয়। তাই ওটা “মিথ্যা”। অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হয়। সাপটা বাস্তবে নেই, তবুও ভয় হয়। ভয়টা সত্যিকারের (প্রতিক্রিয়া), কিন্তু সাপটা নেই। বিভ্রমটাই হলো মিথ্যা। স্বপ্নে রাজা হওয়া যায়, কষ্টও হয়, আনন্দও হয়। জেগে উঠলে সব মুছে যায়। স্বপ্ন একেবারে নেই—এটা বলা যায় না (কারণ আমরা অভিজ্ঞতা করেছি), আবার তা সত্যও নয় (কারণ টিকে থাকে না)। তাই স্বপ্নও “মিথ্যা”।

এই দৃশ্যমান জগৎ (জগৎ, দেহ, ইন্দ্রিয়, মানসিক অভিজ্ঞতা)—মিথ্যা। অর্থাৎ: এটা স্বপ্ন, মরীচিকা, দড়ি-সাপ বিভ্রমের মতো। এটা আছে বলে মনে হয় (প্রতীতি আছে), কিন্তু চূড়ান্ত সত্য নয়। চূড়ান্ত সত্য একটাই—ব্রহ্ম (যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, অদ্বৈত)। “মিথ্যা” = যা না একেবারে সত্য, না একেবারে মিথ্যা—ভ্রান্তির কারণে যেটাকে সত্য বলে ধরা হয়।

যদিও বিষয়টি এমন যে, অধ্যাস যুক্তিসিদ্ধ নয়, তবুও দেখা যায়, এটি সহজাত—অর্থাৎ অন্তরাত্মার মাত্র অস্তিত্বের (mātrā) সঙ্গেই এটি সর্বদা যুক্ত। এর মানে হলো—“তুমি” এবং “আমি”-এর পারস্পরিক অধ্যাস, যা দেখা যায় লোকব্যবহারে (vyavahāra), যেমন—“আমি এই” (ahaṁ idam), “এটি আমার” (mamedam)। অতএব, যেহেতু অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত, যেমন “আমি” ধারণার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না (এটি নিঃসন্দেহ), তেমনি অধ্যাসকেও অস্বীকার করা যায় না। কারণ অহংকারবোধ (ego-concept) অবধারিতভাবে অধ্যাসের ধারণাকেই বহন করে।

“লোক” শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে সমস্ত প্রাণিজগৎ—যারা “আমি মানুষ” (ahaṁ manuṣyaḥ) এই অহংকারবোধ দ্বারা আচ্ছন্ন। “ব্যবহার” (vyavahāra) মানে হলো সেই সাধারণ দৈনন্দিন প্রয়োগ। অধ্যাসের অর্থ এখানে স্পষ্ট—“আমি” এবং “আমার”-এর মাধ্যমে যে অহংকার প্রকাশ পায়, যেমন “আমি মানুষ”—এটি সকলের অভিজ্ঞতায় সাধারণ বিষয় এবং অনাদি।

প্রশ্ন উঠতে পারে: যদি অধ্যাস (superimposition) মিথ্যা অজ্ঞান (mithyājñāna)-এর ফল হয়, তবে তাকে কীভাবে “অনাদি” বা “সহজাত” (naisargika = beginningless, natural) বলা যায়?

স্বীকার করতেই হবে যে, অজ্ঞান (avidyā)-এর শক্তি বাইরের জগতে যেমন আছে, তেমনি ভেতরের ক্ষেত্রেও আছে। কারণ এটা সব কিছুর প্রকৃতির সঙ্গে সর্বদাই যুক্ত। যদি আমরা অজ্ঞানকে স্বীকার না করি, তবে ভ্রান্ত প্রকাশ (illusory appearance)—যেমন দড়িতে সাপ, শঙ্খে রুপা—এসবের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হবে না।

জড় বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশে অজ্ঞান কোনো বাধা দেয় না, কারণ জড় বস্তুর অজ্ঞাত থাকা হয় শুধু সঠিক জ্ঞানপ্রমাণ (means of valid knowledge) না থাকার জন্য। যেমন শঙ্খে রুপার ভ্রান্তি। রুপা প্রকাশের আগে এবং পরে—অজ্ঞান থাকলেও—রুপার প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে। তাই অজ্ঞান আসলে ভুল কিছুর প্রকাশ ঘটায়। একে বলে অজ্ঞান-এর বিক্ষেপশক্তি (vikṣepa-śakti), অর্থাৎ অজ্ঞান প্রকৃত সত্যকে নষ্ট করে না, বরং মিথ্যা কিছু তুলে ধরে।