তাহলে “তুমি” (yusmat) দ্বারা বোঝানো জগতের বস্তুগুলির গুণ (dharma) আত্মার ওপরে চাপানো হয়—যেমন সন্তানদের সম্মান বা লজ্জা নিজের ওপর নেওয়া। আর “আমি” (asmat) শব্দ দ্বারা বোঝানো বিষয় হলো সেই অন্তঃকরণ (antahkaraṇa) বা অভ্যন্তরীণ অনুভব-অঙ্গ, যা চেতন অংশ—যা জড়জগত থেকে আলাদা। এটি খাঁটি চৈতন্য নয়, বরং সেই অন্তঃকরণের দ্বারা আত্মার ওপর অধ্যাস ঘটে। যেমন, দেহের গুণাবলি—“আমি রোগা, আমি মোটা”—এসব আত্মার ওপর চাপানো হয়।
এখানে ‘ধর্ম’ (dharma) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বোঝাতে যে, দেহের গুণাবলিই (যেমন মানুষ হওয়া, রোগা-মোটা হওয়া) আত্মার ওপর চাপানো হয়—কিন্তু সরাসরি “আমি দেহ” বলা হয় না। আর এই ধর্মাধ্যাসের (ধর্ম বা গুণের অধ্যাস) ভিত্তিতেই শাস্ত্র নানা ভিন্ন ভিন্ন কর্মের বিধান (rules of action) প্রণয়ন করেছে। অধ্যাস শুধু রূপক নয়, সরাসরি সত্য। আমরা আসলে আত্মাকে ভুলভাবে দেহ বা দেহের গুণাবলির সঙ্গে মিশিয়ে দেখি। আর এই ভুলের ওপরই সমস্ত শাস্ত্রীয় বিধান দাঁড়িয়ে আছে।
‘অধ্যাস’ মানে রূপক খেলা নয়, বরং আক্ষরিক ভুল আরোপ। আমরা সন্তান, সম্পদ, দেহ বা দেহের গুণাবলিকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিই। এই ভুল আরোপই (অধ্যাস) সংসারের শেকড়। শাস্ত্র যে-সব বিধি-নিয়ম দেয়, সেগুলোও এই ভুল-ধারণার ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে—কারণ আমরা নিজেদের দেহ-মন-সম্পদ ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন ভেবে বসি। তাই ভাষ্যকার বলেন: “আমি-ই সুস্থ বা অসুস্থ”—এ ধরনের কথা আসলে আত্মার ওপর দেহের গুণ চাপিয়ে দেওয়া। এটাই অধ্যাসের প্রকৃত রূপ।
‘তর্ক’ শব্দ দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? এর মানে হলো যুক্তি-প্রয়োগ বা Reasoning। কিন্তু এটি তো কেবল সমার্থক শব্দ হলো। এর প্রকৃত স্বরূপের ব্যাখ্যা হলো: তর্ক এমন এক প্রকার বিচারমুখী জ্ঞান, যার মাধ্যমে প্রমাণ (pramāṇa), শক্তি (śakti) এবং বিষয় (viṣaya = অর্থাৎ ব্রহ্ম ও জীবের অভিন্নতা)—এদের সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনা নির্ধারিত হয়।
পূর্বপক্ষী (আপত্তিকারী): যদি তা-ই হয়, তবে বেদান্ত তো তর্কের ওপর নির্ভর করে নিজের বক্তব্যের নিশ্চয়তা প্রমাণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে সে আর স্বাধীন প্রমাণ (অপর-নিরপেক্ষ / স্বতন্ত্র-প্রমাণ) রইল না, এবং তাই অবৈধ হয়ে পড়ল।
সিদ্ধান্তী (উত্তরদাতা): তা নয়। বেদান্ত অবৈধ হয় না। কেননা, বেদান্ত নিজস্ব শক্তি দ্বারাই (sva-śakti) যে-জ্ঞান দেয়, তা সন্দেহাতীত, অব্যর্থ এবং নির্দিষ্ট বিষয়কে প্রকাশ করে। এখানে সেই বিষয় হলো আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা।
পূর্বপক্ষী: তাহলে তর্কের দরকার কী? যদি মহাবাক্য নিজেই জীব ও ব্রহ্মের অভিন্নতার জ্ঞান দিতে সক্ষম হয়, তবে তর্কের কাজটা কী?
সিদ্ধান্তী: তর্কের ভূমিকা হচ্ছে বাধা দূর করা। যখন বিষয়—অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য—অসম্ভাব্য বলে মনে হয়, তখন এই জ্ঞানের ফল (ফল = অনর্থ বা জীবনের দুঃখ-দুর্দশার অবসান) প্রকাশ পায় না। তখন তর্ক তার সম্ভাব্যতা (sambhāva) প্রমাণ করে সেই বাধাগুলো সরিয়ে দেয়।
উদাহরণ: “তত্ত্বমসি” (তুমি সেই) মহাবাক্যে—“তত্” শব্দটি বোঝাচ্ছে ব্রহ্মকে। “ত্বম্” শব্দটি বোঝাচ্ছে জীবকে। কিন্তু জীব মনে করে—“আমার তো ব্রহ্মের সঙ্গে কোনো মিল নেই, বরং আমি তো একেবারে বিপরীত স্বভাবের।” এই ভুল ধারণার কারণে, মহাবাক্য থেকে জ্ঞান উদয় হলেও সে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে পারে না। কিন্তু যখন তর্কের মাধ্যমে প্রথমে নিজের ব্রহ্মত্বের সম্ভাবনা বুঝতে পারে, তখন সেই জ্ঞানকে স্বীকার করতে ও ধারণ করতে পারে।
সহজ করে বললে—বেদান্ত নিজেই প্রমাণ, নিজেই জ্ঞান দেবার ক্ষমতা রাখে। তর্ক সরাসরি জ্ঞান উৎপাদন করে না, বরং “অসম্ভব” বলে যে মানসিক বাধা দাঁড়িয়ে যায়, তা সরিয়ে দেয়। ফলে শাস্ত্রবাক্যের (যেমন “তত্ত্বমসি”) অর্থ জীবের মনে গেঁথে বসে এবং সত্যটি স্পষ্ট হয়।
বেদান্ত (শাস্ত্র) নিজেই প্রমাণ (knowledge-source)। এটি সরাসরি আত্মা-ব্রহ্ম জ্ঞান দেয়। কিন্তু আমাদের মনে অনেক বাধা (দ্বিধা, অসম্ভাবনা, আপত্তি) থাকে। সেই বাধা দূর করার কাজ করে তর্ক (বা যুক্তি)।
উদাহরণ ১: ভাবুন, একজন ডাক্তার আপনাকে ওষুধ দিলেন। ওষুধই আসল চিকিৎসা, ওষুধই রোগ সারায়। কিন্তু আপনি (রোগী) ভয় পাচ্ছেন—“এই ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে না তো? এটা আমার শরীরের জন্য ঠিক আছে তো?” তখন ডাক্তার বুঝিয়ে বলেন, কেন এটা নিরাপদ, কীভাবে এটা কাজ করে। এখানে ডাক্তারের যুক্তি (তর্ক) রোগ সারায় না, শুধু ভয় দূর করে, মনকে নিঃসংশয়ে ওষুধ গ্রহণ করার জন্য তৈরি করে; কিন্তু ওষুধ (শাস্ত্র) রোগ সারায়।
উদাহরণ ২: ধরে নিন, অন্ধকার ঘরে একটা দড়িকে আপনি সাপ ভেবেছেন। শাস্ত্রবাক্য (বেদান্ত) হলো—“এটা দড়ি, সাপ নয়।” কিন্তু তখন আপনার মনে প্রশ্ন—“না, সাপ তো নড়ছে, দড়ি হলে এমন হবে কীভাবে?” তখন শিক্ষক বা গুরু যুক্তি দিয়ে বোঝান—“দড়ি হলে আলোতে যেমন দেখা যেত, এখানেও তেমনই দেখা যাচ্ছে—তুমি মন থেকে সাপের (পূর্ব-) সংস্কার দূর করে দড়ির দিকে তাকাও, সব বুঝে যাবে। আর সাপ হলে তো ফণা, দাগ, শব্দ—এসব থাকত; এখানে ওসব কোথায়?” এই যুক্তি (তর্ক) আপনার ভুল ধারণা ভাঙতে সাহায্য করে—এভাবে আসল সত্যটা জানায় শাস্ত্রই।
উদাহরণ ৩: শাস্ত্রের মহাবাক্য—“তত্ত্বমসি” (তুমি সেই ব্রহ্ম)। জীব ভাবে—“আমি তো ছোটো, দুর্বল, সীমাবদ্ধ। ব্রহ্ম তো অসীম। এ দুটো কখনও এক হতে পারে?” এই সন্দেহই হলো বাধা। তর্ক এখানে বলে—“তুমি আসলে শরীর, মন, ইন্দ্রিয় নও—এগুলো পরিবর্তনশীল। কিন্তু যে সচেতন সত্তা এদের সাক্ষী, সে-ই আসল তুমি। আর সেই চেতনা-সত্তাই ব্রহ্ম।” এভাবে তর্ক বাধা সরায়, আর শাস্ত্রের বাণী জ্ঞানে রূপ নেয়।
বেদান্ত = আসল আলো। তর্ক = মেঘ সরানোর কাজ। আলো সব সময়ই ছিল, কিন্তু মেঘ থাকলে দেখা যাচ্ছিল না। তর্কের মূল অর্থ—যুক্তি (Reasoning), বিচার (Rational inquiry), বিবেচনা (Discrimination), প্রমাণ-অনুসন্ধান (Testing validity)। দর্শনে তর্ক মানে হলো—এমন এক বুদ্ধিগ্রাহ্য বিচারপ্রক্রিয়া, যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি—কোনো প্রমাণ (প্রমাণ) সত্যি কি না, কোনো শক্তি (শক্তি = কার্য-কারণ যোগ) কাজ করছে কি না, এবং কোনো বিষয় (বিষয় = ব্রহ্ম-জীব অভেদ) সম্ভাব্য কি না।
তর্কের কাজ সন্দেহ দূর করা—যেমন, “আমি কি সত্যিই ব্রহ্ম হতে পারি?”—এই অসম্ভাবনাকে সরায়। তর্কই শাস্ত্র বোঝার সহায়ক—শাস্ত্রই সত্য জানায়, কিন্তু তর্ক বাধা পরিষ্কার করে। ভ্রান্তি খণ্ডন—প্রতিপক্ষের যুক্তি বা আপত্তি ভাঙতে তর্ক ব্যবহার হয়। যুক্তি (Reason), অন্বেষণ (Investigation), বিতর্ক (Debate), আলোচনামূলক বিচার (Dialectic inquiry), সিদ্ধান্তানুসন্ধান (Enquiry for certainty)—এ সবই তর্ক বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
শাস্ত্র বলে: “তুমি ব্রহ্ম।” কিন্তু জীব ভাবে: “আমি তো সীমাবদ্ধ।” তখন তর্ক বোঝায়: “যা সীমাবদ্ধ, তা শরীর-মন, কিন্তু তুমি তার সাক্ষী। সাক্ষী সীমাবদ্ধ নয়। তাই তুমি অসীম ব্রহ্ম।” এভাবে তর্ক হলো—গাছের ডালপালা পরিষ্কার করার মতো, যাতে সূর্যের আলো (শাস্ত্রবাক্য) সরাসরি পড়তে পারে।
ন্যায়শাস্ত্রের লক্ষ্য = সঠিক জ্ঞান (প্রমাণ) অর্জন করা—তর্ক সেখানে সহায়ক উপায়। তর্ক মানে হলো কোনো বিষয়ে সম্ভাবনা-অসম্ভাবনা খুঁজে দেখা। যদি বলা হয়—“আগুন আছে, কারণ ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।” তখন তর্ক হবে—“কিন্তু যদি কুয়াশার মতো কিছু হয়, যা ধোঁয়ার মতো দেখায়?” এইভাবে সম্ভাবনা-অসম্ভাবনা যাচাই করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তর্কের কাজ। তর্ক এখানে যুক্তির পরীক্ষা।
বেদান্তের লক্ষ্য = অদ্বৈত ব্রহ্ম-জ্ঞান। এখানে শাস্ত্রই প্রধান প্রমাণ। তর্ক এখানে শাস্ত্রের সহায়ক। শাস্ত্র বলে: “তত্ত্বমসি”—তুমি ব্রহ্ম। কিন্তু জীব ভাবে: “আমি সীমাবদ্ধ, ব্রহ্ম অসীম। অভিন্নতা কীভাবে সম্ভব?” এখানে তর্ক এসে সাহায্য করে—সীমাবদ্ধতা শরীর-মন-এর, আত্মার নয়। আত্মা তো সর্বদা অসীম ও চৈতন্য। তাই অভিন্নতা সম্ভব। তর্ক—অভেদ বোঝাতে শাস্ত্রের বাক্যকে স্বচ্ছ করে।
ন্যায়শাস্ত্রে: তর্ক হচ্ছে প্রমাণ যাচাইয়ের উপায়। বেদান্তে: তর্ক হচ্ছে শাস্ত্র-বাক্যের সত্যতাকে উজ্জ্বল করার উপায়। ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কিত উদাহরণ: কেউ বলল—“গাছে আগুন লেগেছে, কারণ ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।” তর্ক আসবে: “ধোঁয়া না হয়ে কুয়াশাও হতে পারে।” বেদান্ত সম্পর্কিত উদাহরণ: শাস্ত্র বলল—“আমি ব্রহ্ম।” তর্ক বলবে: “আমি তো দুঃখ-কষ্ট পাই! কীভাবে ব্রহ্ম হব?” উত্তর আসবে: “দুঃখ কি কষ্ট, ওসব শরীর-মনের, আত্মার নয়।” তাই ন্যায়শাস্ত্রে তর্ক হলো প্রমাণ পরীক্ষা, আর বেদান্তে তর্ক হলো শাস্ত্র-বাক্যের স্বচ্ছকারী সহায়ক।